প্রসঙ্গ: আল-কায়েদার হুমকি ও তৎপরতা

মিল্টন বিশ্বাস
Published : 16 Feb 2014, 05:48 PM
Updated : 16 Feb 2014, 05:48 PM

পাকিস্তানের 'ডন' পত্রিকার প্রতিবেদন অবলম্বনে বাংলাদেশের একটি দৈনিকে প্রকাশিত 'পাকিস্তান থেকে সরে যাচ্ছে আল-কায়েদা' [১৬ আগস্ট, ২০১৩] শীর্ষক সংবাদটি ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বাস্তব হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। এদিন আল-কায়েদার বর্তমান প্রধানের এদেশের মানুষের প্রতি জিহাদী ডাক স্মরণ করিয়ে দিল তাদের বিশ্বব্যাপী অপতৎপরতার ইতিহাস। ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে পাকিস্তানের মাটিতে ওসামা বিন লাদেনের হাতে যে সংগঠনটি গড়ে ওঠে, তা ২০১১ সালের ২ মে তার মৃত্যুর পর দুর্বল হয়ে পড়বে বলে অনেকেই ভেবেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল ইয়েমেনসহ অনেক দেশের জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সংগঠনটি তাদের যোগসূত্র বাড়িয়ে সন্ত্রাসবাদ লালন করে চলেছে।

তাই বাংলাদেশেরও একাধিক জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকা স্বাভাবিক। পাকিস্তানের সাংবাদিক ইমতিয়াজ গুল তাঁর 'দ্য আনহোলি নেক্সাস: পাক-আফগান রিলেশনস আন্ডার দ্য তালিবান' (২০০২) গ্রন্থে আল-কায়েদার জঙ্গী তৎপরতা বিষয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থে গুল দেখিয়েছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের জন্য পাকিস্তানি শাসকরা জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের ক্যাডারদের বেছে নিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান পাকিস্তানও ইসলামি দলগুলোকে ব্যবহার করছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এবং প্রতিবেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ অনেক পুরনো। বিশেষত জেনারেল জিয়ার শাসনকালে পাকিস্তানমুখী পররাষ্ট্রনীতির কারণে পাকিস্তান ও আফগানভিত্তিক জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে এদেশের ইসলামপন্থীদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বর্তমানেও সেই সম্পর্ক বিচিত্র মাত্রায় অব্যাহত রয়েছে। এজন্য আল-কায়েদার জিহাদের ডাক অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ধারণা করা হয়, জাওয়াহিরি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। এজন্য এই ব্যক্তির সঙ্গে এদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সম্পৃক্ততা থাকা স্বাভাবিক। বার্তাটি মিথ্যা প্রচারণা হিসেবে ধরে নিলেও, এর ভেতর দিয়ে এদেশের উগ্রবাদীদের সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গভীর সম্পর্কের স্বরূপটি উন্মোচিত হয়েছে। ২০১৩ সালের মে মাসে সংঘটিত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে বলে যে অপপ্রচারটি পূর্বের মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে চালানো হয়েছিল, তারই নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে এখানে। বিশেষত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানিদের জামায়াত-প্রীতি আমাদের সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত দুদিন ধরে আল-কায়েদার বর্তমান নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির নাম ও ছবিসহ 'ম্যাসাকার বাহাইন্ড আ ওয়াল অব সাইলেন্স' নামে এক অডিও বার্তা প্রচারিত হচ্ছে ইন্টারনেটে, যাতে বাংলাদেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে 'ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের' বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

[বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪]

এই অডিও বার্তায় জাওয়াহিরির নির্বাক ছবি রয়েছে। তবে শুরুতে বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক সংঘর্ষ ও হত্যাযজ্ঞের কিছু ফুটেজ দেখানো হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ সরকারকে উল্লেখ করা হয়েছে 'ইসলামবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার' হিসেবে।

আরও বলা হয়েছে, ''বাংলাদেশের মুসলিম ভাইয়েরা, ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ক্রুসেড ঘোষণা করেছে, তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। উপমহাদেশ ও পশ্চিমের শীর্ষ ক্রিমিনালরা ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যাতে আপনাদেরকে তারা অবিশ্বাসীদের দাসে পরিণত করতে পারে।''

ওই বার্তায় জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ উগ্র ইসলামী দলগুলোকে বাংলাদেশ সরকার ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশকে 'বিরাট এক জেলখানা' হিসেবে তুলে ধরে বলা হয়, ''এই দেশে মুসলমানদের সম্মান আজ ভূলুণ্ঠিত। . . .বাংলাদেশ আজ এমন এক ষড়যন্ত্রের শিকার, যাতে ভারতীয় এজেন্ট, পাকিস্তানের দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী, বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদরাও জড়িত।''

গত শতকের শেষ থেকে এই শতকের শুরুতে এক রহস্য ও আতঙ্কের নাম 'আল-কায়েদা'। নিউইয়র্ক টাইমসের একাধিক প্রতিবেদনে এই সংগঠনের বিশ্বব্যাপী জঙ্গী তৎপরতা তথা জিহাদী হত্যাকাণ্ডের অনুপুঙ্খ ঘটনা বিবৃত রয়েছে। এর একটি হল, ৪ ফেব্রুয়ারিতে ইরাক ও সিরিয়ায় জিহাদী গ্রুপগুলোর সঙ্গে আল-কায়েদার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন। এ বছরের জানুয়ারি জুড়ে প্রকাশিত হয়েছে আরও কয়েকটি খবর।

২০০৬-০৮ এবং এখন পর্যন্ত ইরাকের গোত্রগত সংঘাতের পিছনে আল-কায়েদার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে। [২৫ জানুয়ারি, ২০১৪]

ইরাকি প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতের জন্য আল-কায়েদা সমর্থনপুষ্ট জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতার সংবাদ পাওয়া যায় অন্য একটি সংবাদে। [২০ জানুয়ারি, ২০১৪]

অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সরকারের নিজের লোকদের ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত রয়েছে এসব ক্ষেত্রে। ওদিকে আল-কায়েদা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগে পশ্চিমা বিশ্বের নাগরিকদের হত্যার টার্গেট করেছে। [১০ জানুয়ারি, ২০১৪]

মার্কিন প্রশাসন ইরাকের গৃহযুদ্ধ অবসানের প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেও, আল-কায়েদা সম্পৃক্ত ইসলামি জঙ্গীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। [৯ জানুয়ারি, ২০১৪]

নিচের লিংক থেকে পড়ুন—

এছাড়া বিশ্বব্যাপী আরও কিছু প্রকাশিত সংবাদে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গী সংগঠন হিসেবে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানানো হয়েছে। কেনিয়ার নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মলে পণবন্দি করেছিল জঙ্গীরা। ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সেখানকার সেনাবাহিনী তুমুল লড়াইয়ের পর পণবন্দিদের মুক্ত করে। মুখোশধারী জঙ্গীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন দুই ভারতীয়সহ ৫৯ জন, আহত হন প্রায় ৮০ জন। হামলার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠ সোমালিয়ার জঙ্গী সংগঠন 'আল সাহবাব'।

বর্তমান মিসরে আল-কায়েদার দর্শনে উদ্বুদ্ধ ইসলামি জঙ্গী সংগঠন 'বেইত আল-মাকদিস' পুলিশ সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছে কিছুদিন আগে। ২০১২ সালের মে মাসে ইয়েমেনে বিমান নাশকতার ছক ছিল আল-কায়েদার। সেই ষড়যন্ত্র বানচাল করেছে মার্কিন গোয়েন্দারা। ওসামা বিন লাদেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সেখানে আত্মঘাতী বিমান নাশকতার চেষ্টা হয়েছিল। তার আগে ২০১২ তারিখের ১৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসের সভাকক্ষ ওয়াশিংটন ডিসি ভবনে আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী এক মরোক্কান যুবককে গ্রেফতার করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। লেবাননে আল-কায়েদা নেতাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। দেখুন–

ইদানিং টুইটারে নিজেদের অ্যাকাউন্ট খুলেছে আল-কায়েদা। ২০১২ সালের প্রথম মাসেই আমরা জানতে পারি যে, পাকিস্তানে একটি উর্দু পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামিক জিহাদের পক্ষে বাড়িতে বাড়িতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এই জঙ্গী সংগঠন। পাকিস্তানে আল-কায়েদা জঙ্গীদের সমাধিস্থল গণ্য হচ্ছে পবিত্র ধর্মস্থান হিসেবে। এমনকি ভারতেও আল-কায়েদার তৎপরতা বাড়ছে। কোলকাতার সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় ২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত 'লাদেনবাহিনীর সঙ্গে মিশছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে–

''আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন৷ দুর্ধর্ষ জঙ্গী নেতা ওসামা বিন লাদেন প্রতিষ্ঠিত আল-কায়েদা জঙ্গীগোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে৷ এই গোষ্ঠীর কাজের ব্যাপ্তিও বিশ্বজুড়ে৷ সেই তুলনায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের কাজকর্ম মূলত ভারতকেন্দ্রিক৷ খুব শীঘ্রই এই দুই জঙ্গীগোষ্ঠী এক হয়ে যাচ্ছে৷ সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে গোয়েন্দারা একটি বিশেষ রিপোর্ট পাঠিয়ে এই গোপন খবর দিয়েছেন৷''

এভাবে পৃথিবীব্যাপী তাদের হাত প্রসারিত হচ্ছে বলেই মনে হয়। ২০০৩ এর ২০ মার্চ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরাক আক্রমণ করেছিল। তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে বন্দি করা হয় ও ৩০ ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু এই ২০১৪ সালেও সেখানে আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন পুরোমাত্রায় সক্রিয়। উপরন্তু আছে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যেকার সংঘর্ষ।

অন্যদিকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে তাদের সমস্ত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তখন থেকে ইরাকে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এক নতুন চেহারা নিয়েছে। শিয়া ও সুন্নি দু'পক্ষই তাদের জঙ্গী সংগঠন জোরদার করতে ব্যস্ত। আল-কায়েদা এ সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। তবে ৪ জানুয়ারি, ২০১৪ বাগদাদ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী ও সহযোগী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৬২ জন আল-কায়েদা জঙ্গী নিহত হয়েছে। তবে ইরাকের বিধ্বস্ত শহর ফালুজা দখল করে নিয়ে সেখানে একটি স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে আল-কায়েদা। এখন ফালুজার সরকারি অফিস আদালতে উড়ছে ওদের পতাকা।

পাকিস্তানি জঙ্গীরা প্রচার করছে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলি থেকে যতদিন না মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে, ততদিন লড়াই চলবে। তারা মনে করে, মুসলিমদের হয়ে লড়াই করার জন্য আরও একজন লাদেন প্রয়োজন। গোটা বিশ্বে আল-কায়েদার শাখাগুলির কার্যকলাপ উৎসাহী করছে তারা। ২০১৩ সালে আল-কায়েদার আতঙ্কে ঢাকায় কানাডাসহ একাধিক দেশের হাইকমিশন বন্ধ ছিল। সে সময় ২১ মুসলিম দেশে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ রাখা হয়েছিল। লিবিয়ার বেনগাজিতে হামলা চালিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনা সকলেরই মনে থাকার কথা।

আল-কায়েদা সদস্যরা বিকৃত রুচির জঙ্গী সংগঠন হিসেবেও গণ্য হয়েছে। তারা নারীদের জিহাদী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং বলাৎকারকে বৈধ বলছে। একটি বাংলা ব্লগ পোস্টে আল-কায়েদার একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে যাতে দেখা গেছে, আল-কায়েদার একটি উদ্ভট ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ইসলামে বিজয়ের লক্ষ্যে জিহাদ করতে গেলে 'পায়ু-ধর্ষণ' পর্যন্ত নাকি জায়েজ!

বাংলাদেশে নানা সময়েই আল-কায়েদার মতাদর্শে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর কার্যকলাপ চালানোর খবর পাওয়া যায়। ২৬ আগস্ট, ২০১৩ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৯ জঙ্গীকে আটক করা হয়েছিল। তখন জানা গেছে, আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদা, তেহরিক-ই-তালেবানসহ যেসব জঙ্গী গ্রুপ রয়েছে তাদের আদলেই গড়ে ওঠা সংগঠনটি সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এদের পরিকল্পনা হল, জিহাদের মাধ্যমে সরকারকে হটিয়ে এ দেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। এ লক্ষ্যে ৪ বা ৫ জনের ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে রাসুল (স:)-এর অবমাননাকারীদের ও ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করে এরা। এছাড়া বিভিন্ন থানায় হামলা করে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থাপনায় আক্রমণ করাও এদের লক্ষ্য।

বর্তমানে তারা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, বোমা ও গ্রেনেড তৈরি ও কীভাবে পরিচালনা করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এদের অনেক কর্মী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। ব্লগার রাজীব হত্যার সঙ্গে এদের সদস্য নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে। উগ্রপন্থী বয়ান প্রচারের মাধ্যমে দেশের যুবসমাজ ও সাধারণ মানুষকে জঙ্গী তৎপরতায় উৎসাহিত ও প্ররোচিত করছে এসব সংগঠনের মৌলবাদী নেতারা। এর মাধ্যমে জঙ্গীরা সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে দেশে সার্বভৌমত্ব বিপন্নের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এসব জঙ্গীরা আল-কায়েদার আদর্শ, নীতি ও কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে।

উদ্বেগের বিষয় এটাই যে, দেশে দেশে তৎপরতা চালানো আল-কায়েদা ও তাদের সহযোগী জঙ্গীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে লড়তে এবং দেশের অভ্যন্তরে নাশকতা চালাতে গোপনে ওরা এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে। বাংলাদেশি জঙ্গীদের বেলায়ও এটা সত্যি। তাছাড়া অন্য দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গীরা আমাদের দেশের জঙ্গীদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দিচ্ছে গোপনে। ২০১৩ সালের আগস্টে বগুড়া থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র তারই প্রমাণ।

গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে যে ক'টি জঙ্গী সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে– জামায়াতুল মুজাহেদিন, বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ, লস্কর-ই তৈয়বা, জাদিদ আল কায়দা, হিযবুত তাহরীর, শাহাদাতুল হিকমা এবং হিযবুত তাওহীদ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নতুন নামে গড়ে ওঠা জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জাদিদ আল কায়েদা, জুমাআতুল আল সাদাত, তামির-উদ-দীন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামিক মুজাহেদিন বা মুজাহিদ অন্যতম।

এভাবে এখনও জঙ্গীরা গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। এসব সংগঠনের যেসব সদস্য বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তারা এখন শুধু হাত-বোমাতেই সীমাবদ্ধ নেই, ভারী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও ব্যবহার করতে জানে। কিছুদিন আগে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের স্বীকারোক্তি থেকে আমরা জেনেছি যে, বিদেশে প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা দেশে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেনসহ পাশ্চাত্য দেশ থেকে প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা দেশে এসেছে। তারা বর্তমান সরকারের সময়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই এদের আর হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাচ্ছি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন আদালত ফোনে আড়িপাতা আইনসম্মত বলে ঘোষণা করেছে। আল-কায়েদার জঙ্গী আক্রমণ রুখতে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা এনআইএ-র ফোনে আড়িপাতা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে আদালত জানিয়েছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে সাধারণ নাগরিকের ফোনে গোয়েন্দা সংস্থার আড়ি পাতা প্রয়োজন। কারণ জঙ্গীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। ফলে তাদের দিক থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ফোনে নজরদারি দরকার। গোয়েন্দা নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। আর ইতোমধ্যে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের কর্মকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সরকারকে আরও কিছু দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের নির্মূল করতে হবে।

শেষ করছি একটি তথ্য দিয়ে। গত বছর মিশরের নিরাপত্তা বাহিনী সে দেশ থেকে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির ভাই মোহাম্মেদ আল-জাওয়াহিরিকে গ্রেফতার করেছে। তিনি মিশরের চরম রক্ষণশীল জিহাদী সালাফি সংগঠনের নেতা। সেখানে থেকে তিনি সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। 'ডেইলি মেইল'-এ ১৭ আগস্ট, ২০১৩ তারিখে এ সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

আশা করা যায়, মোহাম্মেদের মতো একইভাবে আয়মান আল-জাওয়াহিরিও গ্রেফতার হবেন। কারণ তিনি ও তার নেতৃত্বের জঙ্গী সংগঠনটির কাজকর্ম প্রমাণ করে, তারা আসলে মানবজাতির জন্য দানবতুল্যই বটে।

ড. মিল্টন বিশ্বাস: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।