হিন্দুরা এদেশে থাকবে কেমন করে

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 14 Jan 2014, 09:21 AM
Updated : 14 Jan 2014, 09:21 AM

বিএনপি-জামায়াতের প্রবল প্রতিরোধের মুখে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছে। নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে ৪৯ সদস্যের এই মন্ত্রিসভা দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তা দূর করতে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারবে অথবা এই সরকার কতদিন টিকতে পারবে সে প্রশ্ন বিভিন্ন মহল থেকে তোলা হচ্ছে।

তবে দেশে-বিদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এই সরকারের মেয়াদ একেবারে কম হবে এমনটা মনে করছেন না কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এই সরকার যদি দেশে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে তাহলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। তাছাড়া বিএনপির পক্ষে খুব সহসাই সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা সহজ হবে বলেও মনে হয় না।

সরকার যদি বড় ধরনের কোনো ভুল না করে তাহলে বিএনপিকে মাঠ গোছাতে বেগ পেতে হবে। তবে নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর যে হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তা এখনই বন্ধ করতে না পারলে সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হবে। হামলার জন্য বিএনপি-জামায়াতের উপর দায় চাপিয়ে সরকার যদি দায়িত্ব এড়াতে চায় তাহলে সেটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মানুষ আশা করছে সরকার কঠোর হাতেই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমন করবে। শুধু আশ্বাস বা সান্তনা সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তা তৈরি করতে সহায়ক হবে না।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই যশোর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, গাইবান্ধাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা শুরু হয়েছে। ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হচ্ছে, আগুন দেওয়া হচ্ছে এবং লুটপাট করা হচ্ছে। গৃহহীন হয়ে এবং সহায়সম্বল হারিয়ে তীব্র শীতের মধ্যে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু নিদারুণ কষ্টে পড়েছেন। মন্দিরে হামলা ও বিগ্রহ ভাঙচুরের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশাহারা হয়ে ছোটাছুটি করেছেন অনেকেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণের সময় বনে-জঙ্গলে-আখ ক্ষেতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হামলা হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনযাপন করছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। বেশ কয়েকটি জায়গায় নির্বাচনের আগের রাতে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট দিলে বিপদ হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ভয়ে-আতংকে কোনো কোনো জায়গায় হিন্দুরা ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছেও যায়নি। তারপরও তারা আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। অর্থাৎ আক্রমণের জন্য ভোট দেওয়া বা না দেওয়াটা কোনো বড় বিষয় নয়। হিন্দু বলেই তাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং হচ্ছে। দিনাজপুরের একজন আক্রান্ত ব্যক্তি, অনন্ত চন্দ্র রায় দুঃখ করে বলেছেন, 'ভোট এলেই আমাদের উপর নির্যাতন নেমে আসে। কোনোদিন কি এর প্রতিকার হবে না? কেমন করে এদেশে থাকব?'

এই জিজ্ঞাসা শুধু অনন্ত রায়ের নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের কমবেশি সব সদস্যেরই। নির্বাচন উপলক্ষে মাঠপর্যায়ে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও দুর্বৃত্তরা হিন্দুদের ওপর হামলে পড়ার দুঃসাহস কোথায় পেল সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। এমন অভিযোগও শোনা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো জায়গায় প্রশাসনকে আগেভাগে জানিয়েও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পায়নি হিন্দু সম্প্রদায়। প্রশাসনের এই উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা অথবা গাফিলতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণে-অকারণেই তাদের উপর হামলা হয়, আক্রমণ হয়। তাদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা হয়। তাদের সম্পদ লুটপাট করা হয়। জায়গাজমি জবরদখল হয়ে যায়। আতংক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এটা কোনো মানুষের জীবন নয়। ভোটের সময় হামলা-আক্রমণের ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি নির্বাচনের আগে-পরেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে থাকে।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার আগে-পরে এই হামলা-আক্রমণের ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এটাই যে, প্রতিটি হামলা-নির্যাতনের সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির জড়িত থাকলেও কাউকেই তখন গ্রেফতার করা হয়নি, আইনের আওতায় এনে একজনকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশা করা হয়েছিল ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রতিটি ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত হবে এবং প্রকৃত আপরাধীদের শাস্তি বিধান করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো মহাজোট সরকারের আমলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর, আরও স্পষ্ট করে বললে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস আক্রমণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে।

কোনো ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতকারীরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে এমন কোনো প্রমাণ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে দুএকটি মামলা হয়েছে, দুএকজনকে গ্রেফতারও হয়তো করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। ফলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করা, তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা, ত্রাসের মধ্যে তাদের বসবাসে বাধ্য করা যেন তাদের 'নিয়তি' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একসময় অনেকেই আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতেন। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সবাই যেন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের পরিচিত প্রতিবেশিদেরও হামলার সময় অচেনা মনে হয়। দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে সংখ্যালঘুদের ওপর এই ধরনের আক্রমণের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না।

বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না– এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু নানান রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি আমাদের দেশের রাজনীতিতে ঠাঁই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সমাজে-রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে-প্রশাসনে যত শক্তি সঞ্চয় করেছে, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যত বাড়ছে, দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতার উপাদান ততই বেড়েছে। উদারতা, সহনশীলতার পরিবর্তে উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটেছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি প্রকটভাবে দেশের উপর চেপে বসার সুযোগ পেয়েছে। জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে এই উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে আপোস করেছে মধ্যপন্থার রাজনৈতিক শক্তি। এখন তার খেসারত গুণতে হচ্ছে গোটা দেশকে।

উগ্রবাদ এবং গণতন্ত্র যে একসাথে চলতে পারে না এটা না বুঝতে না পারার ব্যর্থতার কারণেই দেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। সংখ্যালঘুদের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে সেটাও এই উগ্রপন্থার রাজনীতিরই পরিণতি। রাজনীতি থেকে সব ধরনের উগ্রবাদীদের হঠাতে না পারলে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

যারা একদিনের ভোটের গণতন্ত্রের শুদ্ধতার জন্য বিলাপ করেন, তারা সাধারণ মানুষের জীবন সংহার করছে যে উগ্রবাদী রাজনীতি তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটিও করছেন না। ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য যারা সোচ্চার তারা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ হতে দেখেও বিচলিত বোধ করেন না।

মধ্য-ডানপন্থার রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে উগ্র-ডানের জামায়াতে ইসলামীর বেশিমাত্রায় মাখামাখির কারণেই দেশের রাজনীতি যে সংঘাতময় ও সহিংস হয়ে উঠছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গত কয়েক মাসে আমাদের দেশের রাজনীতিতে আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চলছে তার জন্য মূলত দায়ী জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত যে একটি অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী দল সেটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেই পরিষ্কার হয়েছে।

এই দলটি গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গোপনে নিজেদের সহিংস রাজনীতির চর্চা অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা না দেখেই তারা সশস্ত্র ক্যাডারবাহিনী গড়ে তুলেছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাথায় রেখে। বিএনপির আশ্রয়-প্রশ্রয় জামায়াতের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করেছে।

জামায়াত যে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে গ্রাস করে ফেলছে এটা বিএনপি বুঝতে পারছে না। বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডাও এক নয়। জামায়াতের আশু লক্ষ্য হল, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত দলের শীর্ষনেতাদের মুক্তি। অন্যদিকে বিএনপির আশু লক্ষ্য হল ক্ষমতায় যাওয়া। দেশের মধ্যে অরাজকতা-নৈরাজ্য তৈরি হলে জামায়াতের লাভ, বিএনপির ক্ষতি। কিন্তু বিএনপি এখন অন্ধ আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার কারণে তারা কোন ফাঁদে পা দিয়েছে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হল নির্বাচন। অথচ জামায়াতের প্ররোচনায় পড়ে বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো না। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে উল্টো নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। নির্বাচন প্রতিহত করা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দেশে পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে কিংবা বোমা মেরে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এতে নির্বাচন প্রতিহত হয়নি। অথচ ভুগতে হবে শিক্ষার্থীদের। নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে এই যে, শিক্ষার ক্ষতি করা হলো এটাকে কি গণতান্ত্রিক রাজনীতি বলে মেনে নেয়া যায়? বিএনপি কেন নিজেরা নির্বাচন বর্জন করে ভোটারদের নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পরিবর্তে নির্বাচন প্রতিহত করার সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লো?

এই প্রশ্নের উত্তর বিএনপির সকল স্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের জানতে চাইতে হবে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে গত কয়েক মাসে যেভাবে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানো হয়েছে, যেভাবে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা হয়েছে, দেশের সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে, তাকে কোনোভাবেই গণতন্ত্রসম্মত বলা যায় না। গণতন্ত্রে বলপ্রয়োগের সুযোগ নেই।

শক্তির জোর নয়, যুক্তির জোরই গণতন্ত্রের সার কথা। অথচ বিএনপি এবার জামায়াতের খপ্পরে পড়ে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে জড়িয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য কত বড় ক্ষতি করেছে সেটা তারা এখন বুঝতে না পারলেও এক সময় এজন্য তাদের আপসোস করতে হবে।

বলা হচ্ছে, দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বিএনপি আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলনের মূলকথা হল নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যেমন একটি ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্ত তেমনি সব ভোটারের নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারাটাও ভালো নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে ধর্মবিশ্বাসের কারণে দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে চায় তাদের কোন বিবেচনায় গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি বলে ধরা হবে?

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, হিন্দু সম্প্রদায়সহ আরও কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষকে ভোটদানে বিরত রাখার জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাদের মধ্যে বিএনপির নামও আছে। আগে এই কাজটি বিএনপি সমর্থকরা রেখেঢেকে করলেও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর এখন এটা তারা নগ্নভাবেই করছে। জামায়াতি রাজনীতির উগ্রপন্থার প্রভাব বিএনপিকে এতটাই আছন্ন করেছে যে, তারা গণতন্ত্রের নাম করে এমন সব কর্মকাণ্ড করছে যা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিএনপি নেতৃত্বকে এটা বুঝতে হবে যে, উগ্রপন্থা এবং গণতন্ত্র এক সাথে চলে না। বলপ্রয়োগ, ভয়-ভীতি দেখানো আর গণতন্ত্র সমান্তরাল পথে চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা যদি বিকশিত করতে হয় তাহলে হিংসার পথ পরিহার করে, সন্ত্রাস-নাশকতার ইতি টেনে বিএনপিকে শান্তির পথেই ফিরে আসতে হবে। বলপ্রয়োগ করে দাবি আদায়ের কৌশল ত্যাগ করে যুক্তির জোরকে প্রাধান্য দিতে হবে। শান্তি ও সমঝোতার পথে না হাঁটলে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণ করা যাবে না।

বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই হোক, কিংবা আদর্শবিহীন ও সুবিধাবাদী ভোটের রাজনীতি অথবা সম্পত্তি দখলের স্বার্থের সমীকরণেই হোক, অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরাও এখন আর দৃঢ়তার সঙ্গে হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানোর গরজ বোধ করেন না। হিন্দু বা অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের সংশ্লিষ্টতার কথাও শোনা যায়।

এ এক অদ্ভূত অবস্থা। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলেও হিন্দুদের মার খেতে হয়, হারলেও। বিএনপি-জামায়াত ভোটে জিতলেও হিন্দুদের মার খেতে হয়, ভোট না করলেও হিন্দুদের রেহাই নেই। দেশটা সংখ্যালঘুশূন্য হলে কিংবা একধর্মের মানুষ বসবাস করলেই কি দেশে শান্তি থাকবে?

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি কী হয় সেটা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দেখেই উপলব্ধি করা উচিত। ক্রমাগত হামলা-নির্যাতনে টিকতে না পেরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি নিরুপায় হয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য উগ্রপন্থার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয় হবে এবং ক্ষতি হবে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির। বাংলাদেশকে যারা পাকিস্তানের মতো একটি উগ্র-জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন উদার গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষদের এক হয়ে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়।

কেবল প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবেলা করা যাবে না। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির সম্মিলিত প্রতিরোধই পারবে ওই অপশক্তির সব ষড়যন্ত্র-জাল ছিন্ন করতে।