বাঙালির জয়, বাংলার জয়

মহাদেব সাহা
Published : 15 Dec 2009, 05:01 PM
Updated : 15 Dec 2009, 05:01 PM

বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরবের সময় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতি ত্যাগে মহত্ত্বে অসামান্য হয়ে ওঠে, তার চেতনা ও বোধের সর্বোত্তম বিকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সমগ্র জাতি যে সাহস, ত্যাগ ও মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় দেয় তার তুলনা নেই। তার বাহুতে সঞ্চারিত হয় শক্তি, তার বুকে সঞ্চারিত হয় সাহস, চোখে সঞ্চারিত হয় স্বপ্ন। একেকটি মানুষ হয়ে ওঠে তার নিজের চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক বিশাল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষ না কতোভাবেই এগিয়ে আসে মানুষের জন্য, মানুষ হয়ে ওঠে মানুষের ভাই, মানুষের আত্মীয়। সকলের জন্য সকলের দুয়ার সেদিন উন্মুক্ত। এ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যতোই ভাবি ততোই বিস্মিত হই। এই জাগরণের যিনি মহানায়ক তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালির জীবনের সে এক অনন্য ইতিহাস। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, দু'লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান বিজয় দিবস আমাদের উজ্জীবিত করে। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছে অস্ত্র হাতে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন  যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে শত্রু হননে সেদিন একাত্ম হয়েছিল সমগ্র বাঙালি জাতি।

এই জাগরনের সূচনা ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির সে এক অসামান্য আত্মত্যাগ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালিরা প্রমাণ করে বাংলা তাদের প্রাণের ভাষা। ভাষা আন্দোলনের অসম্প্রদায়িক চেতনা যে বোধের জন্ম দেয় তা থেকে ভাষা ভিত্তিক সেক্যুলার রাষ্ট্রের চেতনারও জন্ম হয়। বন্ধবন্ধু এই চেতনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন বাংলার মানুষকে। লক্ষ একটাই, স্বাধীনতা অর্জন। এর পর ধাপে ধাপে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু স্বকণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ইতিহাসে এই ভাষণের তুলনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আব্রাহাম লিংকন ও চার্চিলের ভাষণ ছিলো লিখিত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিলো অলিখিত বক্তৃতা, তাৎক্ষণিক, স্বতঃস্ফূর্ত। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। আর স্বাধীনতা অর্জন একদিনের একটি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য অতিক্রম করতে হয় বহু দীর্ঘ পথ। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। এর পরও যারা বির্তক সৃষ্টি করে, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করতে চায় তারা প্রকৃত পক্ষে সুকৌশলে স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করে।

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন। তিনি আমাদের জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। নির্যাতন, নিঃপীড়ন, জেল জুলুম, এমকী ফাঁসির ভয় দেখিয়েও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে এক চুলও বিচ্যুত করা যায়নি। তিনি বজ্র কণ্ঠে যেমন ঘোষণা করেছিলেন 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'  তেমনি শত নির্যাতন ও নিঃপীড়নের মধ্যেও ছিলেন ইস্পাতের মতো দৃঢ় ও অবিচল। ১৬ই ডিসেম্বরের এই বিজয় দিবসে সমগ্র জাতি শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে।

এবারের বিজয় দিবস আরও ভিন্ন তাৎপর্যে উদযাপিত হচ্ছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মহাজোট সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতির হারানো গৌরব প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ। পিতার স্বপ্ন সার্থক করে তোলার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস কর্মসাধনায় নিয়োজিত আছেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি দিন বদলের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এজন্য তাঁকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ইতিমধ্যেই দেশের মানুষের মনে সঞ্চারিত  হয়েছে নতুন আশা ও উদ্দীপনা। সুদীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তিবিধান হয়েছে, যদিও খুনি অপরাধীদের দণ্ড এখনো কার্যকর হয়নি। এই বিচার ও শাস্তিবিধান স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই বিচার সম্পন্ন হয়েছে। শেখ হাসিনা অশেষ সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, কোনো বিশেষ আদালত বা ট্রাইবুনাল গঠন করেননি। আইন তার স্বাভাবিক পথে চলেছে। আমরা জানি এই বিচারকে বন্ধ করার জন্য যেমন অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিলো তেমনি বিচারকে বিলম্বিত বা সুকৌশলে বানচাল করারও ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেই দুর্যোগ কেটে গিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে আশার আলো। চৌত্রিশ বছর পর জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এবারের বিজয় দিবসের তাৎপর্য তাই ভিন্ন।

এই বিজয় দিবসে আমাদের আরও দৃপ্ত শপথে আলোর পথে এগিয়ে যেতে হবে। দূর করতে হবে সব রকমের অনাচার ও অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকারই হোক এবারের বিজয় দিবসের মূল লক্ষ। আমাদের জেগে ওঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। দেশ থেকে এখনো দারিদ্র দূর হয়নি, অগণিত মানুষ কর্মহীন বেকার, অসংখ্য মানুষ বৈষম্য, অভাব-অনটন ও মানবেতর জীবনের মধ্যে বেঁচে আছে। জেলহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে এইসব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বাংলার মানুষকে উপহার দিতে হবে সুখী সমৃদ্ধ জীবন। ১৬ই ডিসেম্বরে বাঙালির বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের সমবেত অঙ্গীকার।