মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 30 April 2014, 07:11 PM
Updated : 30 April 2014, 07:11 PM

মেদিবস এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই দিনে প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে শ্রমিকরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সমবেত হন। মিছিল-মিটিং-সমাবেশ-আলোচনায় যোগ দেন। কিছু দাবি-দাওয়াও উচ্চারিত হয়। কোথাও কোথাও একটু বিপ্লবী গানবাজনারও আয়োজন থাকে।

শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নের চাবি যাদের হাতে, তারাও ইদানিং মে দিবসে এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের পক্ষে একটু মায়াকান্না কেঁদে যান। কিন্তু তাতে শ্রমিকের জীবনের ন্যূনতম দাবি পূরণ হয় না। বরং এদিন গাড়ি-কলকারখানা বন্ধ থাকায় অনেকের আয়-রোজগার বন্ধ থাকে। তাদের অনেক কষ্টে দিনটি পার করতে হয়। মে দিবস বাংলাদেশের অনেক শ্রমিকের কাছে এমন 'প্রহসন' হয়েই আসে। অথচ বিশ্ব ইতিহাসে শ্রমিকশ্রেণির দাবি ও অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে দিনটি অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে চলেছে।

ইতিহাসের সব যুগেই শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগেও শ্রমিকের অস্তিত্ব ছিল। খ্রিস্টের জন্মের বহু বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠে। এই সভ্যতা নির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। মিশরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রেও ছিল শ্রমিক। এদের বলা হত দাসশ্রমিক। এই শ্রমিকরা ছিল বাধ্য-শ্রমিক। তাদের নিজস্ব কোনো মতামত বা স্বাধীনতা ছিল না। মালিকের ইচ্ছেমতো তাদের চলতে হত বা কাজ করতে হত। দাসশ্রমিকদের শ্রমেই নির্মিত হয় মিশরের পিরামিড। হরপ্পা ও মহেনজোদাড়োর নগর নির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এসব সভ্যতা গড়ে তোলার পেছনে শ্রমিকদের ভূমিকাই ছিল প্রধান।

এরপর মানবসভ্যতা যত সামনে এগিয়েছে, শ্রমিকের ভূমিকা তত বেড়েছে। নগর নির্মাণ, বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার, ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরাই সমৃদ্ধি আর প্রগতির চাকাকে সামনে ঠেলে নিয়ে গেছে। ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির জন্ম হয়। ১৬৪০-৫০ সালে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব ঘটে। এর আগে ১৫২৪-২৫ সালে অস্থায়ীভাবে জার্মানিতে, ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সে শিল্পবিপ্লব ঘটে।

শিল্পবিপ্লবের ফলে অর্থাৎ শিল্পকারখানা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া লোকেরা শ্রমিকে পরিণত হয়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসানের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডেই প্রথম বিপ্লব ঘটে। বুর্জোয়ারা এই সংগ্রামে জয়ী হয়ে গোটা ব্যবস্থাকে তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল শত্রু-শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ে, ভাগ হয় পরস্পরের সম্মুখীন বিশাল দুটি শ্রেণিতে– বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েট, মালিকরা প্রথম শ্রেণিভুক্ত এবং শ্রমিকরা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত।

যুগ যুগ ধরে পুঁজিপতিরা শ্রমিকের শ্রম শোষণের মাধ্যমে নিজেদের বিত্তের পাহাড় গড়েছে। বিত্তবানদের মুনাফার জন্য শ্রমিকদের যুগের পর যুগ ধরে বেগার খাটতে হয়েছে। ইউরোপে শিল্পবিল্পবের আগে শিল্পশ্রমিকদের কাজের কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম ছিল না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হত। কোথাও যদি কোনো শ্রমিক ভুলক্রমে ক্ষীণতম প্রতিবাদ জানাত তাহলে তার উপর শুরু হত অকথ্য নির্যাতন; ছাঁটাই তো অতি তুচ্ছ ব্যাপার মাত্র; প্রহারে প্রহারে শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হত। পরিশেষে অর্কমণ্য করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হত।

এই অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ এবং সংগঠিত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা দাবি জানায়– 'আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়; সপ্তাহে একদিন ছুটি চাই; অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্যহানি অথবা অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন আর নয়।' আর এভাবেই শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায় তথা মানুষের মতো বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়।

মে দিবসের উৎপত্তি মূলত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এটি উৎপাদনমুখী শ্রমিকদের সংগ্রামের ফসল। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায়ের বিষয়টি এক দিনেই সামনে আসেনি। প্রায় ১২১ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, ধর্মঘট, শ্রমিকের রক্তের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই দাবি।

বাংলাদেশে শ্রমিক ও শ্রমিকআন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি

সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অপরিমেয় ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরও তারা ন্যায্য মজুরি পায় না। নিয়মিত কাজ নেই। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। তারা সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারে না। চিকিৎসাসেবা থেকেও তারা এবং তাদের সন্তানরা বঞ্চিত। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন তাদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যেমন গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক তেমনি শ্রমিক আন্দোলনও কার্যকর শ্রমিক-আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যতটুকু অধিকার অর্জন করেছিল, বর্তমানে তার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। যেমন, শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ এখনও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। বঞ্চনা আছে সরকারি কর্মচারী, কৃষি, গৃহশ্রমিকসহ অন্য অনেক সেক্টরে।

পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে মালিকেরা শ্রমিকদের সংগঠন করার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। আইএলও কনভেনশন '৮৭ ও '৯৮-এর ভিত্তিতে এবং '৬৯-এর আইআরও অনুযায়ী পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করা তো দূরের কথা, অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। আজও আইএলও '৮৭ এবং '৯৮-এর ভিত্তিতে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি। পোশাক কারখানা, চাতালসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রমিকদের আইনগত বাধা না থাকলেও, ছলে-বলে-কৌশলে শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হচ্ছে। মালিকদের খামখেয়ালিপনায় শ্রমিক ছাঁটাই-নির্যাতন অহরহ চলছে। বন্ধ কলকারখানা চালু করার ঘোষণা দিলেও এখনও সেগুলো বন্ধ রয়ে গেছে। দেশে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্প গড়ে উঠছে না।

বর্তমানের নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বায়নের প্রতাপে এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর গৃহীত নতজানু নীতির ফলে সারা দেশেই সংগঠিত শিল্পকারখানা দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। বাড়ছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। স্থায়ী কর্মীর তুলনায় বাড়ছে 'ঠিকা' কর্মীর সংখ্যা। তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা এবং অধিকার প্রসারিত করা আজ শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগের বেশি শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছেন। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অসংগঠিত শ্রমিকদের দিয়ে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো হচ্ছে। তাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। ছুটির বিধান নেই, নিয়ম অনুযায়ী ওভারটাইম দেওয়া হয় না। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সমাজে সমমজুরি দেওয়া হয় না। পথে-ঘাটে-বাসায় নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই।

এসব নিয়ে কার্যকর কোনো শ্রমিক আন্দোলনও নেই। আন্দোলনের জন্য সংগঠন প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সংকীর্ণতা, দলবাজি, সন্ত্রাস, নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রাণপণ প্রয়াস ইত্যাদি বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনকে চরম অবক্ষয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

আমাদের দেশে গত চার দশকে যখন যারা ক্ষমতাসীন হয়েছেন, তারা কখনওই শ্রমিকের স্বার্থ দেখেননি। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের যতটা গুরুত্ব আছে, শ্রমিকদের প্রতি রয়েছে ঠিক সেই পরিমাণ অবজ্ঞা ও অবহেলা। কারণটা খুবই সহজ। পুঁজিপতি ও শ্রমিক জন্মলগ্ন থেকেই দুই বৈরী শ্রেণি। শ্রমিককে যত বেশি শোষণ করা যায়, ততই পুঁজিপতির মুনাফা। আমাদের দেশে এ যাবৎ যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সবাই ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি। হাতেগোনা কয়েকটি বামপন্থী দল বাদে সব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে পুঁজিপতিরা। বিশেষত গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা অথবা তাদের প্রতিনিধি, যারা ওই মালিকদের কাছ থেকে নির্বাচনের জন্য বা দল চালানোর জন্য বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকেন। প্রশাসন বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ পুলিশ, র‌্যাব ও প্রশাসনিক আমলা, তারাও মালিকদের কাছ থেকে টাকা পেয়ে থাকেন অথবা সামাজিকভাবে তারা একই শ্রেণিভুক্ত বলে মনে করেন।

আমাদের দেশে সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, সব সরকারই ক্ষমতায় এসে সরকারি আমলা ও কর্মচারীদের বেতন বাড়ায়। নিয়মিত বিরতিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু হায়! দুর্ভাগা শ্রমিকদের মজুরির প্রসঙ্গটি কখনওই কারও কাছে গুরুত্ব পায়নি। আইএলও কনভেনশনে বলা আছে, একজন শ্রমিকের মজুরির ভিত্তি কী কী হবে। খাদ্যপুষ্টি, সাবান, ওষুধ ইত্যাদি আলাদা করে বলা আছে। সেই হিসেব ধরলে সরকার সর্বশেষ যে মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে, শ্রমিকের মজুরি তার চেয়ে অনেক বেশি হওয়া উচিত। আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি এবং টোকেন ভিত্তি ধরে পিস রেটসহ অন্যান্য মজুরি নির্ধারণ করা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমাদের দেশের গার্মেন্টস মালিকরা সেটা মানতেও নারাজ।

এবার আসা যাক শ্রমঘণ্টা ও কারখানার পরিবেশ প্রসঙ্গে। দেশের শ্রম আইনে বলা আছে, কোনো শ্রমিক আট ঘণ্টার অতিরিক্ত শ্রম দেবে না। ওভারটাইম বলে একটা কথা আছে বটে, সেখানে তিনটা শর্ত আছে–

১. শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে ওভারটাইম কাজ করানো যাবে না;

২. ওভারটাইম কোনোক্রমে দুই ঘণ্টার বেশি হবে না;

৩. ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো মালিকই এসব শর্ত মানে না। জোর করে ১৫-১৬ ঘণ্টা বা তারও বেশি খাটানো হয়। ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি কোথাও দেওয়া হয় না। বস্তুত গার্মেন্ট শিল্পে এখনও দুইশ বছর আগের সেই 'শ্রমদাস' প্রথাই বিরাজ করছে। ১৫-১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করার পর এক-দুই মাইল পথ হেঁটে শ্রমিক ঘরে গিয়ে রান্না করে কোনোমতে দুটো খেয়ে ঘুমাতে যায়। চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারে না। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ, তারপরও কাজ করতে হয়। সবচেয়ে অমানবিক ব্যাপারটা হচ্ছে, কোনো কোনো কারখানায় নারীশ্রমিকদের পর্যন্ত বাথরুমে যাওয়ার জন্য পাঁচ মিনিটের ছুটিও ঠিকমতো দেওয়া হয় না।

এক জঘন্য অমানবিক পরিবেশ কারখানায় বিরাজ করছে। একের পর এক পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটছে, অথচ আজ পর্যন্ত কোনো মালিক এর দায় নেননি। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধও দেখা যায় না। বরং মালিকদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা নামমাত্র মজুরি দিয়ে শ্রমিকের জানমাল পর্যন্ত কিনে ফেলেছেন! বাংলাদেশে প্রায় ৫০০০ তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানায় প্রায় ৫০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পকে নিয়মিতই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অথচ কাজের পরিবেশ উন্নয়নে কখনওই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। ফলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটা এবং শ্রমিক মরার ঘটনাকে অবহেলামূলক হত্যাকাণ্ড বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হয় না।

শুধু তাই নয়, দেখা গেছে, গার্মেন্টস মালিকরা কারখানাগুলো অনুপযুক্ত ভবনে স্থাপন করায় এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখায়, শত শত শ্রমিক বছরের পর বছর অগ্নিকাণ্ডে ও ভবন ধসে নিহত হলেও, কোনো সরকারই এ বিষয়ে কিছুই করেনি। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চিন্তা দীর্ঘদিন তাদের মাথায়ই আসেনি। পরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও তার পরিমাণ অতি তুচ্ছ। তাছাড়া অনেক লাশ গুম করে দেওয়ায় তাদের পরিবার সামান্য ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। সর্বশেষ রানা প্লাজা ট্র্যাজিডিতে নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা যে চিত্র দেখেছি, তাকে অমানবিক বললেও কম বলা হয়।

শাসকশ্রেণি, যাদের মধ্যে একটা বড় অংশ হল অবাধ ধনবাদী পন্থায় বিশ্বাসী, তাদের কেউ কেউ দেশটাকে অবাধ ধনবাদী শোষণ ব্যবস্থার দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান। এই শ্রেণি দেশে যেন কার্যকর কোনো শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোকে পঙ্গু ও ধ্বংস করার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অতীতে বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবে প্রাপ্ত অনেক অধিকারও আজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত শক্তি হিসেবে শ্রমিকশ্রেণি যাতে সংগঠিত ও সোচ্চার সামাজিক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে না পারে এবং নিজেদের অধিকার, স্বার্থ ও দাবি আদায় করতে না পারে সেজন্যই যেন সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।

অবাধে সংগঠন গড়ার অধিকার আজ শ্রমিকদের নেই, শ্রমিকরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো ব্যক্তিকে তাদের সংগঠনের মধ্যে গ্রহণ করার অধিকার হারিয়েছে, মানসিক শ্রমে নিয়োজিত শ্রমিকদের কায়িক শ্রমে নিয়োজিত শ্রমিক থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে এবং দেশের শ্রমিক আন্দোলনে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা তাদের মৌলিক অধিকার এবং একমাত্র এই অধিকারের জোরেই তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।

বর্তমানে শ্রমিকরা মালিক বা নিয়োগকারীর কাছে সম্পূর্ণ অসহায় ও হীনবল হয়ে আছে। মালিকদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা মাঝে মাঝে গর্জে উঠলেও শক্তি দিয়ে তা দমন করা হচ্ছে। সরকার, মালিক, সংশ্লিষ্ট আমলা ও শিল্প প্রশাসনের কর্তারা তাদের সব ব্যর্থতার দায় ঢালাওভাবে শ্রমিক ও শ্রমিক আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ছাঁটাই, বরখাস্ত, টারমিনেশন এবং নানা রকমের অর্থনৈতিক শোষণ ব্যবস্থার জালে শ্রমিকরা আজ জর্জরিত এবং সন্ত্রস্ত। এভাবে মহাশক্তিধর একটা শ্রেণিকে, আমাদের সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটা শক্তিকে বন্দি করে ফেলা হয়েছে।

আমাদের দেশের বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরা প্রতিনিয়িত চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। এদেশের নব্যধনিকরা দেশটিকে সর্বনাশের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। সেখানে বাংলাদেশের নবগঠিত শ্রমিকশ্রেণিই হতে পারে নতুন পথের দিশারী। আশা রাখি সব বৈষম্য-বঞ্চনা-অবিচারের বিরুদ্ধে একদিন তারা জেগে উঠবেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরণ আনবেন তারা। শোষণের জোয়াল ভেঙে নব্য পুঁজিবাদীদের লুটপাটের বর্তমান ব্যবস্থাটি ভেঙে ফেলে স্বাধীনতা, মুক্তি ও প্রগতির পথ দেখাবেন।

বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ নয়, তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনের ভণ্ড-প্রতারক-স্বার্থপর শ্রমিকনেতা নয়, এনজিও-মার্কা সুশীল সমাজ নয়, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর দলও নয়– আস্থা স্থাপন করতে চাই বাংলার শ্রমিকশ্রেণির ওপরই। মে দিবসের চেতনায় একদিন তারা জেগে উঠবেন– এই প্রত্যাশা করি।