সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রাজনৈতিক মোড়কে সঙ্গীন জনপদ

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
Published : 28 Jan 2014, 01:02 PM
Updated : 28 Jan 2014, 01:02 PM

ভেবেছিলাম সহিংসতা নিয়ে আর লিখব না। গণ্ডারের চামড়ায় খোঁচা দিলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হয় না। তাই অপেক্ষায় ছিলাম দেরিতে হলেও কিছু প্রতিক্রিয়া হবে। রাষ্ট্র নিপীড়কের ভূমিকা ছেড়ে সত্যিকারের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।

একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও এর প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ এখনও প্রায় শূন্য। নির্বাচনকালীন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এ নিয়ে তাদের কাছ থেকে এখনও কোনো প্রকার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। হয়তো কোনো একদিন আমরা সভ্য হয়ে উঠলে এর ব্যাখ্যা পাব! র‌্যাব, বিজিবি আর পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী আর সেনাবাহিনী নামিয়েও যদি সহিংসতা প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে কাদের দিয়ে সেটি হবে তা বোঝা দরকার।

দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে একদল মানুষ রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কখনও সম্মিলিতভাবে, কখনও-বা একক উদ্যেগে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে আগুন, বাড়ি ও দোকানের সম্পত্তি লুট, মন্দিরে আগুন, লুটপাট ও ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ মে, ২০১৩-এর পর থেকে দেশে যে বহুমাত্রিক সংঘাত শুরু হয়েছে তাতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায় অন্যতম টার্গেট।

কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার উদ্দেশ্যে এসব হামলা চালানো হচ্ছে, এসব পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক হামলা নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার অবশ্যই রাজনীতির মেরুকরণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে, কিন্তু এটাকেই একমাত্র কারণ মনে করলে ভুল হবে। ২০১২-এর সেপ্টেম্বরে রামুতে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে, তার পেছনেও অনেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করা মূল যুক্তি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

ঘটনা-পরবর্তী বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট ও স্থানীয়দের বর্ণনা থেকে রামুর ঘটনায় যারা জড়িত ছিল বলে জানা গেছে তাতে এটি কোনোভাবেই যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্রের কারণে ঘটানো হয়েছে বলে মনে হবার কোনো সুযোগ নেই। রামুর সহিংসতার পর বাঁশখালী, তাইনদং, সাতক্ষীরা, চিরির বন্দর, মাগুরা, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, সাঁথিয়া, যশোর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও ফেনীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংস হামলা ও লুটপাট হয়েছে। কখনও ধর্মীয় অবমাননার গুজব রটিয়ে, কখনও ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

আমাদের খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার কী কী কারণে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানেন কারা এসব হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবের কারণে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পান না। কখনও কখনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রশ্রয় থাকায় কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই মূল আসামীরা গ্রেপ্তার হয় না। এর ফলে দেশের যুবকদের একটি অংশ যেমন সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় হাত পাকাচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক সূত্রে দায়মুক্তি ও বিচারহীনতার কারণে সহিংসতার পুনরাবৃত্তিও বন্ধ হচ্ছে না।

আর এ কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বড় অংশ নিরবে দেশত্যাগ করছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেশত্যাগের ধারাবাহিকতা থাকা সত্ত্বেও, একাত্তরের পর রাষ্ট্রীয় সূত্রমতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২২ শতাংশ; তা বর্তমানে হ্রাস পেয়ে ৮.৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই বিরাট সংখ্যক মানুষ কোথায় গেলেন? তাদের কিছু অংশ সহিংসতার শিকার হয়ে মারা পড়েছেন। আর বেশিরভাগই অপমানে, প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে চলে গেছেন।

দুর্মুখেরা এ নিয়েও নানান সমালোচনার তুবড়ি ছোটান এই বলে যে, হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে উন্নত জীবনের আশায়। শেকড়বিহীন জীবনে যে কী সুখ, তা যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তারাই কেবল বোঝেন। আমাদের দ্বি-দলীয় রাজনীতিতে এই বিষয়টি কখনও জাতীয় ইস্যু হয়নি। প্রফেসর আবুল বারকাতের হিসাব যদি আপাতত সঠিক বলে ধরে নিই, তাহলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভূমি দখলকারী হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, তারপর বিএনপি এবং কিছু অংশে জামায়াত ও জাতীয় পার্টি।

ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে লুটেরাদের ঘনিষ্ঠ ও স্থায়ী সম্পর্কের কারণে সরকার পরিবর্তন হলেও লুটের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয় না। হুমকিতে থাকা প্রাণের বিনিময়ে লুট হতে থাকে হিন্দু ও আদিবাসীদের সম্পদ। ভোগবাদী ব্যবস্থায় মানুষের জীবনে ধর্ম প্রকৃত অর্থে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে তা বলাই বাহুল্য। তাই ধর্ম নয়, আরও বেশি কিছু নগদপ্রাপ্তি মূখ্য হয়ে ওঠে। ধর্মের কল আজ আর বাতাসে নড়ে না। এমনকি নাড়ালেও নড়ে না। বিশ্বাসের সঙ্গে ধারণ করার নামই যদি ধর্ম হয়, তাহলে সেই ধর্মের নামে এত সহিংসতা কেন তা ব্যাখ্যা করতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়া লাগে না।

সমাজবিজ্ঞানী স্বপন আদনানের ভাষ্যমতে, হিন্দুদের আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে দাবি করার যে প্রবণতা এতদিন ছিল তা এখন আর নেই। হিন্দুদের সংখ্যা কমতে কমতে যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তাতে দেশের কোনো অঞ্চলেই তারা ভোটের রাজনীতিতে 'মূল নিয়ামক' (Deciding Factor) নন। ফলে তাদের 'ভোট ব্যাংক' হওয়ার সুযোগ নেই। এই যুক্তি সংখ্যানুপাতিক হারে ক্রমহ্রাসমানতার জন্য কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ঠিক, কিন্তু তারপরও তাদের আওয়ামী লীগের সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে আজীবন মার খেয়ে যেতে হবে, এটাই নিয়তি। তাছাড়া তারা যদি ৫ শতাংশও কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংরক্ষিত ভোটার হিসেবে থাকেন তাহলেও তারা 'ভোট ব্যাংক' হিসেবেই বিবেচিত হবেন। সেটি তাদের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘায়িত করবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

স্বপন আদনানের কথা থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ভিন্ন আঙ্গিক ধারণ করায় এবং সংখ্যার বিচারে হিন্দুরা এখন ভোটের রাজনীতির জয়-পরাজয়ে মূখ্য ভুমিকা না রাখার কারণে, হিন্দুদের প্রতি সব দলেরই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। তবে সেই পরিবর্তন ইতিবাচক হয়নি। সহিংসতার অন্তরালে হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসীদের ভূমিগ্রাসের যে প্রক্রিয়া তা নানা অজুহাতে চলমান থাকে।

এই ভূমিগ্রাস অব্যাহত রাখতে 'শত্রু সম্পত্তি আইন' (নামান্তরে অর্পিত সম্পত্তি) একাত্তরের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের মালিকানায় নেওয়া এইসব সম্পত্তি প্রত্যার্পণের জন্যে নতুন যে আইনটি হয়েছে তাতেও নানা জটিলতা থাকার কারণে সঠিক মালিকের কাছে সম্পত্তি হস্তান্তর দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের কপালে যাই ঘটুক না কেন, লাভ প্রধানত আওয়ামী লীগসহ একই ধারার অপরাপর রাজনৈতিক দল ও শক্তির। এই বাস্তবতা যদি কেউ ধরতে না পারে তবে তার বাড়ি-দোকান পুড়বে, বারবার সর্বস্ব লুট হতে থাকবে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতা নিয়ে শুরু হয়ে ভিন্ন রকম সংকটে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে বোঝা দরকার এখানে কোন রাজনীতির কথা বলছি। একাত্তরের পরের প্রেক্ষিত যদি ধরি তাহলে দেখব, দ্রুত পটপরিবর্তন হয়েছে রাজনীতির। স্বাধীনতার পর দেশগঠনে যেখানে সবার উদ্যেগী হওয়ার কথা ছিল, বিভেদ ভুলে দেশের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' অপবাদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্রতি হতে হত, সেখানে সবাই ব্রতি হয়েছেন ক্ষমতার লড়াইয়ে।

মসনদ দখলের লোভে আমরা জাতির পিতাকেই গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছি। তাঁর শরীরের ক্ষত বেয়ে চুইয়ে পড়া রক্তের অভিশাপ আমাদের পিছু ছাড়েনি। ক্ষমতাপিপাসুরা এরপর থেকে রক্ত ঝরানো আর থামায়নি। নয় বছর ধরে জেঁকে বসা রক্তপিপাসুকে আমরা সজোরে আছড়ে ফেলেছি নব্বইয়ে। তারপর থেকে আশা করা হয়েছিল আমাদের রক্তপিপাসু রাজনীতিতে হয়তো গুণগত পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিমনস্কতা বিনির্মাণে বিপত্তি ঘটাল আমাদের রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিগুলো।

আমরা নতুন করে মুক্তবাজার অর্থনীতি নামক আমদানি করা শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়লাম। আমাদের অর্থনৈতিক বলয়গুলো ভাঙা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা যে আঙ্গিকে ভাঙতে লাগল তা আমাদের সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত না করে আরও ক্ষুদ্র বলয়ে আবদ্ধ করেছে। আমরা বড়জোর নতুন কিছু মধ্যস্বত্বভোগী পেয়েছি যারা ধীরে ধীরে আমাদের বুকের উপর চেপে বসেছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই ক্রমে আমাদের দেশের মূল রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

তথাকথিত এই রাজনীতিবিদরা রাজনীতির যে সংজ্ঞা দেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। পৃথিবীর কোন মানুষটি রাজনীতির বাইরে? আমরা জন্মগতভাবেই রাজনীতির অংশ। আমাদের ইহজাগতিক সকল চিন্তা রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারক-বাহক দুটি বৃহৎ দল বিগত চারটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ শাসন করেছে। দীর্ঘদিন এই দুটি দল ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে, দুটি দলেরই ভয় ছিল তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা। তাই এই দুই দল সে সব কিছুই করেছে যা তাদের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

এরই ধারাবাহিকতায় দুই দল দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রধান দুই দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি। এতে আমাদের রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি অন্য সকল ব্যাখ্যার খোলস ছেড়ে এক 'নৈর্বাচনিক স্বৈরতন্ত্রে' পতিত হয়েছে। বহু দলের রাজনীতির সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় সুস্থ রাজনীতির ধারা তৈরি হয়নি। এই দূষিত রাজনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে সহিংসতা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে, এটা আর অস্বীকার করার জো নেই।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে এবারও ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হামলার শিকার হয়েছেন। সংখ্যা বিচারে সাধারণ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর সহিংস হামলা, যেটি আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে, তা-ও বেশ বিশাল আকারেই হয়েছে। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। দৈনিক সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সংকলন করলে দেখা যায়, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত সহিংসতায় ৩৫৫টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ৩২৭০টি ধর্ষণ ছাড়াও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

২০০১ সালের এই নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের জন্য 'হিউম্যান রাইট্‌স অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ' নামক একটি সংগঠনের দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ৬ মে, ২০০৯ মহামান্য হাইকোর্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। সে মতে ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৯ সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের কাছে মোট ৫৫৭১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়ে। তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল বিশ হাজারেরও বেশি।

কমিশন মোট ৩৬২৫টি সহিংস ঘটনার তদন্ত করে। তদন্ত শেষে ২৯ এপ্রিল, ২০১১ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন মহামান্য হাইকোর্টে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে বিএনপির প্রথম সারির কিছু নেতা, যেমন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, তরিকুল ইসলাম, জয়নাল আবেদিন, রুহুল কুদ্দুস দুলু এবং জামাতের নেতা আলি আহসান মুজাহিদ ও যশোরের সাখাওয়াত হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের অভিযুক্ত করা হয়।

শাহাবুদ্দিন কমিশন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে বেশ কিছু সুপারিশও করেছিলেন। সর্বসাধারণের জন্য সেই প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় কেউ জানতে পারেননি সেই তদন্ত প্রতিবেদনে আর কী কী ছিল। তবে রামুর সহিংসতা সংশ্লিষ্টতায় করা রিট আবেদন করে যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি সে প্রেক্ষিতে বলব, জীবনে আর কোনোদিন বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য বায়না ধরব না। খায়েশ মিটে গেছে।

২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার কেন্দ্র করে সারা দেশে টার্গেট করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন শুরু হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, ৫১ জেলায় মোট ১৪৬টি মন্দির, ২৬২টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর, ২১৯টি দোকান লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাতে ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, ৫ জন নিহত, ৬৫ জন আহত হয়।

এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পাবনার সাঁথিয়ায় ২ নভেম্বর, ২০১৩ রামুর মতো কোরআন অবমাননার অজুহাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৩০-৩৫টি বাড়ি, ৪টি মন্দির, বেশ কটি দোকানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। তারপর ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের অনেকগুলো এলাকা হয়ে ওঠে ভয়ের জনপদ। সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, মাগুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গায় সহিংসতায় মারা যান অনেক মানুষ।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জেনেছি, ২৫ নভেম্বরের পর থেকে মোট ৩২ জেলায় হামলা হয়েছে। এ সময় হিন্দুদের ৪৮৫টিরও অধিক ঘরবাড়ি, ৫৭৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৫২টি মন্দির ও উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা এখনও কোনো কোনো জায়গায় চলছে বলে এখনই সংখ্যার হিসাব মেলানো যাবে না।

দশম (সাংবিধানিক নিয়মরক্ষার) নির্বাচন কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে তাতে সারাদেশের মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন এবং এখনও সোচ্চার আছেন তাতে সরকারকে চাপে রাখা গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ক্ষেত্রে খুব বেশি মানুষ কথা বলেননি। তাই সরকারের উপর খুব একটা চাপ ছিল না।

রামুর সহিংসতার পর সরকারকে চাপে রাখতে পারলে কী হয় তার প্রমাণ আমারা দেখেছি। অথচ গত একটি বছরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর সারাদেশে হামলা, মন্দিরে লুটপাট-আগুন দেওয়া হলেও দেশব্যাপী সে রকম প্রতিবাদ হয়নি। তাই বেদখল হয়ে যাওয়া ঘর-মন্দির পুনঃনির্মাণ কিংবা পুনর্বাসনের কোনো প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি।

আমরা বারবার বলার চেষ্টা করেছি– এটি দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সকল নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার। আর সেটি যদি দিতে না পারে তবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার দায়ও আছে রাষ্ট্রের। আমরা চাই– সরকার গত বছরের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত সকল বাড়ি ও মন্দির নির্মাণে এবং বেহাত হয়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হবে।

নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পর আমরা দিনাজপুর আর যশোরে দেখছি বিজিবির তত্তাবধানে ক্ষতিগ্রস্তদের নতুন করে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আরও যেসব এলাকায় নতুন করে সহিংসতা হচ্ছে তা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সারাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকা চিহ্নিত করে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া তেমন কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। তাহলে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? নাকি এটি ইচ্ছাকৃত?

কোনো এলাকায় সহিংসতা হলে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভর করতে হয় প্রিন্ট ও টেলিভিশন মিডিয়ার উপর। প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা পরবর্তীতে দুই ধরনের রুপ নেয়; একটি প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে পাওয়া ঘটনার বর্ণনা যাতে নতুন তথ্য থাকে, অপরটি রাজনৈতিক কারণে ঘটনার বিকৃত বর্ণনা।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই যেটি অনুপস্থিত তা হল, ঘটনাক্রম। কীসের পর কী হল তা ফৌজদারি অপরাধ ও তার গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আবেগতাড়িত হওয়ার কারণে হোক আর অদক্ষতার কারণে হোক– বেশিরভাগ সময়েই দেখি রিপোর্টগুলোতে কোনো ঘটনাক্রম উল্লেখ থাকে না। যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, সাতক্ষীরা কোনো ঘটনারই কবে, কখন সহিংসতা শুরু হল তার সুস্পষ্ট বিবরণ নেই।

যশোরের অভয়নগরে যে দুজন নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন তাদের সেই অপরাধের সঙ্গে শুরুতে জামাত, বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও এখন অপরাধীদের পরিচয় পাল্টাচ্ছে। এই পাল্টানো সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক কারণে হয় না সেটা পুরনো অভিজ্ঞতা বলে দেয়।

নির্বাচনকালীন ও পরবর্তী সময়ে সহিংসতা হবে এবং সে সময় যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য দায়ী থাকেন তারা ব্যর্থ হবেন– এটি আমরা একপ্রকার মেনে নিয়েছি। বারবার একই রকম ঘটনা বিনা বাধায় হতে থাকলে, এ ধরনের ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সংঘবদ্ধভাবে করা এসব অপরাধ দেশের প্রচলিত আইনে গুরুতর অপরাধ হলেও আইনের প্রয়োগে শিথিলতার কারণে সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি থামছে না। আইনের ধারণাগুলো নৈব্যর্ক্তিক হলেও এর প্রয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে বিধায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও যেন সোনার পাথর বাটি। এর ফল দেশের সর্বস্তরের মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পাচ্ছেন।

দেশের চলমান সহিংসতাকে আমরা রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক যে নামেই ডাকি না কেন, সহিংসতা হচ্ছে এটাই বড় কথা। নামকরণের বাহুল্যতায় কেউ কেউ ফাঁক খুঁজছেন। এতে করে এবারের সহিংসতাকারীরাও গোঁজামিলের কারণে পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। যাবেও হয়তো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং সেই হুঁশিয়ারি থাকা অবস্থায় সহিংসতা চলছে।

মাননীয় আইনমন্ত্রী বিশেষ ট্রাইবুন্যালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার করার কথা বলেছেন এবং যতদিন না সেই ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হচ্ছে, এসব সহিংসতায় দায়ের করা মামলাগুলো সন্ত্রাস দমন আইনের ২৭ ধারা মতে জেলা জজ দ্বারা বিচার করার কথা বলেছেন। ২০১২-এর ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রেক্ষিতে করা মামলাসহ অপরাপর ঘটনারও একইভাবে বিচার করার কথা বলেছেন।

এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যেগ কিন্তু এখনই এর সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহিংসতার শিকার ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করতে সাহস পান না। তাই পুলিশ বাদী হয়ে কতিপয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়। সে সব মামলার তদন্তকালে সত্যিকারের অপরাধীদের শনাক্ত করা হবে এই প্রত্যাশা থাকলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পূরণ হয় না।

অনেকে বলেন, বড়মাপের সহিংসতায় অভিযোগ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। হয়তো তাই, কিন্তু একজনেরও নাম থাকবে না? তার চেয়েও বড় কথা আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে কি প্রকৃত অপরাধীদের নাম পরবর্তীতে সংযুক্ত হয়? সাম্প্রদায়িক হামলায় জামাত-শিবির কিংবা বিএনপি চিহ্নিত টার্গেট, কিন্তু বারেবারেই তো বন্ধুরূপী শত্রুর নাম উঠে আসছে! সেটি যদি না-ও হয় তারপরও তাদের প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতা আছে– যা একপ্রকার অংশগ্রহণ বলা চলে।

আমরা দেখেছি, অজ্ঞাতনামা আসামী হওয়ায় ব্যাপক গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যায়। রামুর ঘটনায় এই বাণিজ্যের বহু অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি বিশেষ দিক যা নজরে আনা প্রয়োজন। সাধারণ নিরীহ মানুষ, যিনি প্রকৃত অর্থে সহিংসতায় জড়িত ছিলেন না তিনি যদি পুলিশি হয়রানির শিকার হন তাহলে ভবিষ্যতে সহিংসতার বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অসম্ভব হবে। তাছাড়া যিনি হয়রানির শিকার হলেন তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম হতে পারে, যা আখেরে সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি–`গুজব' সহিংসতা সৃষ্টির পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। 'হুজুগে বাঙালি' এখন 'গুজবে বাঙালি'তে পরিণত হয়েছে। রামু এবং সাঁথিয়াতে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব আর সম্প্রতি দিনাজপুরে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায়, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, হিন্দুদের দ্বারা দুজন মুসলিমকে জবাই করে হত্যা করার গুজব রটিয়ে জামাত-শিবির কর্মীরা কয়েক হাজার মানুষ হাজির করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন্দ্র করেও নানান গুজব ও অপপ্রচার সারাদেশে হয়েছে– দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী চাঁদে পর্যন্ত চলে যেতে পেরেছেন এই গুজবের সাহায্যে। এই গুজবের ক্ষতিকারক দিকটি হচ্ছে, এতে কিছু সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং জামাতের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন। সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রগতিশীলরা গুজবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার দায়িত্ব নিলে সাধারণ মানুষকে সহিংসতায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত করা সম্ভব।

জামাত-শিবিরের গত এক বছরের তাণ্ডব আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে তাদের শক্তিবৃদ্ধির উৎস নিয়ে। সেখানে আরও অনেক কাজ করার বাকি আছে যা আমাদের নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া যারা গুজব সৃষ্টিকারী বা সহিংসতার পরিকল্পনাকারী তাদের আলাদা করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।

যেমন ধরা যাক, যদি পাঁচজন মূল পরিকল্পনাকারী একটি স্থানীয় বাজারে গিয়ে গুজব রটায় যে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে একটি মুসলিম পরিবারকে হিদুরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে হত্যা করেছে এবং তাতে বাজারে উপস্থিত অসংখ্য লোকজন উত্তেজিত হয়ে একযোগে সেই গ্রামে হিদনুদের সমস্ত বাড়িঘর মন্দির জ্বালিয়ে নির্দোষ ব্যক্তিদের হত্যা করে– তাহলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি মতে মূল গুজব সৃষ্টিকারী বা পরিকল্পনাকারীরা আলাদা বা বিশেষ কোনো শাস্তি পায় না। অথচ যে নিরীহ মানুষরা তাদের মিথ্যা প্ররোচনায় সহিংস হয়ে উঠল তাদের অপরাধ আর এই মূল পরিকল্পনাকারীদের অপরাধ এক নয়।

তাছাড়া কয়েক হাজার ব্যক্তি যদি একযোগে হামলা চালিয়ে কাউকে হত্যা করে সে ক্ষেত্রে কার আঘাতে কোন ব্যক্তি মারা গেলেন তা নির্ণয় করা দুরুহ ব্যাপার। যদি নির্দিষ্ট করে বলা না যায় কে হত্যা করেছে বা কার কার আঘাতের ফলে ব্যক্তিটির মৃত্যু হয়েছে তাহলে কাউকে হত্যার জন্য দায়ী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় না। এই আইনের ফাঁক গলে অনেকে তখন বেরিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে যে নতুন একটি আইনের দাবি তুলছি তার যৌক্তিকতা আরও জোরালো হয়।

কারণ যাই হোক, এসব হামলার পর আইনি যে সব প্রতিকার আছে তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমত, যদি একে রাজনৈতিক হামলা বলে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে স্থানীয় অপরাধীরা এক ধরনের সুবিধা পায়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত করে তাদের আইনি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেন। এজন্য হয়তো প্রকৃত অপরাধীদেরও কিছুটা ছাড় দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের দলবদলের ঝামেলাটুকু মেনে নিতে হয়।

এর ফলে যে 'কালচার অব ইমপিউনিটি' সৃষ্টি হয়েছে তার ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। একজন ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধ করলে দেশের প্রচলিত আইনে যেটুকু আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়, রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক কারণে একই অপরাধ করেছে প্রমাণ করতে পারলে, তাকে ভিন্ন কোনো আইনে বেশি শাস্তি দেওয়ার কোনো আইনি বিধান নেই। তাই একটি ফৌজদারি অপরাধকে যে নামেই ডাকি না কেন, তার শাস্তি বাংলাদেশ দণ্ডবিধির বিধান মোতাবেকই হয়। আক্রান্তরাও এই আইনে সাম্প্রদায়িক কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা বললে আলাদা কোনো সুবিধা পান না।

অপরাধীর শাস্তি হওয়াটাই বড় কথা এবং সেটি যদি প্রচলিত আইনে না হয় তবে আমাদের বিশেষ আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। এটি দেশের সামগ্রিক প্রয়োজনেই করতে হবে। কারণ এই বিচারহীনতা আমাকে আমার বন্ধুর কাছে, প্রতিবেশির কাছে বারবারই লজ্জিত করে। তাদের দিকে বারবার অভিযোগের আঙুল তুলতে আমাদেরও আর ইছা করে না।

বিদেশি বন্ধুরা আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী বলেন তাতে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমার আগ্রহ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যে ভূমিকা আমরা দেখতে পাই তাকে কোনোমতেই সন্তোষজনক মনে হয় না। ২০০৯ সালের পর এই কমিশন গঠন করার পর থেকে সহিংসতা-পরবর্তী সময়ে অনেক কথা বলেছেন এর প্রধান ড. মিজানুর রহমান। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।

সহিংসতা-পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি ভূমিকা রেখেছেন বলে ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন। কিন্তু সহিংসতা প্রতিরোধে তারা কী ভূমিকা রেখেছেন তা দৃশ্যমান নয়। জাতীয় মানবাধিকার আইন, ২০০৯ এর ১২নং ধারা কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের ক্ষমতা দিয়েছে কিন্তু একই আইনের ১৪ ও ১৫ নং ধারা মোতাবেক কমিশনারকে কেবল মধ্যস্থতা ও সমঝোতা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আইনত তাদের আর কিছু করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

তাই বারবার আমাদের বাড়িঘর, মন্দির পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিলেও তিনি এসব প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। তাহলে রাষ্ট্রীয় খরচে এই কমিশন কি কেবল নিয়মরক্ষা, না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুখরক্ষা করার জন্য?

গত বছর যে সহিংসতা হয়েছে তা রাজনৈতিক বিবেচনায় আপাতদৃষ্টিতে এক পক্ষের সহিংসতা মনে হলেও এতে উভয় পক্ষের দায় আছে। দেশকে একটি প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সবার কমবেশি ভূমিকা আছে। সেই প্রান্তিক অবস্থানটির একদিকে 'মুক্তিযুদ্ধ', অপরদিকে 'গণতন্ত্র'। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য কেউ কেউ 'একনায়কতান্ত্রিক গণতন্ত্রের' কথাও বলছেন। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ এ রকম আরও অনেক চটকদার ব্যাখ্যার জন্ম দিচ্ছে যা এদেশে নতুন আমদানি না হলেও বেশ নতুনত্ব আছে এর উপস্থাপনায়। কেউ কেউ আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে, দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্যে আপাতত গণতন্ত্র স্থগিত থাকতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংহত করতে গিয়ে হোক আর গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে গিয়ে হোক, সহিংসতা হয়েছে এবং তাতে প্রাণ হারিয়েছেন সাধারণ মানুষ, যারা কখনও ক্ষমতার অংশীদার নন। এই মৃত্যু কখনও আন্দোলনকারীর ছোঁড়া বোমায়, আগুনে আবার কখনও-বা পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে। মৃত্যু যে কারণেই হোক তা সমর্থন করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশের চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের মতামতের ভূমিকা কোথায়?

আমাদের সামনে এখন দুটি অপশন– গণতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা যারা দুটোই চাই, তাদের অবস্থা আজ বড়ই সঙ্গীন।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া: আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট।