লোড শেডিং কমাতে বাবলা বৃক্ষ রোপণ!

কিউ আর ইসলাম
Published : 15 May 2008, 04:40 AM
Updated : 28 Oct 2010, 03:40 PM

আগামী ২০১২ সালে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। টেলিভিশনে পাওয়া খবরটা এই গরমের মধ্যে শরীরে যেন বিদ্যুত সঞ্চার করল। দিনে রাতে মিলিয়ে আমাদের এলাকায় ৮-১০ ঘন্টা বিদ্যুৎ সবরারহ থাকে না। যত গরম পড়ে বিদ্যুতের আকাল তত বৃদ্ধি পায়। খবরটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে নাসীরউদ্দিন হোজ্জার কথা মনে পড়ে হেসে দিয়ে শংকিত হয়ে পড়লাম।

হোজ্জা তার এক আত্মীয় থেকে বেশ কিছু অর্থ ধার নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই পরিশোধ করতে পারছেনা। আত্মীয়টিকে দেখলেই হোজ্জা পালিয়ে যায়। একদিন বাড়ী থেকে বের হওয়ার আগেই আত্মীয়টি উঠানে ঢুকে পড়ে। তাকে কী বলে বিদায় করবে, স্ত্রীকে তা শিখিয়ে দিয়ে হোজ্জা ঘরে লুকিয়ে থাকে। আত্মীয়টি হোজ্জার খবর নিতেই তার স্ত্রী বলে, "উনিতো সেই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন আপনার টাকা শোধ করবার জন্য বাবলা গাছের বীজ আনতে।" "টাকা পরিশোধের সাথে বাবলার বীজের কি সম্পর্ক?" আত্মীয়টি প্রশ্ন করেন। "জ্বি, এই উঠানে উনি বাবলার বীজ লাগালে যে গাছ হবে তার কাঁটায় আটকে যাওয়া ভেড়ার পশম জমিয়ে বিক্রি করে আপনার দেনা শোধ করবেন," হোজ্জার স্ত্রী উত্তর দেয়।

আমাদের উঠান দিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেশীদের ভেড়ার পাল যাতায়াত করে," সান্তনার সুরে বলে হোজ্জার স্ত্রী। " হোজ্জা বীজ লাগাবে – তারপর চারা গজাবে – চারা বড় হবে – গাছে কাঁটা বের হবে – কাঁটায় পশম আটকাবে -সেই পশম জমা হবে – তারপরে বিক্রি করে টাকা হবে – সেই টাকা দিয়ে পাঁচ বছর আগের দেনা শোধ করবে," কথাগুলো মনে মনে আউড়ে বড় দুঃখে হোজ্জার আত্মীয় হেসে দেয়। হাসির শব্দ পেয়েই হোজ্ঝা আর লুকিয়ে থাকতে পারেনা। লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে আত্মীয়টিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে, "এখন তো হাসবেনই নগদ টাকার গন্ধ পেয়েছেন তো।"

বিদ্যুতের সমস্যা আমাদের অনেক পুরোনো। কেউই সমাধান করতে পারলো না। কত রকম সরকার গেলো। সামরিক সরকার, প্রবাসী সরকার, অস্থায়ী সরকার, সংসদীয় সরকার, বাকশাল সরকার, রাষ্ট্রপতি সরকার, নো সরকার (৩-৬ ই নভেম্বর ১৯৭৫), অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তত্তাবধায়ক সরকার, চারদলীয় জোট সরকার, আর্মীটেকার (আর্মী ও কেয়ারটেকার সংক্ষিপ্ত করে) বা সামরিধায়ক (সামরিক ও তত্বাবধায়ক সংক্ষিপ্ত করে) এবং বর্তমানে মহাজোট সরকার। নানা রকম সরকার প্রাপ্তিতে আমরা ভাগ্যবান হলেও কোনো সরকারই আমদের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান করতে পারলো না। সমস্যা বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে সব সরকারই হোজ্জার মত বাবলা বৃক্ষের বীজ বপন করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে।

গত শতাব্দির নব্বই দশকের মধ্য ভাগ থেকে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট রূপ ধারণ করতে থাকে। ওই সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিদিন দু'একবার বন্ধ হতে শুরু করে। তখন বিরোধী দল সরকারকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার অভিযোগ তুলে বলতে থাকে যে তারা ক্ষমতায় এলে এর সমাধান করবেন। ক্ষমতায় এসে তারা কোন সমস্যার কোন সমাধান না করতে পারলেও এটা নিশ্চিত হলো যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হলে এক ঘন্টার মধ্যে পুণরায় ফিরে আসবে। তখন থেকে 'প্রতিবার এক ঘন্টা' করে দিনে রাতে বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হতে থাকল । বিরোধী দল অভিযোগ করল বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তারা ঠিক করে দেবেন। ক্ষমতায় এসে তারা 'প্রতিবার এক ঘন্টা' এই প্রথা বহাল রাখলেন। তবে বন্ধ হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল। বিরোধী দলের নেতা (বর্তমান প্রধান মন্ত্রী) বললেন আমরা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতাম তা গেল কোথায়? এরপর এলো সামরিধায়ক সরকার।

বলা হলো বাংলাদেশ ২০১০ সালের মধ্যে লোড শেডিং মুক্ত দেশ হবে। ওই সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছিলেন, "আমরা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যূৎ উৎপাদনের জন্য লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছি যাতে করে ২০১০ সালে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাবো যখন দেশে কোন লোড শেডিং থাকবে না।" মনে হলো কিছুটা উন্নতি হতে পারে। 'প্রতিবার এক ঘন্টা' এই ব্যবস্থা অব্যহত থাকলেও দিনে রাতে সরবরাহ বন্ধ হওয়ার সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় আশান্বিত হলাম। এরপর এলেন মহাজোট সরকার। ক্ষমতায় আসার আগেই বর্তমান সরকার প্রধান বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তার সরকার সেচের জন্য বিদ্যুত ঘাটতির কারণ বের করলেন। মনে হলো সেচ মৌসুম পার হলে সমস্যা কমে যাবে। এরপর ঘড়ির কাটা এগিয়ে দেয়া হলো। নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ করা হল। সরকার প্রধান সরকারী কর্মকর্তাদের স্যুটকোট পরিহার করে অফিসে আসতে বললেন এবং অফিস রুমে এয়ারকুলারের ঠান্ডা মাত্রা কমিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। দোকানপাট খোলা রাখার সময়সূচী পরিবর্তন করা হলো, সন্ধ্যার পর বন্ধ করতে বলা হলো। এনার্জি বাল্ব বিতরণ করা হল। সন্ধ্যার পরপর এয়ারকুলার ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয়া হল। এতকিছুর পরেও কোন উন্নতি বোধগম্য হলনা। ঘড়ির কাটা আবার পুর্বের স্থানে ফিরিয়ে নিতে বলা হলো। 'প্রতিবার এক ঘন্টা'র সংখ্যা বেড়েই চলল। ঘরে বিদ্যূৎ নেই, রাস্তায় যানজট, বাজারে জিনিষপত্রের দামে আগুন, কোথায় যাব? অভিযোগ অনেকের। এতে সাড়া দিয়ে অফিস-স্কুলের সময় সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যে ছটা আর হারিকেন থাকলে রাত্র দশটা পর্যন্ত করার পরামর্শ দিলেন।

এর মধ্যে সুযোগ সুবিধামত চাকুরীজীবি অফিসে উপস্থিত হয়ে আট ঘন্টা কাজ করে আসবে আর ছাত্র হলে ছ'ঘন্টা লেখাপড়া শিখে আসবে। কারেণ্ট না থাকলে বা রাস্তায় আটকে থাকলে আর কী উপায়? আর একজন বললেন, যে ভাবে 'প্রতি ঘন্টার সংখ্যা' বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২৪ ঘন্টায় পৌঁছাতে আর দেরী নয়। ফলে সরবরাহ হয়ত একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে অবশ্য উপকার হবে। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবেশ আর দূষিত হবে না। শিল্পপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকার বকেয়া পরিশোধ করতে হবে না। ঋণ খেলাপিরা খুশী হবেন। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ কাজে ব্যবহৃত খুঁটি, তার ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কারন ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে যে এদেশে একদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো।

বাংলাদেশে মাথাপিছূ বিদ্যূৎ শক্তির ব্যবহার খুবই কম (বছরে ১৩৬ kWh) । একজন আমেরিকান যা ব্যবহার করে তার মাত্র এক শতাংশের কিছু বেশী। এই হারে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০% বিদ্যূৎ ব্যবহার করে থাকে। মাথাপিছু বিদ্যূৎ ব্যবহারের পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান ১৫০ এর পরে। বাংলাদেশের পরে আছে কেনিয়া, নাইজেরিয়া, কংগো, সুদান, লাইবেরিয়া, গাম্বিয়া, ইত্যাদি। একজন ভারতীয় বা পাকিস্তানী নাগরিক বাংলাদেশীর তুলনায় তিনগুনেরও বেশী বিদ্যূৎ ব্যবহার করে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩,৬০০ থেকে ৪,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যূৎ উৎপাদন হয়ে থাকে। এর মধ্যে ৩,৩০০ থেকে ৩,৭০০ ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইকনোমিক রিভিউ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৫/৯৬ সালে সর্বাধিক উৎপাদন ২,০৯০ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০/০১ সালে ২,৬৬৫ এবং ২০০৫/০৬ সালে ৩,৮১৫ মেগাওয়াটে পৌঁছে। গত পাঁচ বছরে তিনটি সরকার দায়িত্ব পেলেও এবং বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্র"তি দিলেও উল্লেখযোগ্য হারে কোন বৃদ্ধি হয়নি। গত ২০০০/০১ থেকে ২০০৫/০৬ সালের মধ্যে ডেসকোর সিস্টেম লস ২৭% থেকে ১৬% এবং ডেসার সিস্টেম লস ২৬% থেকে ২০% এ হ্রাস পায়। সাথে সাথে আরইবি'র সিস্টেম লসও কমে ১৪% পর্যন্ত নেমে আসে। ডেসকো ও ডেসার আয় যথক্রমে ৪৫০ ও ৪৯০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়। এমনকি ডেসকো ২০০৫/০৬ সালে ৬৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। পিডিবি'র ২০০৮/০৯ বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী বিদ্যূৎ ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লস ১৯৯১/৯২ সালে ২৮% ছিল। এই লস্ হ্রাস পেয়ে ২০০৮/০৯ সালে ৭% এ নেমে আসে। পিডিবি'র রিপোর্টে গত বিশ বছরে বিদ্যূৎ ট্রান্সমিশন লাইনে উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ করার ফলে লস্ কমেছে বলে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। এর পরেও বিদ্যূৎ সরবরাহ বর্তমানে দিনরাতে ৮-১০ ঘন্টা বন্ধ থাকলে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখনও বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ প্রতিদিন ১,২০০ থেকে ১,৩০০ মেগাওয়াট। সেই সাথে গত বিশ ধরে রয়েছে বিদ্যূৎ উৎপাদন ও উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে একটা বড় ফাঁক। মোট উৎপাদিত বিদ্যূৎ বিক্রি করে যে পরিমাণ অর্থ আয় হওয়া উচিত তার ৭০% থেকে ৮০% পাওয়া গেলেও ২০% বিক্রিত অর্থের কোন হদিছ থাকে না।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি না থাকলে শিল্প খাতে বছরে ৭,০০০ কোটি টাকা বেশী আয় হত। এই হারে কর্মসংস্থানও হতো। দেশের দারিদ্র নিরসণে চাহিদামত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অপরিহার্য। বিদ্যুৎ সরবরাহে উন্নতির জন্য হোজ্জার মত উদ্যোগ নয়, পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও নয়, আশু ও বাস্তব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।