শাহবাগের সাপ

পারভেজ আলম
Published : 18 April 2014, 07:39 AM
Updated : 18 April 2014, 07:39 AM

শাহবাগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ একটা তোলপাড় চলছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে, মঞ্চটি দুভাগ হয়ে গেছে, আর প্রায় প্রতিদিনই সংঘর্ষ বা সংঘর্ষের উপক্রম হচ্ছে। শাহবাগ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছি।

শাহবাগ আন্দোলনে যারা যুক্ত আছেন তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক লিঞ্চিং-এর অভিযোগ এনেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু শাহবাগ থেকে বিনা বিচারে কারও ফাঁসি দবি করা হয়নি। শুধু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ায় বাদিপক্ষের আপিল করতে না পারার ত্রুটি শাহবাগ ধরিয়ে দিয়েছিল। পরে শাহবাগের দাবিতেই ত্রুটিটি সংশোধিত হয়েছে। আর এর ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার ফাঁসিও হয়েছে।

তাই নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে এটা শাহবাগের বিজয়। এ বিজয় বেআইনি কায়দায় অর্জিত হয়নি। বিনা বিচার নয়, শাহবাগের দাবি বিচারের। শাহবাগ আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই পাতায় প্রকাশিত 'শাহবাগের পর' শিরোনামে একটি নিবন্ধে সলিমুল্লাহ খান কথাটি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। যারা একাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলেছে তারা কেন সম্প্রতি দেশজুড়ে চলা বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারছে না, এই গুরুতর প্রশ্নটিও তিনি তখন তুলেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি–

"ইহাতেই শাহবাগের পেছন দরজা। এই চোরাপথেই শত্রু তাহার সর্বনাশ করিতেছে। এইখানেই শাহবাগকে সাবধান হইতে হইবে। শাপলা দিয়া শাহবাগ-বধ সম্পন্ন হয় নাই। সাপ দিয়া হইতে পারে।"

সাপ কোন পথ দিয়ে ঢুকতে পারে তা সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, কিন্তু সাপের নাম-ধাম, পরিচয় দেননি। তাই শাহবাগের সাপ বলতে আমি যা বুঝি তার দায় এর উপর চাপানো যাবে না। আমি দেখেছি শাহবাগের যে সাপ, সে শাহবাগের ওঝাও বটে। তবে কোন সাপ এই মুহূর্তে শাহবাগ বধ করতে উদ্যত হয়েছে তা গত ক'দিনে সবাই অবগত হয়েছেন।

কেউ কেউ বলেন যে, শাহবাগ-বধ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, শাহবাগ-বধ আন্দোলনের তিন দিনের মাথায় সম্পন্ন হয়েছিল। যারা তিন দিনের কথা বলেন, তারা বিপ্লব বেহাত হওয়ার যুক্তিতে এই দাবি তোলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার শাহবাগের বিপ্লবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে শাহবাগ-বধ সম্পন্ন করেছিল, এই হল তাদের যুক্তি।

চোখের সামনে লাখো জনতার স্বতঃস্ফুর্ত জমায়েতের উপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে অনেকেই দুঃখ পেয়েছেন। শাহবাগ আন্দোলনের ভেতরে থেকে এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখার বেদনা তার চেয়ে অধিক, কম কোনোভাবেই নয়– এই দাবি করতে পারি। আমি বলব, এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াই করাই ন্যায়সঙ্গত, শাহবাগ পরিত্যাগ করা বরং অন্যায়।

একাত্তরেও বিপ্লব বেহাত হয়েছিল, এই অভিযোগ রয়েছে। সে বিপ্লব বেহাত না হলে হয়তো দু'হাজার তেরতে বিপ্লব করতে হত না। একাত্তরের বিপ্লব বেহাত হওয়ার পেছনে ভারতের নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করা হয়। শাহবাগের বিপ্লব বেহাত হওয়ার পেছনে আওয়ামী নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে।

আহমদ ছফার দাবি অনুযায়ী, ভারতের হস্তক্ষেপে তড়িঘড়ি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন না হলে বিপ্লব বেহাত হত না। মুক্তিযুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্র নির্মাণ করা যেত। যারা তিনদিনে শাহবাগ-বধের কথা বলেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, তেরর বিপ্লব– যাকে অনেকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলেন– তা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতি নেই। বরং লাভ থাকতে পারে।

হেফাজতে ইসলামের মতো 'এক রাতে বিপ্লব' ঘটাতে গিয়ে নখ-দন্ত হারিয়ে ফেলা রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় দেয় না। শাহবাগকে জামাত বধ করতে চেয়েছে, বিএনপি বধ করতে চেয়েছে, হেফাজত বধ করতে চেয়েছে, আওয়ামী লীগও তাকে বধ করতে চায়। কিন্তু শাহবাগ এখনও জীবিত। এখন আমরা যদি মরার আগেই তার মৃত্যু ঘোষণা করি, তবে আমরাও শাহবাগের সাপের ভূমিকায় অবতীর্ণ হব।

শাহবাগ-বধ করার জণপ্রিয় তরিকা হচ্ছে মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো। এই কাজ জামায়াতে ইসলামী ও তার সহযোগীরা করেছে। এখন যারা শাহবাগ বধ করতে চাচ্ছে তারাও একই কাজ করছে। জামায়াত প্রচার করেছে, জাতি দু'ভাগ হয়ে গেছে। একইভাবে শাহবাগ আন্দোলনের পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকা 'সাপেরা' এখন প্রচার করছে যে, শাহবাগ দু'ভাগ হয়ে গেছে!

যারা এই প্রচারণা চালাচ্ছে তারা কখনও-ই শাহবাগের লাখো জনতার আবেগ অথবা চেতনার প্রতিনিধিত্ব করেনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এখন যাদের গণজাগরণ মঞ্চের বিদ্রোহী হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে, তারাই মঞ্চের ভেতরে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন, প্রথম থেকেই। জনতার নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই তারা শাহবাগ আন্দোলনের মধ্যে এসেছিলেন।

এর মধ্যে ছাত্রলীগ অগ্রগণ্য। শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার মাসখানেক পরেই শাহবাগের উনিশটি সংগঠন একজোট হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের দাবিতে প্রচার শুরু করলে এবং মঞ্চকে এই কর্মসূচি নেওয়ার জন্যে চাপ দিতে থাকলে, মঞ্চের ভেতরকার সরকারপন্থীদের সঙ্গে তাদের বিভাজন চরমে ওঠে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ শাহবাগ ত্যাগ করে।

বর্তমানের তথাকথিত বিদ্রোহীদের বাকিরা প্রায় সবাই মহাজোট সরকারভুক্ত ছাত্র সংগঠনের সদস্য। বিদ্রোহ নয়, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করেই তারা গণজাগরণ মঞ্চ পরিত্যাগ করেছে। তারা এখন প্রচার করছে যে মঞ্চের বিভাজন হয়েছে, যার একটি গ্রুপ তারা। বাস্তবতা হল এই যে, সরকারের এজেন্ডা অনুযায়ী তারা মঞ্চে ছিল; তাই এখন মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

সুতরাং ন্যায়সঙ্গত কোনো বিদ্রোহ তারা এতদিন কেন করেনি সে প্রশ্ন তুলতে হবে। কাদের মোল্লা যাবজ্জীবন রায় পেয়ে বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছিল। এ বিজয় আওয়ামী লীগ সরকারের আপোসকামিতার কারণে পেয়েছিল বলে জনগণ সন্দেহ করেছিল। রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আপোসকামিতার ইতিহাস আওয়ামী লীগের আছে। সন্দেহ তাই অমুলক ছিল না।

'আপোসের রায় মানি না' বলেই জনগণ শাহবাগে হাজির হয়েছিল। দাবানলের মতো জ্বলে ওঠা এই আন্দোলনটি আওয়ামী লীগ সরকারকে যে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, সেটি তারা খুব ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে। শুধু মোকাবেলাই করেনি, নির্বাচনী বৈতরণীও পার হয়েছে।

এখন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াটি ঝুলিয়ে দেওয়া এবং যখনই তাদের ক্ষমতা আবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তখনই নিজেদের বাঁচাতে ইস্যুটি ব্যবহার করা। গণজাগরণ মঞ্চ এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করেই সরকারের রোষানলে পড়েছে। মঞ্চের ভেতরে যারা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মিশন নিয়েছিলেন, তারাই এখন এই বিভাজনের নাটকটি করছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে জামায়াত-শিবির লাশের রাজনীতিতে নেমেছিল শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই। শাহবাগ আন্দোলনের পর এই লাশের রাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পাশাপাশি চলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। এই রাজনীতিতে প্রথম সারির প্রতিটি দলের কর্মীদেরই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল যে, বাংলাদেশের সামন্তবাদী রাজনৈতিক দলগুলো একে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের নামে হত্যাকাণ্ডের রাজনীতি কায়েম করেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে দেশব্যাপী বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি ইতোপূর্বের যে কোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেল। জঙ্গী-দমন, শিবির-নিধন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু রাখা ইত্যাদির কাছ থেকে বৈধতা দাবি করে সকল ভিন্নমত ও বিরোধী শক্তি দমন করে একটি একদলীয় শাসন বাংলাদেশে বর্তমানে কায়েম হয়েছে।

জনসমর্থনের অভাব পুষিয়ে নিতে সরকার বিভিন্ন বিদেশি শক্তির, বিশেষ করে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। বিদেশি শক্তির আনুকূল্যের প্রতি অনুগত অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপিও। তাতে বাংলাদেশের জল, জঙ্গল ও জ্বালানির উপর মালিকানা হারিয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছেন।

এইসব মালিকানা-হারানো মানুষের পক্ষে কে দাঁড়াবে? ৫ ফেব্রুয়ারির পর মানুষ ভেবেছিল শাহবাগ দাঁড়াবে। কিন্তু দেখা গেল যে, সে সময় শাহবাগ শুধু বাংলা পরীক্ষাই দিতে চাচ্ছে। অবশ্য তারা বলেনি যে, তারা ভবিষ্যতে কোনোদিন ইতিহাস অথবা ভূগোল পরীক্ষা দেবে না। তবুও অনেকে এতে হতাশ হয়েছিলেন। দুঃখ পেয়েছিলেন, শাহবাগের বিরুদ্ধেও গেছেন। তাই শাহবাগ এখন মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে চাইলেও তাদের কেউ কেউ সন্দেহ করেন।

এই সন্দেহ মুখে বলে দূর করার কিছু নেই। কাজে দূর করতে হবে। সাপের কামড়ে শিশু শাহবাগের অকাল মৃত্যু হবে নাকি শাহবাগ হারকিউলিস হয়ে সাপ বধ করবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। হারকিউলিস হতে গেলে শাহবাগকে অবশ্যই বাংলাদেশের জল, জঙ্গল ও জ্বালানির উপর মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

মনে রাখতে হবে, একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাজ ছিল পাকিস্তানের বিনাশ, দ্বিতীয় কাজ ছিল ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানানো। দ্বিতীয় কাজটা হয়নি বলে বিপ্লব বেহাত হয়েছে শোনা যায়। শাহবাগকে দ্বিতীয় কাজটি করতে হবে। তবে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু কেন্দ্র করে শাহবাগ আন্দোলনের শুরু, সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যে কোনো টালবাহানা ও রাজনৈতিক আপোসের বিরুদ্ধে শাহবাগকে প্রস্তুত থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে।

এ ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। এ সংগ্রামে ব্যর্থ হলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গঠন করা যাবে না– যেমন গত বিয়াল্লিশ বছরেও গঠন করা যায়নি।

এখন আপনি শাহবাগের সাপ হবেন না লাঠি, সেটা আপনার সিদ্ধান্ত।

পারভেজ আলম: ব্লগার ও রাজনৈতিক কর্মী।