করপোরেট মিডিয়ায় নারীর উপস্থাপন ও জেন্ডার-বৈষম্য

সঞ্জীব রায়
Published : 8 March 2014, 06:10 PM
Updated : 8 March 2014, 06:10 PM

দেশে করপোরেট মিডিয়ার বাজার রমরমা। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বাজার বাড়ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনুষ্ঠান-আয়োজন। এই অগ্রগতি বারতা দেয় সমাজ-প্রগতির। যে সমাজ-প্রগতির সঙ্গে অনিবার্যভাবে নিশ্চিত হবার কথা নারীর অগ্রগতি আর দূর হবার কথা জেন্ডার-বৈষম্য। কিন্তু কার্ল মার্কসের পুঁজিবাদী সমাজ বিশ্লেষণ সত্য প্রমাণ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই করপোরেট মিডিয়া নারীকে পরিণত করেছে মুনাফাদায়ী পণ্যে।

ভিজ্যুয়াল মিডিয়া কী প্রিন্ট মিডিয়া, দুটোতেই নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে বিশাল আয়োজন। বিশেষ দিনে, বিশেষ আয়োজনে নারীর অধিকার আর নারী স্বাধীনতার বুলি আউড়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির মহাযজ্ঞ সাধনের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন মিডিয়া পরিচালকেরা। কিন্তু সেসব মিডিয়াই প্রতি সেকেন্ডে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপনে ছাড়িয়ে যায় প্রতিপক্ষকে। যেসব পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে নারী দিবসে ব্যানার হেডলাইন হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে বিশেষ পাতা এবং আলোচনা হচ্ছে– তারাই নারীশরীর প্রদর্শনবাদের নতুন মোড়কে হাজির করছে প্রতিদিন।

জেন্ডার-বৈষম্য নিয়ে গত তিন দশকে যে তাত্বিক এবং নারীবাদী চিন্তাবিদেরা কাজ করেছেন, তারা মনে করেন নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, বৈচিত্র্যময় কর্মক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা এবং নীতিনির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ অবাধ করার কাজটি গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। এই বিষয়গুলো যখন কমবেশি একটি ছন্দে এগিয়ে চলছে তখন করপোরেট মিডিয়া নারীকে বৈষম্যের আরেকটি নতুন বোতলে বোতলজাত করতে প্রায় অনেকটাই সফল হতে পেরেছে। করপোরেট মিডিয়া নারীকে বিক্রি করছে মুনাফার বাজারে। প্রতিটি সেকেণ্ডে, প্রতিটি আয়োজনে, প্রতিটি অনুষঙ্গে।

বিজ্ঞাপনের কথায় আসি। একটি সাবানের বিজ্ঞাপনে মেয়েটির উন্মুক্ত পিঠে লিখে দেওয়া হল 'সীমাহারা'। নারীর উন্মুক্ত পিঠ দর্শকের চোখে উপভোগ্য, এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই নারীশরীর বিপণন করা হল বিজ্ঞাপনটিতে। এমন অসংখ্য বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দেশীয় চ্যানেলে পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রে 'আইটেম সং' এখন যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সফল বাণিজ্যিক ছবি তৈরি করতে হলে একটা 'আইটেম সং' চাই-ই চাই। নারীবাদ কিংবা নারীর অগ্রগতির কথা যারা প্রতিনিয়তই বলছেন তাদের অনেককেই দেখা যাচ্ছে এসব চলচ্চিত্র নির্মাণের সামনে-পিছনে। সমাজ-প্রগতির অনুষঙ্গ হিসেবে যদি একজন নারীকে 'আইটেম' হিসেবে জনসমক্ষে বাজারজাত করা হয়, তাহলে জেন্ডার-বৈষম্য কতটুকু কমল-বাড়ল তার বিশ্লেষণটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে বলে মনে করি।

এবার আসি গণমাধ্যম প্রসঙ্গে। টেলিভিশনগুলো এখন সংবাদ-অনুষ্ঠান অথবা টক-শো করে সমাজ বাস্তবতার সবচেয়ে ঝকঝকে আয়না হিসেবে জায়গা করতে চায়। কিন্তু টেলিভিশন সংবাদ থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে নারীর উপস্থাপন প্রদর্শনবাদের সব চাহিদাই পূরণ করে। বইমেলা প্রাঙ্গনে বই নিয়ে আলোচনা বা অনুষ্ঠানে বা সংবাদে মুখে 'রঙপালিশ করা' নারীদের আধিপত্য। বইমেলার মতো জায়গায় রঙপালিশ থেকে বড়জোর শাড়ি-চাদরের বিশেষ সাজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজনে তো কোনো সীমারেখা নেই, যতটা প্রদর্শনযোগ্য করা যায়, যতটা বিক্রি করা যায় নারীর আকর্ষণীয়তা!

আর পত্রিকা বলি বা ম্যাগাজিন– দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক– কেউই কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই নারীশরীর কতটা আকর্ষণীয়ভাবে চাররঙা পৃষ্ঠায় তুলে ধরা যায় সেই কাজে মুন্সিয়ানা দেখাতে। কত নতুন ভঙ্গিমায় হাজির করা যায় নারীর শারীরিক আকৃতি আর প্রত্যঙ্গগুলো, চলছে তারই প্রতিযোগিতা! অথচ একই পৃষ্ঠাতেই হয়তো কলামভর্তি নারীর অধিকার আর অগ্রগতির জ্ঞানগর্ভ লেখা।

মিডিয়ায় নারীকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা আর পুরুষাধিপত্যের সমাজে বিনোদনের ভোগ্য অনুষঙ্গ হিসেবে তুলে ধরার এই প্রবণতাকে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু এর ফলে নারীর অগ্রগতি আর নারীর প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্য আরও দিকভ্রষ্ট হয়েছে। ষাটের দশকের পর থেকেই পশ্চিমা সমাজে মিডিয়ায় নারীর উপস্থাপন নিয়ে নারীবাদী তাত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষকেরা কাজ করছেন, বিশ্লেষণ করছেন। বেটি ফ্রেইডেনের 'দ্য ফেমিনিন মিসটিক' (১৯৬৩), লিন্ডা বাসবি'র 'সেক্স রোল রিসার্চ অন দ্য ম্যাস মিডিয়া' (১৯৭৫), লেসলি জে ফ্রায়েডম্যানের 'সেক্স রোল স্টেরোটাইপিং ইন দ্য ম্যাস মিডিয়া: অ্যান অ্যানোটেটেড বিবলিওগ্রাফি' (১৯৭৭), ডোনা অ্যালেন সম্পাদিত মিডিয়া 'রিপোর্ট উইমেন' (১৯৭৮), গেই টাকমেন, আরলেন কাপলান ড্যানিয়েলস এবং জেমস বেনেট সম্পাদিত 'হার্থ অ্যান্ড হোম: ইমেজেস অব উইমেন ইন দ্য ম্যাস মিডিয়া' (১৯৭৮) উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ।

এই গবেষণাধর্মী রচনাগুলোতে উঠে এসেছে মিডিয়া করপোরেট মুনাফা আর বাজারজাতকরণের নেশায় কীভাবে নারীর প্রতিকৃতি বিকৃতভাবে তুলে ধরে এবং কীভাবে 'ভালগার' এবং 'সেক্সিজম'-এর পুনরুৎপাদন করে।

আমাদের করপোরেট মিডিয়ায় নারীকে পণ্যরূপে হাজিরের মধ্য দিয়ে যে উপস্থাপনরীতি জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে তার পিছনে কর্তৃপক্ষের একটিই যুক্তি– দর্শক এমনটিই চায়। দর্শকের কোন চাহিদা পূরণ করা, কোন চাহিদা তৈরি করা মিডিয়ার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সেটি অন্যদিনের আলোচনার বিষয়। এই আলোচনার শেষে এটাই বলা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দর্শকের খোরাক জোগানোর মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জনের কাজটিই মিডিয়ার কাছে প্রধান।

তাহলে নারীপ্রগতি, সমাজ-প্রগতির বুলিগুলো না আউড়ানোই শ্রেয়! কারণ করপোরেট মিডিয়া নারীকে যে মাত্রায় এবং যে ধরনে উপস্থাপন করছে তা সামগ্রিকভাবে নারীকে পিছিয়ে দিচ্ছে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে– নারীকে করে তুলছে আরও নারী।

সঞ্জীব রায়: গবেষক, সাংবাদিক।