যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা: আমরা এখন কোথায়

ইমরান এইচ সরকার
Published : 28 March 2014, 04:30 PM
Updated : 28 March 2014, 04:30 PM

সমবেত সুধীজন,

মহান স্বাধীনতা দিবসের অভিবাদন গ্রহণ করুন। আজকের এই দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করা ৩০ লক্ষ শহীদদের, দুই লক্ষ সম্ভ্রম উৎসর্গ করা মা-বোনদের। আমাদের পরম শ্রদ্ধা মহান বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের সাহস ও ত্যাগ আমাদেরকে স্বাধীন সার্বভৌম এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাঁদের কারও ঋণ আমরা কখনও-ই শোধ করতে পারব না, তবু বারবার সেই ঋণ আমরা ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি।

সুপ্রিয় উপস্থিতি,

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা: আমরা এখন কোথায়'। স্বাধীনতা দিবসের উৎসবমুখর এই দিনে শুধু উৎসবের কোলাহল যাতে আমাদেরকে লক্ষচ্যুত করতে না পারে, এ জন্যই আজকের এই আলোচনার সূত্রপাত।

আপনাদের স্মরণ থাকার কথা, ঠিক এক বছর আগে এই শাহবাগে দাঁড়িয়েই বিশ্বের দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ জাগরণে ধ্বনিত ৬ দফা দাবি করেছিলাম। উত্তাল শাহবাগে আমরা প্রথমবার ৮ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশে ৬ দফা দাবি তুলে ধরি। পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে টানা অবস্থান সমাপ্ত করার সময়ও আমরা ৬টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো পূরণ করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি। আমরা মনে করি, ৬ দফা থেকে উঠে আসা ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রণীত পরবর্তী দাবিগুলোসহ গণজাগরণ মঞ্চের এই প্রস্তাবগুলোই বাংলাদেশের ইতিহাসে 'ঘাতক-দালাল নির্মূলের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা' হিসেবে বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

এর কারণ হচ্ছে, শাহবাগের গণজাগরণ কোনো বিচ্ছিন্ন সাময়িক সমাধান চায়নি। সারাদেশ যখন ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে একাত্তরের সকল খুনি-ধর্ষক-লুটেরাদের বিচার সম্পন্ন করতে চেয়েছে, তখন আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আমাদের ৬ দফা দাবির মাধ্যমে আমরা চেয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটিকে একটি সুন্দর ও পরিপূর্ণ সমাধান দিতে, যাতে করে আর কোনোদিন বাংলার মাটিতে এসব হায়েনা গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দিক থেকে এসব ঘাতক দালালদেরকে নির্মূল করার প্রস্তাব ছিল আমাদের দাবিগুলোর মধ্যে।

আজকে হতাশার সঙ্গে বলতে হয়, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালদের নির্মূল করার এই পূর্ণাঙ্গ সমাধানটিতে সরকার যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আমার আশংকা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি কোনো না কোনো ভাবে আরো দীর্ঘদিন আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হবে। এর ফলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা তা চাই না। আমরা চাই না যুদ্ধাপরাধীরা রাজনীতির মাঠে ইস্যু হয়ে টিকে থেকে অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতার দাবার ঘুঁটি হোক।

আসুন, আমরা এক এক করে আমাদের দাবিগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখি।

আমাদের প্রথম দাবিটিই ছিল, "একাত্তরের সকল ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।" আজ এক বছরেরও বেশি সময় পরে যদি ফিরে তাকাই তাহলে দেখি মাত্র একজন ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু বাদবাকি মামলাগুলোর অগ্রগতি হতাশাজনক। সেই সময় আপিল নিষ্পত্তির জন্য ৬০ কার্যদিবসের কথা উল্লেখ করে আইন সংশোধিত হলেও, সাঈদীর আপিলের নিষ্পত্তি আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনো সন্দেহ নেই যে, বিচার তার প্রত্যাশিত গতিতে এগুচ্ছে না।

নিজামীর মামলার শুনানির পরে রায় অপেক্ষমান থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর অবসরে গিয়েছিলেন ৩১ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার এই ট্রাইবুনালের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করেছেন। এখানে বিষয়টি লক্ষ করা যাক। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের পদ কিন্তু পদত্যাগ কিংবা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ শূন্য হয়নি, বরং অবসর একটি সুনির্দিষ্ট সময়। সরকার জানতেন যে, ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হতে যাচ্ছে, কিন্তু খুব দ্রুত এই পদ পূরণের কোনো প্রস্তুতি যে তাদের ছিল না, তা প্রায় দু'মাস পরে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হল।

এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি ছোট-বড় পদের কেউ অবসরে কিংবা অন্য কোনো কারণে ট্রাইব্যুনাল থেকে দূরে সরে গেলে পরের দিনই সে পদ পূরণের প্রস্তুতি থাকার কথা, সেখানে একটি চেয়ারম্যান পদের নিয়োগের জন্য যদি দু'মাস অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে সরকারের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন হয় না। মাঝখানে হঠাৎ সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরদের মধ্যে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

আমার প্রশ্ন– এত কিছুর পর, এত জনমত আর গণবিক্ষোভের পরেও ট্রাইবুনালকে এ রকম অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার মধ্যে ফেলে রাখতে হবে? পরবর্তী গণবিক্ষোভ সামাল দেওয়া যাবে তো?

২.

আমাদের দ্বিতীয় দাবিটি ছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষের মতো বাদীপক্ষেরও আপিলের সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মাথায় আপিল নিষ্পত্তির আইনি বিধান রেখে আইন সংশোধন করতে হবে ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অধিকার এই আইনের ক্ষেত্রে রহিত করতে হবে।

এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে যে, আইনটি সংশোধন হয়েছিল এবং সংশোধিত আইনে কাদের মোল্লার ফাঁসিও হয়েছে। তবে সংগঠন হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আইনে আবারও কোনো ফাঁক রয়ে গেল কি না সেটি নিয়ে সেই সময়ও কথা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

খেয়াল করে দেখবেন, এক বছর গত হওয়ার পর মাত্র গতকাল যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের বিরুদ্ধে বহুলপ্রত্যাশিত এই মামলাটির প্রাথমিক ধাপ হিসেবে তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে। দেরিতে শুরু হলেও এই মামলা দায়েরের প্রস্তুতির বিষয়টি আমাদেরকে স্বস্তি দিতে পারত। কিন্তু মিডিয়ায় খবর এসেছে, যে আইনের মাধ্যমে এই বিচার শুরু হয়েছে, সেই আইনে সংগঠন হিসেবে এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের কী শাস্তি হতে পারে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।

এই বিষয়টি আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করেছে। আশা করি আইনের অস্পষ্টতা খুব দ্রুতই কেটে যাবে। যদি সত্যি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে সরকারের উচিত হবে দ্রুতই সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। এর আগে '৭৩ সালের আইনটিকে সংশোধন করা সত্ত্বেও বাদীপক্ষের আপিল করার ক্ষমতা সেখানে ছিল না। এ রকম একটি অপূর্ণাঙ্গ আইন তৈরির দায়ভার তখনকার আইনপ্রণেতারা এড়াতে পারেন না। আশা করি, আইনের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই সংগঠনের বিচারের এই মামলা ট্রাইব্যুনালে আনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

৩.

সেই সময় আমাদের তৃতীয় দাবিটি ছিল–

"যেসব রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।'' দাবিটি যদি আজকের দিনে এসে মূল্যায়ন করি, তাহলে অনেকের জন্যই বিষয়টি বিব্রতকর হয়ে যাবে।

এই আঁতাত ও আপোষকামীতা যে শুধু চিহ্নিত মহল করছে এমন নয়, বরং যাদের কাছ থেকে আঁতাত আশা করা হয় না, তারাও বিভিন্ন সময় এরকম আঁতাতের চিহ্ন দেখিয়ে বেড়ান। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টার বড় টাকার জোগান আসে ইসলামী ব্যাংকের অপারেশনের মাধ্যমে। সেই ব্যাংকের কাছে প্রায়ই দেখি আমরা অনুদানের জন্য হাত পাততে হয়।

আমি শুধু এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, যারা দেশের রাজনীতিকে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রেখে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবিরকে বাঁচানোই মূল টার্গেট করে রাজনীতি করেছিলেন. তারা দেশবাসীর কাছে কীভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন তা মাত্র কয়েকমাস আগেই দেখা গেছে। সন্ত্রাস করে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো তো যায়ই না, বরং নিজেদেরও দেউলিয়া হয়ে যেতে হয়।

এই নজির বিবেচনায় রেখে যে যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য এখনও চেষ্টা করছেন তারা নিজেরাই সতর্ক হবেন, অন্যথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন, এটাই জোর দিয়ে বলতে পারি।

৪.

আমাদের চতুর্থ দাবিতে আমরা বলেছিলাম, "ধর্মকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে ঘাতক-দালালরা দেশ-ধ্বংসের যে রাজনীতি করে সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ করা এসব কুলাঙ্গারদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।"

গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশেও আমরা দাবি করেছিলাম যে "গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তাণ্ডব বন্ধে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সকল সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ গোপন আস্তানাসমূহ উৎখাত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করে দিতে হবে।"

দাবিটি সময়মতো না মানায় আমাদের কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে তার স্বাক্ষী হয়ে আছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ, যাদের প্রিয়জনরা গত এক বছরে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের দাবিটির যৌক্তিকতার সাক্ষী দেবে সারাদেশের হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটগুলো, সাক্ষী দেবে কিশোর মনির, অন্ধ মায়ের একমাত্র অবলম্বন পুত্রের লাশ, কিশোরী মেয়েকে নিয়ে কাজে বের হওয়া অর্ধদগ্ধ গীতা সরকার।

আমাদের সেই দাবি মানা হয়নি। আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো বিশেষ অভিযান চালানো হয়নি। এতে করে দেশের আনাচে-কানাচে জামায়াত-শিবিরের হাতে রয়ে গেছে অজস্ত্র অবৈধ অস্ত্র। বছরের পর বছর ধরে তাদের মেসে-আস্তানায় সেই অস্ত্রের মজুদ তারা গড়ে তুলেছে।

সেই অস্ত্র কত ভয়ংকর ছিল, গত বছরের শেষভাগে এসে তা সাতক্ষীরা থেকে সাতকানিয়া পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। যে সরকার এই অভিযান সময়মতো চালায়নি, সেই সরকারি দলের নেতা-কর্মীদেরও যখন জামায়াত-শিবির নৃশংসভাবে একের পর এক হত্যা করেছে, তখন সাতক্ষীরায় ছোট আকারে অভিযান চালানো হয়েছে মাত্র।

আমি বলতে চাই সাতক্ষীরাই একমাত্র বাংলাদেশ নয়, আরও ৬৩ জেলা বাকি রয়েছে। আজকের দিনই শেষ দিন নয়। আগামীতে আবারও জামায়াত-শিবিরের হায়েনারা ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হতে পারে। তখন বাকি ৬৩ জেলায় অভিযান চালানোতে দেরি হয়ে যাবে। সেই অভিযান যদি আগে থেকে না চালানো হয়, তাহলে সাতক্ষীরার মতোই আরও অনেক প্রাণ অকালেই ঝরে যেতে পারে, যার দায়দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ থাকবে না।

৫.

পঞ্চম দাবিতে বলা হয়েছিল যে পঁচাত্তর-পরবর্তীতে যে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রত্যেককে আবার গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে।

প্রিয় বন্ধুরা, কী আর বলব? দেশে যুদ্ধাপরাধী তো কম নেই, কিন্তু গত এক বছরে নতুন করে কোনো যুদ্ধাপরাধী কি গ্রেফতার হয়েছে? হয়নি। বর্তমান অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের লোকবল অনুসারে যদি যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করতে হয় তাহলে এই বিচার শেষ হতে অনেকদিন লেগে যাবে। বরং যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা বিবেচনা করে জনবল বাড়িয়ে সবগুলো বিচারকে দ্রুততর করাটাই লক্ষ হওয়া উচিত।

৬.

আমাদের ৬ষ্ঠ দাবি ছিল, "যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করতে হবে।"
এই দাবিকেই ২১ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশ থেকে আমরা আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলাদা আলাদা করে দুইভাগে বলেছিলাম, যার প্রথমভাগে ছিল–

"৩. অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে সকল প্রকার জঙ্গিবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেওয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।"

আজকে যখন পত্রিকায় জামায়াতিদের পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাঁদা নেওয়ার ছবি দেখতে পাই, তখন মনে হয় সাধারণ মানুষের সংগঠন নেই বলে, সাধারণ মানুষের টাকা নেই বলে, সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক লবি নেই বলে সাধারণ মানুষের গণজাগরণকে তুচ্ছ করে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের আর্থিক সহায়তা নেওয়ার দুঃসাহস দেখানো যায়।

আমি এখনও মনে করি, অবিলম্বে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। আগামীতে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় একের পর এক কার্যকর হতে থাকবে, তখন সারাদেশে তাণ্ডব ছড়াতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যবহৃত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের ছদ্মাবরণে সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা হয় এবং সকল ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক মদদ দেয়া হয়।

আজ যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মনীতি ও আইনসম্মত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এই কুচক্রীরা ষড়যন্ত্র করে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

এই শেষ দাবিরই আরেকটি অংশ ছিল "যুদ্ধাপরাধীদের গণমাধ্যম যেমন দৈনিক আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, দিগন্ তটিভি প্রভৃতি নিষিদ্ধ করতে হবে।"

স্বীকার করতে হবে যে এই দাবিটি দেরিতে হলেও কিছুটা পূরণ হয়েছে। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জড়িত সেখানে এক মুহূর্ত দেরি করলেও কী ক্ষতি হতে পারে, এই দাবি দেরিতে পূরণ হওয়া তার একটি প্রমাণ হিসেবে আগামী দিনেও স্মরণ করা হবে। আমরা গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই এই শাহবাগ থেকে দাবি জানিয়েছিলাম যে, সংবাদমাধ্যমের ছদ্মাবরণে যুদ্ধাপরাধীদের প্রচারপত্র, যা নির্লজ্জ মিথ্যাচারে লিপ্ত, ক্বাবার ইমাম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যাদের মিথ্যাচার থেকে মুক্ত নয়, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে একজন নিরীহ সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যাদের নোংরা কুৎসিত মিথ্যাচারের শিকার, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ রকম নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এই বাংলাতেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের জন্য পত্রিকার বিচার হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের জঘন্যতম রোয়ান্ডা হত্যাকাণ্ডও এ রকম মিথ্যা সংবাদমাধ্যমের দ্বারাই সংগঠিত হয়েছিল। অথচ সরকার আমাদের সতর্কবাণী সময়মতো কানে নেননি। এর রাজনৈতিক মূল্য হয়তো সরকারকেই চুকাতে হয়েছে; কিন্তু তার পাশাপাশি এসব সংবাদমাধ্যমের মিথ্যা উস্কানিতে দেশেও প্রভূত ক্ষতি হয়েছে।

কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। যা গণজাগরণ মঞ্চ আজকে বলে, দেশের স্বার্থে তা আজকেই ভাবা উচিত। দেরি করে ভাবলেও ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয় না।

সুপ্রিয় উপস্থিতি,

৮ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ থেকে উঠে আসা এই ৬ দফাকেই পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারি 'ঘাতক-দালাল নির্মূলের রূপরেখা' হিসেবে আমরা সহজবোধ্য, অর্জনসাধ্য একটি রূপরেখা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলাম।

যেমন সেখানে আমরা বলেছিলাম–

"ছাব্বিশে মার্চের পূর্বে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সন্ত্রাসী জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশোধিত আইনের অধীনে অভিযোগ গঠন এবং নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।"

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আমরা বারবার বলতে চেয়েছি যে, একজন কাদের মোল্লা কিংবা গোলাম আযম কী নিজামীর ফাঁসির মধ্য দিয়েই একাত্তরের চেতনা-বিরোধীদের ধ্বংস করা যাবে না, বরং তাদের দেশবিরোধী রাজনীতি নির্মূল করতে হবে।

আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, অন্য কোনো উপায়ে নয়, জামায়াতকে বিচার করতে হবে তাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন সাংগঠনিক ভূমিকার জন্য। সে সময় সাংগঠনিকভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আনুগত্য ঘোষণা করেছে, যা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহ। এই রাষ্ট্রদ্রোহে তারা সশস্ত্র অংশগ্রহণ করে যুদ্ধাপরাধ সংগঠন করেছে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে তাদের বিচার করার কোনো বিকল্প বাংলাদেশের হাতে নেই।

আপনাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমরা তখন বলেছিলাম, "যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে।"

আমি জানি না, কেন এই কাজটি এখন পর্যন্ত করা হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থায়ী রূপ দেওয়া আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজন। সরকার আসবে, সরকার যাবে; কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকবে। দেশের সর্বশেষ জীবিত যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই ট্রাইব্যুনালকে সজীব আর কর্মমুখর রাখতে হবে।

প্রিয় বন্ধুরা,

ট্রাইব্যুনাল পরিচালনায় আজ এতগুলো বছর পরেও যে সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে আছে বলে বাইরে থেকে আমাদের কাছে মনে হয় তার প্রতিটি নিয়ে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আজকের এই দিনে বরং সেই পর্ব আড়ালেই রাখা যাক।

তবে বিচার দ্রুততর ও আরও সংহত করার জন্য আমি কয়েকটি জরুরি বিষয়ে সরকারের আশু দৃষ্টি আশা করি।

এক. আপিল নিষ্পত্তি

গণজাগরণের মাধ্যমে যে আইন সংশোধিত হয়েছিল সেখানে উভয়পক্ষের আপিল করার অধিকার তৈরি করা হয়েছিল। আমরা আনন্দিত যে সেই সংশোধিত আইনে ইতোমধ্যেই কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়ে গেছে। কিন্তু একই সঙ্গে খেয়াল করলে দেখবেন যে, সেই সময় সাঈদীর বিচারের রায় নিয়ে আপিল হলেও আজ ট্রাইব্যুনালের রায় বের হওয়ার এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল, অথচ আপিল নিষ্পত্তি হল না।

আমি খুবই সচেতন আছি যে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই, আমি তাই খুব স্পেসিফিক কোনো মন্তব্য এখানে করতে চাইও না। তবে আমরা সাধারণ বিচারপ্রার্থী মানুষের একজন হিসেবে আশা করি সাঈদী এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের যাদের আপিল চলমান কিংবা আগামীতেও হতে পারে– এসব মনিটর করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আলাদা একটি সেল তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে একদল ডেডিকেটেড জনবল শুধুমাত্র এই আপিলগুলো নিয়ে কাজ করতে পারে।

আশা করি, যদি আইন ও বিধি-মোতাবেক হয়, তাহলে তারা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছেও এই আপিলগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষে আলাদা বেঞ্চ গঠনের আবেদন জানাতে পারেন।

দুই. ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি

এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি মাত্র আদালতে বিচারকাজ হচ্ছে। যেহেতু এই বিচারের বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই শুরুতে হয়তো একটি বা দুটি ট্রাইব্যুনালেই বিচার চলা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এখন অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারকে আন্তরিক হতে অনুরোধ জানাই। আমি মনে করি, প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামো সুবিধা দিয়ে খুব দ্রুতই আরও অন্তত ৫টি ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা উচিত।

তিন. পাবলিক রিলেশন অফিস

বিষয়টি নিয়ে আমরা আগেও বিভিন্ন সময় কথা বলেছি এবং আমরা ছাড়াও বিভিন্নভাবে কথাগুলো অনেকেই বলেছেন। কেন যেন সরকারের গড়িমসি শেষ হয় না। জ্বি, আবারও বলি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সকল দেশি-বিদেশি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের পেশাদার লবিস্টরা যে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য সরকারের উচিত একটি পাবলিক রিলেশন অফিস তৈরি করা।

আমাদের ব্লগার বন্ধুরা, যাদের বেশিরভাগই প্রবাসী ছাত্র অথবা পেশাজীবী, তারা প্রাণপণে ব্যক্তিপর্যায়ে এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে হরদম কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের প্রচুর অর্থের বিরুদ্ধে এসব ব্যক্তি-প্রতিরোধ আর কতদিন টিকে থাকবে? সরকারের উচিত অন্তত কিছুটা হলেও বিষয়টির সমন্বয়ের চেষ্টা করা। যদি সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের তরুণ বন্ধুরা, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার বাঙালি ছাত্র ও পেশাজীবী এ কাজে সরকারকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবেন।

সংগ্রামী উপস্থিতি,

আমার এসব প্রস্তাব থেকে যেন মনে না হয় যে বিচার নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করার ব্যাপার আছে। কিন্তু এই বিচারগুলো আসলেই দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কারণ যতক্ষণ এগুলো সম্পন্ন না হবে, ততক্ষণ ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে এবং সেই ষড়যন্ত্রের ছোবল থেকে দেশের কোনো মানুষই নিরাপদ থাকবেন না।

আমার পরবর্তীতে গুণীজনরা নিশ্চয়ই বিস্তারিত আলোচনা করবেন, কিন্তু আমি আমার বক্তব্যের উপসংহার টেনে বলতে চাই, 'দেশকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করা একটি বিশাল ক্যানভাসের কাজ। একে মাত্র কয়েকজন রাজাকারের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করার সুযোগ নেই। দেশকে যুদ্ধাপরাধমুক্ত করার জন্য জাতির মাঝে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে যদি প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হন, সক্রিয় না হন, তাহলে তাদেরও একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।'

সবাইকে ধন্যবাদ।

জয় বাংলা।

(স্বাধীনতা দিবসে আয়োজিত গণজাগরণ মঞ্চের পথসংলাপে পঠিত মূল প্রবন্ধ)