গণজাগরণ মঞ্চ ও কিছু অপপ্রচার

কাজী আহমদ পারভেজ
Published : 10 April 2014, 06:35 AM
Updated : 10 April 2014, 06:35 AM

চাঁদাবাজি আর চাঁদাসংগ্রহ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো কাজ। একটিতে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও বলপ্রয়োগের ব্যাপার জড়িত থাকে। তাই একে 'এক্সটরশন' বলে। অন্যটিতে পারসুয়েশন, আবেগ, প্রয়োজন ইত্যাদির সংমিশ্রণ করা হয়। দাতা একটি ভালো কাজে সংশ্লিষ্ট হবার জন্য স্বেচ্ছায় অর্থ দেন। এটার অন্য নাম তাই 'ফান্ড-রেইজিং'।

গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের সময় কেউ কেউ তাদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছিল বলে জানা যায়। এই সময় মঞ্চ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সতর্ক করা এবং এই রকম চেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে পুলিশের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছিল। শুরুতেই এই ভূমিকাটা দিয়ে রাখলাম, কারণ মূল আলোচনায় এটা লাগবে।

বেশ কয়েকদিন ধরে শুনতে পাচ্ছি, গণজাগরণ মঞ্চ নাকি তাদের উত্তাল সময়টাতে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিল। তাদের এই চাঁদাবাজির শিকার ছিল বৃহৎ, অতিবৃহৎ কিছু ব্যবসাযী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংসদ, এমনকি মন্ত্রীগণও। এই অবস্থায় তাদের কী করণীয় ছিল? তাদের কি উচিৎ ছিল না বিষয়টা আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরে আনা?

কিন্তু তারা তা করলেন না। কেন করলেন না? হতে পারে তারা এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন যে, আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরে এনে জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। বলা তো যায় না, চাঁদাবাজি করা গণজাগরণ মঞ্চে কত যে না কত বড় বড় সন্ত্রাসী আছে। হয়তো পুলিশ ওদের কাছে নস্যি!

এই যদি হত প্রকৃত অবস্থা, তাহলে তো তাদের মানে ওইসব চাঁদাবাজির ভিকটিমদের মুখে আঙুল দিতে চুপটি করে বসে থাকার কথা ছিল যেন কাকপক্ষীটিও টের না পায়। কিন্তু তা না করে তারা সবাই একযোগে কেন যেন যুক্তরাজ্য-প্রবাসী এক ব্লগারকে তাদের এই চাঁদাবাজির শিকার হবার কাহিনি বলে পাঠালেন। উনি কোনো সুপারম্যান-ট্যান হবেন হয়তো। গোটা পুলিশবাহিনী-র‌্যাব যা পারে না, সম্ভবত উনি একাই তা পারেন!

আর এই সুপার-ব্লগার কী করলেন এইসব ভিকটিমদের বাঁচাতে? প্রথমে তিনি মাসের পর মাস চুপচাপ বসে বসে সময় কাটালেন। এরপরে একসময় তিনি একটা এক্সেস কন্ট্রোল সম্বলিত ব্লগিং সাইটে ব্লগ লিখলেন, তাও সব ভিকটিমদের নাম-পরিচয় প্রদানকৃত টাকার অংকসহ। তাই পেয়ে তা কোট করে ন্যূনতম এক্সপোজার পাওয়া বেশকিছু নিউজ সাইট এবং কিছু প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তা ''গণজাগরণ মঞ্চের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি" ইত্যাদি শিরোনামে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করা শুরু করে দিল।

পুরো গল্পটাকে কি বেশ গোঁজামিলে ভরপুর বলে মনে হচ্ছে না? কিন্তু মনে হলেও আমার কী করার আছে, এভাবেই তো অসঙ্গতিতে ভরপুর এই গল্পটা সাজানো হয়েছে।

আসুন অসঙ্গতিগুলোর দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিই–

১) অর্থের যে হিসাব তা কিঞ্চিতাধিক দুই কোটি। এই টাকাকে 'কোটি কোটি' বলাটা কি অতিরঞ্জন নয়?

২) যে সব অখ্যাত নিউজ সাইটগুলো ওই ব্লগনির্ভর সংবাদটি করেছে, তারা কেবল ওই ব্লগের হোস্ট সাইটকেই সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। কথিত চাঁদাবাজির শিকার হওয়া কারও সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন তারা কেউ বোধ করেনি। অদ্ভুত!

৩) ভিকটিমের নাম প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে এবং এমন ভিকটিম যারা পুলিশের কাছে যাবার সাহস পাচ্ছে না কিন্তু সেজন্য তাদের কনসেন্টও নেওয়া হয়নি।

৪) এতদিন গোপন রাখা ভিকটিমদের পরিচয় যখন প্রকাশ হয়ে গেছে, কোথায় তারা আতঙ্কিত হবেন, নিরাপত্তা সহায়তা চাইবেন, তা না করে তারা এই নাম আসা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, তামাশা শুরু করে দিলেন!

এসব অসঙ্গতি দেখে ঘুণাক্ষরেও তো পুরো ব্যাপারটাকে এক্সটরশনের সংজ্ঞায় ফেলা যাচ্ছে না। আর তা যদি না-ই হয় তাহলে প্রথমেই শিরোনামে চাঁদাবাজির কথা বলে যে অসততাটা করা হয়েছে তা আসলে কী সেটা নিজ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়।

দেখা যাচ্ছে, শাহবাগে গণজাগরণের সময়ে যে অর্থসংগ্রহের ব্যাপারটা ঘটেছে, তাকে চাঁদাবাজি বলার কোনো সুযোগ নেই। তা যদি না থাকে, এই হলুদ সাংবাদিকরা তা বললেন কেন? সস্তা সেন্সেটাইজেশন সৃষ্টি করে অখ্যাত সাইটে হিট বাড়ানোর মতলবে? তাছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা তো পাচ্ছি না।

এত বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এল। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ জনসমাগম হল, এর কিছু রুটিন লজিস্টিক্সের তো প্রয়োজন আছে, নাকি? ধরে নিই, কিছুই না, তাদের শুধু পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাতে হাজার পাঁচেক লোকের ৪ থেকে ৫ মাসের শুধু পানিরই দাম পড়বে ওই হিসাবে দেখানো ২ কোটি টাকা বা তার চেয়েও বেশি।

বুঝলাম, তারা কেউ খাবার খাননি। তাই টয়লেটেও যাওয়া লাগেনি। দিনরাত হাওয়া আর পানি খেয়েছেন। আর তাই খেয়েই ওখানে ছিলেন তাতে করেই জুন-জুলাই পর্যন্ত যেতে না যেতেই তাদের সংগৃহীত যাবতীয় অনুদান ফুরিয়ে যাবার কথা। তাই যদি হয়, তাহলে চুরিটা মানে অর্থআত্মসাৎ করল কে? আর তা কোন টাকাটা? অনুদানের যে টাকা খরচ হয়ে গেছে তা আত্মসাৎ হল কীভাবে?

এ রকম একটা মুভমেন্টে খরচ যেমন থাকে, সে খরচের যোগান দেওয়ার জন্য সমব্যথী মানুষেরও অভাব হয় না। আর তা না হলে এই আন্দোলন মাসের পর মাস চলতে পারত না। একটা কথা সত্যি যে, নানা সময়ে গণজাগরণ নানা উত্থান-পতন, বিশ্বাস-সন্দেহ এসবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ ওদের কর্মকাণ্ড ঘিরে স্বপ্ন দেখা কখনও বন্ধ করেনি।

আর এটা ছিল বলেই ফান্ড রেইজিং-এর দৃশ্যমান বিরাট কোনো কর্মকাণ্ড না থাকার পরেও কেবল ফান্ড ক্রাইসিসের জন্য এই দীর্ঘ আন্দোলন তার ক্ষিপ্রতা হারায়নি। সময় সময়ে যে ঝুলে-পড়া পরিস্থিতি এসেছিল, তা হয় প্রাকৃতিক নিয়মে নয়তো সাফল্যোত্তর স্বাভাবিক নিয়মে।
মিথ্যা অপপ্রচারের ঘেরাটোপে পড়ে সময় সময় শাহবাগ আন্দোলনটি হয়ত ঝাঁকি খেয়েছে, কিন্তু কক্ষচ্যুত হয়নি।

এবারের অর্থ-কেলেঙ্কারির এই অপপ্রচারও যে তারা সামলে উঠবেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু এবারের অপপ্রচার ঘিরে তাদের মিত্রদের মধ্যে যে বিভেদের রেখা দেখলাম, তা তারা কীভাবে কাটাবেন, বুঝতে পারছি না। আর এটা ঘিরে প্রতিপক্ষ যদি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, তা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, সেটাও ভাবা দরকার। আবার পক্ষগুলির মধ্যে নতুন করে কেো সমীকরণ আসে কিনা, সেটাও একটা ভেবে দেখার মতো বিষয়।

এত কিছুর পরেও যে সাধারণ মানুষের বড় একটা স্নেহময় প্রশ্রয় যে শাহবাগের গণজাগরণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আছে, সেটাই তাদের সব প্রতিকূলতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রধান অনুষঙ্গ।

আশা করছি, তারা সকল মিথ্যাচার ছিন্ন করে সেটা করতে পারবেন।