আইনের শাসনের সঙ্গে গুম-খুনের সহবাস

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
Published : 3 May 2014, 10:28 AM
Updated : 3 May 2014, 10:28 AM

১৬ এপ্রিল পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি পেট্রোল পাম্প থেকে কতিপয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর দ্বারা অপহৃত হয়ে, দীর্ঘ ৩৫ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিলে, তিনি ১৮ এপ্রিল দিবাগত রাতে ফিরে আসেন। তার অপহরণ হওয়া কিংবা অতি নাটকীয়ভাবে ফিরে আসা, সবই রহস্যময়। এই অপহরণের পর সমাজের একটি বৃহৎ অংশ দলমতনির্বিশেষে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন।

অনেকের সঙ্গেই সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাজ নিয়ে মতভিন্নতা আছে, অনেক রটনাও আছে। কিন্তু তার স্বামী যখন অপহৃত হলেন, তখন সেটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানে জনাব সিদ্দিকিকে আইনবহির্ভূতভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সবার প্রতিবাদটাই মূখ্য ছিল।

তবে এটাও ঠিক, তিনি খুবই ভাগ্যবান মানুষ যিনি সমস্ত জল্পনা-কল্পনার মুখে ছাই দিয়ে জীবিত ফিরে এসেছেন। নারায়ণগঞ্জে ইতোপূর্বে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া কেউই জীবিত ফিরে আসেননি। দৈনিক সংবাদপত্রের হিসেব অনুযায়ী, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মিলে গত এক বছরে মোট ১৫৭ ব্যক্তি গুম ও খুন হয়েছেন। তাদের মধ্যে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীসহ মোট ২০ শিশুও শীতলক্ষায় লাশ হয়ে ভেসে উঠেছে।

খুব সম্প্রতি, ২৭ এপ্রিল, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত প্রাঙ্গন থেকে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে, নারায়ণগঞ্জের পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র জনাব নজরুল ইসলাম, তার তিন বন্ধু ও গাড়িচালক এবং অপর একটি গাড়িতে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালকসহ মোট সাতজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি 'তুলে' নিয়ে গেছে বলে প্রাইভেট টেলিভিশনগুলোর সেদিনের সংবাদ থেকে জানা যায়।

দেশে একই সঙ্গে সাত ব্যক্তিকে 'তুলে' নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। তাদের পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় থানা ও র‌্যাব কার্যালয়ে খোঁজ নিলে ''তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেননি'' বলে জানান। তারপর এসব পরিবারের সদস্যরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ২৭ এপ্রিলের পর থেকে নারায়ণগঞ্জ ছিল প্রতিবাদে মুখর।

অপহরণের তিন দিন পর, ৩০ এপ্রিল বিকেলে, শীতলক্ষায় ছয়টি লাশ ভেসে ওঠে, যাদের মুখমণ্ডল ছিল ঝলসানো, পেট কাটা, পায়ে ইটের বস্তা বাঁধা, যাতে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। রাতে নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের লাশ শনাক্ত করেন। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে অপর একটি লাশ ভেসে ওঠে। এভাবে অপহৃত সাত জনের লাশই পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অপহরণের ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি মামলা হয়েছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

২৭ এপ্রিল অপহরণের (তুলে নেওয়ার) পর ৩০ এপ্রিল অপহৃত সাত জনের লাশ পাওয়া যাওয়ার ফলে বোঝা যায়, অপহরণকারীরা তাদের ছেড়ে দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে চায়নি। এতে সন্দেহ প্রকট হয় যে, যারা অপহরণ করেছিল তারা অপহৃতদের পরিচিত ছিল। এতজন মানুষ একসঙ্গে অপহরণ করে যারা মেরে ফেলার সাহস রাখে তারা অন্তত এতটুকু নিশ্চিত ছিল যে তাদের সমস্যা হবে না। অপরাধীদের এই ভরসার জায়গাটি ভেঙে ফেলা না গেলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা যাবে না।

নারায়ণগঞ্জেসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গুম, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যা করে মাথাকাটা লাশ নির্জন এলাকায় ফেলে যাওয়া, বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার এসব নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও সংগঠিত প্রতিবাদ নেই। খুব কম সংখ্যক কিছু ঘটনায় পুলিশের সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অপহৃত ব্যক্তি উদ্ধার পাচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনার কোনো সুরাহা হয় না। ফলে অপরাধীরা উৎসাহ পায়।

নারায়ণগঞ্জের গত এক বছরের ১৫৭ গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মধ্যে কেবল সিয়াম হত্যার আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ঘটনাগুলো এখনও তদন্তের পর্যায়ে রয়ে গেছে। তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীকে নিয়ে তার বাবা রাফিউর রাব্বির আহাজারি এখনও নারায়ণগঞ্জের বাতাস ভারি করে তোলে। তার সঙ্গে নতুন সাতজনের পরিবার যুক্ত হল।

২৭ এপ্রিল সাতজন ব্যক্তি গুম হওয়ার পর থেকে, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারকে উদ্ধারের জন্যে মহামান্য হাইকোর্টে একটি 'হ্যাবিয়াস কর্পাস' রিট দাখিল করার কথা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল তাঁর 'কাস্টডি' নিশ্চিত করা নিয়ে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি 'হ্যাবিয়াস কর্পাস' রিট করতে হয়, তাহলে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আটক ব্যক্তি কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক আছেন এবং ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পার হয়েছে।

চন্দন সরকার কিংবা অপর ছয়জন, কারও ক্ষেত্রেই এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। পুলিশ কিংবা র‌্যাব, কোনো বাহিনীই তাদের আটক করেছেন বলে স্বীকার করেননি। এ ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিকার ছিল সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করা কিংবা তারা যদি ব্যবস্থা না নেন তবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অপহৃতদের উদ্ধারের জন্যে মামলা করা।

যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ থাকে তাহলে, এই বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়াও আরেকটি সমস্যা হল, নিখোঁজদের পরিবারের কেউ দাবি করেননি যে, নিখোঁজদের 'অপহরণ' করা হয়েছে।

'অপহরণ' বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে সংজ্ঞায়িত একটি অপরাধ, প্রমাণসাপেক্ষে যার শাস্তি নিরুপণ করা আছে। কিন্তু যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আইনবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তারের অভিযোগ থাকে এবং তারা যদি সেটি স্বীকার না করে, তাহলে আইনের ফাঁকে পড়ে যাওয়ায় এর সুরাহা আর মেলে না।

নিয়ম অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ব্যতীত কাউকে গ্রপ্তার করতে পারবেন না। বিষয়টি গ্রেপ্তার, অপহরণ নয়। যদি তারা গ্রেপ্তার স্বীকার না করেন আর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই করা হয়, তখন সেটি গ্রেপ্তার না হয়ে অপহরণে পরিণত হয়।

তাছাড়া এ রকম ক্ষেত্রে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে থানা কিংবা নিম্ন আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়া সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মতো যথাযথ ও দ্রুত ব্যবস্থা কিনা তা-ও বিবেচনায় আনা জরুরি। কেননা মানুষের জন্যে আইন, আইনের জন্যে মানুষ নয়। চলমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা নিরসনে আইনের এই দিকটি, আইন ও বিচার বিভাগের নজরে আসবে, এই প্রত্যাশা করি।

আমাদের দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বিদেশের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মতো অপহরণ কিংবা অন্য কোনো সহিংসতার পর দায়িত্ব স্বীকার করে না। তাই আমাদের তিমিরেই থেকে যেতে হয়। আমরা অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি। আমাদের সন্দেহের তীর উদ্দেশ্যহীনভাবে এধার ওধার গিয়ে পড়ে।

প্রায় একই চিত্র আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। তারা যখন বলেন কোনো একটি অপহরণের অভিযোগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই তখন একটি গুরুতর ব্যাপার সবার অলক্ষে চোখ এড়িয়ে যায়; তা হল, তাদের বিরুদ্ধে 'অপহরণ' কিংবা 'তুলে নিয়ে যাওয়া'র অভিযোগই করা হয়– 'গ্রেপ্তার করা'র অভিযোগ ওঠে না।

তাদের এই অভিযোগ খণ্ডনের ক্ষেত্রে যতটা জোরালো কণ্ঠস্বর থাকা উচিত তা কিন্তু আমরা দেখি না। তাই তাদের উপরও আমাদের বিশ্বাস ক্ষীণ হতে থাকে। এই অবস্থা নাগরিকদের জন্যে মোটেও সুখকর নয়। কারণ তারা বিপদে-আপদে সাহায্যের জন্যে যাদের কাছে ছুটে যাবেন তাদের দিকেই যদি অভিযোগের আঙুল ওঠে তাহলে নিশ্চিত ভরসার জায়গাটিও আর থাকে না। এই অসহায়ত্ব নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনেকগুলো চুক্তি ভঙ্গ করে।

গুম আর হত্যার এই মহোৎসবে নিত্যই নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে আমাদের পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাই না। কেননা আমরা এখন জানি, পুলিশ কোনো সময়েই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণের সুতো যাদের হাতে, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে পুলিশের দক্ষতা ও সাফল্য।

সাগর-রুনি যখন তাদের শোবার ঘরে খুন হলেন, তখন তৎকালীন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর কত আটচল্লিশ ঘন্টা গড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। পরবর্তীতে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর সাগর-রুনির চরিত্রহননের চেষ্টা করেন। অক্ষমের কত রকমে আস্ফালনই না থাকে! তিনিও সাতদিনের মধ্যে সকল অপরাধীকে ধরার নামে অন্য এক ডাকাতি মামলার আসামীদের সাগর-রুনির হত্যাকারী হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

বর্তমান সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর, এখনও অবধি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারও হাতে ন্যস্ত করেননি। অনুমান করি, বিগত সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখেছেন। আমরা এই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছি, যখন তিনি মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ডেকে অপরাধী যে-ই হোক না কেন, তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন।

তবে আমরা আরও স্বস্তি পাব যদি দেখি, ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেবার আর প্রয়োজন হচ্ছে না। তার আগেই তারা সকল শক্তি প্রয়োগ করে প্রচলিত আইনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন, কারও নির্দেশের অপেক্ষা করবেন না। কারণ অপহরণের মতো একটি ফৌজদারি অপরাধ সংগঠনের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের নিজেদের নিয়মে সক্রিয় হওয়ার কথা। তাদের আলাদা করে নির্দেশ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

দেশের সকল মানুষের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছানোর সাধ্য নেই, সকল সমস্যা তাঁর নজরে পড়বে এমন নিশ্চয়তাও নেই। কিন্তু সকল নাগরিকের আইনের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আমাদের সংবিধান দিয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের চুক্তির মূল শর্তই হচ্ছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকের আনুগত্যের বিপরীতে অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি তার জীবন ও মালের নিরাপত্তা প্রদান করবে। দেশে এখনও অনেক মানুষ গুম হয়ে আছেন বা হচ্ছেন বলে প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে জানতে পারছি। এতে দেশের সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে, যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে গুম হয়ে যেতে পারেন।

সমাজে একসঙ্গে থাকতে গেলে হাড়িপাতিলের একসঙ্গে থাকার মতো ঠোকাঠুকি হবেই, কিন্তু তাই বলে কথায় কথায় একে অন্যকে হত্যা করতে উদ্যত হওয়া স্বাভাবিক লক্ষণ নয়। আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের দিনে দিনে অসহিষ্ণু করে তুলেছে; নিছক চুরির অভিযোগে ও পিটিয়ে মেরে ফেলার সংস্কৃতি চলছে। কয়েক বছর আগে কেবল ছিনতাইকারী আর ডাকাতদের পিটিয়ে মারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন কে কখন কাকে মারছে নিশ্চিত করে বলা যায় না।

অব্যাহত সন্ত্রাসের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ একসময় ক্রসফায়ারের মতো বেআইনি হত্যাকে নিরব সমর্থন দিয়েছে। এখন তার নেতিবাচক দিক সবাইকে ভোগ করতে হচ্ছে। আজকের এই অবস্থার জন্যে তাই কোনো বাহিনী বা সন্ত্রাসীরা দায়ী নয়, এর দায়ভার সকল নাগরিককেই নিতে হবে। সবার জন্যে সমান একটি আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা, নিজের স্বার্থের উপরে উঠে অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎসাহস না থাকার ব্যর্থতা, নিজের অধিকার বুঝে নিতে না পারার ব্যর্থতা– সবই আজকের অবস্থার পেছনে দায়ী।

নারায়ণগঞ্জে তানভীর মোহাম্মদ ত্বকীকে যখন গুম করে পরে হত্যা করা হয় তখন অনেকেই মুখ খোলেননি, রাফিউর রাব্বির আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে। তারও আগে যখন ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হলেন, অনেকেই মুখ খোলেননি তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে একমত ছিলেন না বলে। নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্বাসও অনেককে হয়তো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখছে। কিন্তু এতে একটি গুরুতর সমস্যা নিজের নয় বলে পাশ কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা থাকে, সমাধান থাকে না।

একটি জাতির সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যেতে হলে আইনের শাসন কায়েম থাকা খুবই জরুরি। গণতন্ত্রের ভাষা বিশ্বের অনেক দেশেই এখন পরিণত, আমরা তাদের কাছেও শিখতে পারি। আমরা কেবল মুখেই গণতন্ত্রের কথা বলছি। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেসব গণতান্ত্রিক আচরণ দেখি তা আমরা শিখে উঠতে পারছি না। এদেশে ক্ষমতা এমনই এক জিনিস, পেলে আর কেউ ছাড়তে চান না।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরি ডুবে তিনশ'র অধিক মানুষের মৃত্যু কেন্দ্র করে তুমুল সমালোচনার মুখে কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা তাই আমাদের বিব্রত করে না। রানা প্লাজাতে যে সংখ্যক শ্রমিককে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে আমাদের দেশের অনেক মন্ত্রীর একযোগে পদত্যাগ করাই যথার্থ হত!

নারায়ণগঞ্জ যেন একটি ত্রাসের জনপদ। সেখানে নদীতে মাছের পরিবর্তে লাশ ভাসে প্রতিনিয়ত। লাশের মিছিলে সামিল হয়েছে শিশু, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। রিজওয়ানা হাসান তার স্বামীর অপহরণের পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের টর্চার সেলগুলোতে খোঁজ নিলে হয়তো তার স্বামীকে পাওয়া যাবে। এ কথার জবাবে, পুলিশের এক কর্তাব্যক্তি জানিয়েছিলেন যে, তারা সেসব টর্চার সেল আগেই ভেঙে দিয়েছেন।

পুলিশের উক্ত কর্মকর্তা মূলত স্বীকার করে নিলেন যে, নারায়ণগঞ্জে টর্চার সেল ছিল। এসব তারা এতদিন স্বীকার করেননি। রাফিউর রাব্বি কিংবা আইভি রহমান যেসব অভিযোগ করে আসছিলেন, এতদিন পর তা সত্য বলে প্রমাণ হল। তাহলে ত্বকীর হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে এত দেরি কেন? তারা তো জানেন, কোথায়, কার নির্দেশে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে!

পরিশেষে বলতে চাই, সাতটি লাশের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আমরা আমাদের আইনি ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরে পেতে চাই। আমাদের পুলিশ যেন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ওঠে।