গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু ‘নিরপেক্ষ’ ছিলেন না

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 6 Jan 2014, 01:59 PM
Updated : 6 Jan 2014, 01:59 PM

অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে বিরাট সম্পদ। জ্ঞানীজনরা বলেন, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই অভিজ্ঞতা বদলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁর "বাংলাদেশ: জাতির অবস্থা" শীর্ষক বক্তৃতায় বলেন, "প্রজন্মের পার্থক্যের এই সমস্যা সব সমাজেরই অতীতে ছিল, এখনও রয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল উন্নত দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও প্রকট।"

আমরা লক্ষ করি, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কম নয়। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চিন্তা-চেতনা বা সামগ্রিক জীবনবেধে পার্থক্যটা দৃশ্যমান। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে পার্থক্যটা আরও বেশি প্রকট এবং অনতিক্রম্য।

প্রজন্মগত ভাবনার পার্থক্যের বিষয়টি অকস্মাৎ নজরে এল ২০১৩ সালের জেএসসি, জেডিসির ফলাফল প্রকাশের সংবাদ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখে। সফল শিক্ষার্থী আর তৃপ্ত অভিভাবকের আনন্দ-উজ্জ্বল অভিব্যক্তি মনটা ভরিয়ে দিল। কিন্তু কী ভীষণ প্রতিকূলতার মধ্যে হরতাল ও অবরোধের ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে তাদের। পরীক্ষার সময়সূচিতে পরিবর্তন এসেছে বহুবার। তারপরও পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে সবার হাসিমুখ দেখে ভালো লাগল।

কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ৮ম শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফল গণমাধ্যমে কোনো গুরুত্ব পেত না। মনে হয় সেদিন ৮ম শ্রেণিতে পড়েছি। হিসেব করে দেখি ১৯৭৯ সাল। মাত্র চৌত্রিশ বছর পূর্বে। পুরনো ঢাকার এক অখ্যাত বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ১০ বছর একই বিদ্যালয়ে পড়েছি। ১ম-১০ম শ্রেণি পর্যন্ত। স্কুলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানই ছিল বেশি।

চৌত্রিশ বছর কম সময় নয়। মেঘে মেঘে বেলা অনেক হল। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র– সর্বত্র পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। ৪ বছর যাবৎ ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসবে স্কুল, মাদ্রাসায় কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে সরকার নতুন বই তুলে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে ৩০ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে।

আমাদের সময়ের সাধারণ চিত্র ছিল বড় ভাইবোন বা পরিচিতজনের কাছ থেকে পুরনো বই সংগ্রহ করতে হত। অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই পুরনো বইয়ের খোঁজ করে, বইপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বইয়ের পাতা ছেঁড়া বা সেলাই ছেঁড়া থাকত। বইয়ের প্রচ্ছদ কেউ দেখেছে বলে মনে পড়ে না। নতুন বইয়ের আলাদা ঘ্রাণ কখনও পাইনি। কড়কড়ে পাতা, এক্কেবারে নতুন বই আমিই প্রথম পড়েছি তা কখনও হয়নি। যতদূর মনে পড়ে পাঠ্যপুস্তকে ছবি ও ড্রইংয়ের সংখ্যা খুবই কম ছিল। রঙিন ছবি ছিলই না। নিম্নমানের কাগজ আর সাদা-কালো বই দিয়ে স্কুলজীবন শেষ করেছি।

১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ ছিল এসএসসির শেষ পরীক্ষা। পরের দিন ২৪ মার্চ দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হল। সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিয়াত্তর বছর বয়সী নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে বলপূর্বক সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন।

এর ফলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপির নেতা-কর্মীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যান। যাদের চোখের দিকে তাকিয়ে লোকজন কথা বলতে সাহস করত না, তাদের গলার সুর বেশ নরম। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস না থাকলেও স্বস্তি দেখা গেছে পুরোমাত্রায়।

১৯৭৫ সারের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনে। প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন জারি হল; সংবিধান সংশোন হল; রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলে গেল; নাগরিকদের নতুন পরিচয় দেওয়া হল—বাংলাদেশি; সরকার ও রাজনীতিতে ধর্ম গুরুত্ব পেতে শুরু করল; রাষ্ট্রের নাম, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি উঠল। অর্থাৎ ৩০ লাখ শহীদ আর ৪ লাখ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় তা চেনার উপায় ছিল না। প্রায়-পাকিস্তান বানিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী সামরিক-বেসামরিক চক্র।

দীর্ঘ ইতিহাস আলোচনার সুযোগ নেই। ১৯৭৫ সালে আমি ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর কীভাবে বা কার কাছে প্রথম শুনেছি আমার মনে নেই। চারদিকে থমথমে অবস্থা, অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক। শোক এবং ভয়। কোনটা বেশি কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিষ্ঠুর, বর্বর হামলার শিকার হবেন– কেউ ভাবতে পারেনি। হঠাৎ পরিবারের প্রধান চলে গেলে যা হয়, কে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। বাঙালি জাতি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, এমনকি সমর্থকদেরও নানা রকম অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ধরপাকড় শুরু হয়। রাত ১০টা-১১টা বাজলে কার্ফু জারি করা হত। পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারত। কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রয়োজন পড়ত না। ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান পদে পদোন্নতি পান। জিয়া ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে বলপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে খন্দকার মুশতাক, পরে বিচারপতি সায়েম ছিলেন কাগজে-কলমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল সেনানিবাস, যার প্রধান ছিলেন জেনারেল জিয়া।

জিয়া যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁকে রাজনীতি করতে হলে আওয়ামী লীগবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত করে এক মঞ্চে আনতে হবে। এক কথায় পদ-পদবি-অর্থলোভী ও রাজনৈতিক আদর্শহীনদের মাঝে সরকারি পদ, রাষ্ট্রীয় অর্থ এবং দ্রুত বিত্তশালী হবার সুযোগ করে দিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।

সামরিক শাসকদের সাধারণ প্রবণতা হল ইতিহাস বিকৃত করা, সম্ভব হলে মুছে ফেলা। ইতিহাসভীতি থেকে পাকিস্তানে ইতিহাস পড়ানোর বদলে 'পাকিস্তান স্টাডিজ' পড়ানো হয় যাতে প্রকৃত ইতিহাসবোধসম্পন্ন, সচেতন নাগরিক গড়ে না ওঠে। জিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডিত এবং বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করেন।

রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিশেষভাবে টেলিভিশন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, রাজাকার ইত্যাদি শব্দগুলো নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি নাটক, চলচ্চিত্রেও উচ্চারিত হত না। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের সংবাদে দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা বলা হত, কিন্তু হানাদার পাকিস্তান বাহিনী উল্লেখ করা হত না। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান, বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম, স্বাধীনতাবিরোধীদের তৎপরতা, ভারতসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা উপেক্ষা করা হত।

মুক্তিযুদ্ধকে একটি সামরিক যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অস্বীকারের চেষ্টা ছিল স্পষ্ট। অর্থাৎ 'মেজর'দের বিপরীতে সবাই ছিল 'মাইনর'। জেনারেল এরশাদ রাজনীতিতে খুব একটা সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। যে কারণে তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে কোনো নতুনত্ব নেই। জিয়ার নীতিকেই 'কপি-পেস্ট' করে চালিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে 'তুই রাজাকার' শুনে সাধারণ মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পাখির মুখে এই দুটি শব্দের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতির তীব্র ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছে। যতটুকু মনে পড়ে 'নিমকহারাম' চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের অংশবিশেষের অডিও শোনানো হয়েছিল। পরিচালক ছিলেন শামসুল হক সিরাজী। জিয়ার শাসনের শেষের দিকে সেন্সর বোর্ড জানিয়ে দেয় 'জনৈক নেতার অকথ্য ভাষণ' কর্তন না করলে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না!

এই জাতির মুক্তির সংগ্রামে আর কেউ কি বঙ্গবন্ধুর চাইতে বেশি অবদান রেখেছেন? ত্যাগ স্বীকার করেছেন? শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তাঁর সহধর্মিনী, পুত্র-কন্যাসহ পুরো পরিবার সীমাহীন নিপীড়ন, নির্যাতন আর কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে। জাতির পিতা পরিণত হলেন 'জনৈক নেতা'য়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে গেল 'অকথ্য ভাষণ'!

পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জাতির মুক্তির আকাঙ্খা এমনি সুনিপুণ, প্রাঞ্জল ও সর্বজনগ্রাহ্য করে উপস্থানের দ্বিতীয় নজির পাওয়া দুস্কর। বাঙালি জাতির চিরকালীন প্রেরণার উৎস হিসেবে থেকে যাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বাংলাদেশে সামরিক-বেসামরিক কোনো শাসকই বঙ্গবন্ধুর কীর্তি মুছে ফেলার চেষ্টা করে সফল হবে না। এই অপকর্মে যারা লিপ্ত হবেন, তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।

জয় বাংলা– মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি।হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুজিবনগর সরকার 'জয় বাংলা'কে জাতীয় শ্লোগানে পরিণত করে। পাকিস্তান জিন্দাবাদের বিপরীতে 'জয় বাংলা' ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তাই সঙ্গত কারণেই জিয়া ক্ষমতা দখল করে 'জয় বাংলা' নিষিদ্ধ করলেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদের অনুকরণে চালু করলেন 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'। যে শ্লোগান বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অগ্নিশিখার ন্যায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রজ্বলিত রেখেছে।

সেই জয় বাংলা পরিণত হল কেবলই আওয়ামী লীগের দলীয় শ্লোগানে। কিন্তু জয় বাংলা যে এত প্রবলভাবে ফিরে আসবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বাধীনতাবিরোধীদের– তা অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কেন্দ্র করে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষিত হয়। সমগ্র জাতি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সুশীল সমাজের 'নিরপেক্ষ' প্রতিনিধিরা বলতে শুরু করলেন সরকারি ষড়যন্ত্রের কথা। আওয়ামী লীগ সরকার 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে' বিচার করছেন তা প্রমাণ করে দিলেন। বলা হল, বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ তলেতলে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করছে। তাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ শেষ হবে না, রায় হলেও কার্যকর হবে না, ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ আলোটুকু যখন নিভু নিভু, তখন হাজার হাজার তরুণ গভীর মমত্ব, হৃদয়ের উত্তাপ আর দেশপ্রেম নিয়ে জেগে উঠল শাহবাগে। তরুণদের এই উত্তাপ ছড়িয়ে গেল সব বয়সের নারী-পুরুষের মাঝে। এই জাগরণ জন্ম দিল গণজাগরণ মঞ্চের। 'জয় বাংলা' শ্লোগানে মুখরিত শাহবাগ চত্বর, এর ঢেউ আছড়ে পড়ল সারা বাংলায়। ১৯৭৫ সালের পর জয় বাংলার এমনই অভূতপূর্ব সমাবেশ আর হয়নি। নিরপেক্ষ হতে গেলে বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা বা রাজাকার বলা যাবে না। আসলে এটা নিরপেক্ষতা নয়, স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ নেওয়া। নতুন প্রজন্ম তা সুস্পষ্টভাবে তা উপলব্ধি করেছে।

এর জন্য প্রয়োজন জাতির সামনে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস উপস্থাপন। শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে উঠবে সেদিকে নজর দেওয়া। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়ার সুযোগ নেই। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পরে হলেও এর প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে কেউ অনুভব করলেন না। ব্যতিক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করেছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসপাঠে এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ কেউ নিয়েছেন বলে জানি না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো আকাশ থেকে পড়বে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পঠন-পাঠন, চর্চা, গবেষণার দৃশ্যমান সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে, ২০১৩ সালে নতুন প্রজন্ম শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল জ্বালাতে পারত না। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় না এলে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হত না। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্র যেটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে শাহবাগ আন্দোলনের তাৎপর্যময় অবদান আছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে বিরাট জনমত সংগঠিত হয়। প্রজন্ম যোদ্ধাদের দাবির মুখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল আইন সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে বাদিপক্ষের আপিল করার বিধান করা হয়। শাহবাগ আন্দোলন ব্যতীত আইনের সংশোধন হত কী না যথেষ্ট সংশয় আছে।

সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে এই প্রজন্মের হাতে। বাংলাদেশে ১৮-৩০ বছর বয়সী নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। স্বাধীন রাষ্ট্রের আলো, জল, হাওয়ায় যারা জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন তারা ভাগ্যবান। দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ নর-নারী আত্মাহুতি দিয়েছেন, অকথ্য অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন অনেকে। ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে মানুষ আর্দশের টানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আদর্শ প্রতিষ্ঠায় জীবনদানেও কুণ্ঠাবোধ করেন নি।

তাই বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কাছে যে ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ তা কোনো দিন ছিন্ন হবার নয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ– এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। সুতরাং কোটি কোটি বাঙালির অপরিসীম ত্যাগ, অতুলনীয় ভালবাসা, সহযোগিতা, দেশপ্রেম, এই ভূখণ্ডকে বিজয়ী করছে।

যুগসন্ধিক্ষণে কখনও কখনও এমন অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যখন কোনো একজন নেতা সমগ্র জাতির প্রতিনিধিতে পরিণত হন, তিনি হয়ে ওঠেন পথপ্রদর্শক। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শুধু তাঁর নির্দেশের জন্য। বাঙালি জাতির জীবনে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন নেতার দ্বিতীয় নজির নেই। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের প্রধানতম ব্যক্তিত্ব। আমরা সেই হতভাগ্য, অকৃতজ্ঞ জাতি যারা এই মহান নেতাকেও নানা ছলচাতুরির আড়ালে ছোট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হই।

বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠাতা বা জনককে নিয়ে গর্ব করে। আমাদের সমাজে মীরজাফরদের বংশধররা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে 'নিরপেক্ষ' হতে বলেন। 'নিরপেক্ষ' সুশীল, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধু বলেন না। বঙ্গবন্ধু বললে নিরপেক্ষতা থাকে না। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়ে থাকেন প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একবার লিখে পরে শুধু শেখ মুজিব লিখলে উভয়কূল রক্ষা হয়। তথাকথিত নিরপেক্ষতার আড়ালে সুবিধামতো নিজের অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ সংরক্ষিত থাকে।

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৮০ সালে মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় শুধু 'বঙ্গবন্ধু' লিখেছেন, শেখ মুজিবর রহমান উল্লেখ করেননি। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু তো দুজন নেই। সম্ভবত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক 'নিরপেক্ষ' থাকতে চাননি। তিনি স্পষ্টত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ নিয়েছিলেন। বর্তমান প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে তারা কোন পক্ষ নেবে।

গোপালগঞ্জ নিয়ে সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্য আমাদের হতবাক করেছে। চরম বিস্ময়ের সঙ্গে ভেবেছি সত্যি কি তিনি এই অশ্রাব্য, অশালীন বক্তব্য রেখেছেন? সবকিছু বাদ দিলেও গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান– এটা ভুলে যাওয়াটা অপরাধের শামিল। এই গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বাঙালির ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে কোনোদিন আপোষ করেননি। তিনি নিরপেক্ষও ছিলেন না। তিনি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকারের প্রশ্নে 'নিরপেক্ষ' থাকলে, বিভিন্ন সময় পাকিস্তানের কারাগারে প্রায় ১৩ বছর তাঁকে আটক থাকতে হত না।

তিনি কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ছিলেন না। তিনি সর্বান্তকরণে বাঙালির পক্ষে ছিলেন। আমার শিক্ষক মুনতাসীর মামুন এক আলোচনায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এ দেশ স্বাধীন না করলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন হয়তো। আর আমাদের অবস্থা কী হত ভাবতে গা শিউরে উঠে।

শেষ করতে চাই অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। তিনি মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এক বস্তনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন। একটু দীর্ঘ হলেও পাঠকের হয়তো ভালো লাগবে এই প্রত্যাশায় উপস্থাপন করছি।

"জাতির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে, জাতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বিচার করতে, যে চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুর মতো আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের পেছনে কাজ করেছে, তার গভীরে যাওয়া প্রাসঙ্গিক।… দেশপ্রেমের সংজ্ঞাকে যত ব্যাপক করে তোলা যাক না কেন, বঙ্গবন্ধু ততখানিই তাঁর দেশকে ভালোবাসতেন।… বঙ্গবন্ধু একজন ভালো মুসলমান, অনেক ক্ষেত্রে, প্রায় বিশুদ্ধবাদী মুসলমান ছিলেন।… ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত যে সময় দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং শুধু বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকেরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল।

… এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে তাঁর আগে অন্যান্য আরও প্রতীক ছিল। কিন্তু ১৯৭১এর প্রতীক এবং তার আগের প্রতীকগুলোর মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে। শুধু দুটো উদাহরণ নেওয়া যাক। গান্ধী এবং জিন্নাহ। দুজনের প্রত্যেকেই কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।

জিন্নাহ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, যুক্তিতে দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ জননেতা, যিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে উদ্দেশ্য সঠিক মনে করেছেন তার পক্ষে কাজ করেছেন এবং তাকে প্রায় সফল পরিণতিতে নিয়ে গেছেন। পরিপাটি নয় এমন কোনো আবেগ, যেমন প্রেম, জিন্নাহকে প্ররোচিত করবে সেটা ভাবা বেশ কঠিন।

গান্ধী ছিলেন আলাদা। তিনি প্রেমের কথা প্রচার ও প্রতিপালন করেছেন। অবশ্য তাঁর কাছে প্রেম ছিল ধর্ম– সব ধর্মের মানুষ। তিনি ছিলেন সর্ব বিশ্বের। এটা একটা নেহায়েৎ দুর্ঘটনা যে তিনি ভারতীয় ছিলেন। তাঁর গভীর ধর্মীয় চেতনাকে বাদ দিয়ে তাঁর রাজনীতির পর্যালোচনা করা অর্থহীন।

… উভয়েরই ছিল কোটি কোটি ভক্ত। এসব জনতার কেউই গান্ধী বা জিন্নাহকে তাদের নিজেদের একজন বলে ভাবতে পারত না। এটাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিন্নাহ বা গান্ধীর পার্থক্য। বঙ্গবন্ধু জাতি আর তাঁর নিজের মধ্যে একটা অবিভাজ্য মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন।"

[আবদুর রাজ্জাক, 'বাংলাদেশ: জাতির অবস্থা']