দাস ব্যবসার নিকৃষ্টতম স্থান কাঁটাবন

রেইনার এবার্ট
Published : 27 April 2014, 12:09 PM
Updated : 27 April 2014, 12:09 PM

সমাজের সম্মুখ দুয়ারের আড়ালে কত রকম দাসত্বই না লুকিয়ে রয়েছে। তৈরি পোশাক আর চামড়া কারখানা থেকে শুরু করে, এমনকি আমাদের ঘরের দরজার আড়ালেও দাসত্ব বিদ্যমান। আমরা সবাই জানি, প্রতিনিয়ত কী ঘটে চলেছে এইসব দরজার পেছনে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এসব ঘটনা আমলে নিই না। কারণ আমরা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাই। তাছাড়া কী দরকার সমাজের ফাঁপা সৌন্দর্যের আড়ালের কদর্যকে খুঁচিয়ে তোলার! এমন সমাজ কেউ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু কখনও কখনও আমরা ভাবতে বাধ্য হই যখন কোনো মানুষের প্রতি দাসত্বের বর্বরতা লোকচক্ষুর সামনে এসে পড়ে।

আদুরীর বেলায় যেমনটা হয়েছিল। গৃহপরিচারিকা আদুরী মুমর্ষূ অবস্থায় পড়েছিল একটি ডাস্টবিনে। চোখের সামনে এমন বর্বরতা দেখলে আমরা কেঁপে উঠি। সন্দেহ হয়, আমাদের প্রতিবেশির বাড়িতে ঠিক এমন কিছুই ঘটছে না তো! এমন ঘটনা ঘটে; কারণ আমরা গৃহপরিচারিকা অথবা শ্রমিকদের আমাদের চেয়ে নিচু মনে করি, দুর্বল মনে করি। তাদের কোনো কিছুতেই আমাদের কিছু এসে যায় না, আর তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাও আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারি না। আমরা প্রায় সবাই এমনটাই ভাবি এবং এর প্রেক্ষিতেই কাজ করি।

আরেক ধরনের দাসত্ব আছে যার নির্মম রূপ দিনের আলোতেও স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমানের 'মানুষ দাস'কে ছাড়িয়ে এটি প্রাচীনকালের নিকৃষ্টতম দাসত্বের মতোই। আমরা মনে করি, এই দাসেরা তাদের মালিকের কিনে ফেলা কোনো 'বস্তু'। এদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ নিয়ে আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না।

আমরা কথা বলছি কাঁটাবন পশু বাজারের দাসদের নিয়ে। যাদের দুর্দশা এই পৃথিবীতে অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা অন্য হাজার হাজার প্রাণির মতোই। গত আগস্টে আমরা কাঁটাবন পশুর বাজার পরিদর্শনে যাই। দেখতে পাই খাঁচাবন্দি আহত-অসুস্থ্ অনেক বিড়াল, খাবার দেওয়া হয়নি, পানি খেতে দেওয়া হয়নি। তীব্র সূর্যের আলোর নিচে এরা পড়ে আছে। ময়লায় থাকতে থাকতে খরগোশদের শরীরে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। কুকুরগুলো ত্রস্ত পায়ে পায়চারি করছে অপ্রশস্ত খাঁচার ভেতরেই, যে খাঁচার মেঝেটা পর্যন্ত তৈরি হয়েছে লোহার শিক দিয়ে।

অনেক পাখি দেখেছি যারা কোনোদিন ডানা মেলে উড়েনি। ছোট ছোট খাঁচায় ডজন খানেক ইঁদুর গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। খাঁচার আকার একটি কাগজের পৃষ্ঠার সমান হবে। কাঁটাবন পশুর বাজারের এসব দৃশ্য সংবেদনশীল মানুষের জন্য নয় (পাঠকরা ছবি দেখে বুঝে নিতে পারেন)।

এখানে প্রাণিদের বিবেচনা করা হয় সম্পত্তি হিসেবে। আমরা (মানুষ) বনাম তারা (পশু) মানসিকতার ছোঁয়া লেগে আছে এই বাজারের সর্বত্র। নৈতিকতার ধারক হিসেবে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। কারণ এই প্রাণি-দাসগুলো আমাদের মতোই জীব। ইঁদুর, গিনিপিগ, পাখি, মাছ, কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, কচ্ছপ আর এই বাজারে বিক্রি হওয়া অন্যান্য পশু প্রত্যেকেরই জীবন আছে– আমাদের মতন। আমাদের মতন তারাও পৃথিবী দেখে, বুঝতে চেষ্টা করে। ব্যথা পায়, বিশ্বাস করে। তাদের মনেও অনেক ইচ্ছা জাগে। আর নিজের জীবনটাকে তারা ভালোবাসে– যেমন আমরা আমাদের জীবনকে ভালোবাসি।

তবুও কি অন্যের সম্পত্তি না হয়ে, জীব হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারটুকু তাদের নেই? যদি তা থাকে, তবে তাদের এই অধিকার প্রতিনিয়ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কাঁটাবনে। এ ধরনের নির্যাতন শুধু মানুষ কেন, অন্য যে কোনো প্রাণির সঙ্গে ঘটলেও মেনে নেওয়া যায় না।

সবাই যদি কাঁটাবন বাজার থেকে এই দাসরূপী প্রাণি কেনা বন্ধ করে দেন তবে এই দাস-ব্যবসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা কথা বলেছিলাম বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাণি কল্যাণ সংস্থা 'অভয়ারণ্য'-এর প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমেদের সঙ্গে, জানতে চেয়েছিলাম কাঁটাবনে প্রাণি ক্রয়-বিক্রয়ের কথা।

রুবাইয়ার সংস্থা ইতোমধ্যেই ঢাকার কুকুর নিধন বন্ধের সফল প্রচারণা চালিয়ে প্রাণিপ্রেমিদের দৃষ্টি কেড়েছে। তিনি আমাদের জানান, মূল সমস্যা হল সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণি পোষ্য হিসেবে কুকুর-বিড়াল রাখাটা মর্যাদার প্রতীক মনে করেন এবং পোষা প্রাণি কেনার জন্যে কাঁটাবনেই তাদের যেতে হয়। কিন্তু তারা আশেপাশের কোনো আশ্রয়হীন কুকুর অথবা বিড়ালের প্রতি আগ্রহ দেখান না। যখন অবজ্ঞা-অবহেলায় অনেক প্রাণি আশ্রয়হীন অবস্থায় রাস্তায় রয়ে গেছে, যাদেরকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব, তখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নতুন করে প্রাণি উৎপাদন এবং এই উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

জাতের ভিত্তিতে কোনো প্রাণিকে উচ্চ মর্যাদার প্রতীক মনে করা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। আর স্বঘোষিত প্রাণিপ্রেমীরা এই কাজটাই করে থাকেন। এই বিষয়ে রুবাইয়া বলেন, এরা প্রাণিদের শুধুমাত্র জাতভেদে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন, কখনও আশ্রয়হীন প্রাণিদের কথাও ভাবেন না, বুঝতেও পারেন না টাকা দিয়ে এই প্রাণিদের কিনে আনলে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।

যদিও 'অভয়ারণ্য' ঢাকাকে কুকুর নিধনমুক্ত করেছে এবং রাস্তার প্রাণিদের অবস্থা উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, তবুও এখনও ঢাকার রাস্তায় অনেক কুকুর-বিড়াল ধুঁকছে। ঢাকার বাইরের চিত্রও একই রকম। আপনি যদি পোষা হিসেবে কোনো প্রাণি রাখতেই চান তবে তা কেনার বদলে আপনার চারপাশের আশ্রয়হীন প্রাণিদেরই কেন দত্তক নিচ্ছেন না?

পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, 'পোষ্য' শব্দটির ব্যাপারে রুবাইয়ার আপত্তি আছে। তার চেয়ে তাদের বন্ধু ডাকুন, সঙ্গী ডাকুন। পোষ্য শব্দটি মধ্যযুগীয়। তিনি শুধু মনে করেন, না কিনে দত্তক নিন। কাঁটাবনের ব্যবসায়ীরা প্রাণিদের অসহায়ত্ব পুঁজি করে মুনাফা লুটছে। তাদের জন্য এটি কেবল ব্যবসা, উপার্জনের মাধ্যম।

এই বাজারের ব্যবসায়ী এবং শিক্ষিত ক্রেতা উভয় শ্রেণিকেই প্রাণি কেনা-বেচার ক্ষতিকর দিকটি বোঝানো প্রায় অসম্ভব। এদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই আমরা জানতে পারি যে, প্রাণিদের দুর্দশার বিষয়টি তারা অনুভব করতে পারলেও, তাদের তেমন কিছু করার নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, মালিকের নির্দেশেই ছোট খাঁচায় প্রাণিগুলোকে রাখা হয়েছে, এদের ভরন-পোষণের খরচ মালিকই বহন করেন, যদিও তা যথেষ্ট নয়।

কাঁটাবনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানতে পারি, এই বাজারটি গড়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এলাকার ভেতরেই। বাংলাদেশের প্রাণি নির্যাতন আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনো প্রাণিকে অহেতুক যন্ত্রণা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই নয়, বরং আইনানুগভাবেই কাঁটাবনের পশু ব্যবসায়ীদের চাপ প্রয়োগ করে বাজারটি বন্ধ করে দিতে পারেন অথবা অন্ততপক্ষে দোকানগুলোতে প্রাণিদের থাকার ব্যবস্থার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেন।

শেষ করার আগে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার– যারা ব্যক্তিগতভাবে বিদেশি জাতের প্রাণি উৎপাদন করছেন, তাদের জন্য এটি একটি সাবধান বার্তা হতে পারে। আপনারা নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো প্রাণি-উৎপাদকের সঙ্গে পরিচিত, যারা মনে করেন যে কাঁটাবনের ব্যবসায়ীদের তুলনায় তারা প্রাণিদের লালন-পালনের ব্যাপারে বেশি দায়িত্বশীল। আসলে 'দায়িত্বশীল' প্রাণি-উৎপাদক নামে কোনো কিছুই থাকতে পারে না। একজন যখন 'উন্নত জাতের' একটি প্রাণির জন্ম নিশ্চিত করছেন, তখন রাস্তার একটি আশ্রয়হীন প্রাণির কারও কাছে আশ্রয় পাবার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।

এই প্রাণি-উৎপাদকরা মূলত শংকর প্রজাতির প্রাণি উৎপাদন করছেন, যা কিনা কুকুর বা বিড়ালের বংশগতিকে হুমকির মুখেও ফেলছে। প্রাণিগুলো অসুস্থতা নিয়ে বড় হচ্ছে। "কম বয়সে দেখলে হয়তো বোঝার উপায় নেই যে শংকর প্রাণিগুলো বৃদ্ধ অবস্থায় কী গভীর শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হবে"– রুবাইয়া সতর্ক করে দেন।

'অভয়ারণ্য' কিছু অভিজ্ঞ আইনজীবকে নিয়ে প্রচলিত 'বাংলাদেশ প্রাণি নির্যাতন আইন ১৯২০' সংশোধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রাণি-নির্যাতন কমিয়ে আনা। যদি আইনটি বৈধতা পায়, তবে সব ধরণের প্রাণি-উৎপাদক ও ব্যবসায়ীকে সরকারের কাছ থেকে আগে লাইসেন্স নিতে হবে।

বন্ধুভাবাপন্ন প্রাণিগুলো অবশ্যই ভালোবাসা ও সম্মান পাবার যোগ্য। উৎপাদক আর ব্যবসায়ীরা প্রাণিদের এই মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এই প্রাণিদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে এদের মানসিক ও দৈহিক নির্যাতন করছেন। যদি সত্যিই আপনি প্রাণিদের ভালোবেসে থাকেন, তাহলে রুবাইয়ার কথাটি সবসময় মনে রাখুন– না কিনে দত্তক নিন।

কাঁটাবন পশু বাজারটি বন্ধের দাবিতে স্বাক্ষর গ্রহণ চলছে। আপনিও এই স্বাক্ষর কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য ক্লিক করুন–

মূল:

শাহ্‌নূর রাব্বানী: ফ্রিল্যান্স লেখক এবং ক্রীড়া বিশারদ, রেডিও স্বাধীন।

রেইনার এবার্ট: স্নাতক, দর্শন বিভাগ, রাইস বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ লিবারেল ফোরাম; এসোসিয়েট ফেলো, অক্সফোর্ড সেন্টার ফর অ্যানিমেল এথিক্স।

অনুবাদ: নূর উস সাফা অনিক।