সংখ্যালঘুকে কেমন রেখেছি গুরুরা

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 28 April 2011, 11:06 AM
Updated : 13 Jan 2014, 07:24 AM

নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছে এর মধ্যে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রশ্নে আলোকপাত করতে গিয়ে প্রসঙ্গটা তুললাম এজন্য যে, আশা করব নতুনভাবে গঠিত সরকার দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পরই প্রথম যে কাজটা করবে তা হল, নির্বাচন শেষ না হতেই যারা এখানে সংখ্যালঘুর ওপর ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর ভিত্তিতে গঠিত সরকার নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু দেশে তো জনপ্রশাসন রয়েছে। সংবিধান বহাল আছে এবং বিরাজ করছে না কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা। অন্তত আইনগত বৈধতা নিয়েই বহাল রয়েছে সরকার।

সরকার ও প্রশাসন বহাল থাকা সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর এই ক'দিনে যা হয়েছে, তা যেন অবিলম্বে থামে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পরও কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের কাছে নাকি তথ্য ছিল এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হতে পারে। তা সত্ত্বেও হামলা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বা যায়নি কেন, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। এমন কোনো ঘটনার কথা তো জানতে পারলাম না যেখানে হামলা প্রতিহত হয়েছে বা ধরা পড়েছে হামলাকারী ও এর ইন্ধনদাতা।

ব্যর্থ দু'একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্লোজ বা বদলির খবর অবশ্য রয়েছে। সাম্প্রদায়িক হামলা হয়ে যাওয়ার পরও প্রজাতন্ত্রের কোনো কোনো কর্মকর্তা এমনভাবে কথা বলেছেন যে, তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারের কাছে কতটা তথ্য ছিল কে জানে; তবে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের মাঝে শঙ্কা ছিল পুরোপুরি। বিভিন্নভাবে তারা সেটা প্রকাশও করেছিলেন। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন সেরে ফেলার ব্যস্ততায় সরকার মনে হয় সে বিষয়ে চিন্তার অবকাশ তেমন পায়নি!

যশোর, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় যখন হামলা হয়, তখন কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন মোকাবেলায় সরকার তত ব্যস্ত ছিল না। এদের কর্মকাণ্ড বরং ঝিমিয়ে আসছিল তখন। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ বেড়ে উঠছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অঞ্চলগুলোয়। পরিতাপের বিষয়, এর মধ্যেও ঘটে গেল বর্বর হামলাগুলো।

২০০১-এর মতো বিস্তৃত পরিসরে না হলেও এবারের সাম্প্রদায়িক হামলা মোটেও হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত হত্যাকান্ড ঘটেনি, তবে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে হামলাকারীরা। যশোরে একই পরিবারের দুই নারী হয়েছেন এর করুণ শিকার। ভোট দিতে যাননি বলে প্রমাণ দেখানোর পরও তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে মুখ ঢেকে আসা বর্বররা। এতে বার্তাটি হল, ভোট দিতে না গেলেও রক্ষা নেই। নির্বাচনসহ নানা উপলক্ষে এমনটি যেন ঘটবেই। হিন্দু, দুর্বল জনগোষ্ঠী ও নারী হলে রক্ষা নেই আরও।

কিশোরী পূর্ণিমার কথা মনে পড়ে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ২০০১-এ আমরা তাকে দেখতে গিয়েছিলাম প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের (ওয়াহিদ ভাই) উদ্যোগে। পাকিস্তান পর্বেও সাম্প্রদায়িক হামলা রোধে প্রচণ্ড নৈতিক সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ছোটখাটো দেহের এ অসাধারণ মানুষটি। বাসে যেতে যেতে ওয়াহিদ ভাইকে দুঃখ করে বলেছিলাম, 'আপনারা আর কত করবেন? এখন তো তরুণদের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার কথা'।

ওয়াহিদ ভাই বেঁচে থাকলে দেখে খুশি হতেন গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা যশোরের অভয়নগরে আক্রান্ত হিন্দুদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের বাংলাদেশ রক্ষার শপথ নিয়েছে তারা নতুন করে। রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে এরা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের যথাযথ বিচারের দাবিতে। তাদের অনুসরণ করে লাখো মানুষ। দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষার বিষয়টি এ থেকে মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়।

আমরা কি লক্ষ করিনি, ওইসব মামলায় দণ্ডিতদের রক্ষায় নাশকতা চলার সময় সংখ্যালঘুদের ওপরও আঘাত হানা হয়েছে? এসব হামলাকারী বোধহয় বারবারই মনে করিয়ে দিতে চায়, তারা পাক হানাদার বাহিনীর আদর্শ ও পন্থা অনুসরণ করে চলেছে এখনও।

অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০০১-এ বিএনপির সঙ্গে জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে যাওয়ার পর দেশের কোনো কোনো স্থানে ধর্মান্তরকরণের ঘটনাও ঘটেছিল, ঠিক একাত্তরের মতো। ধর্ষণের ঘটনা তো ঘটানো হয় এন্তার। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই নারীর কথা, যিনি হামলাকারীদের বলেছিলেন– ''বাবারা, তোমরা একজন করে যাও। আমার মেয়েটা ছোট!''

সংখ্যালঘুদের মানসিকভাবে ধ্বসিয়ে দিতে সার্বরাও ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বসনিয়ায়। ভারতের গুজরাটেও এটি করেছে জঙ্গি হিন্দুরা। এতে অনেক ক্ষেত্রে এমন মনোভাবও কাজ করে যে, 'আমরাই শ্রেষ্ঠ'! শ্রেষ্ঠত্বের দাবি সবসময় ভয়ঙ্কর। এটা সমাজে অকারণ বিভক্তিও এনে দেয়; আর একে কাজে লাগায় অশুভ রাজনীতি।

প্রধানত বিএনপি-জামায়াতকেই এখন এসব নির্যাতনের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। কোনো কোনো ঘটনায় যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুর্বৃত্তরাও জড়িত নেই, তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটনা নির্বাচনের পর ঘটলেও দেখা যাচ্ছে, হামলা বা নির্যাতন হয়েছে জমি দখলের চক্রান্ত ঘিরে।

এক তরুণ সংবাদকর্মীর পুরনো ঢাকার বাড়ির আঙ্গিনায় দুটি ককটেল ফাটানো হয়েছে ঠিক নির্বাচনের দিন। তারা এলাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত হিন্দু পরিবার। তারপরও ঘটনাটি কারা যেন ঘটিয়েছে আর এতে আক্রান্তরা কিছুটা অবাক। থানা-পুলিশ করেননি তারা; তবে এর উদ্দেশ্য বুঝতে চেয়েছেন।

এ ধরনের ঘটনায় অনেক সময় সাম্প্রদায়িক সারবস্তু তেমন থাকে না। আবার থাকেও। টোকা দিয়ে দেখার বা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে মহলবিশেষ। প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দিতেও এমন কিছু ঘটানো হয়। তবে অস্বীকার করা যাবে না, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দু না হলে তাদের আঙ্গিনায় ককটেল ফাটত না।

২০০১-এর ঘটনাবলি দেখে 'সিটিজেনস ভয়েস' নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা নিয়েছিলাম রাজধানীর কিছু উদ্বিগ্ন হিন্দু আর লজ্জিত মুসলমান। তখন একটি আধা-প্রকাশ্য পরামর্শ সভায় দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এক নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ''আমাদের গায়ে হাত তোলা অত সোজা না। আমরা গরু খাই, শুয়োরও খাই।'' কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ।

সংখ্যালঘু হলেও দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম। পশ্চিমাদের ক্ষুব্ধ করতে স্বভাবতই রাজি নয় সাম্প্রদায়িক হামলাকারীরা। এ অঞ্চলের ইতিহাস ও চলমান রাজনীতির গভীরেও নিহিত রয়েছে বেছে বেছে হিন্দুর ওপর হামলে পড়ার কারণ।

এদেশে আদিবাসীরা রয়েছে আরও চাপে। দলবদ্ধভাবে বাস না করলেও এদের তো চেনা যায়। চেহারায় রয়েছে অন্য ছাপ মারা। পর্যায়ক্রমিকভাবে হিন্দু তাড়িয়ে আমরা তাদের ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছি। আদিবাসীদেরও ওদের নিজ অঞ্চলে পরিণত করেছি সংখ্যালঘুতে। এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনদেরও দায় আছে। বাহাত্তরের সংবিধানেও আদিবাসীদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়নি। পঁচাত্তর-পরবর্তী ইতিহাস তো করুণ।

তবু ভালো, শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সই হয়েছিল। এ-ও সত্য, এতদিনেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হল না। আওয়ামী লীগের ওপর হতাশ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু) মাঝে মাঝে অপ্রিয় কথাও বলে বসেন এখন।

এর কারণ তো রয়েছে। তিনি দেখলেন, সাম্প্রতিককালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও শুধু সংখ্যাগুরুর জাতীয়তার স্বীকৃতি দেওয়া হল। পরিবর্তিত বাস্তবতায় সুযোগ তো ছিল সংশোধনের, উদার হওয়ার। অতীতের অনুদারতা আঁকড়ে থাকার মানে কী? প্রসঙ্গটা আনা হল বলতে যে, সংবিধানে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রাজনীতিতে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ওটার। হিন্দুর সঙ্গে আদিবাসীকেও সমনাগরিক হিসেবে মর্যাদাদানের প্রশ্ন তো রয়েছে।

বারবার আক্রান্ত হিন্দুদের অনেকে অবশ্য ভোটাধিকারই বর্জন করতে চায় এখন। যশোরের ওই নারী ধর্ষিত হওয়ার আগে হাতে কালির দাগ নেই দেখিয়ে বলেছিলেন, ভোট দিতে যাইনি তো! তাতে কী; হামলাকারীর বিশ্বাস, ভোটকেন্দ্রে গেলে নৌকাতেই সিল মারত। সুতরাং ধর্ষণসহ নির্যাতন, এমনকি মৃত্যু তার প্রাপ্য। সবচেয়ে ভালো হয়, ভিটেমাটি যা আছে সেটা তাদের কাছেই কম দামে বেচে দিয়ে ভারতে চলে গেলে। ওখান থেকে মুসলমানদের যদি একইভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এদেশে? তাহলে কিন্তু আপত্তি করবে এসব হামলাকারীর ইন্ধনদাতারা। বলবে, এটা সাম্প্রদায়িকতা!

ভারতের মুসলমানরা অবশ্য এদেশে আসতে চায় না। মার খেলেও ওখানে পড়ে থাকতেই তারা সচেষ্ট। পাকিস্তানে তো যাবেই না। ওটা আর কোনো দেশ নয় এখন। পাকিস্তান হল নিজেরা খুনোখুনি করে নিঃশেষ হওয়ার একটা জায়গা। তাহলে বাংলাদেশের হিন্দু কেন মার খেয়ে ভারতে যাবে?

সম্পদশালী, সুশিক্ষিত ও উচ্চ পেশাজীবী হিন্দুরা অনেক আগেই ভারতে চলে গিয়েছিল। দেশবিভাগের সময় যারা যায়নি, পাকিস্তান পর্বে বিভিন্ন অপঘটনায় তাদেরও একাংশ সেখানে চলে যায়। তুলনামূলক পছন্দের ব্যাপার ছিল বৈকি। নিরাপত্তাবোধের বিষয়ও ছিল।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশা তো জেগেছিল, এত কিছুর পরও 'মায়ার ছলনায়' হলেও যারা ভারতে যায়নি, সেই ২০-২২ বা ২৫ শতাংশ হিন্দু এদেশে অন্তত নিরাপদে থাকতে পারবে। দুঃখ যে, সেটুকুও নিশ্চিত করা গেল না।

ইতোপূর্বে বিডিনিউজের এক নিবন্ধেই লিখেছিলাম, মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লেখা হলেও এর পক্ষে রাজনৈতিক কাজ করা হয়নি বললেই চলে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তো সংবিধান থেকেও নীতিটাকে উৎখাত করা হয়। এমনি ধারায় এগোতে এগোতে এক পর্যায়ে 'রাষ্ট্রধর্ম'ও প্রতিষ্ঠা করা হয় সংবিধানে। এতে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানের মন তো ভেঙেছেই, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মন ভেঙেছে সবচেয়ে বেশি। ইতোমধ্যে দেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে উগ্র মুসলিম মতবাদেরও হয়েছে আমদানি ও চাষবাস।

আমরা কেবলই বলি, এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেছিলেন শান্তি ও সমন্বয়বাদী সুফি-সাধকরা। গর্ব করে এখনও বলি, আমরা সহিষ্ণু মুসলমান। কিন্তু লক্ষ করি না, দেশের মুসলিম সমাজের বিরাট অংশে ছড়িয়ে পড়েছে উগ্রতা। অন্যান্য মুসলিম দেশেও এটি লক্ষণীয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে নিরুৎসাহিত করার পরও ধর্মীয় উগ্রতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক ও মিসরের মতো দেশে। বাংলাদেশে তো একে উৎসাহিত করা হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে!

দশকের পর দশক ওহাবি মওলানারা যেসব ওয়াজ করেছেন দেশের আনাচে-কানাচে গিয়ে, তার প্রভাব কি পড়েনি সমাজে? এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ঘুরেফিরে এখনও রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বিএনপি-জামায়াত মোকাবেলায় এর 'প্রয়োজনীয়তা'ও অনেকে ব্যাখ্যা করবেন জানি। কিন্তু অস্বীকার করা কি যাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বাড়িয়ে তোলায় ওই স্বৈরশাসকের ভূমিকা?

১৯৯০-এ অযোধ্যার বাবরি মসজিদের প্রথম ঘটনাটি ঘিরে তার ধারেকাছেও না থাকা এদেশের হিন্দুর ওপর যে সহিংসতা হয়, তাতে কি ছিল না রাষ্ট্রীয় মদদ? ওই সময়ে বেশ চালু একটি চিহ্নিত সংবাদপত্রের উস্কানিমূলক ভূমিকাও ছিল।

না, গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় উত্তরণের পরও এর জন্য দায়ীদের বিচার তো দূরের কথা; জবাবদিহিও করতে হয়নি। বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা নিয়ে আবারও হামলা ও চাপের মুখে পড়ে এদেশে থেকে যাওয়া হিন্দুরা। মনে আছে, সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ওটা 'স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া'! হিন্দুরা নিজ পছন্দে ভোট দিতে গেলে মার খাবে, সেটাও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভোট দিয়েছিল বিএনপি সমর্থিতদের। এমন খবর পাইনি যে, এজন্য ক্ষমতাসীনরা তাদের ওপর কোথাও হামলে পড়েছে। কারও ওপর হামলে না পড়ে তাকে বুঝতে চাওয়াটাই গণতান্ত্রিক মানসিকতা। সেটি থাকলে বিএনপি চেষ্টা করত এদেশে বসবাসরত হিন্দুর মন ও চাহিদা বুঝতে।

গবেষকরা বলেন, তাদের জমিজমা আওয়ামী লীগের লোকজনই বেশি কব্জা করেছে। বিএনপির তো জন্মই হল পরে। তারপরও হিন্দুরা নৌকায় ভোট দেয় কেন, তার নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে যেটুকু আছে, তা নিয়েও নিরাপদ বোধ করে না হিন্দুরা। এরও সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। এদেশের হিন্দুরা তো দেখেছে, কারা বা কাদের প্রশ্রয়ে তাদের ওপর হামলা হয়ে থাকে সাধারণত। তারা জানে, হামলার সরাসরি শিকার না হলেও কাদের ভূমিকায় তাদের মানসিক চাপে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত।

হ্যাঁ, কক্সবাজারের রামুর মতো দু'চারটা ঘটনা রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকর্মে একজোট হয়েছে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ। কিন্তু লাগাতারভাবে হিন্দু নির্যাতন ও বিতাড়নে নিয়োজিত আছে কারা? কারা তাদের 'শক্র' বিবেচনা করছে রাজনৈতিক-আদর্শিকভাবে?

২০০১-এ এটা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে অন্তত এদেশের হিন্দুদের কাছে। প্রতিবেশি হয়ে, পাশে থেকেও আমরা মুসলমানরা ঠিক বুঝব না মানসিকভাবে কতটা উন্মূল হয়েছেন তারা ওইসব ঘটনায়। সমাজের গভীরে ঘটে চলা পরিবর্তনও তারা টের পেয়ে গেছেন, যখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছেন খোদ প্রতিবেশিকে বদলে যেতে।

এবারও তেমন কিছু ঘটনা নাকি রয়েছে। প্রশাসন উদাসীন। প্রতিবেশিরা হামলাকারী না হলেও বিপদে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না ওয়াহিদুল হকের মতো। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগ তার সরকারের মেয়াদশেষে এলাকা থেকে উধাও।

পরস্পরকে জড়িয়ে এক জায়গায় কোনোমতে পড়ে থাকা হিন্দুকে তাহলে বাঁচাবে কে? তাই ওদের ঘরবাড়ি ফেলে সাঁতরে পেরোতে হয়েছে কনকনে শীতের নদী। তরুণীদের আগেই সরিয়ে দিতে হয়েছে নিরাপদ কোথাও।

শুরুর কথায় ফিরে আসি। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর কিন্তু বলছে, ২০০১এ ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি গত পাঁচ বছরে।

প্রধানমন্ত্রী 'যতটা প্রয়োজন' কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনায় এসব ঘটনা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তোলার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে অতীতে দেখেছি, যত গর্জে তত বর্ষে না। বেশি কথা শুনলে তাই মনে হয়, কাজের কাজ কিছুই হবে না। এদিকে বিএনপি-জামায়াত প্রায় অভিন্ন সুরে বলছে, সরকারই ঘটাচ্ছে এসব বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে। তাদের কথা যে ঠিক নয়, সেটি প্রমাণেও দায়িত্বও রয়েছে সরকারের।

তাদের দাবি মেনে নিয়েই না হয় গঠিত হোক একটা বিচার বিভাগীয় কমিশন। সর্বজনগ্রাহ্য কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে করা হোক এর প্রধান। আক্রান্ত হিন্দুরা সেখানে গিয়ে অন্তত মন খুলে বলুক, 'সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির' এই দেশে কেমন আছে তারা।

ওইসব শুনে আমরাও হয়তো কিছুটা বুঝতে পারব, সংখ্যালঘুকে কেমন রেখেছি গুরুরা।