আদালত অবমাননা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

শওগাত আলী সাগর
Published : 11 March 2014, 06:06 PM
Updated : 11 March 2014, 06:06 PM

১.

প্রথম আলো'র যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাটি বিচার বিভাগ আর গণমাধ্যম সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন আলোচনায় নিয়ে এসেছে। বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদের বেঞ্চে মামলাটির শুনানির প্রথম দিনে বিষয়বস্তুর উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। একটি বিচারাধীন মামলার শুনানিতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় উঠে এলেও এ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা এবং একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দরকার।

আদালত অবমাননার মামলায় বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক আদালতের রুল নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রথম আলো'য় প্রকাশিত সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজে ও ডিইউজের বিবৃতি আদালতের নজরে আনেন। এর আগেই আদালত বলেছিল, বিচারাধীন বিষয়ে এ ধরনের বিবৃতি কীভাবে প্রকাশ করা যায়? বিএফইউজে বা ডিইউজে'র বিবৃতিটির আগে ল' রিপোর্টারদের সংগঠনও একটি বিবৃতি দিয়েছে। মিজানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে রুল জারির পরপরই সংগঠনটি আদালতকে 'সহনশীল' আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়।

আদালত কী ধরনের 'অসহনশীল' আচরণ করেছে বা করছে তার কোনো উল্লেখ না থাকলেও ল' রিপোর্টারদের সংগঠনটি তাদের বিবৃতিতে কোনো কোনো আইনজীবী মিজানুর রহমান খানকে আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখার কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এটাকে যদি 'অসহনশীলতা' হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সেটি তো করেছেন 'কোনো কোনো' আইনজীবী, আদালত নয়। তাহলে সংগঠনটি আদালতের বিরুদ্ধে অসহনশীলতার অভিযোগ তুলল কীভাবে?

বিএফইউজে এবং ডিইউজেও আদালতকে গণমাধ্যমের প্রতি 'উদার' ও 'সহনশীল' হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে ওঠা সাংবাদিকদের দুটি সংগঠনের কোনোটিই কিন্তু গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হবার পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাদের অবস্থান যেন 'মিডিয়া যা-ই করুক তাকে কিছুই বলা যাবে না' ধরনের!

'বিচারাধীন বিষয়ে এ ধরনের বিবৃতি কীভাবে প্রকাশ করা যায়'– আদালতের এই প্রশ্নের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করি। পৃথিবীর কোথাও আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে দেখা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারাধীন বিষয় নিয়েই কেবল নয়, আদালতের রায় নিয়েও এমনসব বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করা হয়, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে সেগুলো কল্পনাই করা যায় না।

কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হলে বা বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে, তারা আদালতে আইনি লড়াইয়ের বদলে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আদালতকে খেলো করে দেওয়ার শেষ চেষ্টাটুকু পর্যন্ত করেন। মামলাটা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে হলে সরকারের অনেক মন্ত্রী আদালতে বিচারের আগেই নিজেরা রায় দিয়ে ফেলেন। পুরো চর্চাটাই ন্যায়বিচারের জন্য, আদালতের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অথচ এগুলো যেন গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে কখনও-ই কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে দেখা যায়নি।

আবার আইনজীবীরাও যেহেতু আইনজীবী পরিচয়েই দলীয় রাজনীতি করেন, সেহেতু দলের শীর্ষ নেতানেত্রীরা মাঝেমধ্যেই তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। কিন্তু নেতানেত্রীরা বক্তৃতা করতে গিয়ে আদালত ও বিচার বিভাগ নিয়ে এমনসব কথাবার্তা বলেন, যা বিচার বিভাগকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ''বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। বিচারপতিদের কোন স্বাধীনতা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে তাঁদের সেভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সমস্ত বিচার ব্যবস্থা আওয়ামী লীগের হাতে শৃঙ্খলিত, নিয়ন্ত্রিত।''

বেগম খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য গ্রহণ করলে আদালতের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?

সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো সরকারের 'মিডিয়া দমননীতি'র সমালোচনা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও, আদালতকে নিয়ে কখনও কোনো বক্তব্য দিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এবারই ল' রিপোর্টারদের সংগঠনটির পরপরই বিএফইউজে, ডিইউজে পর্যন্ত আদালতের 'সহনশীলতা' নিয়ে প্রশ্ন তুলে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচার করল। সাংবাদিক ইউনিয়নও রাজনীতিকদের মতো আদালতকে প্রভাবিত করা বা আদালত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিচারকাজ ব্যাহত করার অপ-ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।

আদালতকে 'সহনশীল' হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার আগে বিএফইউজে এবং ডিইউজে যদি পেশাদার সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের একটি প্যানেল করে অভিযুক্ত উপসম্পাদকীয়টি পর্যালোচনা করে নিত, তাহলে তাদের বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকার সুযোগ তৈরি হত। কিন্তু সংগঠন দুটো তা না করে রাজনীতিকদের মতো দায়িত্বজ্ঞানবর্জিত ভূমিকা নিল।

অতীতে এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক যখন বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছেন, তখন এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়াটা ভালো। আমার মনে হয়, সিনিয়র আইনজীবীরা এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা বা গাইডলাইনের নির্দেশনা চাইতে পারেন আদালতের কাছে। প্রয়োজনে আরও আইনজীবী ও পেশাজীবীকে শুনানিতে ডেকে বা বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা করে বিচারাধীন কোনো মামলা নিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি বন্ধ করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের প্রস্তাবনাটিও এই আলোচনার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যারিস্টার রোকন বলেছেন, "বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। আইনজীবীদের জন্য বার কাউন্সিল আছে, ডাক্তারদের জন্য মেডিকেল কাউন্সিল রয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য এ ধরনের কিছুই নেই। এ কারণে তাদের অনেকেই ভাবেন, তারা আইনের উর্ধ্বে। তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যবহার করে যে কাউকে অভিযুক্ত ও নাজেহাল করতে পারেন।"

ব্যারিস্টার রোকনের এই বক্তব্যে সত্যতা যেমন আছে, তেমনি সরলীকরণও আছে। তিনি আদালতে গণমাধ্যমের যে চিত্র এঁকেছেন সেটি কোনো বিবেচনায় সর্বজনীন চিত্র নয়। আমার ধারণা ব্যারিস্টার রোকন নিজেও সেটি বিশ্বাস করেন। তবে সাংবাদিকতার জন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলে হয়তো-বা এই 'আদালত অবমাননা' মামলার জন্মই হত না।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যবস্থা নেওয়ার আশংকা থাকলে মিজানুর খান নিজেও হয়তো কলামটি লেখার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতেন এবং তাঁর লেখাটি আরও অবজেকটিভ হত। আমাদের সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা গণমাধ্যমের নীতি-নৈতিকতার উৎকর্ষতা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, গুণগত উৎকর্ষতা– এসব নিয়ে কিন্তু কখনও-ই কথা বলেন না। অথচ এগুলো নিয়েই এখন বেশি বেশি বলা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে এখন অনেক মিডিয়া। সাংবাদিকও অনেক। পেশাদারিত্ব বা গুণগত উৎকর্ষতার বিবেচনা করলে মিডিয়াভেদে এর রকমফের হয়। পেশাদারিত্ব-বর্জিত উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতারও যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে বাংলাদেশে। যেহেতু সাংবাদিকদের পেশাগত নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সে কারণে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতাও সে অর্থে বিকশিত হয়নি। নগ্নভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো রাজনৈতিক পরিবার, এমনকি কোনো কোনো নেতার পক্ষ হয়েও কোনো কোনো মিডিয়া যা-ইচ্ছে-তাই প্রকাশ করে।

পশ্চিমের বড় বড় সংবাদপত্রগুলোতে 'পাবলিক এডিটর' বলে একটা পদ আছে। এরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পরিবেশিত খবরের যৌক্তিকতা, মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পেশাদারিত্ব পর্যালোচনা করেন। পাবলিক এডিটরের পর্যালোচনা বা মতামত সংশ্লিষ্ট মিডিয়াকে হুবহু প্রকাশও করতে হয়। বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় নিজস্ব পাবলিক এডিটর বা এ ধরনের কোনো 'নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা' আছে বলে আমার জানা নেই। তবে ঢাকার মিডিয়ার পেশাদারিত্ব ও সত্যনিষ্ঠা পর্যালোচনার একটা ব্যবস্থা থাকাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

২.

একটি 'উপসম্পাদকীয়' লেখার জন্য আদালতের রুল জারিতে বিস্মিত হয়ে পড়া সাংবাদিক নেতারা মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতা এবং তাঁর লেখা উপসম্পাদকীয়গুলোর মূল সুরটা কখনও খতিয়ে দেখেছেন কিনা, এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমরা তুলতে পারি। যে নিবন্ধ নিয়ে আদালত অবমাননার মামলার সূত্রপাত হয়েছে সেটি নিয়ে আমরা কোনো আলোচনা বা মন্তব্যে যাব না। তবে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার জন্ম দেওয়া সাংবাদিক হিসেবে মিজানের লেখালেখি ও সাংবাদিকতা নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা আলোচনা করতে পারি।

মিজানের পাঠকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিচার কিংবা আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি করার জন্য রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক তদবিরকারীদের 'বুদ্ধিবৃত্তিক' কুশীলব তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত শিবিরের দেশব্যাপী সহিংস আন্দোলন এবং সেই সহিংসতা পুঁজি করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের তদবিরে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাইরে এই 'বুদ্ধিবৃত্তিক' কুশীলবরাও সক্রিয় ছিলেন। তাদের কেউ পত্রিকায় লিখে, কেউ টক শোতে বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের আতঙ্ক জাগানোর পাশাপাশি জনমত গঠনেরও চেষ্টা করেছেন। মিজানের লেখালেখি এবং বক্তব্য এই গোষ্ঠীর পক্ষেই সোচ্চার থেকেছে।

একটি ঘটনার উল্লেখ করি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দেওয়া বিএনপি- জামায়াত জোটের ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন একটি বিবৃতি দেয়। ওই বিবৃতি প্রকাশের পরের দিনই ৫ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিলের ই-মেইল সাক্ষাতকারের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনে রুপার্ট কোলভিলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, "সাক্ষাতকারে চলমান সহিংসতার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সম্মুখীন করার দিকে ইঙ্গিত করার কারণ ও প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছেন। ওই মুখপাত্র বলেন, সংলাপের মাধ্যমে সুরাহা না হলে সামনের মাসে এই সহিংসতা আরও নিকৃষ্ট রূপ নিতে পারে। আর ফৌজদারি অপরাধের দায় থেকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কেউই শুধু পদমর্যাদার কারণে রেহাই পেতে পারেন না।''

মিজানুর রহমান খানের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ''জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষযক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই ১ ডিসেম্বর জেনেভায় দেওয়া এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বিশ্বের যেসব রাষ্ট্র রোম সংবিধির ভিত্তিতে গঠিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের পক্ষভুক্ত, বাংলাদেশ তার অন্যতম। অন্যান্য পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কিংবা নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ অপরাধ সংঘটনকারীরা বিচারের সম্মুখীন হয়েছে। এটা সত্য যে, জাতিসংঘ এই প্রথমবারের মতো আইসিসির এখতিয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।"

মূলত আগের দিন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতির সূত্র ধরে বিবৃতির একটি অংশের ব্যাখ্যা চেয়ে প্রথম আলো এই সাক্ষাতকার নিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে মিজানুর রহমান খান বেশ কিছুটা চতুরতার আশ্রয় নিয়ে দেশের চলমান সহিংস ঘটনাবলীর জন্য 'প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হেগে বিচার হতে পারে' বলে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

মিজান উল্লেখ করেছেন– ''২০০৭ সালে কেনিয়ায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় এক হাজারের বেশি নাগরিকের মৃত্যুর দায়ে কেনীয় প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি প্রেসিডেন্ট বর্তমানে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারের সম্মুখীন।"

প্রতিবেদনটিতে কেনিয়ার দৃষ্টান্ত হাজির করা হলেও ঘটনার প্রেক্ষাপট ও প্রকৃত চিত্র তুলে না ধরে প্রতিবেদক চতুরতার আশ্রয় নেন। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বা ডেপুটি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আইসিসি যখন অভিযোগ গঠন করে, তখন তারা প্রেসিডেন্ট বা ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হননি– এই তথ্যটা প্রথম আলো'র প্রতিবেদনে নেই। এমনকি ওই সহিংসতায় যে দুই পক্ষের লোকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হয়েছিল তাও মিজান এড়িয়ে গেছেন। কেনিয়ার সহিংসতায় আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযুক্তদের মধ্যে একজন কিন্তু সাংবাদিক, যিনি সেদেশের একটি রেডিওতে টক শো হোস্ট হিসেবে কাজ করেন।

কেনিয়ার ঘটনাটি ছিল নির্বাচনোত্তর সহিংসতা। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুটি দলের সমর্থকদের মধ্যকার দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে। নৃশংসতার ভয়াবহতার কারণে আইসিসি সেখানে সম্পৃক্ত হয় এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করে। পরবর্তীতে তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে।

বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি-পূর্ব সহিংসতাগুলো ঘটেছে মূলত একপক্ষের আয়োজনে। কেনিয়ার আদলে মামলা হলে সেই মামলায় বিরোধী দলেরই জড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু মিজানুর রহমান খান 'কেনিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে' বলে উল্লেখ করে সরকারের দিকে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছেন।

এখানেই শেষ নয়। জাতিসংঘ কর্মকর্তাকে মিজান প্রশ্ন করেছেন, "আপনি কি মনে করেন যে, রাজনৈতিক সহিংসতাজনিত হত্যাকাণ্ড এবং গুমবিষয়ক অভিযোগের তদন্ত শুরু করার জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া সমীচীন হবে?"

মিজান এই ধরনের প্রশ্ন করে জাতিসংঘ কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ বিষয়ে উসকানি দিয়েছেন। কিন্তু ২০০১ সালে হিন্দুদের ওপর নির্বাচনোত্তর হামলার ঘটনায় আইসিসির প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। প্রতিবেদক যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই জাতিসংঘ কর্মকর্তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন এখানে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা, কেনিয়ার যে সহিংসতার জন্য আইসিসি তদন্ত করে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রকৃতি ও তীব্রতার সঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

লন্ডনে ব্রিটিশ সংসদ এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সংসদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ দুটি শুনানি বা বিতর্ক নিয়ে মিজানুর রহমান খান নিবন্ধ লিখেছেন। ব্রিটিশ সংসদের আলোচনায় কোনো উপসংহার, প্রস্তাবনা বা সিদ্ধান্ত ছিল না। পুরো আলোচনার ট্রান্সক্রিপ্টই ব্রিটিশ সংসদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ফলে যে কেউ সেটি ডাউনলোড করে পড়ে নিতে পারেন।

তা সত্বেও ওই আলোচনা নিয়ে ঢাকার মিডিয়া নির্মোহ কোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ প্রকাশ করতে পারেনি। প্রত্যেকটি পত্রিকা নিজেদের মতো করে খণ্ডিত অংশবিশেষ নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে। ফলে ব্রিটিশ সংসদের আলোচনার প্রকৃত চিত্রটি প্রকাশ পায়নি। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনার চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেছে এবং আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছে। সর্বসম্মত সেই প্রস্তাবই ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংসদ মিডিয়ায় প্রচার করে এবং তাদের ওয়েবসাইটেও আপলোড করে।

ব্রিটিশ সংসদের আলোচনা নিয়ে বিবিসির সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমেদের একটি লেখা প্রথম আলো'তে প্রকাশিত হওয়ার পর একই বিষয় নিয়ে মিজানুর রহমান খান একটি নিবন্ধ লিখেন। কামাল আহমদের লেখা অনেকটা ভারসাম্যমূলক হলেও মিজানের লেখা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। তার ওই লেখাটি পড়ে যে কারও মনে হবে যে, ব্রিটিশ সংসদ সম্ভবত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকা থেকে উঠিয়ে নিতে চায়!

ব্রিটিশ সংসদের বিতর্কের ট্রান্সক্রিপ্ট যেহেতু ওয়েবসাইটে আছে, ফলে মিজানের লেখার যথার্থতা পরীক্ষা করা সহজ ছিল। মিজান পুরো লেখাতেই ব্রিটিশ এমপিদের বক্তব্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাদের বাংলাদেশের সরকারবিরোধী অবস্থানের ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একদিন পরই তিনি ইউরোপীয় সংসদের বিতর্ক নিয়ে আরেকটি নিবন্ধ লিখেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদের সর্বসম্মত প্রম্তাব নিয়ে তিনি কিন্তু নিবন্ধ লিখেননি। কোনো সভায় আলোচনা-পর্যালোচনা যাই হোক না কেন, যখন সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় তখন আর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কে কী বলেছিলেন তার তেমন একটা গুরুত্ব থাকে না। সেই বক্তব্যগুলো গৃহীত হয়নি বলেই সর্বসম্মত প্রস্তাবনায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদে নেওয়া সর্বসম্মত প্রস্তাবটিকে 'গুরুত্বহীন' প্রমাণ করতে মিজান ইউরোপীয় এমপিদের বক্তৃতার ট্রান্সক্রিপ্ট সংগ্রহ করেন। জার্মান, ফরাসীসহ ইংরেজি ভাষার ট্রান্সক্রিপ্টগুলো থেকে গুগল ট্রান্সলেশনের সহযোগিতায় সরকারের বিরুদ্ধে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ইউরোপীয় এমপিদের কে কী বলেছিলেন তার ফিরিস্তি দিয়ে বিশাল নিবন্ধ লিখেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেহেতু সংসদের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যের ট্রান্সক্রিপ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করেনি, সে কারণে মিজানের উদ্ধৃতিগুলো নিয়ে সংশয় হলেও প্রমাণ করা যায়নি। যেমনটি করা গিয়েছিল ব্রিটিশ সংসদের আলোচনার লেখাটিতে।

একটি সংসদ যখন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা প্রচার করে তখন তো সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা। তার আগে আলোচনার সময় কে কী বলেছে তার গুরুত্ব কী? কিন্তু মিজান আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এমপিদের আলোচনার উদাহরণ টেনে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইউরোপীয় এমপিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের অপেক্ষায় বসে আছেন! জামায়াত-শিবিরের সহিংস রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বিএনপির প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শও মিজান উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন এই বলে যে, সংসদের এতজন এমপির বক্তৃতার কোথাও বিষয়টি নেই, কেবল ঘোষণায় এক লাইনে উল্লেখ ছাড়া। সংসদ সারাদিন সারারাত আলোচনার পর যদি এক লাইনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কি সিদ্ধান্তের চেয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত মিজান উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এমপিদের বক্তৃতার ট্রান্সক্রিপ্ট সংগ্রহের কাহিনি শুনিয়ে। এখানেই মিজানুর রহমান খানের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। এই অসততাটি তিনি করে গেছেন বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপের জন্য জামায়াত-বিএনপির তদবির চাঙ্গা রাখতে।

প্রথম আলো'র নিজস্ব 'পাবলিক এডিটর' থাকলে কিংবা পেশাজীবীদের পেশাগত অসদাচরণ পর্যালোচনার জন্য যে ধরনের রেগুলেটরি সংস্থা আছে সাংবাদিকদের জন্য তেমন কোনো সংস্থা থাকলে, মিজানুর রহমান খানের এই লেখাগুলোর ব্যাপারে প্রতিকার চাওয়া যেত। কিন্তু সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গণমাধ্যম বা উপসম্পাদকীয়ের নামে মিজানুর রহমান খানের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা এবং দেশকে আন্তর্জাতিক শাস্তির মুখোমুখি করার অনৈতিক তৎপরতারও কোনো প্রতিকার চাওয়া বা পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বিবৃতি দেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকলেও পেশাগত পর্যবেক্ষণের কাজটা তাদের ভাবনায়ও স্থান পায় না।

আইন নিশ্চয়ই তার নিজস্ব গতিতে চলবে। মিজানুর রহমান খান আদালত অবমাননা করেছেন কিনা সে সিদ্ধান্তও আদালত নেবেন। তবে সাংবাদিকতা, রাজনীতি এবং বিচার বিভাগ নিয়ে যে প্রশ্ন বা প্রস্তাবনাগুলো উঠেছে, এই মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায়, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা হোক এবং এরপর একটি অবশ্যপালনীয় নিদের্শনা তৈরি হোক।

শওগাত আলী সাগর: দৈনিক প্রথম আলো'র সাবেক বিজনেস এডিটর; টরন্টো থেকে প্রকাশিত নতুনদেশ ডটকমের প্রধান সম্পাদক।