তারেক জিয়ার সত্য-মিথ্যা: বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতা

হাসান মোরশেদ
Published : 31 March 2014, 06:54 PM
Updated : 31 March 2014, 06:54 PM

তারেক জিয়া সত্য বলেছেন। যেমন সত্য বলে তার দল বিএনপি। "শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণের পর দিশেহারা জাতিকে স্বাধীন করতে মেজর জিয়াই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন"– এটাও সত্য। বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্ট, এ-ও সত্য। তেমনি সর্বশেষ সত্য হল– জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জন্য এসবই সত্য। কারণ এ 'সত্য'গুলোই বিএনপির রাজনীতির প্রাণ।

প্রকৃত সত্যের প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা, যারা প্রকৃত সত্য ও বানিয়ে নেওয়া, চাপিয়ে দেওয়া সত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে জানেন এবং যারা ইতিহাসের সাক্ষী ও কুশলী তারা এসবে অস্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু নির্মোহভাবে বিএনপির রাজনীতির তত্ত্ব ও চর্চা বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারা কঠিন নয় যে, সত্যের নামে এসব 'হোক্স'ই (A hoax is a deliberately fabricated falsehood made to masquerade as truth) তাদের রাজনীতির প্রাণভোমরা।

মাঝখানে কিছু প্রক্রিয়াগত ও কৌশলগত বিলম্ব থাকলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলটির প্রকৃত জন্ম আগস্ট ১৫, ১৯৭৫, শেখ মুজিবের রক্তাক্ত লাশের উপর। আগস্ট পনেরোর সেই রক্তাক্ত ভোরে ঘাতকের গুলিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব, গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে তাঁর দীর্ঘ দেহটি নিয়ে শুধু একাই নিহত হলেন না, শেষ হল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিকেলবেলায় এক অবিস্মরণীয় গৌরবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও।

ব্যক্তির মৃত্যুতে তার দেহ বর্জিত হয়, আর রাষ্ট্রের মৃত্যুতে সেটির চরিত্র। ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তানের পূর্বাংশের মৃত্যুর বিনিময়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম, সেটির চরিত্র তাই আলাদা। সেটি ইসলামিক রিপাবলিক না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ, চর্চায় সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত সাংবিধানিকভাবে। তিন বছর ন'মাস পরের আগস্টের ১৫ তারিখেই রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাল আবার। মুজিবের হত্যাকারীদের ঘোষণায় 'পিপলস রিপাবলিক' বাংলাদেশ আবার হল 'ইসলামিক রিপাবলিক'। এই নতুন ইসলামিক রিপাবলিকের প্রথম স্বীকৃতিদাতা কে? আরেক ইসলামিক রিপাবলিক, 'পাকিস্তান'। তাদের দূতিয়ালিতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতির ডালা নিয়ে এগিয়ে আসা, যারা আগের তিন বছর নয় মাসের পিপলস রিপাবলিকের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি।

যদিও ক'দিন পর শক্তিশালী প্রতিবেশি ভারতের চাপে নামবদল রহিত হল কিন্তু অন্তর-আত্না বদল হল ঠিকই। পঞ্চম সংশোধনীর বদলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল সংবিধানের শুরুতে সংযোজন করলেন 'বিসমিল্লাহ'; ধর্মনিরপেক্ষতা হটিয়ে রাষ্ট্রের মূলনীতি হল 'আল্লাহর উপর পূর্ণবিশ্বাস'। একাত্তরের পরে ঘাপটি মেরে থাকা, কারাগারে থাকা ঘাতক-দালালরা পুনর্বাসিত হল; গোলাম আযমসহ প্রধান ঘাতকরা ফিরে এল নিরাপদে।

তারপরের বাংলাদেশ আজকের বাস্তবতা।

ব্যক্তি মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ঘাতক কারা সে আমাদের জানা, নামগুলো পরিচিত। কতিপয় মাঝারি র‌্যাংকের কিছু সেনাকর্মকর্তা আর লোলুপ রাজনীতিকের দল– স্রেফ এ-ই? আর কেউ নয়? ব্যক্তি মুজিবের সঙ্গে এই যে রাষ্ট্র নিহত হল, অন্তত রাষ্ট্রের চরিত্র– এ কেবল তাদেরই ষড়যন্ত্র? এই রাষ্ট্রহত্যার, এই মতাদর্শিক বদলের পেছনে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্ধন, যোগসাজশ কিছুই নেই?

আমার মনে হয়, এই জায়গাটা একেবারে অনুচ্চারিত রয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে। যে কোনো রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনেই বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থাকে। ধর্মজীবী পাকিস্তান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়নেও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল গৌরবের। রাজনীতির মিছিলে কিংবা যুদ্ধের মাঠে তারা ততটা প্রকাশ্য না হলেও রূপকল্প প্রণয়নে তারাই ছিলেন অগ্রণী। তারপর আবার 'ধর্মনিরপেক্ষ' বাংলাদেশ থেকে 'বিসমিল্লাহ' যুক্ত, 'আল্লাহর উপর পূর্ণবিশ্বাসী' বাংলাদেশ। যে মুসলিম বাংলার জন্য মুজিবরের মৃত্যুর কোনো বিকল্প ছিল না– তার রূপকল্পে কোনো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না?

শেখ মুজিবের প্রবাদপ্রতীম ইমেজের বিপরীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যেমন কেবলই নিম্নশ্রণির রাজনীতি নয়, এর পেছনেও রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্ধন– তেমনি ইন্ধন রয়েছে ১৫ আগস্টকে খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে প্রচার করার পেছনেও। কেবলমাত্র হতাশা, ক্ষোভ, রাগপ্রকাশ নয়– ঠাণ্ডা মাথায় বুঝা জরুরি যে এই সময়ে কেন আবার নতুন 'হোক্স'– কেন আবার জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাবি। এমন তো নয় যে, তারেক জিয়ার একদিন ঘুম ভাঙল আর ঘুম থেকেই উঠেই তিনি এই দাবি করে বসলেন। এই দাবির পেছনেও পরিকল্পনা আছে, আছে প্রস্তুতি, আছে বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ইতিহাসের অনেক কিছুই এখন নতুন প্রজন্মের কাছে সহজলভ্য; সহজে মেলে এখন তর্ক-বিতর্ক-সিদ্ধান্ত। শেখ মুজিবকে আত্মসমর্পণকারী সাজিয়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক তথা মহানায়ক বানানোর ধান্দাবাজি এই সময়ে এসে আর ধোপে টিকছে না। গণধিকৃত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে 'নাছোড়বান্দা প্রেম', যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দায়িত্বহীন সন্ত্রাস, নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে তৃণমুল সংগঠনকে হতাশ করে ফেলা– সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির এই দিশেহারা সময়ে নতুন 'হোক্স' দরকার। এটা নিয়ে তর্ক হবে, আলোচনা হবে, কিছু মানুষ গিলবে, কিছু মানুষ উগড়াবে। মিথ্যে প্রচারণা যে রাজনীতির প্রাণভোমরা, নতুন মিথ্যেয় তার প্রাপ্তি ছাড়া হারানোর কিছু নেই।

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিএনপির প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকার রাজনীতির পেছনের 'বুদ্ধিবৃত্তিক মকারী' সবসময় আলোচনার বাইরে থেকে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গে আমরা কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে নতুন করে চিনেছি। এমনিতে যাদের কেউ কেউ 'সুশীল' কিংবা 'বাম' তকমাধারী– অথচ তাদের কথায়, লেখায়, আলোচনায় যুদ্ধাপরাধীদের 'সাফাই'।

এই সময়ে বোধকরি বুদ্ধিবৃত্তিক মকারীর বিরুদ্ধে আরও সচেতন হওয়া জরুরি– যেমন শার্ল দ্যা গল উচ্চারণ করেছিলেন–

Intellectuals must be held accountable for the consequences of the ideas they propagate.