‘বিদ্বেষ ছড়ানোয় উস্কানি প্রদান’ আর ভারত-রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক (!) কাঠামো

স্বাধীন সেন
Published : 5 June 2008, 03:22 PM
Updated : 6 Nov 2010, 11:54 AM

ভারত-রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী, সহিংস ও নিপীড়নমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করায় সম্প্রতি অরুন্ধতি রায়-সহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকারের প্রতি বিদ্ধেষ ছড়ানোয় উস্কানী প্রদানের আইনী অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মূলধারার প্রচারমাধ্যমে তাঁদের বক্তব্যকে সেনসিটাইজ করার মাধ্যমে উসকে দেয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদী নাগরিক মধ্যবিত্তীয় আবেগ; পুরুষালী ভাষায় ব্যক্তিগত জীবন-যাপনকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী তাদেরকে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করেছেন; ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সমষ্টি ও সমাবেশ থেকে তাদের বিচারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে; আর ইলেকট্রনিক প্রচারমাধ্যমের উপস্থিতিতে অরুন্ধতি রায়ের বাসায় বজরং দলের নারী কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন।

ভারত-রাষ্ট্রের সীমানার বাইরের ভারতের আধিপত্যর অধীনস্থ একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, এবং নিজ-রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক ভূমিকা সম্পর্কে সতর্ক পর্যবেক্ষণকারী হিসাবে এই ঘটনাবলি ও ঘটনাবলির পরম্পরার দিকে আমার গভীর মনোযোগ রয়েছে। এই ঘটনাবলি, পক্ষ-বিপক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সক্রিয় প্রতিক্রিয়া, রাষ্ট্র ও মিডিয়ার তৎপরতা, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উচ্চকিত জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তিসমূহ, বুদ্ধিজীবীদের নানামুখি সক্রিয়তা আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করার, বোঝার ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। এই লেখায় আমার এই বোঝাপড়া ও বিশ্লেষণের কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই।

অরুন্ধতি রায় বিভিন্ন সময়েই ভারত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন দমননিপীড়ন, নির্যাতনমূলক ভূমিকা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণসমূহ আমাদের সামনে হাজির করছেন। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, বাঁধ নির্মাণ ও আদিবাসি জাতিসমূহের অধিকারের প্রসঙ্গে, কর্পোরেট আধিপত্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রকাশ্য গাঁটছড়া থাকা প্রসঙ্গে, মাওবাদীদের দমনের নামে আদিবাসিদের উপরে তীব্র রাষ্ট্রীয় দমন, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন প্রশ্নে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রের সামরিকায়ন বিষয়সহ বহুবিধ সাম্রাজ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক, সামরিক, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য ও তার নতুন নতুন উদ্ভাস নিয়ে তাঁর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও প্রতিবাদ আমার কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তবে যে-বিষয় ও ঘটনাবলি নিয়ে সরকারের (ও রাষ্ট্রের) বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অপ্রীতির বিস্তার ঘটানোর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সে সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা দরকার। কারণ বাংলাদেশের মূলধারার প্রচারমাধ্যমে ও বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যে এই প্রসঙ্গে আগ্রহোদ্দীপক নিরবতাও ভাবনার দাবি রাখে এবং ঘটনাবলির অনুপুঙ্খ পর্যালোচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অরুন্ধতি রায়সহ অনেক অ্যাকটিভিস্ট ও অধিকারকর্মী রাষ্ট্রীয়, সামরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বিদ্যায়তনিক, লিঙ্গীয় ও মতাদর্শিক নিপীড়নের স্বীকার হয়েছেন। মূলধারার তাবেদারি বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় এঁদের সংখ্যা অনেক কম। সাম্প্রতিক ঘটনার সূত্রপাত দিল্লীতে আয়োজিত একটি সেমিনারে প্রদত্ত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ভারত-রাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গে ২১ অক্টোবর নতুন দিল্লীর মান্ডি হাউসে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য কমিটি/কমিটি ফর দি রিলিজ অব পলিটিকাল প্রিজনার- এর উদ্যোগে 'আজাদি একমাত্র পথ' শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজিত হয়।

এই সেমিনারে অরুন্ধতি রায় ছাড়াও যাঁরা বক্তব্য রাখেন তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন কাশ্মীরের হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতা এবং আয়োজক কমিটির প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলী শাহ জিলানী (যার জঙ্গীবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, ইসলামপন্থী হিসাবে 'সেক্যুলার' ও 'প্রগতিশীল' মহলে পরিচিতি আছে), কবি এবং মাওবাদী হিসাবে পরিচিত বরাবরা রাও, নাগা পিপলস মুভমেন্ট ফর হিউম্যান রাইটস-এর সেক্রেটারি জেনারেল ড. এন. বেনু, মণিপুরের কমিটি ফর পিস এন্ড ডেমোক্রেসির প্রতিনিধি মালেম নিংথুজা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আয়োজক কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল অমিত ভট্টাচার্য, তামিল ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্টের সেক্রেটারি জেনারেল থিয়াগু, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. শেখ শওকত হোসাইন, জম্মুর গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মী শিব নন্দ, মিডিয়া পর্যালোচক শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত, ইকোনমিক টাইমস-এর সহকারী সম্পাদক নাজিব মুবারকী।

ব্লগের লেখালিখি ও আন্তর্জালিক/ইন্টারনেট খবরাখবরের সূত্রে জানা যায় যে, এই সেমিনার আয়োজনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই তৎপরতা চলছিল। সেমিনার চলাকালীন কিছুসংখ্যক প্রতিবাদকারী – যারা কাশ্মীরের আজাদির বিরুদ্ধে, যারা জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন- গন্ডগোল করার অপচেষ্টা করেন এবং বক্তৃতামঞ্চে জুতা ছুঁড়ে মারেন। আরো জানা যায় যে, এই জাতীয়তাবাদী আক্রমণ সত্ত্বেও সেমিনারটি সফলভাবেই শেষ হয় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে। যাঁরা এই সেমিনারে বক্তব্য রাখেন তাঁরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে কাশ্মীরের সামরিকীকরণ, এই অঞ্চলকে অধিকৃত ভুখন্ডে রূপান্তরকরণ, সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অব্যহত হত্যা, ধর্ষণ, গ্রেফতার, গুমখুন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন। কাশ্মীরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে হক্ ও আজাদির দাবির প্রতি সমর্থন জানান। ওখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু ও পন্ডিতদের অধিকার, মূলধারার গণমাধ্যমের হেজেমনির ও নিপীড়ক মতাদর্শের উৎপাদন ও প্রতিপালনের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন।

সেমিনারে অরুন্ধতি ও সৈয়দ জিলানীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক গোষ্ঠীগত, দলগত এবং মূলধারার প্রচারমাধ্যমের তথ্যবিকৃতি ও অতিরঞ্জনগত তৎপরতা ঘনীভুত হতে থাকে। ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪এ ধারা অনুসারে অরুন্ধতি ও জিলানীর বিপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর (সেডিসনের) উস্কানী প্রদানের অভিযোগ দায়ের করে কতিপয় নাগরিক ও সংগঠন রাচি, পাঞ্জাব ও দিল্লীতে; উত্তর প্রদেশের একজন আইপিএস কর্মকর্তা, অমিতাভ ঠাকুর, দিল্লীর পুলিশ কমিশনারের কাছে উপরুক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগপত্র দায়েরের অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বজরং দল প্রকাশ্যে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিযোগ দাখিল করে বক্তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে, সেনসিটাইজ করে জাতীয়তাবাদী আখ্যান ও মনস্তত্ত্বকে পুঁজি করে প্রচারণা চালাতে শুরু করে।

এমত পরিস্থিতিতে অরুন্ধতি রায় একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যেটি বাংলাদেশের কোনো কোনো মূলধারার ও আন্তর্জালিক প্রচারমাধ্যমে অনূদিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক, সরকারি দল পরোক্ষভাবে এই সেমিনার ও সেমিনারের বিষয়-বস্তু ও বক্তব্য নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও, পরবর্র্তীতে তারা আইনী অভিযোগ আনতে অনিচ্ছুক বলে জানায়। তারা জানায়, 'সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করার উস্কানী প্রদানের' অভিযোগ নিয়ে তারা তদন্ত করতে আগ্রহী না এই কারণে যে, এমন পদক্ষেপ অভিযুক্তদের আরো প্রচারে আসার সুযোগ করে দেবে এবং তাঁদের সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসবে। ৩১ অক্টোবর সকাল ১১ টায় বজরং দলের নারী সদস্যরা অরুন্ধতির দিল্লীর বাড়ীতে হামলা ও ভাঙচুর করে। সবচেয়ে গুরুতর বিষয় যা অরুন্ধতির তাৎক্ষণিক বিবৃতি মারফত জানা যায় তা হল, এনডিটিভি, নিউজ২৪, টাইমস নিউজ-এর মতো মূলধারার এবং শক্তিশালী ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলোর ওবি ভ্যান (লাইভ সম্প্রচার ও রেকর্ডিং-এর জন্য ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি বহনকারী গাড়ী) হামলার আগে থেকেই তার বাড়ীর সামনে উপস্থিত ছিল।

অরুন্ধতির বিবৃতি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এইসব প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে হামলাকারীদের পূর্বযোগাযোগ ছিল। তিনি প্রশ্ন করেন এই যোগাযোগকে প্রচারমাধ্যমের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যসাধনের সঙ্গে কেবল সম্পর্কিত করা যাবে, না কি হামলাকারীদের সঙ্গে মতাদর্শিক ঐক্য হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে।

'চাকচিক্য উদ্ভাসিত ভারত' – এর প্রচার ও প্রসারে মিডিয়ার তৎপর ও কার্যকর অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক কালে খুবই লক্ষণীয় প্রপঞ্চ। জাতীয়তাবাদী (হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষ), কর্পোরেট দানবকুল ও রাষ্ট্রের সঙ্গে মিডিয়ার প্রকট ও প্রচ্ছন্ন আর্থিক ও মতাদর্শিক গাঁটছড়ার বিষয়টি হালের বিকল্প মিডিয়ার কল্যাণে এবং সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক বুদ্ধিজীবিতার মারফতে আমাদের নজরে আসে। আলোচ্য ঘটনাবলির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত না-হলেও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, ১ নভেম্বর দিল্লী বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ক্যালিফোর্নিয়া ইনসটিটিউট অব ইনটিগ্রাল স্টাডিজ এর নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রিচার্ড সাপিরোকে ঢুকতে দেয়নি। সাপিরো ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইবুনাল অন হিউম্যান রাইটস এন্ড জাস্টিস ইন ইনডিয়ান অ্যাডমিনিসটারড কাশ্মীরের যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং একই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক অঙ্গনা চ্যাটার্জির জীবনসঙ্গী।

সেমিনার ও সেমিনার পরবতী এইসব ঘটনা ও প্রসঙ্গ নিয়ে বিবিধ প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাল দুনিয়ায় লক্ষ করা যাচ্ছে। মূলধারার প্রচারমাধ্যম আর আন্তর্জাল জগতের এই তৎপরতাসমূহ ভারত-রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ, সাম্প্রতিক জাতীয়তাবাদী মনস্তত্ত্বর দৃশ্যমানতা ও সেন্সরশীপ এবং বিভিন্ন মাত্রিক ও বিবিধ পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার পর্যালোচনা ও তাৎপর্য বিষয়ে বাংলাদেশেও আমাদের ভাবনার ও বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার খুবই গুরুত্ববহ অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে বলে আমি মনে করি। নব্য উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দাপটে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ও সেক্যুলার রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত ও স্বতঃসিদ্ধ বলে অনুমিত ও বিভ্রমতাড়িত ধারণাবলি আর অনুশীলনপ্রসঙ্গে পুর্নভাবনার দায়ভার এড়ানো দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে উঠছে বলেও এই ঘটনাবলির বিশ্লেষণ প্রমাণ করতে পারে বলে আমার পর্যবেক্ষণ।

'বাক্-স্বাধীনতা', 'বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা', 'সাংবিধানিকতা-অসাংবিধানিকতা', 'মানবাধিকার', ' আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র' -সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত, স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে-নেয়া ধারণাকে যে প্রশ্ন করা দরকার ও জরুরী তা অধুনা অনেক আলাপচারিতা ও তৎপরতায়ই প্রতীয়মান হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সর্বগ্রাসী, আধিপত্যবাদী ও নিপীড়নমূলক চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে: একদিকে, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন ভিন্ন ভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত অভিব্যক্তিতে জোরদার হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে, ভারত-রাষ্ট্রের ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত সামরিক সত্তা ক্রমশ প্রকাশ্য হওয়ার মধ্যদিয়ে; অন্যদিকে, কর্পোরেট-মিডিয়া-সিভিল ঐক্যের আপাত জৌলুসময় পোষাকের নিচের হতশ্রী চেহারা বিকল্প মিডিয়ার কল্যাণে উন্মোচিত হতে শুরু করার কারণে। কাশ্মীরের আজাদির জন্য আন্দোলনরত এবং প্যালেস্টাইনের ইন্তিফাদা আন্দোলনের অনুকরণে পাথর-ছোঁড়াকে একমাত্র সহিংস প্রতিবাদের রাস্তা হিসাবে বেছে নেয়ার পরেও অসংখ্য বালক-কিশোর সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছেন, বন্দী হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন। দৈনন্দিন যাপিত জীবন হয়ে উঠেছে আতঙ্ক ও নিপীড়ন সংলগ্ন। অপারেশন গ্রিনহান্টের নামে মাওবাদী দমনে আদিবাসীদের উপরে কর্পোরেট-সামরিক-সিভিল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণামূলক নিপীড়ন জারি থাকছে, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিকায়ন পরবর্তী নিপীড়ন দৈনন্দিন যাপিত-জীবনকে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত করেছে, এফোড়ওফোড় করে ফেলেছে। অধিকৃত, বন্দী, আর ক্রমবর্ধমান যাপিত নিপীড়নের পরিসর এই জনপদগুলো ভিন্ন জগত। এই জগত আরোপিত উন্নয়নের আরোপিত বাস্তবতা নিয়ে গঠিত, প্রচারিত ও উন্মোচিত হচ্ছে।

কর্পোরেট পুঁজির অবাধ চলন নিশ্চিত করায় আর স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও আনন্দের আরোপিত বাস্তবতার উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রের সম্পুরক ও তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠছে অন্যান্য ধারার দৃশ্যগত উৎপাদন ( যেমন: চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন) ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড। অব্যহতভাবে আতঙ্ক, ভয় আর অপমানকে যাপন করতে বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকা জাতীয়তাবাদের মূল আখ্যানের বাইরের অধিবাসি এই মানুষজন, রাষ্ট্রের প্রান্তবর্তী আর উন্নয়নের চলচ্চিত্রিয় জেল্লার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া, প্রান্তবর্তী, অধস্তন এই মানুষজনের মনোজগতে ও মনস্তত্ত্বে কী আকাঙ্খা ও স্বপ্ন বিকশিত হতে পারে? বিভিন্ন বাধার মধ্যেও কাশ্মীরের মানুষদের অধিকারের জন্য কাজ করে যাওয়া গবেষক ও অ্যাকটিভিস্টদের বরাতে এ-কথা স্পষ্ট যে, সেই আকাঙ্খা কেবল স্বাধিকারের, সেই স্বপ্ন আজাদির।

প্রতিবাদকারীদের উপরে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়তাবাদীদের সাম্প্রতিক সহিংস, অহিংস, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৃশ্যগত মাধ্যমের আক্রমণকে উদারনৈতিক রাষ্ট্রের স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত বাক্-স্বাধীনতার প্রতি আঘাত হিসাবে দেখা হচ্ছে। অসাংবিধানিক হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আকাঙ্খার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হিসাবে ঠাহর করা হচ্ছে। প্রতিবাদকারীদের অনেকেই এই বিশ্লেষণমূলক বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন।

ঔপনিবেশিক আধুনিকতার শর্ত ও ফলাফল হিসাবে যে জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম এবং এতদ্অঞ্চলে উপস্থিতি ও বিকাশ, সেই রাষ্ট্রের পাবলিক পরিসর শুরু থেকেই কিছু মানুষকে (বা নাগরিককে) বাদ দিয়ে দেয়; অর্থাৎ যেমনটা অনুমান করা হয় ও আদর্শ মনে করা হয় তেমনভাবে সকলের সমান অংশীদারিত্ব এই পরিসরে থাকতে পারেনা কোনোভাবেই। নারী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষ, নিম্নবর্গের ও নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষ, দরিদ্র মানুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেহায়েতই একটি ভোট মাত্র; ভোটের পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী তাদের গুরুত্ব বাড়ে বা কমে। আইন, সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা, বিচারিক ব্যবস্থা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসনসহ সকল রাষ্ট্রীয় যন্ত্রপাতিই উদারনৈতিক পাবলিক পরিসরের এই স্ববিরোধি চরিত্রকে লালনপালন করে। অথচ আমরা অনুমান করতে থাকি, কামনা করতে থাকি যে, এই পরিসরে সম-অংশীদারিত্বমূলক বিতর্ক ও সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব। পাবলিক পরিসরের এই অনুমানকে আদর্শ হিসাবে সামনে রেখে লড়াই করতে থাকি। অধুনা, অনেক রাষ্ট্রচিন্তক বিশ্বায়ন, কর্পোরেট পুঁজির দাপট ও উন্নয়নমূলক এজেন্সিগুলোর অবাধ বিচলনকে আরো বেশি মুক্তিদায়ি ও সম-অংশীদারিত্বমূলক পাবলিক জবানের নিশ্চয়তাপ্রদানকারী হিসাবে বিবেচনা করেন। কিন্ত সেটা সমস্যাজনক।

আমার প্রশ্ন লড়াই নিয়ে নয়। আমার প্রশ্ন মিথ্যা অনুমান আশ্রয় করে লড়াইয়ে। উদারনৈতিক আর, অধুনা নব্য-উদারনৈতিক পাবলিক পরিসরের প্রধান বৈশিষ্ট্য আমরা ভুলে যাই। এই পরিসর আবশ্যিকভাবেই ক্ষমতার সঞ্চালনে গড়ন লাভ করে। এখানে যেই অনুপ্রবেশ করুন না কেন তাকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হয় যে, ক্ষমতা মানুষ ও বস্তুসামগ্রীকে এই পরিসরে আবশ্যকীয়ভাবেই ব্যবস্থায়িত করে। এখানে কিছু মানুষকে অন্যদের সদিচ্ছার উপরে নির্ভর করতেই হয়। নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ খুব চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন ব্যাপারটা বোঝাতে গিয়ে। বাক্-স্বাধীনতা ভোগ করার বিষয়টা শুধুমাত্র কথা বলতে পারার শারীরিক সক্ষমতার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত হয় না। কিন্তু কাউকে সেই কথা না শোনানোর ক্ষমতা, পরিস্থিতি ও শর্ত উপস্থিত না থাকলে, যে-যত জোরে চিৎকার করুন না কেন, তার কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া হবে না। মজার বিষয় হলো, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাক্-স্বাধীনতাকে স্বীকার করলেও, আবার সেই স্বাধীতাকে আনুষ্ঠানিক আইনী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খর্বও করে। গোপনীয়তার অনুশীলন করতে বাধ্য করে। মোটকথা, বাক্-স্বাধীনতাকে খর্ব না করে, সীমায়িত না করে উদার গণতন্ত্রের রাজনীতি, কার্যক্রম ও নৈতিকতা ধ্বসে পড়তে বাধ্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্দিষ্ট ধরনের বক্তা ও শ্রোতা হিসাবে, নাগরিক হিসাবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে, প্রাইভেট পরিসরে আমাদের গঠিত হওয়া। একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকে বোঝার ক্ষমতা অর্জন করার মতো বিষয়ের সঙ্গেও বাক্ স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। এই পরিসরে আমরা কী হয়ে উঠেছি, আর আমরা কী হয়ে উঠতে চাই তার সঙ্গে সম্পর্কিত বাক্-স্বাধীনতার চর্চার চৌহদ্দী টেনে দেয়া।

রাষ্ট্রের ধারণার অস্তিত্ত্ব যখন দাঁড়িয়ে থাকে সার্বভৌমত্বের ধারণার উপরে, সেখানে সেই সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্নকারী (বাক্)স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকলে রাষ্ট্রই তো থাকে না। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ বিবিধভাবে গড়ে ওঠেন। রাষ্ট্র প্রস্তাব করলেও, পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও, কোনো সুনির্দিষ্ট একটি নৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের আনুগত্য থাকে না, থাকতে পারে না। তাদের হয়ে-ওঠা আর হয়ে ওঠার-বাসনার মনস্তত্ত্ব তাদের প্রাইভেট যাপিতজীবনের সঙ্গে লেপ্টে যায়। পাবলিক আর প্রাইভেটের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতা, স্বজাত্যবোধ, জাতীয়তাবাদ তখন নাগরিক নৈতিকতার, বাসনার মানদন্ড নির্মাণ করে। তাই, রামচন্ত্র গুহের মত স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবি যখন প্রকাশ্যে অরুন্ধতি রায়কে আত্মপ্রচারকামী হিসাবে ঘোষণা করেন, বা অর্ণব গোস্বামীর মতো সাংবাদিকগন যখন পাবলিক জবানে ওই সেমিনারে উপস্থিত সকলের বিরুদ্ধে 'সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের' অভিযোগ দায়েরের দাবি করেন তখন তাকে নীতিগতভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী হিসাবে বলার সুযোগ নাই। আধুনিক ক্ষমতার ব্যবস্থায়নের প্রক্রিয়ায় (মিডিয়া যার একটি অতিআবশ্যিক শর্ত) তাদের সুনির্দিষ্টভাবে গড়ে ওঠার ইতিহাস ও ক্ষমতা-সম্পর্কে তাদের অবস্থান তাদের মত ও বক্তব্য অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌছে দিতে পারে; প্রতিবাদকারীগণ সেটা পারেন না। একইভাবে, ভারতের সংখ্যাগড়িষ্ঠ বুদ্ধিজীবি চুপ থাকেন কিংবা সার্বভৌমত্বের রক্ষক হয়ে দাঁড়ান।

প্রাসঙ্গিকভাবে, উত্থাপিত অন্য একটি প্রসঙ্গও চিন্তাউদ্রেককারী। সেলিব্রিটি হিসেবে অরুন্ধতি রায়ের গঠিত হওয়া বক্তা হিসাবে তাঁর ক্ষমতাকে অনেকটাই নির্ধারণ করে। আবার, তাঁর সেলিব্রেটিত্ব যে-কোনো বক্তব্যের মূল বিষয়কে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলে "অরুন্ধতি রায়" কেন্দ্রীক করে তোলে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই কাশ্মীরের বদলে এখন আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে "অরুন্ধতি রায় প্রসঙ্গ"। এই পরিস্থিতিকেও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পাবলিক ও প্রাইভেট পরিসরের উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করা দরকার।

বাংলাদেশে ক্রশফায়ার, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপরে নিপীড়ন, বা বিডিআর বিদ্রোহে বিচারের সম্মুখিন বিডিআর সদস্যদের পরিজনদের নিয়ে আলাপচারিতা বা তর্ক-বিতর্ক হয় না, বা হলেও নির্দিষ্ট স্থান-কালে, নিদিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সেই তর্কের আওয়াজ কমে বা বেড়ে যায়। বিএসএফ-এর গুলিতে অসংখ্য বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হতে থাকলেও, ভারতের পাবলিক পরিসরে সেই হত্যাকান্ড নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলেন না বুদ্ধিজীবিগণ।

কাশ্মীরের আজাদি নিয়ে যারা কথা বলছেন, বিভিন্নভাবে লড়াই করছেন, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নমুখী বৈষম্য, নিপীড়ন ও সামরিকায়নের প্রতিবাদ করছেন তাদের মোবারকবাদ জানাই। তবে, শেষ অব্দি লড়াই যেমন প্রয়োজন, প্রতিরোধ যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন লড়াই-প্রতিরোধের ভাষা, ভাবনা ও পূর্বানুমানের পুনর্চিন্তন।

৪ নভেম্বর ২০১০; ১৩, ব্যাচেলরস কোয়ার্টার, জাবি।