শাহবাগের একশ বাইশটি গান

ওমর শেহাব
Published : 21 Jan 2014, 06:29 AM
Updated : 21 Jan 2014, 06:29 AM

তানিম এহসানের একটি কথা শুরুতে মনে পড়ে যাচ্ছে– "গণআন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য মনে হয় গণসঙ্গীত। যে আন্দোলন গান, কবিতা আর চিত্রশিল্পসহ কোনো কিছু সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে না তাকে গণআন্দোলন বলা যায় না মনে হয় (যেমন সাম্প্রতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন)"।

একশ' বাইশটি গান! ভাবা যায়! সেই ৫ ফেব্রুয়ারি যেদিন প্রথমবারের মতো শাহবাগে সবাই জড় হল, কেমন ছিল সে দিন? শত শত লোক খুন করে কাদের মোল্লা যখন যাবজ্জীবন পেয়ে বিজয়ের চিহ্ন দেখাল, সারাদেশের গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সবার মন কত ছোট হয়ে গিয়েছিল। কত মুক্তিযোদ্ধা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, কত শহীদের সন্তান ক্রোধে-হতাশায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

তারপর যা হল তেমনটি এর আগে বাংলাদেশ একবারই দেখেছিল, সেই ১৯৭১ এ। শাহবাগে যে গণআন্দোলন শুরু হল তার জয়ের প্রথম ধাপ ছিল ১২ ডিসেম্বরে কাদের মোল্লার ফাঁসি। ১০ তারিখ থেকে দেশের সবার মাথায় একটাই চিন্তা– ফাঁসি হবে তো! বিচারক রায় দিয়েছেন তো কী হয়েছে, যদি আমেরিকা বা ইউরোপ থেকে একটা ফোনকল সব কিছু তছনছ করে দেয়!

দেশে সবাই সব কাজ বন্ধ করে টিভির সামনে আর বিদেশে সবাই না ঘুমিয়ে ইন্টারনেটে বসে। মনে হচ্ছে এই একটি শাস্তিই সবার মনে নতুন করে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আশাবাদের বীজ বুনে দিবে। কারণ এটি যে আমাদের জাতির জন্মের সময়ের পাপ, আদিপাপ!

কেমন ছিল এই তিনশ দশ দিন? আজকে থেকে পঞ্চাশ বছর পরে যখন বাচ্চারা পাঠ্যবইয়ে শাহবাগের কথা পড়বে, গণজাগরণ মঞ্চের কথা পড়বে সেখানে কী লেখা হবে? হতাশার কথা? আবার আশার আলো জ্বালানোর কথা? জাহানারা ইমামের সেই স্বপ্ন আবার জাগিয়ে আনার কথা?

সেখানে কি সেই রিকশাওয়ালার কথা থাকবে যে বিনে পয়সায় লোকজনকে শাহবাগে পৌঁছে দিচ্ছিল, কারণ কাদের মোল্লা তার চাচিকে আলুব্দিতে মেরেছিল? সেই লেখার সঙ্গে কি শহীদ নাস্তিক রাজিব হায়দারের ছবি বুকে নিয়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডে বসে থাকা ধার্মিক বৃদ্ধ মানুষটির ছবি থাকবে? সেখানে কি রুমী স্কোয়াডের কথা থাকবে যারা অনশনে নেমেছিল? অথবা সেই মুক্তিযোদ্ধার কথা যিনি শুধুমাত্র শাহবাগের জন্য কানাডা থেকে চলে এসেছিলেন? সেই হাসপাতালে শুয়ে থাকা সেই বৃদ্ধার কথা যিনি আসতে পারছেন না বলে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন?

কী এক অদ্ভুত আগুনঝরা এই তিনশ দশটি দিন। কত কিছু হয়ে গেল! মাঝখানে ঘটে গেল রানা প্লাজার সেই দুর্ঘটনা। যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলন হয়ে গেল রাতারাতি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, রক্তদান আর স্বেচ্ছাসেবী পাঠানোর এক মহাকেন্দ্র। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর আবারও মানুষের চোখে আগুন, গলায় বিচারের দাবি।

কলমসন্ত্রাসী মাহমুদুর রহমান ছড়িয়ে দিলেন 'এটি নাস্তিকদের আন্দোলন'– মানুষ সেখানে জানাজা নামাজ পড়ে দেখাল। হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা দিয়ে শাপলা চত্বর থেকে আক্রমণ করতে এল– ছেলেবুড়ো এক হয়ে লাঠিহাতে ঠেকিয়ে দিল। বিএনপি অভিযোগ তুলল এই আন্দোলন আওয়ামী লীগের– গণজাগরণ মঞ্চ সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিল এই আন্দোলনে জড়িত হওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের রয়েছে, অন্য দলগুলোর মতো।

যখন বিচারপ্রক্রিয়ার গতি দৃশ্যমান হওয়া শুরু হল তখন রাজপথ অবরোধের বিষয় থেকে আন্দোলন সমস্যার আরও গোড়ায় যাওয়া শুরু করল। সেটি কী? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা– এই ব্যাপারগুলোর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর অবহেলাই যে যুদ্ধাপরাধীদের এতদিন আস্কারা দিয়ে এসেছে, ব্যাপারটি শাহবাগ আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

শাহবাগ আন্দোলন চিরকালের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির ভাষা পাল্টে দিয়েছে। এই আন্দোলন প্রজন্মের চিন্তার ভাষা ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে দিয়েছে। এ কারণেই বিএনপির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেনি। শাহবাগ মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে কেউ যদি বলে সে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে এসেছে তাহলে সেটি নিশ্চিতভাবেই ফাঁকিবাজি।

রাজনীতি আর ইতিহাস নিয়ে মিথ্যা প্রচারযুদ্ধ এখন আর চলে না। গাদা গাদা মিথ্যার ভিড় থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সত্যগাঁথা খুঁজে বের করার যে বিদ্যে আমরা শিখে ফেলেছি সেটি তো আর ভুলে যাব না। শাহবাগেই এক মুক্তিযোদ্ধা এসে বলেছিলেন, 'অস্ত্র জমা দিয়েছি, কিন্তু ট্রেনিং জমা দিইনি'। যুদ্ধাপরাধের বিচার যেদিন শেষ হবে সেদিন তরুণ প্রজন্ম শান্ত হবে কিন্তু ট্রেনিং সবসময়ই থেকে যাবে। প্রয়োজনে সেটি আবারও অস্ত্র হয়ে ঝলসে উঠে মিথ্যার চাদর ছিঁড়ে ফেলে সত্য বের করে নিয়ে আসবে।

শাহবাগ বলে দিয়েছে আমাদের ফিল্টার হল একাত্তর। এ কারণেই কয়েকদিন আগের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৭ আসনের সাংসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠায় গণজাগরণ মঞ্চ আবারও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। পাকিস্তানি দূতাবাসকেও তারা জানিয়ে দিয়েছে যদি একাত্তরের কাজের জন্য ক্ষমা না চায় আর ক্ষতিপূরণ না দেয় তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো কথা নেই।

শাহবাগ মোড় থেকে আমরা সবাই চলে এসেছি। আন্দোলন এখন চলছে ভিন্ন ক্ষেত্রে– আরও অনেক গভীরে। বিচারের বাকি কাজ শেষ করা, প্রাতিষ্ঠানিক আর বিদেশি যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করা, পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা আদায় করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেবারে আমাদের মগজের মধ্যে চিরকালের জন্য ঢুকিয়ে দেওয়া– এই ব্যাপারগুলোই এখন গণজাগরণ মঞ্চের কাজের জায়গা।

আমরা সেই চত্বর থেকে আসার সময় সবাই বুকের ভেতর এক টুকরো করে শাহবাগ নিয়ে এসেছি। এ কারণেই গণজাগরণ মঞ্চের আহবানে পাকিস্তানের সংসদে ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদে বসুন্ধরা সিটি কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানি পণ্যের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে, আর ডিশ ব্যবসায়ীরা বন্ধ করেছেন পাকিস্তানি চ্যানেলের প্রচার।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাতেও এখন পাকিস্তানি পণ্য বিক্রি হয় লুকিয়ে। কারণ সবাই জানে সেদিন পাকিস্তানের সংসদে যেভাবে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ছোট করেছে এরপর এদের পণ্য বিক্রয় করা ভীষণ অন্যায়। কেউ করলে সেটি খুবই লজ্জার ব্যাপার, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে করে।

কেউ বুঝুক আর না বুঝুক গত তিনশ দশ দিনে সারাদেশে একটি মহাবিপ্লব ঘটে গেছে। কেউ কোনো সন্দেহজনক কথা বললেই সবাই পকেট থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার বের করে টেস্ট করে দেখে। যদি দেখে সমস্যা তাহলে সেই লোকের খবর হয়ে যায়।

২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ চিরদিনের জন্য পাল্টে গেছে। এখন সবাই জানে যুদ্ধাপরাধের বিচারে কেউ বাধা দিতে পারবে না। সবাই জানে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কেউ যদি প্যাঁচানো কথা বলে সেই কথা কেউ শুনবে না। হিসেব খুব সহজ। বিচার চলবে সাজা হবে। খারাপ কাজ এখন যেমন খারাপ চল্লিশ বছর আগেও তাই ছিল। কাজেই সাজা এড়ানো যাবে না।

আমরা সবাই টুকটাক কিছু না কিছু শাহবাগের গান শুনেছি। কিন্তু আমার কোনো ধারণাই ছিল না কতজন কবি, গায়ক, শিল্পী, যন্ত্রী শাহবাগের বন্যায় ভেসেছিলেন। কেউ কি জানেন? তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ? এটি আসলে আপনাদের ধারণারও বাইরে! একশ বাইশটি! হ্যাঁ, এটি কিন্তু আরও বেশিও হতে পারে। আমি খুঁজে পেয়েছি এই ক'টি। স্বাধীনতার পর থেকে আর কখনও বাংলাদেশে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে এত কম সময়ে এতগুলো গান হয়েছে? প্রতি আড়াই দিনে একটি করে নতুন গান? ভাবা যায়?

একটি নতুন গান মানে একটি নতুন সুর, একটি নতুন কবিতা– যেগুলো চিরদিনের জন্য আমাদের সবার হয়ে গেছে। মুখে মুখে ছড়িয়ে যাবে দেশ থেকে বিদেশে। যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এগুলো বেজেই যাবে। কোনো দিন থামবে না। ঠিক সেই মুক্তিযুদ্ধের গানগুলোর মতো!

কে গান করেননি? সত্তরের উপরে যার বয়স সেই বিখ্যাত প্রতুল মুখোপাধ্যায় যখন দেখলেন প্রজন্ম চত্বরে ছেলেমেয়েরা তার পুরোনো গান গাইছে তিনি ফোনেই গেয়ে দিলেন আস্ত একটি নতুন গান! দেশে দেশে প্রবাসীরা বেঁধে পাঠালেন গান। ইউটিউব থেকে সেগুলো সরাসরি উঠে গেল শাহবাগে আসা মানুষের গলায়। পাকিস্তানের একটি ব্যান্ড 'লাল' তো উর্দু ভাষাতেই শাহবাগের জন্য গান করে ফেলল (আফসোস ওদের পার্লামেন্টে ও রকম মানুষ কম ছিল বলে তারা সেই খারাপ কাজটি করতে পারল)।

তারেক নুরুল হাসানের এই গানটি হিমুর সঙ্গীতে নিঘাত তিথির গাওয়া–

সাত সমুদ্রের এপার থেকে দেখছি রাঙা ভোর,
আমার প্রিয় ভাই বোনেদের কণ্ঠে ভীষণ জোর।
ডাক দিয়েছে হাঁকছে ওরা তুই রাজাকার বলে,
শাহবাগ আজ মুখরিত শত সহস্র কল্লোলে।

একদম সহজ কথা কিন্তু কত মায়া! কিছু গান আবার একদম অন্যরকম। শুনলে মনে হবে প্রত্যেক লাইনে আগুন ঝরছে! তানভীর আলম সজীব ও কোয়্যার ৩১-এর এই গানটা যে শুনবে সে বুঝতে পারবে কী ক্ষোভ মানুষকে শাহবাগে নিয়ে গিয়েছিল। আবারও চার লাইন দিয়ে দিচ্ছি–

জ্বলে শাহবাগ, জ্বলে বাংলা,
শ্লোগানে মুখর প্রাণ।
পুঞ্জিভূত বেদনার ক্ষোভে,
সমবেত এই গান।

যখন জামায়াতে ইসলামীর লোকজন 'নাস্তিকদের আন্দোলন' বলা শুরু করল প্রীতম আহমেদের 'নাস্তিক' গানটি ছিল তার মোক্ষম জবাব। ওপার বাংলার কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী কবির সুমন তো একটি দুটি নয় পাঁচ পাঁচটি গান গেয়ে ফেললেন। মানুষ ভীষণ রেগে থাকলেও রসিকতা হারিয়ে যায়নি। তার প্রমাণ 'মহিনের ছাগুগুলি' অ্যালবাম (বাংলা ভাষার ব্লগগুলোতে জামাতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষদের মজা করে 'ছাগু' বলে ডাকা হয়। এর ইতিহাস নিয়ে রীতিমতো বিশদ লেখা আছে)।

ব্যক্তির বাইরেও অনেক গানের দলই অদ্ভুত চমৎকার কিছু গান করেছে শাহবাগের জন্য। অসম্ভব সুন্দর তাদের আবেগ, কী চমৎকার তার প্রকাশ!। গানটি যখন কানের কাছে বাজতে থাকে, আপনার মনে হবে আপনি তাদের হৃদস্পন্দন শুনছেন। আপনি নিশ্চিতভাবে কল্পনা করতে পারবেন এই সৃজনশীল মানুষগুলো যখন বসে গান বাঁধছিল কিছু একটা তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তটির দিকে। সেটি আর কিছুই নয়, একাত্তর, যেটি দুই হাজার তের হয়ে আমাদের কাছে ফিরে এসেছে।

গত তিনশ দশ দিনে কিছু চমৎকার শিল্পী তাদের কথায়, কবিতায়, সুরে শাহবাগের আগুনঝরা দিনগুলো অমর করে দিয়ে গেছেন। নেহায়েত কৌতূহলের বশে আমি একটি দুটি করে সচলায়তনের একটি লেখায় তার তালিকা করতে শুরু করলাম। বেশিরভাগ গানের শিরোনাম কাছাকাছি, ঘুরেফিরে শাহবাগ আর তার আগে ও পরে একটি বা দুটি শব্দ।

কাজেই আমাকে আবার প্রত্যেকটি গান শুনে শুনে বুঝতে হচ্ছিল একটি গান দুইবার দিয়ে দিচ্ছি কিনা। কোন দিক দিয়ে যে এক সপ্তাহ কেটে গেল টেরই পেলাম না! সেই ঘোর আর কাটলই না! ঠিক যেমন আমাদের পূর্বপুরুষরা মুক্তিযুদ্ধের ঘোর থেকে আজও বের হতে পারেননি। আপনি যদি শুনতে চান ঘুরে আসতে পারেন সচলায়তনের সেই লেখা থেকে।

শুধু একটি ছোট্ট সতর্কতা। সারাজীবনের জন্য শাহবাগের গানে বাঁধা পড়ে যেতে পারেন! তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আপনার তাতে আপত্তি হবে না!

তথ্যসূত্র:

[১] 'শাহবাগের গানগুলি', সচলায়তন, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪

ওমর শেহাব: ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচ-ডি অধ্যয়নরত; সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটিজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।