নৈঃশব্দ আর উৎসবের রাজনীতি!

মানস চৌধুরী
Published : 21 Oct 2010, 02:35 PM
Updated : 21 Oct 2010, 02:35 PM

বাংলাদেশে রাজনীতি বিষয়ক আলাপচারিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষ আর বিপক্ষ শক্তি সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষতা। আলাপচারিতায় প্রতিপক্ষতার ধরনটি এমনই শক্তিশালী যে পক্ষ-বিপক্ষের কার্যকারণ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন তুলতে যাওয়া ধড় আর মাথার অবধারিত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে পারে। মুস্কিল হচ্ছে, এই দুটো অবস্থান থেকে আদতেই যে কার্যকর কিছু ঠাহর করা যায় তার কোনো নিশ্চয়তা, কিংবা প্রমাণ নেই। একটা সহজ সমাধান হলো পাকিস্তানপন্থী ও বাংলাদেশপন্থী বলে বিষয়টাকে চালানো। কিন্তু ছোটবেলার খেলার মাঠে এ নিয়ে তর্ক করা এক কথা, আর আধুনিক বিশ্বের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সম্পর্কের মধ্যে পন্থিতা বিষয়ক আলাপ করা আরেক কথা।

এখানে রাষ্ট্রের কোন অংশ যে কীসের পন্থী তার সহজ কোনো ফয়সালা নেই। এবং পরিশেষে সকলে মিলেমিশে এক বিশ্বব্যবস্থার পন্থী হওয়া ছাড়া আর তো কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যায় না। আর সেটার মানে হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'বন্ধুত্ব' করে থাকা। আফগান হামলার সময়কাল থেকে বিষয়টা আরও ঘোঁট পাকিয়ে গেছে। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় কেন্দ্র হিসেবে ভারতকে দেখার জন্য আলাদা করে কোনো দূরবীণ যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ আম-মানুষদের বোঝাবুঝি চুলোয় যাক, পরাক্রমশীল সাদ্দাম হোসেন পর্যন্ত কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের গাদ্দারি দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। জানা যায় না, জীবিত কালে ওটাই তাঁর সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল কিনা।

যাহোক, আমার আলোচ্য বিষয় ছিল স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বোঝার দুরূহ দিক নিয়ে। কিংবা হয়তো স্থূলতা নিয়ে। একটা সহজ রাস্তা বহুকাল চর্চিত হয়ে আসছিল। তা হচ্ছে, জামাত-শিবির হচ্ছে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি আর আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি। বিএনপি-জাপাকে কোথায় রাখা হবে সেটা প্রতিবারই তর্কসাপেক্ষ একটা বিষয় হিসেবে চলে আসছিল। এবং তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি কেইসে স্বতন্ত্রভাবে ফয়সালা হবার পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। বা, আরও নিঁখুতভাবে বললে, ফয়সালাহীনতাই বিরাজ করে আসছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলাপচারিতায় 'জামাত-শিবির' এমন এক পদ বা বর্গ যা দিয়ে এক গাদা আপত্তি ও প্রতিপক্ষতা একত্র করে অভিব্যক্তি করা সম্ভব ছিল। এটা নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয় যে 'ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি'র শোরগোল ফেলা কালে 'জামাত-শিবির' আরও নিবিড়ভাবে 'ঘাতক-দালাল' পদযুগলেরই সমার্থক হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে। এরকম একটা নির্ধারিত প্রতিপক্ষ থাকার পরও আমার তেমন কোনো আরাম কখনো লাগেনি। আরাম না-লাগার বড় কারণ হলো এই পদগুলো কালে কালে নানাবিধ বিদ্বেষ ও মূল্যবোধ আশ্রয় করতে করতে একটা জেনেরিক বর্গে পরিণত হয়েছে। এবং কিছুতেই রাজনৈতিক আলাপচারিতায় এই ধরনের মূল্যবোধাশ্রয়ী গড়গড় বর্গ কোনো সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে পৌঁছাতে দেয় না। সেটাকে বিপজ্জনক বিবেচনা করি আমি। যেভাবেই হোক না কেন 'যুদ্ধাপরাধী' বলে একটা পদ যে সাংবাদিকতা এবং সাধারণ আলাপচারিতায় গৃহীত হয়েছে একেবারে সাম্প্রতিক দু'চার বছরে সেটাতে, শর্তসাপেক্ষে এবং আপাতভাবে, খানিক স্বস্তি আমার হয়েছে।

যে বে-আরামের কথা হচ্ছিল সেটা পুনর্বার চাঙ্গা হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের হত্যার বিচারের তোরজোর চলার সময়ে। দেয়াল লিখন ও ব্যানার বিশেষভাবে আমাকে সচকিত করে। ঢাকা শহরের দুরারোগ্য ট্র্যাফিকের কারণে উপায় নেই যে রাস্তার পাশের প্রতিটা লিখন, মায় ঝোলানো সিনথেটিক কাপড়ের শব্দমালাগুলো প্রায় মুখস্ত না করে ফেলি। 'মুজিব হত্যার বদলা' নেবার ঘোষণা এবং নিহত পিতাকে আস্বস্তি প্রদান প্রায় নৈমিত্তিক কর্মসূচি, বিশেষত গজায়মান স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে। 'বদলা' কথাটির রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা প্রকট। এতে অনুভূতির সত্যতা যতটা প্রকাশ পায়, ততটাই লিবেরেল রাজনীতি চর্চার বিধিমালা লঙ্ঘিত হয়। ফলে ঢাকা শহরের নিরীহ এক বাসযাত্রী হিসেবে এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। তারপরও ভেবেচিন্তে দেখলে, আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু 'বদলা'র অলিবেরেল দম্ভ চিহ্নিত করা নয়। রাজনীতিতে লিবেরেল মূল্যবোধের পাহারাদার, আর যিনিই হোন, আমার না হলেও চলবে।

আমার ভাবনার মূল জায়গা বরং মুজিব হত্যার বিচার 'হয়ে যাওয়ায়' জনমনে (পড়–ন মধ্যবিত্ত মননে) যে স্বস্তির স্রোত বয়ে গেছে সেটা নিয়ে। এটা নিয়ে বোধহয় সন্দেহ না করলেও চলে যে যাদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাঁরা মুজিবকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। হয়তো অন্যান্য দেশ থেকে অপর হত্যাকারীদের ধরে আনার সরকারী প্রচেষ্টার ঘোষণাকেও কোনো সন্দেহ ছাড়া বিশ্বাস করা চলে। কিন্তু মুজিবকে হত্যার মুখ্য অনুঘটকদের চিহ্নিত করা গেছে কি? কিংবা আমাদের মনে মনে যেসব ক্রিটিক্যাল ফয়সালা আছে তা শব্দমালায় উচ্চারণ করা সম্ভব কি? একজন প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ককে হত্যার স্থপতির যে জটিল রাষ্ট্রীক ও আন্তরাষ্ট্রীয় চেহারা তা উন্মোচনের দায়দায়িত্ব কেউ নিচ্ছেন কি? এসব প্রশ্নের সদুত্তর নেই। এমনকি এসব প্রশ্নের উত্থাপনও নেই। আছে গভীর নৈঃশব্দের অনুশীলন। আর আছে একটা তরল সরল সন্তোষের চেহারা। একটা আত্মমগ্ন উদ্যাপন: 'যাক, তবুও একটা বিচার তো হলো।'

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সঙ্গে ভারতের সামরিক মৈত্রী কতগুলো অবধারিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বাধীনতা-উত্তর কালে। ভারতের সঙ্গে এই মৈত্রী ভাল ছিল নাকি মন্দ, কিংবা মৈত্রীটা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হালহকিকত কী হতে পারত এগুলো সব স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। কিন্তু এই মৈত্রীর কারণে নব-গঠিত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিচয় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছে নির্দিষ্ট হয়ে যায় যার খেসারত খুব চড়া মূল্যে দিতে হয়েছে। যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে এই ভারত-মৈত্রী অবধারিতভাবে একে সোভিয়েত-ব্লকের একটি নবোদিত শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। অধিকন্তু, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের একটা স্পষ্টভাষী কণ্ঠস্বর হিসেবেও বাংলাদেশ এবং এর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান আত্মপ্রকাশ করেন। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের তৎকালীন সমাজতন্ত্রমুখী, বা অন্ততঃ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের এই ভূমিকা মার্কিন-ব্লকে যে প্রতিহিংসার জন্ম দেয় তা গুরুতর গবেষণা ছাড়াই জানা যায়। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে মুজিব হত্যাকেই বা এই পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে অনুধাবন করি কীভাবে?! মুজিব হত্যার বিচারে প্রকাশিত সন্তোষ তাই খোদ কতগুলো অবশ্যম্ভাবী, তথাপি জটিল, প্রশ্ন থেকে বিযোজিত থাকার তাগিদ।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে বুঝবার ক্ষেত্রে অন্যতম জটিল একটি প্রসঙ্গ হচ্ছে, আমার ধারণা, খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেই-থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুগত একটা শক্তিশালী পক্ষ। পক্ষটিকে সম্ভবত ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হয়েছে লম্বা একটা সময়। ইতিহাস চর্চায় এই পক্ষটি বড় অনুদ্ঘাটিত থেকে গেছে বলে আমার ধারণা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, এবং বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, ক্ষমতা-প্রতিহিংসা তৈরি হয়েছিল অন্ততঃ তিনটা শিবিরে এক, সামরিক বাহিনীর মধ্যে মার্কিন-অনুগত পক্ষ; দুই, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তানী শাসক এবং/বা সামরিক বাহিনীর প্রতি লয়্যাল পক্ষ; তিন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে থাকা সেই শক্তি যা জোট নিরপেক্ষ বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণে বিচলিত বোধ করেছে  সরলভাবে, আওয়ামী লীগের মধ্যকার মার্কিন-অনুগত পক্ষ। আপাতঃভাবে, এই তিনটা পক্ষকে যতটা সমান্তরাল ও সমস্বার্থিক মনে হোক না কেন, এরা একটা মোর্চা বা ফ্রন্ট হিসেবে একত্রে কাজ করেছে এটা ভাবা সম্ভবতঃ অযথার্থ। বরং, কোনো পক্ষে কিছু ক্রিয়ার ফলাফল অন্যপক্ষকে অনিবার্যভাবে সুবিধা দিয়েছে। এভাবে একটা পরোক্ষ এবং শিথিল স্বার্থমোর্চা হিসেবে এরা শরীকী জমিন পেয়েছে। সঙ্গতভাবেই, মুজিব হত্যার জন্য যাঁরা শাস্তি পেয়েছেন তাঁরা নিজেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবমুক্ত করে দিতে পেরেছেন নানান রকমের স্বার্থগোষ্ঠীকে, বিশেষত তাঁদের যাঁর খোদ সরকারেরই নানান মাপের স্তম্ভ। আর এই ফাঁসিপ্রাপ্তরা 'তবু তো শাস্তি হলো' ধরনের এক লঘু উৎসবমুখরতা নিশ্চিত করতে পেরেছেন।

মুজিব হত্যার বিচারের এই মধ্যবিত্ত উৎসবমুখরতার পরপরই 'যুদ্ধাপরাধ' নিয়ে নতুন জজবা দেখা দিয়েছে। আগেই বলেছি, এই শব্দটি পাবলিক জবানে আবিষ্কৃত হবার পর কিছুটা আরাম আমার হয়েছে। সেটা এই পদটি তুলনামূলকভাবে কম গড়গড়া বলে। 'যুদ্ধাপরাধী' চিহ্নিত করা এবং বিচার করা আধুনিক বিশ্বের হিংস্র রাজনীতির মোকাবিলার স্বার্থে জরুরি। নানান পক্ষ এ নিয়ে অশান্তিতে আছে, থাকারই কথা। পাশাপাশি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, পত্রিকা-পড়–য়া অংশ এবং অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এমন মানুষজন বিচারের জন্য অপেক্ষাই করছেন। কিন্তু, মৌলবাদ বনাম সেক্যুলারবাদের উত্তুঙ্গ রাজনৈতিক বোধের মধ্যে 'যুদ্ধাপরাধী' বাছাই কাজটা নৈঃশব্দের আর উৎসবমুখরতার আরেক দলিল না হয়ে দাঁড়ায়।

আমার দুর্ভাবনাটি খুবই সরল প্রকৃতির। যদি 'সেক্যুলার'পন্থী কেউ যুদ্ধাপরাধী হয়ে থাকেন তিনি ধরা পড়বেন তো? যদি বর্তমান সরকার ও শাসকদলের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীরা থাকেন, এই হুলুস্থূল 'যুদ্ধাপরাধী-অনুসন্ধান' কার্যক্রমে তাঁরা চিহ্নিত হবেন তো? বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা সে বিষয়ে তেমন সায় কিন্তু দেয় না।

(২১শে অক্টোবর ২০১০॥ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার)