ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 March 2014, 06:33 AM
Updated : 29 March 2014, 06:33 AM

'রামায়ণ' রচনা প্রসঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের 'ভাষা ও ছন্দ' কবিতায় লিখেছিলেন, 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।'

পৌরাণিক যুগে একটি মহাকাব্য রচনার জন্য এ কথাগুলো কবির কল্পনায় হয়তো প্রাসঙ্গিক ছিল। তারেক রহমান, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতানেত্রীরা ইতিহাসের ক্ষেত্রেও রবি ঠাকুরের উক্তিকেই বিশ্বাস করে চলেছেন। তারা ভাবছেন, তারা যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, সেটাই সত্য– যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে তা সত্য নয়! তা না হলে বেগম জিয়া ও তারেক রহমান কেন বলবেন যে, জিয়া বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি!

[তারেক জিয়ার দাবির ভিডিও–

মা ও ছেলে মিলে ইতিহাস নিয়ে যখন এত বড় মিথ্যাচার করছেন, তখনও বিএনপির ওয়েবসাইটে জিয়াকে দেশের ৭ম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে!

দুই.

তারেক রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া যে মনের ভুলে বা সরল মনে জিয়া সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বিষয়টা অবশ্যই পরিকল্পিত। বিএনপির নেতারা অনেক ভাবনাচিন্তা করেই একেকটি বিষয় আরোপ করে বসেন। আকস্মিকই একদিন যেমন আমরা জেনেছিলাম যে, ১৫ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন! তার মানে আওয়ামীবিরোধীদের জন্য একটা উৎসবের উপলক্ষ তৈরি করে দেওয়া। বিভাজনের 'বিকল্প ধারা' সৃষ্টি।

যেভাবে একসময় সৃষ্টি করা হয়েছিল 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'। আওয়ামী লীগ সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংযুক্ত করেছে, কাজেই বিকল্প চাই, জুড়ে দাও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সৃষ্টি হোক কূটতর্ক, দ্বিধা-বিভক্তি, সন্দেহ-সংশয়। এভাবে স্থির বিশ্বাস, যুক্তি ও আদর্শের জায়গাগুলো আলগা করে তুলতে হবে। সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-বিভাজন সৃষ্টি করতে হবে। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতীয়তবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা– সবখানে বিকল্প চাই।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলরা তো এমনটাই চায়। তারা বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনি। এই দেশে মৌলবাদী-প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সবচেয়ে বড় শত্রু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। কাজেই এই দুটোর বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়া তারা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠেকিয়ে রাখার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য হেন কোনো চেষ্টা নেই যা হয়নি। কিন্তু 'ফিনিক্স' পাখির মতো আওয়ামী লীগ ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনিও দৈবক্রমে বেঁচে গেছেন!

হত্যার চেষ্টা, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র কোনো কিছু দিয়েই যখন কাবু করা যাচ্ছে না, তখন আবার শুরু হয়েছে জেনারেল জিয়াকে নিয়ে মিথ্যাচার। তারেক রহমানের পর বেগম খালেদা জিয়াও বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষক এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান!

তিন.

স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাস নিয়ে লন্ডনে তারেক রহমান অনেক কথা বলেছেন। তারেক রহমান কিংবা তার দলের কারও-ই যে ইতিহাসে কোনো অবদান নেই। স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাসে যারা ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা বলেন এক কথা; আর তারেক রহমান ও বেগম খালেদা জিয়া বলেন ভিন্ন কথা। কুখ্যাত টিক্কা খানের নির্দেশে ২৫ মার্চের মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, পাকবাহিনী বাংলাদেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সে সময়েই ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রেরিত এক বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানালেন, ''হয়তো এটাই আমার সর্বশেষ বার্তা, বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ যে যেখানে আছেন, আমার আহ্বান যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীকে মোকাবেলা করুন। যতক্ষণ পর্যন্ত শত্রুবাহিনীর একজন সৈন্য অবশিষ্ট থাকবে এবং যতক্ষণ না অর্জিত হবে চূড়ান্ত বিজয়, ততক্ষণ আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।'' এর মধ্য দিয়েই ২৬ মার্চে শুরু হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ।

[যতীন সরকার, সমকাল, ২৬ মার্চ, ২০১৩]

যে জিয়াকে তার স্ত্রী-পুত্র এত উচ্চাসনে বসাতে তৎপর, সেই জিয়া সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা আমরা পাই তারই সহকর্মীদের জবানিতে। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার 'অনিচ্ছুক অংশগ্রহণ' প্রসঙ্গে লিখেছেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম তাঁর 'লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে' এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি তাঁর 'বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল' বইয়ে। সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষ গুপ্ত, তাঁর 'ইতিহাসের ছায়াচ্ছন্ন প্রহর ও বঙ্গবন্ধু' বইতে সিরু বাঙালির বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। সন্তোষ গুপ্ত বলেন:

'''একটি জাতির জন্ম' প্রবন্ধে জিয়া যে 'জয় বাংলা, 'জয় বঙ্গবন্ধু' বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' বলেছেন, তা তার মনের কথা ছিল না। পরিবেশের চাপে পড়ে নেহায়েৎ দায় ঠেকে বলেছেন। চট্টগ্রামে জিয়া ছিলেন রফিকের সিনিয়র সেনা অফিসার। এই কারণে মেজর রফিক সময়মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে জিয়ার দ্বারা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। জিয়া বার বার মেজর রফিককে এই কথা বলে নিরস্ত করেছেন যে, আগাম কিছু করা ঠিক হবে না, একটা মীমাংসা হয়েই যাবে। মেজর রফিকের বইতে লেখা আছে: 'কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও পাকিস্তানিরা আক্রমণ করার আগেই যে তাদের উপর আমাদের আঘাত হানতে হবে'– আমি যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইলাম– 'এবং সেটা এ সময়ই না করলে পরে আর সে সুযোগ কখনও-ই পাওয়া যাবে না। পাকিস্তানিরা গণহত্যার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। আমরা এখনই আক্রমণ করে ওদের ধ্বংস না করলে ওরা আমাদের সবাইকে জবাই করে ফেলবে।'`চিন্তা করো না'– মেজর জিয়া বললেন– 'ওরা অমন চরম ব্যবস্থা নেবে না'। 'আমিও তাই মনে করি'– সায় দিলেন লে. কর্নেল চৌধুরী– 'তোমার সৈন্যদের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে তুমি এখনই থামিয়ে দাও।' পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় আমি সে রাতের মতো সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেও স্থগিত করতে বাধ্য হই।… নিয়তির কী অমোঘ বিধান! মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরের ঘটনাবলীই প্রমাণ করে দিল তারা দু'জনে (জিয়া ও লে. ক. চৌধুরী) পাকিস্তানিদের যেভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন তা ছিল ভুল। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার আমার কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি ছিল ওই দু'জনের একজনের জন্য– তার অজান্তেই আত্মঘাতী। অন্যদিকে সমগ্র জাতিকে দিতে হল চরম মূল্য। পাকিস্তানিদের সংঘটিত গণহত্যায় নিহত হল লক্ষ লক্ষ বাঙালি।"

['লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে', অনন্যা, তৃতীয় প্রকাশ ১৯৮৯, পৃ. ৮৯]

মেজর রফিকই (তখন ক্যাপ্টেন) জিয়ার কমান্ডের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজ বুদ্ধিতে, নিজস্ব প্রেরণায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এই সংবাদও রফিক জিয়ার অধীনস্থ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ক্যাম্পে ম্যাসেজ আকারে পাঠিয়েছিলেন। জিয়া তখন ক্যাম্পে ছিলেন না। সিরু বাঙালি তার বইয়ে প্রশ্ন করেছেন, ওই রাতে কোথায় ছিলেন জিয়া?

মেজর রফিক বলেন:

"তার (জিয়ার) কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে 'সোয়াত জাহাজ' থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামিয়ে তা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসার জন্য তিনি চট্টগ্রাম পোর্টে যাচ্ছিলেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, চট্টগ্রাম নিউমার্কেট শাখার ম্যানেজার জনাব কাদের যখন ডা. জাফর ও কায়সারের কাছ থেকে আমার 'ম্যাসেজ'টি নিয়ে ৮ম ইস্ট বেঙ্গলে গিয়ে পৌঁছেন, মেজর জিয়া ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন কর্নেল জানজুয়ার কাছ থেকে নির্দেশ নিতে এবং তারপর রওয়ানা হয়েছেন চট্টগ্রাম পোর্টের অভিমুখে। জনাব কাদের তখন ম্যাসেজটি ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি ডিউটি অফিসারকে দিয়ে চলে আসেন। এই ম্যাসেজ পেয়েই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে সর্বশেষ ঘটনা জানাতে এবং 'সোয়াত' জাহাজ যাওয়া থেকে বিরত রাখতে একটি গাড়ি নিয়ে ছুটে চলল মেজর জিয়ার সন্ধানে।"

[ঐ, পৃ. ১০৮]

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম একটি প্রবন্ধে জিয়া সম্পর্কে বলেছেন:

"চট্টগ্রাম থেকে আমরা খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে 'সোয়াত' জাহাজে করে অস্ত্র এসেছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ প্রেরণ করেন। খবরটি ছিল সোয়াত জাহাজ থেকে যেন অস্ত্র নামাতে না দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে মেজর জিয়া কোনো সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় পরবর্তীকালে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি।"

['মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার', রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত 'সম্মুখ সমরে বাঙালি', আগামী ১৯৯৯]

লেখিকা মিনা ফারাহ জিয়া সম্পর্কে লিখেছেন:

"২৫ মার্চ এই দিনেও জিয়া যুদ্ধে না গিয়ে, পূর্ব পরিকল্পনামতো পাকিস্তানের ২০ বালুচকে আগেভাগে আক্রমণ না করে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বিশাল গণহত্যা ঘটতে দেয়। নিজের সৈন্যগুলোকে নিষ্ক্রিয় রেখে বরং রাত ১১.৩০ মিনিটে দুই পাকিস্তানি জওয়ানকে সঙ্গে করে 'সোয়াত' জাহাজে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিল গণহত্যার জন্য বয়ে আনা পাকিস্তানের অস্ত্র খালাস করতে, যার সবই জিয়া জানত। জিয়া '৭০ থেকেই চট্টগ্রামে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করছিল। সোয়াত জাহাজের অস্ত্রসহ সব খবরই তার জানা। ফলে বাঙালিদের কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়ে প্রাণের ভয়ে, তাৎক্ষণিক যে বিদ্রোহের চাতুরি জিয়া করেছিল, সেটাই 'জিয়ার বিদ্রোহ' বলে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিএনপিদের প্রোপাগান্ডা মেশিনে প্রচার করা হয়।''

['হিটলার থেকে জিয়া', চারুলিপি, ৫ম মুদ্রণ-২০০৯, পৃ. ৯-১০]

অপকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে জিয়া শুরু করেন পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ম্যান্ডেটবিরোধী। এতেও প্রমাণিত হয় তিনি ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন।

জিয়া যে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন, এটা সত্য। কিন্তু এই সত্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনেক বড় করে দেখানো সত্যের অপলাপ মাত্র। জিয়ার মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার বলেন:

''একাত্তরের ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রথম ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। পরে সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আবারও ঘোষণাটি দেন। এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ভারতের 'দি স্টেটসম্যান' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের দলিলেও এটি রয়েছে। সে ঘোষণাটি ছিল, 'আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান সেনাপতি হিসেবে এতদ্বারা আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে, আমরা ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর অধীনে একটি স্বাধীন বৈধ সরকার গঠন করেছি। এই সরকার আইনগতভাবে এবং সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সরকার সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রয়াসী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য কাজ করে যাবে। আমি বাংলাদেশে পরিচালিত বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশে জনমত সংগঠিত করার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম বৈধ সরকার এবং এ সরকার বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।''

'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক গোলাম মুরশিদ (প্রথমা প্রকাশন) এই বইয়ের তৃতীয় ভাগে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, জিয়ার ঘোষণাটি ঐতিহাসিক হলেও বেলাল মোহাম্মদ যদি ২৭ মার্চ কালুরঘাট থেকে জিয়াকে ডেকে না নিয়ে আসতেন, জিয়া রেডিওতে আসতেনই না। এর আগেই এম এ হান্নান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়ার প্রতি ভাগ্যদেবী প্রসন্ন থাকার ব্যাপারে মুরশিদ ১৯৭৫ সালের সাতই নভেম্বর কর্নেল তাহের কর্তৃক জিয়াকে মুক্ত করে আনার ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন।

নিয়াজির প্রেস সেক্রেটারি সিদ্দিক সালিকের বইতে স্পষ্ট করেই লেখা আছে যে, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস বার্তা ক্যান্টনমেন্টের বেতারে ধরা পড়ে। পাকিস্তানি মেজর সালিক নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে গুণগান গাইতে সে কথা লিখেননি, নিন্দে করেই লিখেছেন। যদি জেনারেল রাও ফরমান আলীর বই পড়েন তাহলে ৬ দফা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন; স্বায়ত্তশাসন ছাড়াও, আলাদা মুদ্রা, আলাদা পতাকাসহ এমন কিছু বিষয় ছিল যা পক্ষান্তরে আলাদা দেশেরই মতন।

তাই পাকিস্তানি জেনারেলরা আওয়ামী লীগের বিজয়ে শংকিত ছিলেন। এসব পাকিস্তানিদের লেখা বইয়ের কোথাও কোনো অংশে জিয়ার উল্লেখ নেই। কারণ জিয়া ইতিহাসের কোথাও ঠাঁই পাওয়ার মতো কেউ নন। তাই তার নাম কোথাও নেই। পাকিস্তানিরা প্রতি পাতায় পাতায় কেবল মুজিবের কথাই বলেছে। কারণ ইতিহাসে তার অবস্থান খুবই স্পষ্ট।

চার.

আগামীকাল আমরা কেমন সমাজ গড়ব, তার নির্দেশ পেতে গেলে গতকালের কাছে আমাদের অনেক প্রশ্ন নিয়ে যেতেই হবে। বিস্মৃত অতীত আর জানা-অজানা নিযুত-কোটি মানুষের ধারা সম্পর্কে না জানলে বর্তমান বা আগামীর জন্য কল্যাণমূলক সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

তাছাড়া যে অতীত ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ভুলে যাওয়াটাই অপরাধ, তেমন অতীতের সৃজনশীল বিনির্মাণ কিন্তু এখনও অব্যাহত আছে। যেমন, নাৎসিদের অত্যাচার যেন ভুলে না যাই, আমরা সেগুলো স্মরণ করে যেন বেদনা পাই, তার ব্যবস্থা করবার জন্য 'শিন্ডলারস লিস্ট'থেকে শুরু করে 'লাইফ ইজ বিউটিফুল', 'দ্য পিয়ানিস্ট'-এর মতো কত কত উৎকৃষ্ট ছবিই না নির্মিত হয়ে চলেছে। কাজেই অতীত সব সময় মুছে ফেলার, বিস্মৃত হওয়ার জিনিস নয় মোটেই।

অতীত বাদ দিয়ে যেমন বতর্মান বুঝতে পারা যায় না, তেমনি বর্তমানের বিশ্লেষণ ছাড়া ভবিষ্যতের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না। আমাদের রাজনীতির বর্তমান সংকট বুঝতে হলে অতীতের রাজনীতি ভালোভাবে বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক ধারার বৈরিতার উৎসগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বর্তমান বৈরিতার জন্য যদি দল হিসেবে কোনো একটিকে দায়ী করতে হয়, তাহলে বিএনপিকেই করতে হয়। বিএনপি অতীতে আওয়ামী লীগের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষত সারিয়ে তোলার মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের অনেকটা নিহিত। কিন্তু সেই ক্ষত সারানোর পথে কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

এই ক্ষত সারাতে হলে প্রথমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু পনেরই আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন সেই আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে। এটাকেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমঝোতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই একটি গুরুতর বাধা অপসারণ না হতেই আরেকটি নতুন বৈরিতার খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। এখন আর কেবল 'স্বাধীনতার ঘোষক' নন, জেনারেল জিয়াকে 'বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, অতীতের সত্য কখনও পালটানো বা কাটাছাঁটা যায় না। নথি নিশ্চিহ্ন করা যায়, স্মৃতি লোপ করা যায়, তবু বাস্তব ইতিহাসের (রচিত ইতিহাসের নয়) অঙ্গ হিসেবে অতীত থেকেই যায়। গর্দভের গায়ে সিংহের চামড়া পরিয়ে দিলেই সত্য মিথ্যে হয়ে যায় না।

আমাদের ইতিহাস রচনা, পাঠ ও অনুভবের সীমাবদ্ধতা আছে। ইতিহাস খণ্ডিত করে, সংক্ষিপ্ত করে, এমনকি মনগড়া ব্যাপার ইতিহাস হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে। এই আত্মঘাতী আহাম্মকি যুগে যুগে অনেকেই করেছেন। আমাদের অনেকের কাছে ২৫ মার্চ– যার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা হচ্ছে কেবল 'একটি কালরাত্রি'। এমনকি 'মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস' যেন নয় নয়টি মাসের বিবরণ নয়, এটি যেন পূর্বনির্মিত রাজনৈতিক ভাবাদর্শের একটি অধীনস্ত প্রত্যয়, যেন একটি দ্রুত ঘটে যাওয়া পর্ব, যার প্রতিটি দিনের কোনো বিবরণ নেই বা যা হারিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের সামরিক যুদ্ধের খাতওয়ারি দিনলিপির মধ্যে।

যদি ইতিহাসকে 'ক্রম-প্রকাশ্য' (আগে থেকে অনুমান সম্ভব নয় এমন) কাহিনি হিসেবে বর্ণনা করা যেত তাহলে আমরা অন্যরকম ইতিহাসের বয়ান পেতাম। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি জীবন্ত, সত্যাশ্রয়ী ও মানবিক দেখাত ওপরের বর্ণিত জাতীয় মাইলফলকগুলো। সেখানেও স্বাধীনতার ইচ্ছা কীভাবে দানা বেঁধে উঠছিল তাকে ধরার চেষ্টা থাকত; কিন্তু সেটা হত সরলীকৃত জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের চেয়ে আরও জটিল, বহু-সম্ভাবনাময় এবং বহু-ইঙ্গিতময় বয়ান।

সেখানে উত্থান-পতন, সংশয়-দোলাচল, অস্থিরতা ও গণজাগরণ থাকত সব মানবিক বাস্তবতা নিয়ে। সেটি কেবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা সমরকৌশলের বিবরণ মাত্র হয়ে উঠত না। এ কারণেই 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' বা এসব কথাকে কখনও-ই আমরা ঘটনাপরম্পরায় শনাক্ত করতে পারিনি। এ জন্যই আমাদের মৌলিক সাংবিধানিক প্রত্যয়গুলোতে, যেমন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের 'বাঙালিত্ব', সমাজতন্ত্রের 'অভিপ্রায়', গণতন্ত্রের 'বৈশিষ্ট্য' বা ধর্মনিরপেক্ষতার 'মানে কী' এ নিয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসা কোনো 'সংজ্ঞা' আমরা আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ডিসকোর্সে তুলে ধরতে পারিনি বা তা নিয়ে সুস্থ বিতর্ক করতে পারিনি।

এটা সম্ভব হত যদি আমরা বাংলাদেশের 'জনগণের ইতিহাসকে' (পিপলস হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ) আমাদের ইতিহাসচর্চার প্রধান বিষয় হিসেবে শনাক্ত করতাম। তা না করে আমরা যা করেছি তা হল, ইতিহাস এবং ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা। এ ক্ষেত্রে মতলব এবং দলের বৃত্তের বাইরে আমরা নিজেদের বড় বেশি স্থাপন করতে পারিনি।

পাঁচ.

আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে তিনটি গভীর 'ক্ষত' আছে। প্রথম ক্ষত, একাত্তরে জামায়াতের বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো এবং পরবর্তী সময়ে একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা না-চাওয়া। সেই ক্ষত না ঘুচতেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং তার রেশ না মেলাতেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এ তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে বলেই অনেকে মনে করেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু জন্মদানগত কারণে কিছুটা বিলম্বেও মায়ের মৃত্যু ঘটে। শাসনগত অনেক ব্যর্থতার জন্য হয়তো ব্যক্তি মুজিবকে ক্ষমতা ছাড়তে হত। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম দিতে গিয়েই যে তাঁকে সপরিবারে নিহত হতে হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যাবে কি? ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে, পঁচাত্তরের ঘটনা একাত্তরেরই ধারাবাহিকতা। আর ২১ আগস্ট তার ধারাবাহিকতা।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই তিনটি ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের নামের সঙ্গে বিএনপি নামক দলটির একটি যোগসূত্র বা সম্পর্ক আছে। তারা সব সময়ই বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয়-সুরক্ষা ও সমর্থন পেয়েছে। এখন এক পক্ষ যদি আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে স্বজন হত্যার অভিযোগ আনে, তাহলে তারা কী করে একে-অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করবে?

জিয়ার ভূমিকা নিয়ে তারেক এবং বেগম জিয়ার সর্বশেষ উক্তি আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক বৈরিতাই আরও বাড়িয়ে তুলবে।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।