চাঁপা রানী হত্যা ও আমাদের যা করণীয়

তানিয়া বুলবুল কিটি
Published : 15 May 2008, 04:21 PM
Updated : 3 Nov 2010, 09:08 AM

আলুর দোকানে বেগুনের খোঁজ করলে পটল তুলতে হয়। চেয়ারম্যান জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, কিন্তু আইন প্রয়োগে তার ক্ষমতা নাই, তা জনসাধারণের ভাবনার অতীত। কিন্তু প্রশ্ন হল, চাঁপা রানী যদি থানায় জিডি করতেন তবে কি তাঁর এভাবে প্রাণ যেত না ?

ইভ টিজিং বা নারীদের উত্ত্যক্ত করা এই দেশে কোন নতুন ঘটনা নয় এবং সেই কারণ ধরে অল্প বয়সে বিয়ে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ, বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ইত্যাদি অসংলগ্ন বিধি নিষেধের মধ্য দিয়েও এই ভূখন্ডের নারীরা প্রমাণ করেছেন তারা বিপ্লবী। পরিসংখ্যান মতে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারীরা এগিয়ে, প্রশাসনিক কাজে নারী কর্মচারীরা তাদের পারদর্শীতা দেখিয়েছেন ইতিমধ্যে। প্রমাণ করেছেন, প্রতিকূলতাই গতিশীলতার চাবিকাঠি। কিন্তু এইরূপ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কি এই ভুখন্ডকে মধ্যযুগের জাদুঘর হিসাবে চিহ্নিত করে না ?

ভিন্নরকম উদাহরণ প্রসঙ্গে ঢাকার একটি বেসরকারি মহিলা কলেজের গল্প বলি। পাড়ার বখাটে যুবকেরা যেন উক্ত কলেজ ছাত্রীদের যাতায়াতে বাধা দিতে বা আইনী পরিভাষায় উত্ত্যক্ত করতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটির মালিক তথা চেয়ারম্যান একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি সেই সকল যুবকদের উক্ত কলেজে চাকরী দিলেন। তো, তাতে লাভ হুল দুটো। এক, কিছু বেকার যুবকের কর্ম সংস্থান হল। দ্বিতীয়, যারা উত্ত্যক্ত করতেন পক্ষান্তরে তারা প্রায় অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। এই উদাহরণটি ইঙ্গিত দেয় যে, বেকারত্ব উত্ত্যক্ত করার একটি কারণ হতে পারে। প্রশ্ন দাড়ায়, এভাবে কি বেকারত্ব নিরসন বা উত্ত্যক্ত বন্ধ করা সম্ভব ?

এটি এমন একটি সমাজের চিত্র, যেখানে অতি আহ্লাদে লালিত পূত্র সন্তানটি নিজের ঘর গোছাতে শেখেনি, নিজের খাবার চুলায় চাপাতে চায় না, তাকে একটি অফিসের কাজ দিয়ে আইনমত ৮ ঘন্টা ইভ টিজিং থেকে বিরত রাখা যেতে পারে। আর বাকী ১৬ ঘন্টার হিসাব কে ঠিক করে দিবে ?

এই সমাজের অধিকাংশ পুরুষ তার জীবনের স্মৃতি থেকে বলতে পারবে কি "অমুক নারী দ্বারা উত্ত্যক্ত হইয়া আমি আমার সাধের তম্বুরা বাজানো ছাড়িয়া দিয়াছি?"


ধরুন একটি বালক। বয়স তার এগারো। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র হবার কথা। সে প্রত্যহ সকালে উঠে বিছানা গুছিয়ে, নিজেকে তৈরি করে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে দুপুরে বাসায় ফিরে, অতঃপর গোসল করে, খেয়ে নিজের প্লেটটি ধোয়। কিংবা বাসায় আরও ছোট বা বৃদ্ধ কেউ থাকলে তারটিও ধুয়ে গুছিয়ে রাখে। তারপর তো বিকালের খেলা বা গৃহশিক্ষকের লাঠি। পড়ালেখা শেষ করে, মাকে বা বাবাকে রান্নায় সাহায্য করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা । দুপুরের ন্যায় থালা বাসন পরিষ্কার করে, রাতে ঘুমাতে যাবার সময় কেউ মনে করিয়ে দেয়ার আগেই দাঁত মেজে পরের দিনের স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমাতে যাওয়া। এই রকম একটি জীবন প্রণালীর মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা কোন কিশোর কি বখাটে বেকার যুবকে পরিনত হতে পারে ?

যেই সমাজে একজন নিজের কাজ থেকে অন্যের কাজ পৃথক করতে পারে না, বা এভাবে বলা যেতে পারে অধিকাংশই যখন পরজীবী, সেই সমাজে ইভ টিজিং বন্ধের জন্য আইন হবার এক বছরের মাথায় মাত্র ১২৬৯ উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো কোন অভিযোগই নয়। নারীরা তবে এখনো অভিযোগ করতেই শেখেন নি। কোথায় করবেন, তা তো অনেক দূরের প্রশ্ন।

মা'রা যদি তার ছেলে শিশুটিকে কাজ করতে শেখাতেন, তবে বোধ করি আজকের সময়, চাঁপা রানীকে তার মেয়ে শিশুটির ভবিষ্যতের কথা ভাবতে যেয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না। হয়তো দেখতে হত না মা'র মৃত্যুতে ভাবী মা'দের আতঙ্ক আর কান্না জুড়ে থাকা কোন দৈনিকের প্রথম পাতা।

যখন নামে হয় প্রতিষ্ঠান এবং কাজ করলেই কর্মী, বসে থাকাও একটি কাজ বটে। জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর উপরের সারির রাষ্ট্র ধরা যেতে পারে এই ভূখন্ডকে। এর রাষ্ট্র-পরিচালনায় যারা আছেন তাঁরা অবশ্যই সর্বজ্ঞানী হবেন। তাঁদের এই জ্ঞানের ব্যাপকতায়, সমাজের চিত্র পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তথাকথিত চিন্তাশীলদের ছোট ছোট গোল টেবিল বৈঠক কতটুকুই বা আস্ফালন ফেলতে পারে? যখন সমাজের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লাগামধারীদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, জনসাধারণের সাধারণ থাকার অবস্থা লুপ্ত হয় বৈকি। অকুতোভয় কলেজ শিক্ষক, ন্যায় বিচারের দাবীতে বেঘোরে প্রাণ হারান। তখন অলেখক ও লেখক হয়ে ওঠেন। হন দেশছাড়া, দেশদ্রোহী নাম কাঁধে।

তানিয়া বুলবুল কিটি: কবি, লেখক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী।