শাহ আলী সরকার: মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরেন নাই

মুন্নী সাহা
Published : 15 Jan 2014, 05:19 AM
Updated : 15 Jan 2014, 05:19 AM

এই সেদিন। খুব শীত পড়েছে। লেপ মুড়ি দিয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে হঠাৎ মনে হল এই বুঝি ফোন বাজবে, আমি `হ্যালো' বললেই ওপাশ থেকে ভেসে আসবে– "নয়নমনি, কেমন আছ তুমি? আমি উপরঅলার কাছে সব সময় দোয়া করি, আমার নয়নমনি যেন ভালো থাকে, ভালো ভালো কাজ করে…।" আমি একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলব, "শাহ আলী ভাই, ঠান্ডা লাগাচ্ছেন না তো… যমুনার পাড়ে কী ভীষণ শীত, আর এত সকালে কে আপনার নয়নমনিকে ফোন করতে বলছে? আমি কিন্তু আর ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে পারব না…"

এটা আমার হঠাৎ মনে হওয়ার কথা বলছি। গত একমাসে আমাকে ফোন করেননি শাহ আলী সরকার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভাওয়াইয়া শিল্পী। রংপুরের এই যোদ্ধা বন্দুক নিয়ে যুদ্ধে করবার জন্যে রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন। সেখানে তার সেক্টর কমান্ডার জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কোলকাতায়, স্বাধীন বাংলা বেতারে। ৭১ এর অনেক আগে থেকেই শাহ আলী সরকার রংপুর বেতারের এনলিস্টেড শিল্পী ছিলেন।

এই শাহ আলী সরকার সেই শাহ আলী, যিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ফান্ড সংগ্রহের সেই সাংস্কৃতিক দলের সাথে ৭১ এর নভেম্বরে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইংল্যান্ডের বহু জায়গা। গান করেছেন, বুকে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে। ভাওয়াইয়ার এই মরমী শিল্পী, সুরের এই যোদ্ধা দেশ ম্বাধীনের পর তেমন কিছু চাননি। চেয়েছিলেন ঢাকায় থাকতে, আর রেডিওতে একটা চাকরি। সহজ-সরল সাদামাটা এই মানুষটিকে সেই সামান্য চাওয়াটুকুও দেওয়া হয়নি। তাই অভিমান। আর অভিমান করে হারিয়ে ছিলেন এই বাংলায়। কখনো রংপুর, কখনো লালমনিরহাট, কখনো চিলমারির পথে পথে। অভিমানে রংপুর রেডিওতেও ফেরত যাননি।

তার মিষ্টি পাতলা কন্ঠের ভাটিয়ালি, মারফতি, লালন শাহর গান উত্তরবঙ্গের জেলা উপজেলায় ঘুরতে ফিরতে থাকলেও, ইতিহাস বইতে তিনি ছিলেন মৃত। সেই সময়কারই রেডিওর এক বড় কর্মকর্তা একাত্তরে তার স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন শাহ আলী সরকারের কথা। আর তার সম্পর্কে শেষ লাইনটি হল… 'শুনেছি শাহ আলী মারা গেছেন'।

সেই বইয়ের ফটোকপি, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই স্বাধীন বাংলা বেতার নিয়ে লেখা নানান রিপোর্ট, লন্ডন ট্যুরের ব্রশিয়র, ট্যুর করতে করতে যেসব খবর ছাপা হয়েছে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রিকায়, সে সবের কাটিং আর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে এক সন্ধ্যায় হাজির হলেন শাহ আলী সরকার। আমার অফিসে। ২০১২ এর ২৬ মার্চের ২ দিন আগে। সঙ্গে মাজহার ভাই, স্বাধীন বাংলা বেতারের কন্ঠসৈনিক।

এই মাজহার ভাইই আমাকে বলেছিলেন শাহ আলী সরকারের কথা। তাঁর ধারণা ছিল, এই 'মৃত' শাহ আলী আবার 'জীবিত' হতে রাজী হতে পারেন আমি অনুরোধ করলে। করেও ছিলাম। এটিএন নিউজের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন, ইত্যাদি নানা দিক আতিপাতি করে খোঁজ মিলল ইতিহাস বইতে মৃত এই সুর যোদ্ধার। টেলিফোনে পরিচয় দিতেই, খুব মিষ্টি করে বললেন, "আপনারে চেনে না বাংলাদেশে কে আছে? কিন্তু আমার মতো মরা মানুষের খোঁজ কেন?" গলায় অভিমান থাকলেও রাগ নেই। আর প্রতি কথার জবাবেই হাসি।

টেলিফোনে কথা বলেই ভক্ত হয়ে গেলাম শাহ আলী সরকারের। অনেকটা অভিভাবকের ভঙ্গিতে বললাম, আপনাকে আবার খুঁজে পেয়েছি, আপনি আমাদের শাহ আলী ভাই, আপনি এটিএন নিউজের। আসবেন না? আমার এই শাসনটা তিনি পছন্দ করেছিলেন, তাই সবকিছু নিয়ে হাজির সিরাজগঞ্জের সেই যমুনার চরের হু হু শীতের গ্রাম থেকে।

২০১২ এর ২৬ মার্চ লম্বা একটা অনুষ্ঠান করলাম শাহ আলী সরকার আর জহীর বয়াতীকে নিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে শাহ আলী সরকার আবার গান গেয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি মরেননি।

আমাদের দর্শকদের মন ভরে নাই। প্রায় ৪ ঘণ্টার অনুষ্ঠান, তাও। অনেক ফোন, অনেক প্রশ্ন। শাহ আলী কোথায় থাকেন, কিভাবে জীবন চালান, তার কোনো সাহায্যের দরকার আছে কিনা… নানান কিছু। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি সারোয়ার ভাই। তিনি বললেন, তুমি যাও না একটু, দেখে আস কোথায়, কেমন করে থাকেন এই গুণী মানুষটা। যাকে আমরা রেডিওতে একটা সামান্য চাকরি দিতে পারলাম না!

সিরাজগঞ্জে অন্য আরেকটি কাজে গেছি। থাকব ২ দিন। ফোন দিলাম শাহ আলী সরকারকে। 'শাহ আলী ভাই এদিক সেদিক কোথাও যেয়েন না। আমি সিরাজগঞ্জে আছি, আসব আপনার এখানে। ফোন পেয়ে যে কী উচ্ছাস তার গলায়! নয়নমনি— কখন আসবেন আপনি, একটু বাদে বাদেই এই প্রশ্ন নিয়ে তার ফোন। সত্তুরের কোঠা পার হওয়া এই মুক্তিযোদ্ধার শিশুর মতো আচরণে অভিভূত আমি। আমি কে… কেন শাহ আলীর এই শিশুসুলভ চপলতা?

মনে করতে পারি, আমাদের টিভিতে, মানে এটিএন নিউজে অনুষ্ঠান করতে আসার পর আমার ওপর তার এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। সন্তানের মতোই স্নেহমাখা ভঙ্গিতে কখনো মা, কখনো নয়নমনি বলে তিনি আমাকে ডাকেন। প্রতি রাতে আমার টক শো দেখার জন্যে ৩ মাইল হেঁটে বাজারে যান আর রাত করে ফেরেন। মাঝে মাঝে সকালে তার সেই আদরের ফোন… নয়নমনি, আমি অনেক দোয়া করি…

শাহ আলীর ঢাকায় আসা আর আমার সিরাজগঞ্জে যাওয়ার মাঝে কেটেছে বেশ ক'টি মাস। এরই মধ্যে কোন গরীব মানুষের শীতের কাপড় লাগবে, কাউকে একটু হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে ইত্যাদি নানা বাহানায় আমাকে সকালে ফোন করতেন শাহ আলী। খুব ভোরে ওঠা পাবলিক আমি না। তাও কেন জানিনা, শাহ আলী ভাইয়ের ফোনের পর যদি আমার উঠে যেতে হতো, খুব ভালো কাটত দিনটা।

ভাবতাম, কিছু কি করা যায় এই মানুষটির জন্যে? আবার ভাবি, কি করব? ওনার তো কোনো চাহিদা নাই। শুধু চান; মারফতি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদীর প্রায় ৪ হাজার গানের স্টক আছে তার পেটে, তা যেন রেকর্ড করার ব্যবস্থা করি। আমি বলতাম হবে, হবে শাহ আলী ভাই হবে। আমরা পারবো। শুধু আপনি ঠান্ডা লাগিয়ে কাশি বাধাইয়েন না তাইলেই আমরা পেরে যাবো। এই কথার জবাবে বলতেন, নয়নমনি আমি তো এই জন্যে খুব সাবধানে থাকি…

এটাকে বলে সাবধানে থাকা? শাহ আলীর ঘরে বসে আমি কেঁদে ফেলি। যমুনার কচকচে বালি পায়ের নীচে। টিনের বেড়া। হু হু করে বাতাস আসছে নীচ দিয়ে। অর্থাৎ টিনটা, ফ্লোর থেকে প্রায় ১০ ইঞ্চি উচুতে। আবার উপর দিকেও একই অবস্থা। ফাঁকা। চালা থেকে ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের বেশি হবেনা ঘরটা। একটা চৌকি। সেখানে শত ছিন্ন মশারি, অনেক কটা তেল চিটচিটে কাথা। একটা বালিশ। চৌকির নিচে ৩/৪টা থালা বাটি। একটা টিনের ট্রাংক। টিনের বেড়ার ওপর এটা সেটা গোজা। মশারির সাথে ঝুলছে শাহ আলীর একটা ব্যাপারি শার্ট, মাফলার, মাংকি ক্যাপ আর গামছা। এই হল আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতারের মুক্তিযোদ্ধার সংসার। আর এই ঘরে আমার শাসনের ভয়ে, গান করার নেশায় সাবধানে থাকছেন তিনি!

সেদিন আনন্দে হরবর করে অনেক কথা বলছিলেন শাহ আলী। সংসারী হয়েও কিভাবে গানের জন্যে সংসার বিরাগী হলেন, ছেলে মেয়েরা কে কোথায়, রংপুরে স্ত্রীর আরেক জনের সাথে চলে যাওয়া, সিরাজগঞ্জে এক পাগলীকে বিয়ে করে বিপদে পড়া… নানান কিছু। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলার গল্প, ইংল্যান্ডের শো, তারপর দেশ স্বাধীনের পর রেডিওতে ৩০ টাকার সম্মানীতে মাসে ২টা প্রোগ্রাম করার অফার, অভিমান, ইচ্ছে করেই সো কলড সভ্য শহর থেকে পালিয়ে থাকা নানান গল্পের মাঝে একটাই গানের লাইন— শোনো বাঙালি গো… দুশমন দেরে দেশে রাইখো না…'

বলছিলেন রাজাকারদের কথা। গানে গানে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মারফতি তো আছেই। কোনো কোনো গান নিজের লেখা, নিজের সুর। আর সেই সব গানের একই বার্তা, আমরা এই প্রজন্ম যেন রাজাকারদের ছেড়ে না দেই। এই দুশমনরা দেশে থাকলে দেশ আর আমাদের দেশ থাকবে না।

মুগ্ধ হয়ে শাহ আলীকে শুনছিলাম। এবার যেতে হবে যমুনার পাড়। উঠবো। হঠাৎ এই মুক্তিযোদ্ধা টিনের বেড়ায় গোঁজা একটা ছোট্ট পলিথিন বের করলেন, পলিথিনের গিট্টুটা খুলতে খুলতে বললেন, 'নয়নমনি, আপনি আসবেন বলে আমি পরশুদিন এই উপহারটা এখানে এভাবে যতœ করে রেখেছি, আমার মতো মানুষের কি আর সাধ্য আছে আপনাকে দেবার!

বলতে বলতেই পলিথিনের ভেতর থেকে বেড়োলো দুদিন আগে তুলে রাখা ২টি গোলাপের পাপড়ি। বুকে হাত দিয়ে বলছি, সেই ঝড়া গোলাপের সুঘ্রাণ আমি সেদিন, সেই মুহূর্তে যেমন পেয়েছি, যতবার এই ঘটনাটা মনে করি, আমি গোলাপের ঘ্রাণ পাই। হয়তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গোলাপ সে দুটিই। যা একজন মুক্তিযোদ্ধা সস্নেহে হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর অসমাপ্ত আকাঙ্খাটা এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা দিতে।

আজ তেরই জানুয়ারি রাতে বসে যখন সেই গোলাপের কথা লিখছি, বারবারই ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। রাত আটটার পর সেই কাঙ্খিত কন্ঠের 'নয়নমনি' ডাকটা দূর আকাশে মিলিয়ে গেছে। তিনি তো আর চাইবেন না, আমি চাইলেও মোবাইলে শাহ আলী সরকার নামে বাটন চাপলে ওপাশ থেকে বলবেন না, ভালো আছেন নয়নমনি? আপনার জন্যে অনেক দোয়া…

কত কত দিন যে, সকালের ফোনে শাহ আলী ভাই কে বলেছি, 'আমি আসছি, আমরা আসছি, আপনার গান রের্কড করবো, ৪ হাজার গান। একটু সময় পেলেই আসছি।' আমাদের সময় সব, দুঃসময় ছিনিয়ে নিয়ে যায়… তাই বলে, আমাদের জাগরণের গান নিয়ে আপনার মরে প্রমাণ করতেই হলো, যে শাহ আলী সরকার মরে নাই!

মুন্নী সাহা: সাংবাদিক।