গণজাগরণ মঞ্চের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট

ইমরান এইচ সরকার
Published : 24 Jan 2014, 03:47 AM
Updated : 24 Jan 2014, 03:47 AM

সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,

শুভ বিকেল। এক দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল যাত্রা শেষে আমাদের দ্বিতীয় রোডমার্চ সমাপ্ত হয়েছে। আপনারা জানেন, সারাদেশের অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধের ডাক দিয়ে আমরা ১০ ও ১১ জানুয়ারি শাহবাগ থেকে যশোর মালোপাড়া পর্যন্ত প্রথম রোডমার্চের আয়োজন করি। সেই রোডমার্চ কেন্দ্র করে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ও জনমত গড়ে উঠে।

তারপর দেশের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসপীড়িত অন্যান্য জনপদের মানুষের সঙ্গেও আমাদের সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি আমরা ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও আমাদের দ্বিতীয় রোডমার্চের ডাক দেই। ইতোমধ্যেই জেনেছেন যে এই যাত্রাপথে বারবার আমাদের উপর একাত্তরের পরাজিত শক্তি হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আমাদের উপর ককটেল ও হাতবোমার আক্রমণ হয়েছে, আমাদের জনসভাস্থলে বোমাবাজি করা হয়েছে।

কিন্তু সারাদেশ যখন এসব বোমাবাজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, তখন বোমা মেরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের জয়যাত্রা থামানোর চেষ্টা তাদের নির্বুদ্ধিতার রাজনীতিরই সম্প্রসারণ মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণ সমাজ প্রমাণ করেছে, কোনো বাধাই তারুণ্য ও গণজোয়ারে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। গণজাগরণ মঞ্চের রোডমার্চ সাফল্যের সঙ্গেই ঢাকা থেকে সকল বাধা ডিঙিয়ে ঠাকুরগাঁও গিয়ে পৌঁছেছে।

যাত্রাপথে আমরা নির্ধারিত-অনির্ধারিত অন্তত ৩০টি পথসভা ও সমাবেশ করি। যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করেছি।

প্রিয় সহযাত্রী সাংবাদিক বন্ধুগণ,

আমাদের এই রোডমার্চে অর্জিত পর্যবেক্ষণগুলো নিয়ে আমরা আবার তাই আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমরা খুব কাছে থেকে দেখার ও বুঝার চেষ্টা করেছি এসব সাম্প্রদায়িক হামলার বিভিন্ন মাত্রা ও দিক। এসব সাম্প্রদায়িক হামলার প্রকৃত কারণ, হামলা প্রতিহত করার ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব এবং এই সন্ত্রাস রোধে স্থায়ী প্রতিকার নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের টিম সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে।

রিপোর্ট ও তথ্যসংগ্রহকারী দল:

প্রথম রোডমার্চের মতোই এবারের রোডমার্চেও আমরা একটি ১৬ সদস্যের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং টিম গঠন করেছিলাম। আমাদের এই টিম দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী তরুণদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, যাদের অধিকাংশেরই তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণে মাঠপর্যায়ের পেশাদারী অভিজ্ঞতা রয়েছে। কমিটিতে নারী ও পুরুষ সদস্যের সমান সংখ্যক অংশগ্রহণ ছিল যার ফলে নিরীহ তৃণমূল নারীরা আলাদাভাবে আমাদের নারী সদস্যদের সঙ্গে গোপনীয় কিন্তু খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতেও সক্ষম হয়েছেন। কমিটি দলীয় আলোচনা এবং আলাদা ইন্টারভিউ নিয়েছে। আক্রান্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি স্থানীয় মুসলিম প্রতিবেশি, তৃণমূল জনপ্রতিনিধিবৃন্দ ও তৃণমূল রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গেও আমাদের টিম কথা বলেছে। সব মিলিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণটির সারসংক্ষেপ নিচে তুলে ধরছি।

আক্রমণের কারণ:

আমরা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। গাইবান্ধার পলাশবাড়ি, দিনাজপুরের কর্ণাই এবং ঠাকুরগাঁও-এর গড়েয়া। এই ৩ এলাকাতেই মূলত ভোটপ্রদান কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। আমাদের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনার মানসিকতাই এই হামলার পেছনের একটি প্রধান কারণ। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির এবং তাদের দোসরদের বদ্ধমূল ধারণা যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঐতিহ্যগতভাবেই তাদের ভোট দেয় না।

তাই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তাদের দীর্ঘদিনের আক্রোশ সময় পেলেই প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচনের মতোই ২০১৩ সালের নির্বাচনের পরেও জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী এই নৃশংস হামলা পরিচালনা করে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা:

পলাশবাড়ি: পলাশবাড়িতে তদন্ত করে আমরা জানতে পেরেছি যে দেশের অন্যান্য স্থানের মতোই এখানেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে প্রশাসনের নজিরবিহীন ব্যর্থতা ছিল। আক্রান্তরা অনেকবার অবহিত করলেও প্রশাসন সেখানে উপস্থিত হয়নি। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও এখানে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর পূর্ব কোনো প্রস্তুতি ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এখানে নির্বাচনের পক্ষের দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন। ঘরে ঘরে ঢুকে আগুন দেওয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবিরের হায়েনারা এখানে আওয়ামী লীগের অনেক মুসলিম কর্মীর বাড়িতে ঢুকে পবিত্র কোরআন শরীফসহ অনেক হাদিসের বই পুড়িয়ে দেওয়ারও দুঃসাহস দেখিয়েছে।

পলাশবাড়ির হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতা এমনকি এখন পর্যন্ত প্রশাসনের যে উদাসীনতা, সেটি খতিয়ে দেখা জরুরি। প্রশাসন এখানে হামলার পরেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেনি। কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের ভাষ্যমতে, তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের পলাশবাড়ি পরিদর্শনের আগের দিন (১৭ জানুয়ারি) রোডমার্চ প্রতিহত করার লক্ষ্যে এই চিহ্নিত অপরাধীরাই পলাশবাড়ি সদরে সভা করেছে।

এভাবে পুলিশের নাকের ডগায় তাদের প্রকাশ্য বিচরণ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে উস্কানিমূলক আচরণ অব্যাহত থাকায় পলাশবাড়ির সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করছে।

তেলিপাড়া ও কর্নাই-দিনাজপুর:

কর্নাইতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই হামলার আশংকা সৃষ্টি হয়। সকাল ৭টায় পার্শবর্তী মহাদেবপুরের নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দেওয়া রাজনৈতিক দলের কর্মীরা তেলীপাড়ায় উপস্থিত হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়।

সকাল ৮টার কিছু পরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে আশ্বস্ত করলে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, যাদের মধ্যে তেলিপাড়ার নারী-পুরুষ ভোটাররাও ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে একই এলাকার ওই সকল সন্ত্রাসী তেলিপাড়ায় গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না আসার জন্য বাধা দেয় এবং যারা ইতোমধ্যে ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরে গেছেন তাদের শনাক্ত করতে প্রত্যেকের হাত দেখে দেখে অমোচনীয় কালি আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করতে থাকে এবং নির্যাতন চালাতে থাকে। তেলিপাড়ার সবগুলো রাস্তা আটকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয় গোটা গ্রাম।

এ সময় তেলিপাড়ার ভোটাররা যারা ভোট দিতে যাননি তারা গ্রামেই আটকা পড়েন এবং যারা কেন্দ্রে এসেছিলেন তারা কেন্দ্রে আটকা পড়েন। ভোট দিয়ে ফেরার পথে প্রত্যেক মানুষ এখানে হামলার শিকার হন। এই সময়ের স্থানীয় অধিবাসীরা প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলেও তাদের সহায়তায় কেউই এগিয়ে আসেনি। এমনকি ভোটকেন্দ্রে আটকাপড়া ভোটার বিশেষ করে নারী ভোটাররা নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করলেও তাদের বাড়িতে পৌঁছুতে সহযোগিতা করা হয়নি।

সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে ভোটকেন্দ্র কর্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হামলা শুরু হওয়ার পর দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য আবেদন জানালেও তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। এ সময় হামলকারীরা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়। মহাদেবপুর গ্রামের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কাটাপাড়া, সাহাপাড়া, ডুমুরতলীর সন্ত্রাসীরা যুক্ত হয়ে দফায় দফায় মারাত্মক হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চালায়।

অপরদিকে নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর আরেক দল সন্ত্রাসী দুপুর দেড়টা থেকে ২টা পর্যন্ত তেলিপাড়ায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ শেষ করে ভোটকেন্দ্রের মাঠে জমা হয়। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীরা সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করলে তারা আরও শক্তি বৃদ্ধি করে ভোটকেন্দ্রের পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে হামলা চালিয়ে কর্নাই বাজারে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালায় এবং নারী-শিশুসহ সকলের উপর নির্যাতন চালায়। এই হামলায় ৮০ বছরের বৃদ্ধও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি। এদের একজনের কান ছিঁড়ে গহনা নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা এবং ধর্ষণ করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নিরাপত্তা বাহিনী বাজার এলাকায় এলেও এর আগেই বাজারের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রায় সব কয়টি দোকান ও বাড়িঘর পুড়ে শেষ হয়ে যায়। প্রশাসনের কাছে ভোটবাক্সের নিরাপত্তা যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, সাধারণ অধিবাসী মানুষগুলোর নিরাপত্তা তার সিকিভাগও গুরুত্ব পায়নি। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে এ সকল এলাকা ও ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হলেও নির্বাচন কমিশনের কাছে আলাদা গুরুত্ব পায়নি। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় মাত্র চার জন পুলিশ সদস্য ও কয়েকজন আনসার ছিলেন।

ঠাকুরগাঁয়ের গড়েয়া:

গড়েয়ার হামলার মুল কারণও নির্বাচন। এখানেও নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রশাসনের বাড়তি কোনো প্রস্তুতি ছিল না এ ধরনের হামলা প্রতিহত করার। স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী তরুণেরা প্রাথমিক প্রতিরোধও গড়ে তুলেছিল গড়েয়ায়। হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া অন্তত দুজনকে হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিল তারা। পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসনের সমঝোতার আহবান এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে সন্ত্রাসীদের ছাড়িয়ে নেবার পর, আরও দূরদূরান্ত থেকে সন্ত্রাসী এনে গড়েয়ায় হামলা করা হয়।

এই হামলায় সুস্পষ্টভাবেই আক্রান্তরা খালেক নামে স্থানীয় ইউপি সদস্যের নেতৃত্ব দেবার কথা বলেছেন। এখানেও স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বারবার খবর দেবার পরও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষায় এগিয়ে আসেননি।

সময় স্বল্পতার কারণে আজকের সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে আমি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থেকে বিরত থাকলাম। পরবর্তীতে বিস্তারিত রিপোর্টে সেটি আমরা তুলে ধরব।

দায়দায়িত্ব ও ব্যর্থতা:

১. আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যর্থতার বড় দায়টি নির্বাচন কমিশনের। একটি উত্তেজনাকর ও সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটারদের নিরাপত্তায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, সে রকম কোনো ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন নিয়েছেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়নি। আগেই উল্লেখ করেছি যে এসব ভোটকেন্দ্রগুলি যে ভোটারদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ, এ বিষয়টি নির্বাচন কমিশন আলাদাভাবে গুরুত্ব না দেওয়ায় কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে নামমাত্র পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে।

২. আমাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে এই হামলার জন্য দায়ী নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দেওয়া রাজনৈতিক শক্তিগুলোর স্থানীয় নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে চূড়ান্ত হামলাগুলো অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান। এসব হামলায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ব্যাপক সংখ্যাক বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়েছে, এটা আক্রান্তদের বক্তব্যে পরিষ্কার উঠে এসেছে।

৩. এই হামলা রোধে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা যথেষ্ট সক্রিয় থাকলে হয়তো হামলার তীব্রতা অনেকটা কমে যেত।

ক্ষয়ক্ষতি:

বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের শিকার পরিবারগুলোর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরূপণ করা সংক্ষিপ্ত সময়ে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর বাইরে এখানে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সামাজিক সৌহার্দ্য নষ্ট হওয়ায় ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ নির্ণয় করাও সম্ভব নয়। হামলার কারণে স্থানীয় নিরীহ জনসাধারণের যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

সুপ্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,

আপনারা জানেন যে আমরা এসব হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট তিনটি দাবি পেশ করেছি। এই দাবিগুলো হচ্ছে–

১. সাম্প্রদায়িক এসব সামাজিক সন্ত্রাস রোধে আলাদাভাবে আইন তৈরি করা;

২. দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে গ্রেফতার করে অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত তাদের বিচার করা;

৩. সারাদেশে হামলার শিকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষতি নিরূপণ করে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা।

আমরা জানতে পেরেছি যে ইতোমধ্যে যশোরের মালোপাড়ায় আক্রান্তদের জন্য সরকার পর্যাপ্ত সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন। এই উদ্যোগে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আক্রান্তদের জন্যও পর্যাপ্ত সহায়তা ও ক্ষতিপূরণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত এসব সন্ত্রাসের সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে আইনশৃংখলা বাহিনীকে আরও তৎপর হওয়ার জন্যও আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের প্রধান যে দাবি, অর্থাৎ "সাম্প্রদায়িক এসব সামাজিক সন্ত্রাস রোধে আলাদাভাবে আইন তৈরি করা"– দাবিটি পূরণে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনটি বলবৎ করা দরকার বলে আমরা মনে করি।

প্রিয় বন্ধুরা,

এই দাবিগুলোর পাশাপাশি, দ্বিতীয় রোডমার্চে প্রাপ্ত নতুন পর্যবেক্ষণ এবং আমাদের পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে আমরা গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতের করণীয় হিসেবে নিচের সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট সকলের আশু বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি।

আশু করণীয় বিষয়ে প্রস্তাবনা:

১. ভবিষ্যতে নির্বাচনকেন্দ্রিক সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতনের বিষয়টিতে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমান পদ্ধতিতে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র নিরূপণের যে পদ্ধতি চালু আছে, তা এ রকম সন্ত্রাস বন্ধে যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে ভোটারদের এথনিক ডাইভার্সিটির বিষয়টি মাথায় রেখে কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমরা জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আমরা মনে করি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে আরও বেশি ক্ষমতায়ন করা গেলে নির্বাচনকালীন এসব ধর্মীয় ও সামাজিক সন্ত্রাস কমানো সম্ভব।

২. আক্রান্ত জনপদগুলোর সামাজিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আক্রান্তদের মাঝে ভূমিহীন প্রান্তিক চাষী ও দিনমজুরদের সংখ্যা অনেক। এরা আংশকা করছেন ভবিষ্যতে তাদের পক্ষে কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। বিষয়টি বিবেচনা করে এসব এলাকায় কাবিখা ও অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সরকারি কর্মসূচি চালু করার জন্য আমরা জোর সুপারিশ করছি।

৩. আমরা আগেও বলেছিলাম যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বিস্তারের মূল কারণ। এদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসেরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। নব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী তাণ্ডব থেকে শুরু করে গত কয়েক বছরের ঘটনাগুলোর কোনোটারই বিচার হয়নি। এমনকি এসব মামলার অধিকাংশেরই কোনো তদন্ত পর্যন্ত হয়েছে বলে দেখা যায় না। এসব কারণে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই অবিলম্বে বিগত দিনের সকল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মামলাকে চাঞ্চল্যকর মামলার মতো আলাদা তালিকা করে ফলোআপ করা ও বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৪. তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনযন্ত্রের প্রশিক্ষণে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বিষয়টিকে জোর দিয়ে আলাদা কার্যক্রম নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা আবারও অনুভব করেছি আমাদের দ্বিতীয় রোডমার্চে। একমাত্র এভাবেই থানা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বিষয়টিকে আলাদা সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ পাবেন। এসব সন্ত্রাসের জন্য সরকারি প্রশাসনকে আলাদাভাবে জবাবদিহিতার অধীনে আনা প্রয়োজন।

৫. সারাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বিশেষ করে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের 'সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস' বিষয়ে সচেতন করা ও তাদের দায়িত্ব পালনে সহায়তার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

৬. সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রোধে গণমাধ্যমের আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ আছে। হিন্দুদের উপর আক্রমণকে প্রথাগত রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করার কারণে হামলাগুলোর পেছনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো চাপা পড়ে যায়। রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করার কারণে এসব হামলাগুলোকে আমাদের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হালকাভাবে দেখা হয়, যা শুধু অন্যায়ই নয়, অমানবিক। এমন প্রতিটি হামলার রাজনৈতিক কারণের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এসব সন্ত্রাসকবলিত এলাকায় সন্ত্রাস পরবর্তী মিডিয়ার ফলোআপ ও মনিটরিং ভবিষ্যত হামলা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।

৭. উগ্র সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দেশের সামাজিক সৌহার্দ্য রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রকে সে ব্যাপারে আরও কঠোর ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন।

৮. সারাদেশের ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বিষয়ক ডাইভারসিটিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংযুক্ত করা প্রয়োজন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হলেও আমাদের দেশে আলাদাভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয়নি। এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার যাতে আমাদের দেশের শিশুরা সকল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,

২য় রোডমার্চে প্রাপ্ত আমাদের পর্যবেক্ষণ রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার আপনাদের কাছে এতক্ষণ উপস্থাপন করলাম। আপনারা জানেন যে এই দীর্ঘ যাত্রাপথে আমরা সান্ত্বনা, সহমর্মিতা ও সাহস জোগানোর পাশাপাশি আমাদের সাধ্যমতো ত্রাণ সহযোগিতাও করে এসেছি। কিন্তু ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে এসব ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। সাহস ও সহযোগিতা প্রদানের মূল দায় রাষ্ট্রের, এ কথাটি আমরা যেন ভুলে না যাই।

আমাদের এই দুইটি রোডমার্চে সহযোগিতা করার জন্য আমরা জনসাধারণ, আপনাদের মতো দায়িত্বশীল গণমাধ্যম, যাত্রাপথের অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসমুহ, আইনশৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসন, পরিবহণ শ্রমিকবৃন্দসহ সকলের প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আপনাদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে এই যাত্রায় শারীরিকভাবে অংশ নিয়েছেন। আমাদের অনভিজ্ঞতা এবং সম্পদের অপর্যাপ্ততার জন্য আপনাদের দায়িত্ব পালনে যদি গণজাগরণ মঞ্চের কোনো ভুলত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে সেটি আপনারা অতীতের মতোই সহযোগিতাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখবেন, এই অনুরোধ জানাই।

এই শীতের সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে যাত্রাপথে যে লাখ লাখ মানুষ আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের বিনম্র অভিবাদন। একটি সুখী, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আগামীতেও আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। সেই লড়াইয়ে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি তাঁদের সহযোগিতা ও সমর্থন অব্যাহত রাখবেন, এই কামনা করছি।

ধন্যবাদ।

জয় বাংলা।

১০ মাঘ ১৪২০

২৩ জানুয়ারি ২০১৪

ডা. ইমরান এইচ সরকার: মুখপাত্র, গণজাগরণ মঞ্চ।