গালিভারের প্রস্থান

Published : 11 Jan 2014, 09:06 PM
Updated : 11 Jan 2014, 09:06 PM

গৎবাঁধা অনুভূতি থেকে বলতেই পারি যে এই মৃত্যু অসম্ভব, এই মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শুধু মাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে অনুসরণ করে আমাদের জাতীয় জীবনের নতুন বিন্যাস তৈরি করতে চেয়েছিলাম আমরা। সেটা সাংস্কৃতিক অর্থে যেমন, তেমনি রাজনৈতিক অর্থেও।

সাংস্কৃতিক অর্থে এই জন্যে যে তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশের ইতিহাস, কোরআন এবং সংবিধান-সংক্রান্ত যে-লেখাগুলো আছে সেখানে আমরা তার ভূমিকাকে অনেক বেশি স্পষ্ট রূপে দেখতে পাই। বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে এগুলো যে মৌলিক উপাদান তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

হাবিবুর রহমান তার কর্মজীবনে এগুলোকে সব সময়ে তার চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছিলেন। এর বাইরেও তার নানান ধরনের লেখা রয়েছে। তবে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে তিনি আমাদের জাতি গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোকেই তার চর্চার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এমন কি, এও লক্ষ্য করবো যে তিনি ভাবনায় এবং বক্তৃতায় বিষয় হিসেবে যেসব ধারণাকে বেছে নিয়েছেন সেখানেও তিনি বাংলাদেশের সমস্যার ও সম্ভাববনার মুল বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

সব বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না বটে, তবে যখনই যেসব বিষয়ে বলেছেন তখন তা নতুন পর্যবেক্ষণ, নতুন বিশ্লেষণে ছিলো অনন্যসাধারণ। এর কারণ তিনি স্বভাবসুলভ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পৌঁছে যেতে পারতেন বিষয়ের গভীরে। আর তার সততা ও দুঃসাহস তাকে সমসময় সাহায্য করতো এমন সব বক্তব্যে যা সচরাচর আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরল।

১৯৯৬ সালে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান হিসেবে। অসম্ভব দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে তিনি এই জটিল দায়িত্বটি সম্পাদন করেছেন। ক্ষমতার শীর্ষে, এমনকি ক্ষমতার আশেপাশে থেকেও, কত ক্ষুদ্র মানুষও নানান ধরনের বৈষয়িক সুবিধায় ফুলেফেঁপে ওঠেন। কিন্তু হাবিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এরকম কোনো উদাহরণ কেউই খুঁজে পাবেন না। বাংলাদেশের মতো প্রবলভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ একটি দেশে সৎ ও নির্ভীক থাকা যে কী কঠিন ব্যাপার তা যে কেউ স্বীকার করবেন। হাবিবুর রহমান ছিলেন এই কঠিন পথের এক বিরল পথিক।

আমাদের বুদ্ধিজীবী আছেন অনেকেই কিন্তু দুঃসময়ে সঠিক কথাটি সঠিক সময়ে বলার লোক খুব কম। তিনি কোনো রকম সুবিধা বা সুযোগের আশায় সঠিক কথাটি বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি কখনোই। ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ গুণের অধিকারী। কোনো দল বা মত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কখনো নিজের ব্যক্তিত্বকে ছোট করে ফেলেননি।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল লিলিপুটদের দেশে এই গালিভারতুল্য মানুষটির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের। সম্পর্কটির সূচনা হয়েছিলো এমন এক সময়ে যখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। হঠাৎ করেই একদিন আমি, ব্রাত্য রাইসু এবং সাজ্জাদ শরিফ তার বাসায় গিয়েছিলাম। রাইসু এবং সাজ্জাদ শরিফকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন, আমি ছিলাম তার কাছে পুরোপুরি অপরিচিত। রাইসু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরই তিনি যা বলেছিলেন তা আমার এখনও মনে আছে: "আরে, আপনি তো ভারি দুষ্ট লোক। হুমায়ুন আজাদের মতো লোকের মুখোমুখি হয়ে টিকে থাকার যোগ্যতা যার আছে তিনি দুষ্ট না হয়ে পারেন না।"

আমার নেয়া হুমায়ুন আজাদের সাক্ষ্যাৎকার সবে প্রকাশিত হয়েছিলো মানবজমিন পত্রিকায়, তিনি সেটাও লক্ষ করেছিলেন বুঝলাম। আমি সেদিন তার সঙ্গে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ পাইনি। পরে, প্রায় ১২/১৩ বছর পর আবার যখন দেশে ফিরে এসে তার সঙ্গে যোগাযোগ হলো তখন তিনি 'সাধারণ' একজন মানুষ। সাধারণ এই কারণে যে তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন মানুষ, কিন্তু লেখালেখিতে সদাচঞ্চল।

আমার বহুদিনের আকাংক্ষা ছিলো তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমে যোগদানের পরপরই তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার আশায়। সবাই জানেন যে তিনি নানান বিষয়ে লেখালেখি করলেও সাক্ষাৎকার দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি কৃপণ। অনেক কাঠখড় পুরিয়ে শেষে রাজি করাতে পেরেছিলাম তার সাক্ষাৎকার নেয়ার ব্যাপারে। কেন যে তিনি রাজি হয়েছিলেন তা আল্লাহ মালুম।

তিনি যে একটু খেয়ালি মনের মানুষ ছিলেন তা আমি বুঝেছিলাম তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই। হয়তো এই খেয়ালি মনের দুর্বল মুহূর্তে তাকে বশ করতে পেরেছিলাম বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য এই যে হাবিবুর রহমান বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের লেখক ছিলেন। যখনই তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে লেখার দাবী জানিয়েছি তিনি সেসব দাবী পূরণ করেছেন। সর্বশেষ দাবির প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে উপস্থিত হয়ে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন।

অনলাইনে বা ইন্টারনেটের ব্যাপারে তিনি বিশেষ কিছু না জানা সত্ত্বেও বিডিনিউজের প্রতি কৌতুহলী ও উৎসাহী ছিলেন সবসময়। তার উৎসাহ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে তার লেখা সম্পর্কে এক পাঠকের কটু মন্তব্যের জবাবও তিনি দিয়েছিলেন মন্তব্যের ঘরে।

আমার সঙ্গে তার দাপ্তরিক যোগযোগের বাইরেও একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো এবং সেটা গড়ে উঠেছিলো ২০১০ সালে দেশে ফেরার পরপরই। আমার স্ত্রী এবং ছেলেকে তিনি একদিন দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন তার বাসায়। এটা ছিলো এক অভাবিত আমন্ত্রণ। আমার মতো তুচ্ছ, নামগোত্রহীন মানুষকে তিনি দাওয়াত করে কেন খাইয়েছিলেন তা আমার কাছে এখনও রহস্যাবৃত। বড় মানুষের মধ্যে অনেক রহস্যময় গুন থাকে, এটি হয়তো তারই এক নমুনা।

মনে পড়ছে, আমার স্ত্রী যখন সন্তানসম্ভবা তখন তাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সন্তানের জন্য একটি নাম নির্বাচন করার। বলেছিলাম আমাদের যদি মেয়ে হয় তাহলে তিনি যেন একটি নাম নির্বাচন করেন তার জন্য। আমার সে অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন। অসম্ভব সুন্দর একটি নাম রেখেছিলেন তিনি আমার মেয়ের জন্য: মায়া।

এই নামের পেছনে দুটি দেশের ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্বকে ঘুচিয়ে তিনি ছোট্ট অথচ মায়াবী একটি শব্দে তাঁর অনুভূতিকে প্রকাশ করেছিলেন যথার্থ রূপে। একই সঙ্গে এটি দুই সংস্কৃতির বন্ধনকেও তুলে ধরে। প্রতি সপ্তাহেই তার সঙ্গে ফোনে আলাপ হতো। আলাপে তিনি তার নাতনী মায়ার কথা জিজ্ঞেস করতে কখনোই ভুলতেন না। আমার ছেলে ও স্ত্রীর কথাও জিজ্ঞেস করতেন। শুভেচ্ছা জানাতেন তাদেরকে।

এই অসাধারণ মানুষটির সাধারণ হওয়ার গুনটি ছিলো অসাধারণ ব্যাপার। একটি দেশের ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করার পরও কারো পক্ষে সাধারণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। হাবিবুর রহমান ছিলেন এই অসাধারণ গুণের এক মানুষ। আজকাল তার মতো পণ্ডিত, বিবেকবান, সৎ আর নির্ভীক মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে তাঁর প্রয়াণ আমাদের কাছে যেমন বেদনার, তেমনি অপূরণীয় ক্ষতির এক বিরল দৃষ্টান্ত। আপনাকে আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাই।

রাজু আলাউদ্দিন: লেখক ও সাংবাদিক।