রক্তাক্ত ব্যর্থ আন্দোলন ও বিএনপি নেতৃত্ব

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 20 Jan 2014, 04:47 AM
Updated : 20 Jan 2014, 04:47 AM

পই-পই করে বলেও খালেদা জিয়া ও তার সহকর্মীদের বোঝানো গেল না, এ রকম সহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে নেই। তাও আবার 'যুদ্ধাপরাধীদের দল' জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এবং তার বিপুল সহায়তায়। মাঝে তো অনেকে এমনও বলতে লাগলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন বিএনপির কেউ না কেউ; আর তা বাস্তবায়ন করছে বা এর সুযোগে সন্ত্রাস করছে জামাত-শিবির ক্যাডাররা।

এ লেখক অবশ্য তাদের সঙ্গে পুরো একমত নন। বিএনপিও কম করেনি জাতীয় নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার আদায়ের দাবিতে 'আন্দোলন' চলাকালে। পাঠক, লক্ষ করবেন, সহিংসতার বদলে 'সন্ত্রাস' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। এটি সচেতনভাবেই করা হয়েছে পরিস্থিতি বোঝাতে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে রাজধানীর পল্টনে দু'পক্ষে যে হানাহানি হয়েছিল– এবারকার ঘটনাবলী কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এটা। প্রত্যন্ত মফস্বলেও এক পক্ষের লোক অপর পক্ষের কাউকে গিয়ে পিটিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা করেছে। তা-ই শুধু নয়, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে পেট্রোল বোমা বা ককটেল ছুঁড়ে।

নিছক পেটের দায়ে বাস-ট্রাক নিয়ে পথে নামা লোকদের মধ্যে ৫৫ জনকে নাকি পুড়িয়ে মারা হয়েছে। জানি না এর মধ্যে নিরীহ বাসযাত্রীদের ধরা হয়েছে কিনা। কী অপরাধ ছিল তাদের? অবরোধের মধ্যে অফিস করতে যাওয়া? পাইকারি বাজারে পণ্যসামগ্রী আনতে যাওয়া? এটা তো তাদের সাংবিধানিক অধিকার। ক্ষমতাবান দলগুলোর হরতাল-অবরোধ অগ্রাহ্যের অধিকারও কি নেই মানুষের? সেজন্যই বলতে হয়, এতদিন যা হয়েছে, সেটা সহিংসতাও নয়– সন্ত্রাস এবং ফৌজদারি অপরাধ।

সন্দেহ নেই, হরতালকালে অতীতেও আগুন দেওয়া হয়েছে যানবাহনে। তাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে করুণ মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। বিবেকবান মানুষ মাত্রই এর নিন্দা করেছেন, দাবি করেছেন বিচার। বিচার হয়নি। তার দায় তো সরকারের। বিগত বিএনপি সরকারও কি এ দায় এড়াতে পারবে? সবচেয়ে বড় কথা, অতীতে কোথাও এমনটি ঘটেছিল বলে শতগুণে বর্ধিত করে সেটা ঘটাতে হবে এখন, নতুন পরিস্থিতিতে?

আর কিছু ঘটনা তো এদেশের আন্দোলনের ইতিহাসে এবারই প্রথম ঘটল। সিএনজিচালিত স্কুটারে আগুন দেওয়ার সময় চালককে বেরুতে না দেওয়া, তাকেও পুড়িয়ে মারা। ট্রাকে আগুন দেওয়ার সময় পলায়নরত চালক বা হেলপারকে ধরে এনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। জানতে ইচ্ছা হয়, এ যুগে কোনো দেশেই কি দাবি আদায়ের চেষ্টায় এমনতরো ঘটনা ঘটিয়েছে আন্দোলনকারীরা? অন্ধের মতো সব ধরনের পণ্যবাহী যান চলাচলও তারা বন্ধ করে রেখেছিল দিনের পর দিন। এ অবস্থায় ট্রাকে আগুন দিয়ে অবোধ গবাদিপশু পর্যন্ত পুড়িয়ে মেরেছে তারা। এগুলো সন্ত্রাস না হলে সন্ত্রাস তাহলে কী?

সত্যি বলতে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বানচাল করতে জামাত একা যে সন্ত্রাস শুরু করেছিল দেশে, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করতে গিয়ে বিএনপি তাতেই যোগ দেয়। তারা স্বতন্ত্র কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাই করেনি। চলমান আন্দোলনের ওপর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও কর্তব্য মনে করেননি দলটির নেতৃত্ব। তারা লক্ষ করেননি, আন্দোলনের নামে নাশকতা অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। লক্ষ করেননি, এতে কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই; দলের সাধারণ নেতা-কর্মীও তাতে অংশ নিচ্ছেন না।

চরিত্রের দিক দিয়ে সহিংস আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ কোথায় তাদের? সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরোধীরাই কেবল এমনতরো আন্দোলনে অংশ নিতে উৎসাহী থাকে। আর যোগ দেয় ভাড়াটে লোকজন। জনগণের অর্থে তৈরি রাস্তা তারা কেটেছে, ব্রিজের পাটাতন সরিয়েছে, সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে ব্যারিকেড দিয়েছে, রেললাইন উপড়ে যাত্রীহত্যার ব্যবস্থা করেছে, স্কুলঘর পুড়িয়েছে। দেখে মনে হচ্ছিল, দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেছে একটা কিংবা কোনো সন্ত্রাসবাদী দল বিরাট কোনো পরিবর্তন আনার লড়াইয়ে নেমেছে।

মাঝে বিএনপি চেয়ারপারসনের এক কূটনীতিক উপদেষ্টা এটাকে 'যুদ্ধ' বলে বর্ণনা করলেন বিবিসির কাছে! কীসের জন্য যুদ্ধ? গ্রহণযোগ্য পরিবেশে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তো? সেটা গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হলেও কী জুটবে জনগণের কপালে? বর্তমান সরকারের মতো কিছু একটা? নাকি এর চেয়ে খারাপ কিছু? ভালো কিছু দেওয়ার লক্ষণ কি আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে?

ঠিক আছে, গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আপনাদের যা ইচ্ছা, তা-ই না হয় 'উপহার' দেবেন আমাদের। কিন্তু সেটি অর্জনের পথ কি এ-ই? গণতন্ত্রে দাবি আদায়ের আন্দোলন কি এভাবে গড়ে তোলা হয়? আপনারা তো 'গণঅভ্যুত্থান' গড়ে তোলার আওয়াজ দিয়েছিলেন। গণঅভ্যুত্থান একবারই হয়েছিল, সেটা ১৯৬৯ সালে। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ওটা আর হয়নি। হয়েছে বড়জোর গণআন্দোলন। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ বা খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়, সেটা বড়জোর গণআন্দোলন।

তাও খণ্ডিত বলতে হবে। ওসব ছিল মূলত রাজধানী ও বড় শহরকেন্দ্রিক; অনেকটা পলাশীর যুদ্ধের মতো। গ্রামের লোকজন শুনেছে– শহরে গণতন্ত্র বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জোর আন্দোলন হচ্ছে। বিএনপি এবার তেমন আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি। সে চেষ্টাই করেননি এর নেতৃত্ব। জ্বালাও-পোড়াও এবং সুনির্দিষ্টভাবে পুলিশকে আক্রমণের যে কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল জামাত, বিএনপি নেতৃত্ব সেটাকে বড়জোর সংগঠিত রূপ দিয়েছেন।

সেটি আবার জাতীয় রূপ পরিগ্রহ করেনি। অল্প ক'দিন ব্যতীত রাজধানীর জনজীবনে দাঁত বসাতে পারেননি তারা। শেষদিকে অবরোধ তো একেবারেই ভেঙে পড়তে দেখেছি এখানে। দেশের এক বড় অংশেও বিএনপি-জামাতের অবরোধের প্রভাব অতটা পড়েনি। সমস্যা হল, ওই খবর মিডিয়াও প্রচার করেনি সেভাবে। খারাপ খবরই আমাদের কাছে 'খবর' হয়ে রয়েছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক। বিদেশি মিডিয়াও খণ্ডিত খবর প্রচার করেছে।

তাতেও হয়তো উৎসাহ পেয়েছে বিএনপি। মনে করেছে, আর ক'দিন অবরোধ করা গেলেই সরকার উল্টে পড়ে যাবে। তারা লক্ষ করেননি, আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য এদের জনপ্রিয় দাবিও দুর্বল হয়ে পড়ছে; বাড়ছে জনবিচ্ছিন্নতা। লক্ষ করেননি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ালেও তাদের 'আন্দোলন'টি সমর্থন করতে পারছে না। এতে কিন্তু 'ব্যালান্স' হয়ে যাচ্ছিল এবং পরিস্থিতিটা সরকারের জন্য হয়ে উঠছিল লাভজনক।

দেশে-বিদেশে জামাতের ভাবমূর্তির দিকেও লক্ষ করেনি বিএনপি। দলটিকে কেবল দেখেছে অনড় একটি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে। এ দল যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বারবার 'সন্ত্রাসী সংগঠন' বলে সাব্যস্ত হচ্ছে– রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার মোহে সেদিকেও তাকাননি বিএনপি নেতৃত্ব। জামাতকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসময় আন্দোলন চালিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে বিএনপিকে জঙ্গি উত্থানের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারে, সেটাও তাদের মাথায় কাজ করছিল না। ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কিন্তু উঠেছিল আগেই। বিএনপির তো রীতিমতো সতর্ক থাকার কথা ছিল এ ব্যাপারে।

দলটির নেতৃত্ব কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি। আর ওই ধরনের আন্দোলনের পক্ষে তারা কেবলই বলে যাচ্ছিলেন, 'শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি' পালন করতে দেওয়া হয়নি তাদের। আবার বলছিলেন, নাশকতার সব ঘটনাই ঘটাচ্ছে সরকার! প্রথমটি কিছুটা গুরুত্ব পেলেও দ্বিতীয়টি হালে পানি পায়নি। নির্বাচন শেষ না হতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যা হয়েছে, সে ব্যাপারেও তারা সরকারকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করলেন। বিএনপি-জামাত হল সাধু!

এই সাধুদের কথা শুনে সরকারের এখন উচিত হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠন করা। আর আইন বা রীতিতে না আটকালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে এর সঙ্গে যুক্ত করা। প্রতিপক্ষের ওপর নৃশংস হামলাসহ আগুনে নিরীহ মানুষ ও জন্তু পুড়িয়ে মারা আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা তো দরকার। প্রচলিত ধারায় তদন্তের মাধ্যমে কাজটি মোটামুটি সঠিকভাবে এগোলেও তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন থেকে যাবে। তাই হয়তো একটু অপ্রচলিত ধারায় এগোতে হবে এখন।

বাংলাদেশ নিয়ে ইইউ পার্লামেন্ট সম্প্রতি যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তাতে বলা হয়েছে 'সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত' দল নিষিদ্ধ করতে। এখন যদি কেউ বলে, বিএনপিও কি এমন কার্যকলাপে লিপ্ত হয়নি? সরাসরি লিপ্ত না হলেও (সমালোচনার মুখেও) তারা কি ওইসব কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেননি অব্যাহতভাবে?

একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার এমনতরো চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা আবার হঠাৎ করেই থেমে গেলেন। সেটি নাকি বিদেশিদের পরামর্শে! এ দেশের জনগণের জীবন, সম্পদ ও সম্ভাবনা কি দলটির কাছে মূখ্য নয়? তাহলে সরকার নয়– তারা এতদিন লড়ছিলেন এসবের বিরুদ্ধে? সে কারণেই হয়তো জয়ী হতে পারলেন না।

চাটুকারদের করতালি কন্টকিত সংবাদ সম্মেলনে সেজন্য দুঃখও প্রকাশ করলেন না খালেদা জিয়া। তবে অচিরেই যেন বুঝতে পারেন, গুণগতভাবে ভিন্ন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিনি ও তার সহকর্মীরা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী বিএনপির লোকজনও এখন তাদের প্রশ্ন করতে পারেন সদ্যসমাপ্ত রক্তাক্ত ও ব্যর্থ আন্দোলনটির বিষয়ে।

এ হঠকারিতায় লন্ডনে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক।