উচ্ছেদ রিপোর্টিংয়ে মিডিয়া প্রশ্নবিদ্ধ

শওকত মাহমুদ
Published : 16 Nov 2010, 05:51 PM
Updated : 16 Nov 2010, 05:51 PM

বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জরবদস্তি গৃহচ্যুত করার ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগও সকল মতের মানুষের ঢের ধিক্কারে পড়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আরেক স্তম্ভ মিডিয়াও কিন্তু অনেকখানি প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি অধীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ অফিস (আইএস পি আর) এবং একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা গত সপ্তাহান্তে মিডিয়াকে খেলিয়ে-ধমকিয়ে দেশবাসীকে যেভাবে ধূম্রজালে নিক্ষেপের অপপ্রয়াস পায়, তার কোনও কালে গণতন্ত্রে বাংলাদেশে এমনটি দেখিনি। মিডিয়া হ্যান্ডলিংয়ে ১/১১র ফৌজী খলনায়কদের পদ্ধতি ও চরিত্র তো অব্যাহত আছেই এবং ইদানীং তার আরও অবনতি দেখছি।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনায়, গোটা বিশ্ব জানে, জার্মানি যখন পোল্যান্ড আক্রমণে উদ্যত, তখন গোয়েবলসদের প্রচারণায় সাধারণ জার্মানরা জানছে যে, পোল্যান্ড নাকি জার্মানিকে আক্রমণ করতে আসছে। নাৎসীবাদী গোয়েবলস একটা ব্যক্তি-নাম মাত্র নয়, একটা প্রবণতা, একটা অস্ত্র। বেগম জিয়ার শনিবার 'স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দেবেন'–মিডিয়ায় এই মিথ্যা প্রচারণা গিলিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের মতো সংরক্ষিত এলাকায় উল্টো সেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করার অপারেশন চালানো হয়েছে। জাহাঙ্গীর গেটে সাংবাদিকদের আটকে অস্থায়ী ছাউনি থেকে আইএসপিআর তিনবার ব্রিফ করেছে। কাণ্ডজ্ঞানহীন সরকারের প্রবণতা হল, জনমানসকে চালনা করতে গিয়ে তারা আসল খবরকে ঢেকে দেয় আর মিথ্যা খবর বানিয়ে তোলে। যিনি বা যারা এইরকম  রটনা করেন সজ্ঞানে, সহজ-সরল মানুষের একটা বিশ্বাস-প্রচারণাকে তারা কাজে লাগাতে চান। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের জানার জগৎটাকে বিক্ষিপ্ত আর অস্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু ওই ঘটনায় জনগণ শুধু কানই খোলা রাখেনি, নিজস্ব বিচারবোধের সজীবতাও জাগ্রত রেখেছে। যে জন্যে রোববারের হরতালটা প্রায় বিনা পিকেটিংয়ে সফল হতে পেরেছে।

সাংবাদিক মহলে এই খবর শুক্রবার সন্ধ্যায় চাউর হয়ে যায় যে পরদিন শহীদ মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িতে জবরদস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা তাদের পছন্দের সাংবাদিকদের কাছে কম্পিউটারে টাইপ করা একটি মিথ্যাশ্রয়ী রিপোর্ট পাঠায় যার সোজা কথা হচ্ছে বিএনপি চেয়ারপার্সন স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। বেগম জিয়া কোন্ কোন্ তারিখে কয়টি ট্রাক দিয়ে মালামাল সরিয়েছেন সেসবও বলা হল। পরদিন যথারীতি দৈনিকগুলোতে ফলাও করে ছাপা হল যে শনিবার বেগম জিয়া চলে যাবেন। অথচ কোন রিপোর্টে বেগম জিয়ার এ ধরনের কোন উক্তি নেই বা তার পক্ষে কেউ বলেছেন যে শনিবার তিনি বাড়ি ছাড়বেন–এমন কোন বক্তব্য নেই। আর টিভিগুলোতে হরদম প্রচার শুরু হয়ে গেল। অথচ ভোরবেলায়ই পুলিশ, র‌্যাব, সাদা পোশাকধারী নিরাপত্তা কর্মীরা বেগম জিয়ার বাড়িতে উচ্ছেদের জন্য ঢুকে গেছে। মিডিয়ার এই মিথ্যা খবর যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথমবারের জননির্বাচিত  রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এক কাপড়ে তাঁর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার বর্বরতাকে জায়েজ করেছে, তা এখন অনেকের মুখে মুখে। ওয়ান ইলেভেনের সময় ঠিক একইভাবে আটক রাজনৈতিক নেতাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বানানো প্রতিবেদন বা সিডি যেভাবে গওচচ (মিলিটারী ইন্টারেস্টেড প্রেস পার্সন)  সাংবাদিকদের দিয়ে বোমা ফাটানোর মতো প্রচার করা হল, এবার একই কায়দায় তা করা হল বা হবে। অথচ পরে দেখা গেল, আটক রাজনৈতিক নেতারা  কোর্টে গিয়ে বলছেন তারা এমন কোন স্বীকারোক্তি দেননি। আজকের প্রধানমন্ত্রীও তখন এমন অপপ্রচারের শিকার হয়েছেন যাদের হাতে, তারা এখন তাঁর বিশ্বস্ত অপারেটর। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল সাংবাদিকেরা গোয়েন্দা সংস্থা থেকে টিপস পেতে পারে কিন্তু যাচাই করে নেবে না তথ্যটা সত্য কিনা! তথ্যজ্ঞানের জগতে এই ভয়টা সব সময় থেকে যায়, কোনটা যথার্থ তথ্য আর কোনটা নয়। লক্ষ রাখতে হয় কে জানাচ্ছেন সেই তথ্য। সরকারের ধর্মই হল সত্য আর মিথ্যার অবস্থানটাকে মুহূর্তের মধ্যে  ওলট পালট করে দেওয়া। অবশ্য সরকারের রাজনীতি দিয়ে নিজের মস্তক গুলিয়ে ফেলে যে সাংবাদিক, তাকে কিছু বলে লাভ নেই। শনিবার তাদেরকে যতোই বলা হয়েছে– বেগম জিয়ার বাড়িতে উচ্ছেদ অভিযান চলছে– তারা তাতে কম কান দিয়ে বেশি মন দিয়েছে আইএসপিআরের প্রতি। তারা যদি আইএসপিআরকে  বলতেন 'যদি স্বেচ্ছায় বেগম জিয়া বাড়ি ছাড়ে, আমাদেরকে সরেজমিনে দেখান', তা হলে আইএসপিআর রাজি হতো না।  স্বেচ্ছায় যিনি বাড়ি ছাড়বেন তার জন্যে পুলিশ কেন যাবে অথবা বেগম জিয়া চলে যাবার জন্যে ট্রাক ভাড়া  করেছেন কিনা এসব প্রশ্নও তো জিজ্ঞেস করা যেত। তারা শনিবার শহীদ মইনুল রোডে গেলে দেখতেন কীভাবে বেগম জিয়ার স্টাফ ও তাদের পরিবার-পরিজনকে বলপূর্বক গাড়িতে উঠিয়ে অন্যত্র নিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। সরকার ট্রাক নিয়ে হাজির হয়েছেন, কীভাবে বাড়ির দরজা ভাঙা হয়েছিল, অভিযানের সময় ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া, বিকেলে সিনিয়র  কর্মকর্তারা উচ্ছেদ অভিযানের পর বাড়িটি দেখতে গিয়েছিলেন। অভিযানের এক পর্যায়ে বেগম জিয়া ফোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে জ্যামার বসিয়ে ওই বাড়িতে ফোনের নেটওয়ার্ক অচল করে দেওয়া হয়।

উচ্ছেদ অভিযানে জ্যামারও লাগে। যাহোক, শনিবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়ার অশ্রুসজল বক্তব্য যখন সরকারের অপপ্রচারকে চপেটাঘাতের পাশাপাশি জাতিদের সত্য জানাল তখন damage control-এর জন্যে খলনায়কেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রোববার ঘটা করে সাংবাদিকদের সেই ঐতিহাসিক বাড়িতে চরাও হল, উদাম করে দেওয়া হল ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়ি। বেগম জিয়ার চরিত্র হননের ঘৃণ্য তৎপরতা তো সাংবাদিকদের হাস্যরসের খোরাক হলই কিন্তু তারা যখন রিপোর্ট করল ও ছবি ছাপাল যে বেগম জিয়ার বেডরুমের দরজা ভাঙার আলামত সুস্পষ্ট তখন খেপে গেল পাইক বরকন্দাজরা।

বেশ কয়েকজন সাংবাদিক একান্তে অভিযোগ করেছেন যে, সোমবার তাদেরকে ডেকে নিয়ে বা ফোনে ম্যালা বকুনি দিয়েছে ওরা। বকা খাওয়া এক সম্পাদক যখন বললেন আইএসপিআর তো নিজেই দরজা ভাঙার আলামতের ছবি দিয়েছে, তখন ওপাশ নিরুত্তর। এছাড়া টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর শনি, রবি ও সোমবার যারপরনাই সেন্সরশিপের মহড়া দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হরতাল হয়নি এমন খবর প্রচারের জন্য গোয়েন্দা চাপ ছাড়াও বেশ কয়েকজন এমপি মফস্বল সাংবাদিকদের বলদর্পিত অনুরোধ করেছেন বলে জানা যায়। এখন তো প্রতিদিনই সাংবাদিক দৈহিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। চট্টগ্রামে ট্রাক চাপা দিয়ে একজন সাংবাদিক হত্যার জন্যে ছাত্রলীগের নেতার বিরুদ্ধে মামলার খবর তো সর্বশেষ সংবাদ। তার ওপর খবর চাপিয়ে রাখা বা খবর বানানোর মচ্ছবে মিডিয়ার ত্রাহি অবস্থা।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে, ঈদের আগেই উচ্ছেদের পর বুলডোজার দিয়ে  শহীদ মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি গুড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন হয়েছিল আপীল বিভাগের রায়ের ফলে তর সওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।  জিয়া পরিবারের সেই স্বপ্নের বাড়িটি নিয়ে গোয়েবলসদের পরবর্তী নাটক এবং কুশীলবদের অভিনয় নতুন করে দেখার কৌতূহল সবার মধ্যেই আছে।

সরকারের অপশাসনে ক্ষুব্ধ জনগণকে নিয়ে জননেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন কী করবেন  জানি না। ঈদের আগে কারাবন্দিদের যেখানে মুক্তি পাবার রেওয়াজ আছে, বাস্তুচ্যুত বেগম জিয়ার ততোখানি অধিকারও সরকার দিতে চায় না। শুধু গৃহচ্যুত নন, পরিবারচ্যুতও তিনি। তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান অসুস্থতার জন্যে বিদেশে, নানা মামলায় আক্রান্ত। বেগম জিয়ার প্রিয় নাতনি জাঈমাও কাছে নেই। এত প্রতিকূলতায়ও অসম্ভব স্থির বিএনপি চেয়ারপার্সন। হয়তো তাঁর কানে বাজছে সেই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ব্রিটিশ গান (১৯১৪তে লিনা গিলবার্ট ফোর্ডের লেখা)

Keep the home fires burning
While your hearts are yearning,
Though your lads are far away
They dream of home;
There's a silver lining,
Turn the dark cloud inside out,
Till the boys come home.

———-
ফেসবুক লিংক । মতামত-বিশ্লেষণ