চব্বিশ ঘণ্টার শ্রমিক নারীর ট্রেড ইউনিয়নে আসার বাধা যেখানে

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 2 May 2014, 08:49 AM
Updated : 2 May 2014, 08:49 AM

রান্না করতে, বাচ্চার কাঁথা ধুতে, কাপড় কাচতে জরায়ু লাগে না।

— নারীবাদীদের মধ্যে প্রচলিত প্রবাদ

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন কিছু বন্ধুর সঙ্গে বসা হয় প্রায়ই। শ্রমিক অসন্তোষ, আন্দোলন, ট্রেড ইউনিয়ন এসব নিয়ে আলোচনা হয়। আমার ভূমিকা অবশ্য শ্রোতার, যেহেতু এ ক্ষেত্রে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই, যতটুকু অভিজ্ঞতা তার পুরোটাই দেখা আর শোনার মধ্য দিয়ে।

কিছুদিন আগে বন্ধুরা যখন দেশের শ্রমিক অধিকার ও আন্দোলন সম্পর্কে আমার যৎসামান্য অভিজ্ঞতা থেকে লিখতে বললেন, তখন প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মেয়ে শ্রমিকদের সংগঠনে আসার বাধাগুলোর ওপর লিখতে চাইলাম। এর কারণ এই নয় যে, আমি নিজে মেয়ে বরং কারণটা এই যে, আমার কাছে মনে হয়েছে শ্রমিক অধিকার বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা করেন এমন ব্যক্তি তিনি পুরুষই হোন আর নারী, সকলেরই নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বাধাগুলো নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার আছে এবং এসব বাধা কীভাবে পার হওয়া যাবে সে সমাধানও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

এর আরও একটা বড় কারণ এই যে, গার্মেন্টস অর্থাৎ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের সুবাদে দেশে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের একটা বিরাট অংশ আজ নারী। তাই শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে শ্রমিক সংগঠনগুলোতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে কিছু শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনকে মোটামুটি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনই ছিল প্রধান। শ্রমিক সংগঠন সম্পর্কে কোনোরকম অভিজ্ঞতা না থাকাতে প্রথমদিকে অবাক হতাম এসব সংগঠনে ওপর সারির নেতাদের প্রায় কেউই শ্রমিক নন দেখে।

অবাক লাগত পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা মূলত পুরুষ দেখে। কারণ তৈরি পোশাক খাতে নব্বই ভাগের ওপর শ্রমিক নারী, শ্রমিক সংগঠনের নেতাও তো নারীই হওয়ার কথা, অন্তত স্বাভাবিক বুদ্ধিতে তো সেটাই মনে হয়। পরে বুঝেছিলাম শ্রমিক সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে এটাই দস্তুর– সেখানে ওপরের সারির নেতারা শ্রমিক হবেন না; একইভাবে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনগুলোও পরিচালিত হবে পুরুষ নেতাদের দ্বারা।

পরবর্তীকালে এসব সংগঠনে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে জানার সুযোগ আরও কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে। আর তার থেকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে নব্বই শতাংশের ওপরে শ্রমিক নারী হলেও, গার্মেন্টস শিল্পকেন্দ্রিক ট্রেড ইউনিয়নে সাধারণ সদস্য থেকে নেতৃ পর্যায়ে কেন তাঁদের উপস্থিতি পুরুষের চেয়ে কম তার সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা হয়েছে। এর কিছু মনে হয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিজেদের দুর্বলতা। আবার অনেকগুলো ক্ষেত্রে সার্বিক সামাজিক পরিস্থিতির ভূমিকা মুখ্য মনে হয়েছে।

প্রথম কারণটা সম্ভবত শুধুই সময়ের অভাব। কারখানার হাড়ভাঙা খাটুনি তো আছেই, আছে বাসা থেকে কারখানা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া-আসার সময় ও শরীরের ধকল। তারপর আছে সংসারের কাজ। এ ক্ষেত্রে অবিবাহিত বা একলা শ্রমিক যাঁরা অন্যদের সঙ্গে মেস করে থাকেন তাঁদের সাংসারিক খাটনি একরকম, বিবাহিত শ্রমিকের চেয়ে তুলনামূলক কম। আর বিবাহিত হলে তো কথাই নেই। বাচ্চা পালা থেকে পরিবারের সকলের জন্য রান্না করা, ঘর গুছানো, বাজার-সদাই, কাপড় ধোয়া, কুটুম্ব দেখভাল সবই মেয়ে শ্রমিকটিকেই করতে হয়। তারপর 'সংগঠন করব' এটা ভাবার মতো সময়ই বা কোথায়?

আর দ্বিতীয় কারণটা সেই খাড়া-বড়ি-থোড়, 'পুরুষের জগৎ' তত্ত্ব। অর্থাৎ ঘরের বাহির মানেই পুরুষের জগৎ, শ্রমিক সংগঠনও যার ব্যতিক্রম নয়। আর তাই সেখানেও পুরুষেরই আধিপত্য স্বাভাবিক, সে নেতৃত্বের বেলায় হোক কী সাধারণ সদস্যের বেলায় হোক।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হতে পারে, নারী তো আজ বাইরে এসেছে, কাজ করছে, নিজের উপার্জনই আজ বহু নারীর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল, তাহলে অন্তত পোশাক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে কেন নারীর উপস্থিতি এত কম? উত্তরটা মোটা দাগে মনে হয় এই যে, ঘরের বাহিরে নারী বের হলেও গড়পড়তা নারী তো ক্ষমতার ধারকাছেও নেই। ট্রেড ইউনিয়ন তো 'ক্ষমতা আদায়', 'অধিকার' অর্থে যদি বলি, তারই জায়গা, অতএব সেখানে নারীর থাকার কথাও নয়।

সমস্যা যেখানে, উত্তরণের প্রসঙ্গও সেখানে। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এটাই বলে যে, শ্রমিক সংগঠনে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হলে গৃহকর্মে তার সম্পৃক্ততা কমাতে হবে। সময়ের হিসাবটা এখানে সবচেয়ে বড়। পৃথিবীর দিনরাত্রি ২৪ ঘণ্টা তো আর ৪৮ ঘণ্টায় নেওয়া সম্ভব নয়। যদি নেওয়া যেত তবে হয়তো নারী এখন যেভাবে ঘরের ম্যানেজার কাম পরিচারকের দায়িত্ব সামলায়, তখনও সেভাবেই বাকি সময়টা বাইরেও কাজ করতে পারত।

নারীকে কেন এত কাজ একাই করতে হবে, কেন এত ভূমিকা একাই নিতে হবে, কেন তাকে 'সুপারওমেন' অর্থাৎ দশভুজা দূর্গা হতে হবে– সে সঙ্গত প্রশ্নে না-ই বা গেলাম। শুধু সময়ের হিসাব কষেই বলে দেওয়া যায় ঘর আর পেশা সামলে সংগঠনকে নারী শ্রমিক যদি-বা সময় দিতে পারেন সেটা হবে একেবারে খুব কম, বড় দায়িত্ব বা সংগঠনের যে কাজে সময় দিতে হয় সে রকম দায়িত্ব তাঁরা নিতে পারবেন না।

এসবই অনেকবার বলা কথা, যাকে বলে পুরান প্যাচাল। আমাদের পুরুষ বন্ধু-সহকর্মীরা তো বটেই, এমনকি নারী বন্ধুরাও অনেকে আজকাল ভীষণ বিরক্ত বোধ করেন এসব কথা তুললে। বিরক্ত হই আমরা নিজেরাও যারা একই প্রসঙ্গ তুলি– যেটা হবে না সে প্রসঙ্গ বার বার টেনে আনা কেন? কারণ একটাই, এ অবস্থার সমাধান আসতে হবে, না হলে সমষ্টি নারীর পক্ষে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না।

এর একটা অন্য পিঠও আছে। সেটা হচ্ছে পুরুষের দিক। গৃহকর্মের যাবতীয় দায়িত্ব নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে পুরুষের পক্ষে কি সুস্থ জীবন যাপন সম্ভব? উত্তরটা একটা স্পষ্ট 'না'। এর কারণ 'গৃহকর্ম নারীর দায়িত্ব' এই যে শিক্ষা সেটা চরম অমানবিকতার শিক্ষা, এটা যে শেখে সে অমানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। এই শিক্ষা নারী যেমন পায়, তেমনি পায় পুরুষ। সমাজের কোটি কোটি মানুষ এই চরম অমানবিক শিক্ষাকে পরম শিক্ষা মনে করে লালন করে চলেছে, প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছে, এভাবেই আমাদের সমাজ হাজার বছরের একটা অমানবিক সমাজে পরিণত হয়ে আছে।

গৃহকর্ম নারীরই কাজ– এটা এক মূল্যবোধ এবং তা থেকে জাত ভাবনা ও কাজের শিকড়গাড়া অভ্যাস। আর কে না জানে, মানুষের চামড়া খুলে নেওয়া সম্ভব কিন্তু অভ্যাস বদলানো সম্ভব নয়! এমনকি পরিবর্তিত মুল্যবোধ বা বিবেচনার বোধ থেকে যখন আমরা বুঝি যে, কোনো একটা কাজ ঠিক করছি না, তখনও অমোঘ অভ্যাস আমাদেরকে দিয়ে সেই অনুচিত কাজটাই করিয়ে নেয়– এ অভিজ্ঞতা আমাদের কার না আছে?

গৃহকর্মে কী কাজ? পরিবারের খাবার মজুদ করা, খাবার তৈরি, পানির সংস্থান, জ্বালানির সংস্থান, বাসা পরিস্কার, কাপড় পরিস্কার, সন্তান লালন-পালনের হাজার খুঁটিনাটি, বৃদ্ধের সেবা, রোগীর সেবা, এসব কিছুর ব্যবস্থাপনা– মোটা দাগে এ কয়টা ভাগ। কোনো কারখানায় একজনের জন্য এর চেয়ে বেশি কাজ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমরা মেয়েরা কেন ভাবি এ কাজগুলো আমার? ছেলেরাই বা কেন ভাববে এ কাজগুলো শুধুই মেয়েদের? আরও আছে, এসব বিষয় নিয়ে যখনই কোনো আসরে কথা ওঠাই, নারী ও পুরুষ উভয়েই হাঁ হাঁ করে আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উগরে দেন, আমাকে উগ্র নারীবাদী হিসাবে তকমা লাগিয়ে দেন।

এসব শোরগোলে আমার মেয়ে বন্ধুদের আওয়াজটাই যেন মাঝে মাঝে জোরে শুনি। কিন্তু আমার গলা টিপে তো আর সেই সত্যটা পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয় যে, বাচ্চার গু পরিষ্কার করতে বা তাকে ইস্কুলের জন্য তৈরি করতে, কিংবা রান্না করতে বা কাপড় ধুতে দুটো হাতই লাগে, জরায়ু বা স্তন লাগে না।

মজার ব্যাপার এই যে, ঘরের কাজ সেটাই যখন বাইরের কাজ হয়ে যায়, সেটা থেকে যখন দু'পয়সা কামানো যায় তখন আর তা মেয়েদের থাকে না– পৃথিবীর সব জায়গায় ছোট-বড় সব বাবুর্চি, যাদের গালভরা ইংরেজি নাম 'শেফ'– পুরুষ। ধোপাখানা আর ইস্তিরির দোকানের মালিক আর শ্রমিক দুই-ই পুরুষ। মেহমানি ব্যবসার মালিক-শ্রমিক দুই-ই পুরুষ। কত আর বলব! পশ্চিমেই বলুন বা অন্য কোনো অঞ্চলে, মেয়েরা আজকাল ঠেলা-গুঁতা দিয়ে সেখানে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে মাত্র।

শ্রমিক সংগঠনে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিয়ে লিখতে গিয়ে গৃহকর্ম নিয়ে এত কথা বললাম এই জন্য যে, এ ধরনের সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য শ্রমিক হিসেবে উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ এ ধরনের সংগঠনে যুক্তরা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান, উৎপাদন যাদের শ্রমে হয় অথচ শ্রমিক হিসেবে যারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত তাদের ক্ষমতায়ন ঘটাতে চান।

আজ দেশের শিল্পখাতভিত্তিক উৎপাদনে শ্রমশক্তির একটা বিরাট অংশ নারী। তাদের সত্যিকার ক্ষমতায়ন ঘটাতে হলে তা শুরু করতে হবে ঘর থেকে, কারখানা থেকে করলে হবে না। শ্রমিক জীবনে পরিবর্তন ঘটানোর নিয়ামক হিসেবে কোনো শ্রমিক সংগঠন যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে তাকে যাদের সঙ্গে সে কাজ করছে তাদের জীবনের প্রত্যেক অংশই বিবেচনা করতে হবে এবং যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন সেখানে তার সূচনা করতে হবে।

হাজার বছরের মূল্যবোধ আর অভ্যাস বদলানো কঠিন, সেটা বুঝে নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ভাবতে হবে কীভাবে সেই পরিবর্তনের সূচনা তাঁরা করবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নিজের ভাবনার ও কাজের অভ্যাসই প্রথম বদলাতে হবে। সেটা যদি করা না যায়, পরিবর্তনের যে কোনো চেষ্টা, হোক সেটা নারী বা পুরুষ শ্রমিকের, সবই হবে ওপর-ওপর, ক্ষণস্থায়ী, অর্থহীন।

কারখানার আর গৃহজীবনের এত ব্যস্ততার পরও নারী শ্রমিকরা যে একেবারেই সংগঠনের কাজে আসেন না তা তো নয়। কেউ কেউ তো আসেনই। শ্রমিক সংগঠনগুলোর তৎপরতা বা কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতন বা সুবিধাদি নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য নিজ উদ্যোগে নারী শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় সংগঠনের দুয়ার মাড়ান। কিন্তু সেটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা কতটা ভূমিকা তাঁরা রাখতে পারেন সে নিয়ে সন্দেহ আছে। আমি যতটুকু দেখেছি তাতে শুধু নারী নয়, পুরুষ শ্রমিকদেরও সংগঠনে নিয়ে আসা বা যাঁরা আসছেন তাঁদের ধরে রাখার চেষ্টা বলি বা সামর্থ্য, সবকিছুতেই শ্রমিক সংগঠনগুলোর বড় ধরনের ঘাটতি আছে বলে মনে হয়েছে।

নিচে আমার পর্যবেক্ষণগুলো যতটা সম্ভব সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

১. শ্রমিক সংগঠন যে একটি নিরাপদ জায়গা, সেখানে গেলে যে যৌন হয়রানির কোনো আশঙ্কা নেই, সেই আস্থার জায়গাটি নারী শ্রমিকদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। সংগঠনের মধ্যে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

২. কারখানায় যাওয়া-আসার পথে নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির কোনো প্রতিকার আজ পর্যন্ত আমরা করতে পারিনি। নারী শ্রমিকরা এ ক্ষেত্রে একত্রে চলাফেরা, কোনো পুরুষ সহকর্মীকে সঙ্গে রাখা এবং ইদানিংকালে ব্যাপক হারে বোরখা পরার মধ্যে এ সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন।

এ বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর অনেক কিছু করার ছিল, আমার জানামতে এ বিষয়টিই কোনো সংগঠনের মাথায় নেই। শ্রমিক সংগঠন, সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি সংস্থা যারাই নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি নিয়ে মাথা ঘামান, সকলেই কারখানার ভেতরে যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ তোলেন। কারখানায় যাওয়া-আসার পথে যৌন হয়রানি বন্ধ করতে শ্রমিক সংগঠনগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা নারী শ্রমিকদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করবে বলেই মনে হয়।

৩. দিনের যে সময়ে বা যে স্থানে নারী শ্রমিকদের আসতে সুবিধা হবে সে সময়ে বা সে স্থানে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা সভা করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। সভা এমন সময়ে শেষ করা যাতে তাঁদের নিরাপদে বাড়ি ফিরতে সুবিধা হয়। পথ বিপজ্জনক হলে সঙ্গে কেউ যাওয়া। প্রয়োজনে শিশু সন্তানসহ আনতে উৎসাহিত করা। সভার জায়গায় বা সংগঠনে শিশু উপযুক্তভাবে রাখার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে সংগঠনের পুরুষ সদস্যটিকেও উৎসাহিত করা প্রয়োজন যাতে তিনি বাসায় স্ত্রীর ঘাড়ে বাচ্চা ফেলে না দিয়ে সন্তানকে সঙ্গে করেই আসেন।

৪. সংগঠন করার কারণে কোনো নারী শ্রমিকের দাম্পত্য কলহ হলে বা সাংসারিক ঝামেলা হলে সেখানে পর্যাপ্ত পরামর্শ সহায়তা দেওয়া। যদি এ কারণে কারও বিচ্ছেদ ঘটে তবে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের ব্যবস্থা থাকা।

৫. একটি শ্রমিক সংগঠনকে কাজের বিস্তৃত ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলার মতো মানসিকতা নেতৃত্বের থাকা দরকার। অন্তত দু'টি গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক সংগঠন দেখে আমার মনে হয়েছে এ বিষয়ে সদিচ্ছা বা উপলব্ধির যথেষ্ট অভাব রয়েছে শ্রমিক নেতৃত্বের মধ্যে।

এদেশে যাঁরা কারখানার শ্রমিক তাঁদের পারিবারিক পটভূমি এমন যে সেখানে প্রকট দারিদ্র্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব এবং নারী বিষয়ে অত্যন্ত রক্ষণশীল মনোভাব বিদ্যমান থাকে। শ্রমিকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বৃদ্ধি এবং নারীর প্রতি রক্ষণশীল মূল্যবোধ পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারে শ্রমিক সংগঠন।

শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা, নিরক্ষর শ্রমিকদের লেখাপড়া শিখতে উৎসাহিত করা, প্রয়োজনে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া, লিঙ্গসাম্য সম্পর্কে মুল্যবোধ সৃষ্টি ও তা চর্চায় উৎসাহিত করা, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য পরামর্শ সহায়তা দেওয়া ইত্যাদি যে বিষয়গুলো কারখানায় শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয় কিন্তু ব্যক্তি বা সমষ্টিগতভাবে শ্রমিকের জীবনের সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য অনিবার্য, সে বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি।

শ্রমিকের জীবনের সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য, তার সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য এ বিষয়গুলোতে শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা আমি দুয়েকবার কোনো কোনো শ্রমিক নেতাকে বলতে গিয়ে বেজায় বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছি। তাঁরা বলেছেন, শ্রমিক সংগঠনের এ ধরনের ভূমিকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, শ্রমিক সংগঠন কেবল শিল্পমালিকদের কাছ থেকে অধিকার আদায়ের ব্যাপারেই ভূমিকা রাখবে।

আমার প্রশ্ন, কে তাহলে শ্রমিককে এ ব্যাপারে সহায়তা দেবে? আমি শ্রমিক সংগঠনকে স্কুল-কলেজ করার কথা বলছি না নিশ্চয়ই, কোথা থেকে সেই সহায়তা তিনি পেতে পারেন সেই দিকনির্দেশনা তো তাঁরা দিতে পারেন। শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব ডিগ্রিধারী লোকজনের হাতেই, তাহলে যে তথ্য বা যোগাযোগ তাঁদের আছে সেটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংগঠনের সদস্যদের দিতে অসুবিধা কোথায়? সেটা করতে হলে শ্রমিক সংগঠনের ছকে বাঁধা ভূমিকার বাইরে হয়তো কিছু করতে হতে পারে কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত সার্বিকভাবে সংগঠনটিরই লাভ হবে।

আরও একটা বিষয়, এ ধরনের সহায়তা যে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব এখনই তাঁদের সাধারণ সদস্যদের দিচ্ছেন না তা নয়, কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে অনিয়মিতভাবে। সেটাই আমরা আরও কিছুটা নিয়মানুগ ও পদ্ধতিগতভাবে করার কথা বলছি।

৬. নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিকদের সংগঠনে সম্পৃক্ত করা ও নেতৃত্ব বিকাশের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন যার মূল কারণগুলো ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমার স্বল্প অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, অনেক নারী সংগঠনে এসেছেন ঠিকই কিন্তু সংগঠনের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা ও প্রয়োজন, তাঁদের সামর্থ্য ইত্যাদিতে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের ঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন নেতৃত্ব। এর ফলে এই নারীরা অচিরেই হারিয়ে গিয়েছেন। এঁদের কেউ কেউ যদি বা থেকে গেছেন কিন্তু যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন তার কিছুই বিকশিত হয়নি।

সে কারণেই সংগঠনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যেমন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা জরুরি, তেমনি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কীভাবে শ্রমিকদের কাজে লাগানো হবে, তাঁদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে তোলা হবে কীভাবে তারও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।

সংগঠনে নারীদের সম্পৃক্ত হওয়ার পথে যেসব বাধা নিয়ে ওপরে আলোচনা করা হল তা আদৌ কখনও পুরোপুরি অপসারিত হবে কিনা তার উত্তর ভবিষ্যতই দেবে। তবে এটা সত্যি, এসব বাধা অপসারণের জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঐকান্তিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো যত দ্রুত এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে ব্যবস্থা নেবে তত দ্রুত তাদের সঙ্গে নারী শ্রমিকের কার্যকর যুক্ততা গড়ে উঠবে, শ্রমিক সংগঠনে শ্রমিক নারীর নেতৃত্ব বিকশিত হবে।

প্রিসিলা রাজ: সাংবাদিক, অনুবাদক ও গবেষক।