প্রজন্ম চত্বর: তিমিরবিনাশী প্রমিথিউসেরা

Published : 6 Feb 2014, 05:37 AM
Updated : 6 Feb 2014, 05:37 AM

৫ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রজন্ম চত্বরেরর প্রথম জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি স্বাধীনতা-পরবর্তী অমাময়ী দিনগুলোর মধ্যে প্রথম এমন একটি দিন যা আমাদেরকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা যুগিয়েছে।

প্রচলিত রাজনীতির দ্বারা বঞ্চিত ও হতাশ বাংলাদেশিদের যে রাজনৈতিক অর্থে নির্দলীয় এক তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে ন্যায়বিচারের পক্ষে এমনভাবে জাগিয়ে তুলতে পারবে, তা ছিল অভাবনীয়।

অভাবনীয় অন্য আরেকটি কারণেও। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে এই তরুণ প্রজন্ম যেহেতু স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেনি, তাই তারা যুদ্ধকালীন অপরাধ সম্পর্কে সজাগ নয়, অতএব এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, আমাদের এই ধারণা তারা শুধু মিথ্যাই প্রমাণ করেনি, এমনকি তারা প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে এমনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াল যে যুদ্ধ ও অপরাধ সম্পর্কে আমার নিজের প্রজন্ম সজাগ ও সচেতন থেকেও যা করতে পারেনি তা এদের দ্বারা সম্ভব দেখে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। যুদ্ধাপরাধ না দেখেও তারা এত ক্ষুব্ধ হতে পারে, দেশপ্রেমে এতটা উদ্বুদ্ধ হয়ে লেলিহান শিখায় বিস্তৃত হতে পারে তা আমরা কখনও ভাবিনি। কোনো রকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই কেবল দেশপ্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শে বাংলাদেশকে ঘুমের অভিশাপ থেকে জাগিয়ে তুলতে পারবে– এটা কি আমরা কখনও ভাবতে পেরেছিলাম?

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি কেন্দ্র করে যদিও এই জাগরণ, কিন্তু এই তরুণ প্রমিথিউসদের দাবি এতেই আটকে থাকেনি। তারা ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করতে চেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে দাবি করলেও, বহুদিন যাবত যুদ্ধপরাধীদের বিচারকার্য করার কথা তারা ভাবতে পারেনি। যদিও অতিবিলম্বে হলেও আওয়ামী লীগ সে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু মানুষের আশা ছিল এই যে, আওয়ামী লীগ কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই করবে না, তাদের উচিত হবে সংবিধান খেকে রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তিটি সরিয়ে ফেলা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সাংবিধানিক আইন প্রনয়ণের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা। রাজনৈতিক মুনাফার লোভে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনগণের কাঙ্ক্ষিত এই কাজটি করা সম্ভব হয়নি। তাদের ভয়– ধর্মের প্রশ্নে তারা হয়তো জনসমর্থন হারিয়ে ফেলতে পারে আর এই সুযোগে অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো ধর্মকে পুঁজি করে ফুলেফেঁপে উঠবে পচে যা্ওয়া পরিত্যক্ত পশুর মতো। ফলে এখনকার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পক্ষে এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একটি প্রগতিশীল রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল তো সেই কাজই করবে যা অস্বাভাবিক– অবশ্যই সদর্থে। কিন্তু তারা এই কাজটি করার দুঃসাহস দেখাতে পারেনি তরুণ প্রজন্ম আসার আগে পর্যন্ত।

তরুণ প্রজন্ম অনেক সাহস করে জামায়াতে ইসলামী দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে বলে আমি মনে করি। আমি আরও বেশি খুশি হতাম যদি তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা রাজনৈতিক সবগুলো দলকেই নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানাত। তাদের পক্ষ থেকে এই দাবি এলে কোনো দলই এর বিরুদ্ধে কিছু বলার বা এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক মতলব খুঁজে বের করার কথা বলতে পারবে না। কারণ প্রজন্ম চত্বরের তরুণরা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এটি কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ নয়। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটারই হাত, মাথা বা পুচ্ছ নয়। তা যে নয়, সেটাও তারা প্রমাণ করেছে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা মঞ্চ দখল না করতে দেওয়ার মাধ্যমে। সুতরাং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবি জানালে এতে কেবল জামায়াতে ইসলামীই নয়, পালের গোদাসহ অন্যান্য দুষ্টচক্রও এমনি এমনিই ঝরে পড়বে।

এই মুহূর্তে তরুণ প্রজন্মের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপগুলো নিতে হবে সাধারণ মানুষকেই। আমরা যদি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা পরিচালিত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জন করি তাহলে তারা দ্রুতই পঙ্গু হতে শুরু করবে। তরুণ প্রজন্ম এই পথে এগিয়ে পাকিস্তানি পণ্য বর্জন করার জন্য প্রচারাভিযান চালাচ্ছে দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আশান্বিত বোধ করছি। এখন দরকার পাকিস্তানপ্রেমি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর শীর্ষনেতাদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জন করা।

এই সংগঠনগুলো মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাস পুঁজি করে যেভাবে ধর্মের মুখোশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছে তাকে রুখে দেওয়ার এখনই সময়। এই অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ইতিহাসে বারবার ঘটে না। এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে আমরা আবারও প্রচলিত রাজনীতির দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকা পড়ে যাব। যেমনটা আমরা গত চল্লিশ বছর ধরে আছি। তরুণ প্রজন্মের দেশপ্রেমের লেলিহান আগুন চল্লিশ বছরের গাঢ় অন্ধকার নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এই প্রজন্ম আমাদেরকে, বিশেষ করে প্রচলিত রাজনীতিবিদদেরকে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি দিয়েছে তা হল এই যে, কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াই গণস্বার্থের পক্ষে দাবি জানানো সম্ভব এবং সেই দাবির পক্ষে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলাও সম্ভব। দুষ্ট রাজনীতির জন্য এটি যেমন একটি শিক্ষা তেমনি তা হুমকিও বটে। এখন দেখার বিষয়, এই হুমকির মুখে তারা তাদের রাজনৈতিক আচরণ বদলাতে পারে কিনা। না পারলে তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা শেষ হয়ে যাবে এই দশকেই।

তরুণ প্রজন্ম যেহেতু মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর জন্য একটা প্রবল হুমকি হয়ে উঠেছে, ফলে তারা নানা ধরনের বাধা ও ষড়যন্ত্রের মুখে পড়বে। মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের চিরকালের ধারালো অস্ত্র হচ্ছে ধর্ম। ইতোমধ্যে এ নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। বলা হয়েছে, তরুণ প্রজন্ম 'নাস্তিক'। এর উত্তরে তাদের প্রমাণ করার কোনো দরকারই নেই যে তারা 'আস্তিক'। কোনো নাগরিকের আস্তিকতা বা নাস্তিকতার প্রমাণ কেন তাদের কাছে দিতে হবে? তারা কি আল্লাহ হয়ে গেছেন? এর প্রমাণ তো একমাত্র আল্লাহতায়ালাই তলব করার অধিকার রাখেন। আমরা কি কথনও তাদেরকে বলতে পেরেছি যে, 'তুমি এই প্রশ্ন তুলে শেরেকি করছ'? আর যদি কেউ নাস্তিক হ্য়ও আল্লাহতায়ালা কি কুরআন শরীফে বা নবী মোহাম্মদ তার কোনো হাদিসে সেই বিচারের ভার মানুষের উপর ন্যস্ত করার কথা বলেছেন?

যারা নিজেরাই আচরণে ইসলামবিরোধী, তাদের কাছে এর জবাবদিহি করা মানে একটি অবৈধ জিনিসকে বৈধতা দেয়া এবং তাদের কাছে কৌশলগত পরাজয় বরণ করা। ধর্ম-কর্ম ব্যক্তিগত বিষয়। এই বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। এটা যদি আমরা না বুঝি তাহলে ওদের ফাঁদে পড়তে হবে বারবার। আমরা যেন এই ফাঁদের ব্যাপারে সতর্ক থাকি।

রাজু আলাউদ্দিন: লেখক ও সাংবাদিক।