আমার অনুভূতি কী

মুন্নী সাহা
Published : 21 Jan 2014, 06:35 PM
Updated : 21 Jan 2014, 06:35 PM

বিডিনিউজে ছাপা হ্ওয়া আমার প্রথম লেখা, যেটা কিনা ল্যারি কিং নিয়ে লিখতে গিয়ে আসলে একটি অটিস্টিক বাচ্চার গল্প। সেই লেখাটা পড়ে নবনীতার গালাগাল (আপনারা অনেকেই একাত্তর টিভির বিখ্যাত প্রেজেন্টার নবনীতাকে চেনেন, তার কথা বলার ঝাল বুঝতে পারেন)– ''আপনি কেন এমন ঢঙু ঢঙু মার্কা করে লিখলেন যে, আমাকে অনেকেই পছন্দ করে না, এই ফেসবুকের ছেলেমেয়েরা… এইসব এইসব!''

আমি বললাম, ''করে না তো, দেখ না কি আবোল-তাবোল কমেন্ট করে; যা করিনি তাও আমার নামে চালিয়ে আমার পিণ্ডি চটকিয়েই যাচ্ছে, 'বাকারা' বানাচ্ছে?''

নবনীতা আমাকে চেনে অনেক দিন, সেই ভোরের কাগজে যখন কাজ করেছি, তখন থেকে। ষোল-সতের বছরের পুরোনো কথা তুলে নবনীতা বলল, ''মুন্নী আপা, আপনার মনে নাই, আপনি যাই করতেন, তাই-ই নিয়ে আপনার পিছে লাগত। তখন কি ফেসবুক ছিল? আপনার বন্ধু, সহকর্মীরাই তো সারাক্ষণ হিংসায় মরত আর উল্টাপাল্টা কথা ছড়াইত। আপনি এত চিকন কেন, সেইটাও ওদের হিংসার কারণ। তাতে কি আপনারে আটকাইতে পারছে? আপনি মুন্নী সাহা, মুন্নী সাহাই হইছেন…।''

বললাম, ''হ্যাঁ রে, আমার সাংবাদিক বন্ধু, কলিগ বা পরিচিতজনরা কি রণে ভঙ্গ দিয়েছে? দেয়নি। একটার পর একটা মিথ্যা কথা ফেসবুকে ছড়ায়, আর ফেসবুকিং করা পিচ্চি-পাচ্চারা সেটা নিয়ে মেতে থাকে, আমার কার্টুন করে, গালাগাল দেয়। এসব আমার গায়ে লাগে না। তবে বাচ্চাদের জন্যে আমার মায়া হয়, যারা আমার নাম দেখলেই পিরিং করে একটা মন্তব্য দেয় যে, 'আপনার অনুভূতি কী'।''

নবনীতা বলল, ''হ্যাঁ… ওই যে, আপনি যে রেশমারে জিগাইছিলেন…।''

নবনীতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ''তুই কি দেখেছিলি আমার করা রেশমার ইন্টারভিউ?''

'না' বলে মাথা নাড়ল সে। তাহলে কে দেখেছে? নবো বলল, ''ঠিক দেখেছে এমন কারও কাছে শুনি নাই, তবে ফেসবুক খুললেই আপনার প্রসঙ্গ এলেই এই ডায়ালগ!''

বললাম, হ্যাঁ… এটা ডায়ালগই। কারণ আমি রেশমার ইন্টারভিউ করি নাই। রেশমাকে রানা প্লাজা থেকে বের করার সময় স্পষ্ট দেখতেও পাইনি ও কী জামা, কী ওড়না পরা ছিল। ওকে বের করার আগে আমি লক্ষ করেছিলাম, পাশের পাঁচতলা থেকে কেউ একজন একটা সাদা কাপড়ের বান্ডেল ছুঁড়ে মারল। সঙ্গত কারণেই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে গর্তের ভেতর থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো, আধমরা একটা মহিলাকে টেনে বের করা হবে। ১৭ দিন চাপা পড়ে থেকেও বেঁচে যাওয়া মিরাকল কন্যার জন্যে তাই দূরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছিলাম।

তবে রেশমাকে বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় ওর কামিজের ডানহাতের ওপরের অ্যামব্রয়ডারি আমি খেয়াল করেছি। মেরুন, ভায়োলেট ও সাদার কম্বিনেশন। রেশমার সঙ্গে কথা বলতে দিলে এসব জামা-কাপড়ের প্রশ্ন আমি করতাম কিনা জানি না, তবে এভাবে 'মিরাকল গার্ল' হয়ে বেঁচে ওঠার অনুভূতি জানতে চাইতাম। আমার সাংবাদিকতা জ্ঞানে এতে কোনো ভুল নেই, কেননা ১৭ দিন পরে যদি কোনো সারভাইভার কথা বলতে পারে এবং চিকিৎসক, উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ যদি কথা বলতে অ্যালাউ করেন, তাহলে ঘুরেফিরে এসব বিস্ময়ভাঙা প্রশ্নই আসে বা আসত। সেটা আমি হই বা ক্রিশ্চিয়ানা আমানপোর হোন– সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব জানতে চাইত।

তবে সত্য এটা যে সেদিন রেশমা কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেনি, কথা বলার সুযোগ পায়নি। আমার ক্যামেরাপারসন ছবি তুলছিল যখন, রেশমা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আমি খুব স্বাভাবিক আচরণের ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, 'কতদিন আটকা ছিলা জান?' রেশমা মাথা নেড়ে জানাল, না। আমি বললাম, ১৭ দিন। উত্তরে রেশমা বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, 'স-তে-রো দি—ন!' এটিএন নিউজে এর পুরোটাই প্রচার করেছিল। এছাড়া আর কোনো টিভিতে রেশমার আর কোনো আওয়াজ শোনা যায়নি। বলছি সেদিনকার কথা যেদিন উদ্ধার হল।

আর রেশমার ছবি তুলতে আমাদেরকে নেওয়ার আগে রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ওয়ারেন্ট অফিসার বলার চেষ্টা করছিলেন গর্তের ভেতর থেকে রেশমা ওনাকে কী কী কথা বলেছিলেন সেই সব। সেখানে কিছু কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল। তাই আমি হয়তো কিছুটা ধমকের সুরে কথা বলছিলাম। আর এতেই কাল হল, সাভার থেকে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে ফেসবুক সয়লাব, আমি কী কী প্রশ্ন করেছি তাই নিয়ে।

একাত্তর টেলিভিশনের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে নবনীতাকে এত বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিইনি, শুধু বলেছি 'আপনার অনুভূতি কী' এমন কোনো কথা বলার সুযোগ আমি রেশমার সঙ্গে পাইনি। আর এতেই আরও চটে গেল নবনীতা– 'তাইলে মুন্নী আপা, এই সব ঢঙঢাঙ-এর লেখা না লিখে বরং এইটা লিখেন না কেন', এই বলেই গটগট করে চলে গেল ও।

আসলে আমি অনেক দিন বুঝিই-নি যে ফেসবুকে যখন-তখন আমার ছবি, কার্টুন করে এই মন্তব্যটি জুড়ে দেওয়া হত কেন। আমার বোঝার কথা কি? হঠাৎ আশীফ এন্তাজ রবির কাছে জানতে চাই, কেন এই একটি প্রশ্ন? বিশেষ কোনো কারণ কি আছে? রবি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ''না দিদি… মানে, আপনি রেশমাকে…।''

পরে চাপাচাপিতে রবি পুরোটা খোলাসা করল। এবার আমার চাপাচাপি, ''রবি, তোমরা ফেসবুকে আসক্ত পোলাপান, প্লিজ গুগল কর, আমাদের মানে এটিএন নিউজের আর্কাইভ বের কর, দেখ কোথাও পাও কিনা যে আমি এমন প্রশ্ন করেছি বা সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ পেয়েছি বলছি এ জন্যে যে, আমি সুযোগ পেলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম।''

খানিক বাদে চোখ-মুখ লাল করে রবি ফিরে এল; বলল, ''দিদি, সরি।''

রবির 'সরি' বলার কিছু নেই। রবি এটা করেনি। করেছে আমাদের গোত্রের একজন। তিনিই ছেড়েছেন। আমি সূত্র খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেছি। অবাক হইনি। অনেকটা যা ভেবেছিলাম তাই। আমি শুধু আমার প্রতি ঈর্ষাকাতর এইসব বন্ধুদের (!) দিকে তাকিয়ে হেসেছি। তারপর কেটে গেছে আরও কতদিন, কতগুলো মাস। আমার মনেই হয়নি, এই সব ট্র্যাশ নিয়ে লিখি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই। আমি জানি আমি কী…।

তবে বিডিনিউজে আমার প্রথম লেখাটা ছাপা হওয়ার পর অনীক খান সেটা ট্যাগ দিয়েছিল। সেখানে কিছু বিষাক্ত মন্তব্য আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমার চামড়া মোটা। মুর্খ, স্নবিশদের মন্তব্যে আমার কিছুই যায় আসে না। আহত হয়েছি অনীকের জন্যে। অনীক আমার ইয়াং knight, ওকে দেখেই আমি এটিএন নিউজে তরুণদের প্লাটফর্ম 'ইয়াং নাইট' অনুষ্ঠানটি শুরু করেছিলাম। রাত সোয়া একটায় হিট প্রোগ্রাম। আমি কত কিছু যে শিখি এদের কাছ থেকে!

আর আমার দেখা মেধাবী তরুণদের প্রতীক অনীক খান। কী তার পড়াশোনা, কাব্যজ্ঞান এবং উইট! দারুণ এই ছেলেটির ফ্রেন্ডলিস্টে দারুণ দারুণ যুক্তিবাদী বন্ধু থাকবে এই আমার প্রত্যাশা, আর এই তো আমার গর্বের ইয়াং বাহিনী। যাদের লেখা, ক্রিয়েটিভিটি দেখে আমি মুগ্ধ। এই ক্রিয়েটিভ বাহিনী, জেনে বা না জেনে আমাকে যে ব্যাশিং করে, আমার ভালোই লাগে।

কারণ ভার্চুয়াল এই জগতে আমি বিচরণ করি কম। আমার কাছে, সত্যি সত্যি মুখ আর সত্যি সত্যি স্পর্শের মূল্য অনেক। সুতরাং আমার অত্যন্ত দামি সময়টা আমি জৈবিক স্পর্শে, কাজ আর ভালোবাসার কাছেই রাখতে চাই। আবার অনীকের ভার্চুয়াল ক্রিয়েটিভ জগতটাতে আমার কৌতূহল। সেই কৌতূহলের জগতে ফাও ফাও আমি আলোচ্য, হোক না তা মিথ্যে, তাও আলোচনায় থাকতে ভালোই লাগে।

আর এমনি ভালোলাগার জায়গায় অনীকের এক ফ্রেন্ড (ছবিতে একটি মেয়ের মুখ দেখেছি) যে বিরক্তি নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখেছেন তাতে শঙ্কিত হলাম। যে জেনারেশন কিছু না দেখে বিশ্বাস করে না বলে আমার অগাধ শ্রদ্ধা, সেই জেনারেশনের এই বন্ধুটি এত সেকেলে আর বিদ্বেষপূর্ণ দেখে দায়টা আমারই নিতে ইচ্ছে করল। দোষটা আমারই, আমাকে নিয়ে এই হাসিখুশি মেধাবী জেনারেশন ঠাট্টা-মশকরা করতে থাক, মজার মজার কার্টুন বানাক, আমি সত্য-মিথ্যায় আলোচনায় থাকি– এইসব চেয়েছি বলে আমার অনুভূতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করিনি।

কিন্তু সেই মেয়েটির হেইট্রেট, জামাতি বর্বরতার কাছাকাছি। আমি আমার ফেসবুকের ইয়াং নাইটদের ভালোবাসি। আমার অনুরোধ, তোমরা আমাকে ছেড়ে দিও না, যা খুশি বল। তবে তোমরা খোঁজ, দেখ এবং কান পেতে শোন। এখান থেকে হারিয়ে গেলে, জীবন-সময় তোমাদের হারিয়ে ফেলবে।

আর তখন মুন্নী সাহার কার্টুন এঁকে যদি প্রশ্ন রাখ, আপনার অনুভূতি কী– দেখবে তোমাদের জন্যে দু ফোঁটা জল, চোখে।