ক্রিকেট নিয়ে তিন মোড়লের দাদাগিরি

আরিফ রহমান
Published : 27 Jan 2014, 04:18 PM
Updated : 27 Jan 2014, 04:18 PM

বাঙালি ক্রিকেটপাগল জাতি এটা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর কোনো বিষয় নয়। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একবার লিখেছিলেন, "……ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ আমার অসম্ভব প্রিয়। কেউ যেন মনে না করে, আমি একজন খাঁটি বোদ্ধা। আমি ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপ অসম্ভব ভালোবাসি, কারণ এই সময়টাতে সারাদেশের মানুষ লাল-সবুজ রঙের খেলায় মেতে ওঠে। এই খেলায় আমার নিজের দেশ খেলছে এবং আমরা ক্রমাগত 'বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ' করে চিৎকার করছি। দেশকে ভালোবাসার আর দেশকে নিয়ে গর্ব করার একটা সুযোগ করে দেয় এই ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলা। যাঁরা ক্রিকেট বোদ্ধা, তাঁরা খেলার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন, আমি পারি না। আমি খেলা দেখতে পারি, যখন সেই খেলায় বাংলাদেশ জিততে থাকে, শুধু তখন! বাংলাদেশ যদি কখনও কোনো খেলায় হেরে যায়, তখন দুঃখে আমার বুক ভেঙে যায়, মনে হয় হাউমাউ করে কাঁদি।…"

এ রকমই ক্রিকেটপাগল জাতি আমরা। কিন্তু এবার ক্রিকেটের তিন মোড়ল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের নতুন নীতির ফলে অস্তিত্ব হারানোর মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। আইসিসির তিন 'শক্তিধর' দেশের নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের টেস্ট খেলা আজ সত্যিই হুমকির মুখে।

টেস্ট ক্রিকেটকে 'আকর্ষণীয়' করার তারা প্রস্তাব করেছে নতুন এক পদ্ধতির। সোজা ভাষায় বলতে গেলে, টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের র‌্যাঙ্কিং নয়, আর প্রথম দশটি দল টেস্ট খেলতে পারে। মোড়লদের প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে এখন থেকে আটটি দল খেলতে পারবে টেস্ট ক্রিকেট। এই দ্বি-স্তরবিশিষ্ট টেস্ট ক্রিকেটে র‌্যাঙ্কিংয়ের নয় ও দশ নম্বর দলকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে খেলার 'আশঙ্কা' নিয়ে তোলপাড় এখন দেশের ক্রিকেট।

পাঠক একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, তারা আটটি দল নিয়ে খেলার কথা বলছে; নয়টি নয়, আবার সাতটিও নয়। এই পদ্ধতিতে প্রথম কোপটি পড়বে বাংলাদেশের উপর। ক্রিকেট বিশ্বে আমরা যখন পৌঁছে যাচ্ছি অপ্রতিরোধ্য এক অবস্থানে, ঠিক তখনই সংস্কারের নামে ক্রিকেটের তিন 'মোড়লে'র এই অদ্ভূত প্রস্তাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট চিরতরে শেষ করে দেওয়ার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বললেও ভুল বলা হবে না।

তবে আশার কথা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো এই প্রস্তাবের বিপক্ষে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থানের কথা বলছে পরিষ্কারভাবেই। এখন দেখার বিষয় ছিল আমাদের দেশের বোর্ড কী বলে। টেস্ট ক্রিকেটের নবীনতম দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ক্রিকেটকে 'শেষ' করে দেওয়ার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কতটা 'উচ্চকণ্ঠ' হতে পারবে– উত্কণ্ঠার কারণ মূলত ছিল এটাই।

সবার অপেক্ষা, উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবশেষে বিসিবির ঘুম ভাঙে ২৩ জানুয়ারি, জমিদারদের পক্ষেই কথা বলে আমাদের বিসিবি। সভাপতির নির্লজ্জ দালালি দেখে অবাক হলাম আমরা। এটা কি আমার বাংলাদেশ! সিদ্ধান্ত গোপন রেখে সভাপতি বললেন– "যেহেতু বিষয়টা জটিল এবং এ সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা দরকার, সে জন্য আমাদের যে মনোভাবই থাক না কেন, সেটা এখন প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারে অন্য দেশগুলোর অবস্থান জেনে আমরা আমাদের মতামত দেব।''

তবে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। আমরা জেনেছি সভাপতিসহ উপস্থিত ২৩ পরিচালকের মধ্যে ২০ জনই মোড়লদের পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার দাবি ছিল শুধু আহমেদ সাজ্জাদুল আলম এবং নবীন দুই পরিচালক শওকত আজিজ ও তানজিল চৌধুরীর। সাজ্জাদুল আলম তো প্রতিবাদে ওয়াকআউটই করেছেন সভা থেকে। বোর্ড রুম থেকে বের হয়ে আসার আগে তিনি নাকি এমনও বলেছেন, বিসিবির চিন্তাভাবনায় সর্বাগ্রে থাকা উচিত ক্রিকেটের স্বার্থ। কিন্তু এই সভায় যা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মৃত্যুদণ্ডের রায়ই লেখা হয়ে যাচ্ছে।

তবে সভাপতি সাহেবের যুক্তি একটাই, প্রস্তাবটি মেনে নিলে বিসিবি আর্থিকভাবে লাভবান হবে। তাদের সর্বশেষ অর্থবছরে আইসিসি যেখানে ১.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, নতুন প্রস্তাব অনুমোদন হলে নাকি ভবিষ্যতে সেটি ৩.৫ বিলিয়নও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভাগে এখনকার চেয়ে বেশি টাকা পাবে।

এছাড়া ভারতসহ ক্রিকেটের বড় তিন দেশের বিপক্ষে যাওয়ার ঝুঁকিটাও বড় করে দেখেছেন তারা। পরিচালকদের শঙ্কা, বিসিবি এর বিপক্ষে অবস্থান নিলে 'বড় ভাই'দের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তখন অন্যরাও 'বড়'দের রোষানলে পড়ার ভয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা এড়িয়ে যাবে।

নাজমুল হাসানের কয়েকটি উক্তি যা এখন ভাসছে অন্তর্জালে– "টেস্টে আমাদের রেটিং পয়েন্ট আঠার। আগামী দশ বছর টেস্ট খেললেও হয়তো আমাদের আট নম্বরে ওঠা হবে না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আট নম্বরকে হারাতে পারলেই আমরা আট-এ উঠে যাব। এখন তো নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েও লাভ হচ্ছে না।"

পরে আবার বলেছেন– "সার্বিকভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। এটা খারাপ মানছি। কিন্তু ভালোটা কোথায় হচ্ছে? র‌্যাঙ্কিংয়ের বর্তমান অবস্থান থেকে বের হওয়ারও তো কোনো সুযোগ পাচ্ছি না!"

এমন অন্যায্য পরিস্থিতিতেও বিসিবি সভাপতি বলেন– "আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। যদি দেখি আমরা হ্যাঁ বললে যা, না বললেও তা, তখন এক রকম সিদ্ধান্ত নেব। আবার যদি দেখি, আমাদের অবজেকশনের ওপর প্রস্তাবের পাস-ফেল নির্ভর করবে তখন আরেক রকম।"

মোদ্দা কথা কয়েকটি দেশ এখন বাংলাদেশের উন্নতি সহ্য করতে পারছে না। এদিকে ক্রিকেটকে কী করে খেলা থেকে পুরোপুরি বাণিজ্যনির্ভর করে ফেলা যায় সেটাও তাদের মাথায় ঘুরছে। ক্রিকেট বর্তমানে কেবল খেলার মাঝে আটকে নেই, এটি এখন বিরাট এক বাণিজ্যে। যেখানে একজন ক্রিকেটার পণ্যের বিজ্ঞাপন করছেন, নিজেও পণ্যে পরিণত হচ্ছেন, আর ক্রিকেট তার নান্দনিকতার আকর্ষণ হারাচ্ছে জুয়ার আসরে।

সাম্প্রতিক সময়ে জুয়ার প্রভাব ও ম্যাচ ফিক্সিং ক্রিকেটে মহামারির আকার ধারণ করেছে। ক্রিকেটার এবং ক্রিকেটবোদ্ধারা টেস্ট ক্রিকেট ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছেন কয়েক বছর ধরে। আর তারা কয়েকটি ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসিকেই এই ষড়যন্ত্রের হোতা বলে দূষছেন। যেহেতু টেস্ট ক্রিকেট সময়সাপেক্ষ, এতে দর্শকদের উন্মাদনা তুলনামূলকভাবে কম, তাই টেস্টে ব্যবসায়িক ফায়দা কম।

অপরদিকে, ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খুবই কম সময়ে ফলাফল আসে বলে, এতে দর্শক বেশি। তার মানে বেশি কর্পোরেট বাণিজ্য, যার মানে ক্রিকেট বোর্ডের লাখো ডলারের ফায়দা। আর এরই সঙ্গে আসে বাজিকরদের উন্মাদনা আর ম্যাচ ফিক্সিং (পাতানো খেলা), যা ক্রিকেটকে ক্রমাগত কলুষিত করছে।

এমন জুয়া আর ম্যাচ ফিক্সিং শুধু ক্রিকেটকেই আঘাত করছে এমনটাও নয়, তাতে জুয়ার বলি হচ্ছে মানুষের আবেগ। আর ক্রিকেটাররা ক্রমেই পরিণত হচ্ছেন টাকার পুতুলে, যাদের নিজের মতপ্রকাশের উপরেও শর্ত আরোপ করে কর্পোরেট কোম্পানি আর কর্পোরেট ক্রিকেট বোর্ড। এলিট ক্রিকেট বোর্ডসমূহ নিজেদের এই বনেদী প্রস্তাবনায় তাদের উচ্চাভিলাষ আর বাণিজ্যের চিন্তাটাকেই তুলে ধরেছেন। এই বনেদী তত্ত্ব আর কর্পোরেট প্রভাবে ক্রমেই নিষ্প্রভ হচ্ছে নান্দনিক ক্রিকেটের জৌলুস, যার ভাগশেষ কর্পোরেট ক্রিকেট!

সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে সরিয়ে দিতে পারলে সবার সব দিক থেকে লাভ। আর সামান্য টাকার লোভে যেখানে দেশি সংস্থা বিক্রি হয়ে যায় সেখানে আইসিসিকে আর কী বলব। এটা তো জানা কথা, আইসিসির বর্তমান আয়ের সিংহভাগই আসে এই তিন মোড়ল দেশ অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও ইংল্যান্ড থেকে।

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম বাঙালির ক্রিকেট নিয়ে আবেগের কথা। বাঙালি জাতির রক্তে ক্রিকেট, আর তাই এই অন্যায়ের মুখে সোচ্চার হয়েছে আমাদের তরুণেরা। ফেসবুক ইভেন্ট পেজ খুলে সবাইকে বের হতে বলা হয় ঘর থেকে। ইভেন্টের শুরুতে সবাইকে বিসিবি কার্যালয়ের সামনে আসতে বলা হলেও পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দল দেশে থাকায় স্থান পরিবর্তন করে নেওয়া হয় শাহবাগ জাদুঘরের সামনে। ইভেন্টের আহবায়ক বলেন– ''শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দল এই মুহূর্তে ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা কাল প্রাকটিসে যাবে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। ডিএমপির সঙ্গে বিশদ পর্যালোচনা করা হয়েছে কালকের সমাবেশ নিয়ে। কিছুদিন আগে আইসিসির নিরাপত্তা দল মিরপুর স্টেডিয়াম দেখে গেছে। তার নিরাপত্তা নিয়ে অনেক ভুল খোঁজার চেষ্টা করেছে। আর সামনে বিশ্বকাপ, সেটা কে সামনে রেখে আমরাও চাচ্ছি না অপ্রীতিকর কোনো কিছু জন্ম নিক।

সত্যি বলতে ৬০ হাজারকে ইনভাইট করা হয়েছে, ৫ হাজারের উপরে গোয়িং বাটন চেপেছেন চার ঘণ্টায়। রাতের ভেতর ১০-২০ হাজার লোক হয়তো ব্যাপারটা জানবেন। তার ভেতর এক হাজার লোকও এলে তা মিরপুর জোনের জন্য অনেক। দেশের কথা ভেবেই ভেন্যু পরিবর্তন করা হলো। বিসিবি অফিসের সামনের বদলে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচিটি পালন হবে। সময় এবং তারিখ আগেরটাই অর্থাৎ শনিবার বিকাল চারটা।''

পেজটিতে বলা হয়– ''লঙ্কান ক্রিকেট দল অনুশীলনরত কিংবা স্টেডিয়াম ছাড়ার মুহূর্তে এত লোকের সমাগম তাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। মনে আছে কিনা, শ্রীলঙ্কান দলের উপর পূর্বে জঙ্গী কর্তৃক আক্রমণ হয়েছিল। সুতরাং আমাদের ছোট কোনো ভুল আমাদের দেশের উপরেই বিপদ ডেকে আনবে।''

আরও বলা হয়– ''শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে একটি পোস্টার লিখে নিয়ে আসুন, কোনো উগ্র বক্তব্য নয়, তাদের দাবির বিরুদ্ধে যৌক্তিক শ্লোগান লিখুন।''

পরদিন বিকেল হওয়ার আগেই জমতে থাকে মানুষ। প্রাণের টানে ক্রিকেটের টানে মানুষ জড়ো হতে থাকে শাহবাগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন, প্লে-কার্ড নিয়ে কয়েক হাজার ক্রিকেটপ্রেমীর অংশগ্রহণে শাহবাগ মোড় থেকে চারুকলার সামনে পর্যন্ত মানববন্ধন দীর্ঘায়িত হয়। দুই সারিতে মুখোমুখিভাবে অবস্থান করেন শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন। অবস্থান কর্মসূচিতে ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশির পক্ষ থেকে ৪ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হচ্ছে–

১. ৩ মোড়লের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিসিবির শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা।
২. এর বিরুদ্ধে বিসিবির দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করা।
৩. ক্রিকেট নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি না করা।
৪. উত্থাপিত দাবিগুলো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।

তীব্র সমালোচনা আর দেশের মানুষের উত্তপ্ত অবস্থানের কথা বিসিবি সম্ভবত বুঝতে পেরেছে। আর তাই তারা জানায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সংস্কারের খসড়া প্রস্তাবের যে অংশে টেস্ট ক্রিকেটের দ্বিস্তরবিশিষ্ট কাঠামো প্রচলনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে সেই অংশের বিরোধিতা করা হবে।

মনে পড়ছে ১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির কথা। ঢাকা স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে চারদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড দলের প্রতিপক্ষ কমনওয়েলথ একাদশ। তৎকালীন পাকিস্তানের হয়ে ইনিংস ওপেন করতে নামলেন ১৮ বছর বয়সী বাঙালি ব্যাটসম্যান রকিবুল হাসান। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের একমাত্র বাঙালি সদস্য। পাকিস্তান দলের সব ব্যাটসম্যানের ব্যাটেই সোর্ড [তলোয়ার] স্টিকার, যা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু একজন, তিনি রকিবুল হাসান। তিনি মাঠে নামলেন ব্যাটে 'জয় বাংলা' স্টিকার লাগিয়ে, পাশে বাংলাদেশের ম্যাপ!

১ মার্চ ১৯৭১, সোমবার, দুপুর ১টা ৫ মিনিট। নিশ্চিত ড্র-য়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খেলা। তখন রেডিওতে শোনা গেল ইয়াহিয়ার ঘোষণা– জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল গোটা স্টেডিয়াম। ব্যাটে যে 'জয় বাংলা' ধ্বনি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন রকিবুল হাসান, মুহূর্তেই সেই 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠল গোটা দেশ। খেলা মুলতবি ঘোষণা করা হল। সমগ্র জাতি নেমে এল রাজপথে। শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

একজন ক্রিকেটারের জন্য জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলার চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়া নেই। কিন্তু মাতৃভূমির জন্য রকিবুল হাসান ত্যাগ করেছিলেন আজীবন লালিত টেস্ট খেলার স্বপ্ন। কোনো রকম রাজনৈতিক নির্দেশ ছাড়াই যিনি বরণ করে নিয়েছিলেন জুলুম-নির্যাতন, যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

আঠার বছরের টগবগে তরুণ রকিবুল হাসান মাতৃভূমির জন্য টেস্ট খেলার সুযোগ বিসর্জন দিতে পারেন, যে শোষক দলের ওপেনার হওয়ার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন, তার প্রজন্মই তো আমরা। অন্যায়ের প্রতিবাদে সেদিন যেমন রকিবুল মাঠে নেমেছিলেন, ত্রিদেশীয় মোড়লদের অন্যায়ের প্রতাবাদে আজ আমরাও মাঠে থাকব সোচ্চার হয়ে। পৃথিবী আরও একবার বলুক–

"সাবাস বাংলাদেশ
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়…।"