খুলেছে সুদিনের সিংহদুয়ার

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
Published : 4 Jan 2014, 03:04 PM
Updated : 4 Jan 2014, 03:04 PM
শুরুর কথা

বাংলাদেশের সুদিনের সিংহদুয়ার খুলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিস্ময়জাগানিয়া। আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিতরাও প্রশংসায় বাঙময়। এক সাগর রক্ত পার হয়ে চরম মূল্যে অর্জিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা। মূল্যবোধ ও গৌরবে দীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টুঁটি চেপে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পরাজিত শক্তি ও দেশি-বিদেশি অপশক্তির খলনায়কদের পাঁচজন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডিত। একজন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে। অন্যরা কাতারবন্দী। বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সুষ্ঠুভাবে, আইনানুগ প্রক্রিয়ায়, আন্তর্জাতিক মানে।

অচিরেই আগাছা দূর করে শতভাগ দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে রাজনীতি আরও বিজ্ঞ, বিচক্ষণ, দূরদৃষ্ট ও উদ্ভাবনী নেতৃত্বে কল্যাণ রাষ্ট্রের আরাধ্য চ্যালেঞ্জ জয় করে আর্থসামাজিক অগ্রগতির শীর্ষশিখরে পৌঁছার পথে বেগবান হবে। প্রয়োজন হবে সমঝোতা এবং সকল জাতীয় ইস্যুতে মোটাদাগের ঐকমত্য; কারণ গণতন্ত্রের যাত্রাপথে ভিন্নতা থাকলেও অভীষ্ঠ লক্ষ্য তো একই– সম্পদ সৃষ্টি ও এর বিনিয়োগের মাধ্যমে মানব উন্নয়নের সূচকে উচ্চতম ধাপে পৌঁছানো। অনেকে অবশ্য একে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছার কথা বলে থাকেন।

২০০৮-২০১২ সময়টা বিশ্বঅর্থনীতির মহাবিপর্যয়ের কাল হলেও, ২০০৯-২০১৩ সময়ে বাংলাদেশে সূচিত হয়েছে অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চমৎকার সামাজিক রূপান্তর। ২০১৩ সালে লন্ডনভিত্তিক লিগেটাম প্রসাপ্যারিটি সূচকে বাংলাদেশ বিগত পাঁচ বছরে বারো ঘর ডিঙিয়ে উঠে এসেছে ১০৩ নম্বর র‌্যাঙ্কে। আর একই সময়ে প্রতিবেশি ভারতবর্ষ পাঁচ ঘর পিছিয়ে নেমে গেছে ১০৬ নম্বরে। পাকিস্তানের অবস্থান ১৩২।

বাংলাদেশের ইতিবাচক সিড়িভাঙার সোপান হয়েছে সামগ্রিক সমৃদ্ধি (+৫), অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (+৪), উদ্ভাবনী উদ্যোগ (+২), সুশাসন (+১৮), স্বাস্থ্যসেবা (+৫), শিক্ষা (+১), নিরাপত্তা (+৫) ও সামাজিক মূলধন সৃষ্টি (+৩)। একমাত্র ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক পিছুটান (-১৩)। সাংবিধানিক পদ ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

বিশ্বনন্দিত অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বাংলাদেশের চৌকস অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অসাধারণ সামাজিক অগ্রগতিকে চমকপ্রদ ও দক্ষিণ এশিয়ায় 'শ্রেষ্ঠতম' বলে আখ্যা দিয়েছেন। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ও দ্য ইকোনমিস্ট কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণকে 'এশিয়ার বাতিঘর' বলে উল্লেখ করেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তিমুলক প্রবৃদ্ধি এবং জনবহুল নিম্নআয়ের দেশ হয়েও প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র নিরসনে (দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থানকারীদের সংখ্যা গত কয়েক বছরে শতকরা ৩৬ থেকে ২৬ ভাগে নামানো হয়েছে) দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য লাভ করেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক 'ডুয়িং বিজনেস' রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশ নতুন উদ্যোগ শুরুর র‌্যাংকে ২১ স্তর ডিঙিয়ে ৭৪তম স্থানে উঠে এসেছে। বিশেষভাবে উন্নত হয়েছে নিবন্ধন, অটোমেশন, ইন-সার্ভিস ডেলিভারি, ট্রেড লাইসেন্স এবং ট্যাক্সেশন সম্পন্নের প্রক্রিয়ায়।

এদিকে অন্য একটি সারণীতে বিশ্ব ব্যাংক দেখিয়েছে যে, উন্নয়নের প্রধান ১২টি সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ স্বল্পআয়ের দেশসমূহের মধ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগামী রয়েছে। এ রকম প্রশংসার কথা আরও অনেক আছে।

তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার

বর্তমান বিশ্বঅর্থনীতি সাম্প্রতিক মহামন্দা কাটিয়ে উঠছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের ভাষায়, ১১টি উদীয়মান অর্থনীতির অন্যতম বাংলাদেশের সামনে রয়েছে 'আরও বেশি তেজে এগিয়ে যাওয়ার হাতছানি'। উত্তর আমেরিকা ও ব্রাজিলে বিশাল বিপুল তেল ও গ্যাসের মওজুদ ইতোমধ্যে বাজারজাত করা হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরে তেলের দাম অর্ধেকেরও নিচে নামবে; ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বছরে তিন থেকে চারশ কোটি ডলার বেঁচে যাবে তেল আমদানির বিলে। বিনিয়োগ করা যাবে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে।

বিশ্বে চল্লিশ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের কেনাবেচা হয়। চীনের পনের হাজার কোটি ও বাংলাদেশের দুই হাজার কোটি ডলার। চীন ইতোমধ্যে অতিরিক্ত মজুরির কারণে এ খাত থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করছে। বড় বড় ক্রেতাদের পছন্দের সরবরাহের সূত্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে বাজার সম্প্রসাণের বিপুল সম্ভাবনা।

কিন্তু রানা প্লাজা বিষয়ে ধীরগতির সমাধান, তাজরিন ফ্যাশনসসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধানে অনীহা, মালিক বন্ধুদের বৃহৎ পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধা, শ্রমজীবী ভাইবোনদের অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে ভাঙচুর করা, গঠনমূলক আইনানুগ ট্র্ডে ইউনিয়ন শুরু করার বিষয়ে গড়িমসি, ডিজাইন ও বাজারের বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারসহ উদ্ভাবনী নীতিকৌশল গ্রহণে সাহসী পদক্ষেপ বিষয়ে জোরকদমে এগিয়ে গেলে, চীনের ছেড়ে দেওয়া বাজারসহ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রফতানি আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।

প্রকৃতপক্ষে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির পূর্ণ বিকাশ ও উৎপাদন বহুমুখীকরণ সম্পন্ন করার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কর্মসংস্থান, রফতানি আয় ও রাজস্ব আদায়ে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার খাতের সুষ্ঠু সম্প্রসারণ বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। একটি শক্তিমান ও কার্যকর পরিকল্পনা কমিশন এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষা ও মানবসম্পদ

শতকরা ৬৫ ভাগ শিক্ষার হার, প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি ও ঝরে পড়ার হার শতকরা চল্লিশ ভাগের নিচে নেমে আসা, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দৃষ্টিনন্দন অংশগ্রহণ ও সাফল্য, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বিনামূল্যে ত্রিশ কোটি বই বিতরণের উৎসব, উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে অগ্রগতি এবং জনসম্পৃক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়নের সফলতা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।

তবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সসীমায় অবস্থানকারী ১০ কোটি জনসংখার বৃহত্তর অংশকে জনসম্পদে রূপান্তর করার প্রচেষ্টায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মধ্য মাধ্যমিকে দেশে-বিদেশে চাহিদাসম্পন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, উচ্চশিক্ষাকে আরও প্রযুক্তিমুখী করা, যুগোপযুগী শিক্ষা আইন প্রণয়ন, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও হাওর-বাওর অঞ্চলে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বাধ্যতামুলকভাবে শীতকালীন সেমিস্টারে গ্রামে-গঞ্জে পাঠিয়ে সম্পদ ম্যাপিং, জন্মনিবন্ধন, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ, পবিরার পরিকল্পনা, টিকা ও স্বাস্থ্যসেবা, মৎস্য, পশু ও মুরগিপালনে উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাকার বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষার ব্যবস্থা করার খুবই জরুরি।

মনে রাখা ভালো যে, শিক্ষাখাতে কোনো ব্যয়ই খরচ নয় বরং এটি একটি উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ যাতে চিরন্তন মানবপুঁজির জন্ম হয়। বলতে দ্বিধা নেই, বেশ বড় হাতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডস ইন্সটিটিউটকে বিশ্বমানে রূপান্তর করা গেলে শিক্ষা, বাণিজ্য ও মানবসেবা রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অতিরিক্ত সফলতা আসবে। শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিদেশি বিনিয়োগ ও কারিগরি জ্ঞান আহরণের স্বার্থে সাতাশ বছর ঝুলে থাকা কোরিয়ান ইপিজেডের অনুমোদন আবশ্যক।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সাত বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। প্রকৃত উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি, প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট। মুখরোচক সমালোচনায় কুইক রেন্টালকে দোষী করা হলেও, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার দীর্ঘমেয়াদী কুইক রেন্টালের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি লাগসই হয়েছে; কারণ মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ক্রমঅবসান সম্ভব হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, মাত্র একশত বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে ২৮০০ এমএমপিটিএ উন্নতমানের বিটুমিন কয়লার মওজুদ রয়েছে তা যদি খনির মুখে শতকরা ৮৫ ভাগ উৎপাদনশীল উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আহরণ করা হয়, তাহলে ৫০ বছর যাবত ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। সনাতনি খনি পদ্ধতি ইতালি বা জার্মানিতে চলতে পারে। কারণ ওইসব দেশে পানির স্তর ১০০ ফুট নিচে, আর আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে ১০-২০ ফুট নিচেই পানির প্রবাহ।

তাই সর্বোচ্চ শক্তি, সম্পদ, অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য ও ভূমির মালিকদের সব ধরনের সর্বোচ্চ বিবেচনা দিয়ে ওই কয়লা থেকে আগামী তিন বছরেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে বিদ্যুতে একটি টেকসই সমাধান ও আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে উল্লম্ফন সূচনা জরুরি। সারা বিশ্বে যখন কয়লা থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনই রীতি (দক্ষিণ আফ্রিকা ৯৩%, পোল্যান্ড ৯২%, গণচীন ৭৯%, কাজাখস্তান ৭৫%, ভারতবর্ষ ৬৯%, ইসরাইল ৫৮% এবং যুক্তরাষ্ট্র ৪৯%)– সেখানে আমরা মাত্র ৫.৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করি।

আর পৃথিবী যেখানে গ্যাস দিয়ে ২১ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেখানে আমরা বাংলাদেশে ক্ষীয়মান বহুমূল্যবান গ্যাস থেকেই শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। তাও আবার মাত্র ৩৭ ভাগ দক্ষতায়। কারণ সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা হাস্যকর সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাচ্ছেন বলে, অত্যন্ত পুরাতন রোটেটর ব্যবহার করে গ্যাসের অপূরণীয় অপচয় করছেন। এই একটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার দিয়ে দৃঢ়ভাবে গ্যাস থেকে উন্মুক্ত কয়লা পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া অতীব কল্যাণকর ও সাশ্রয়ী হবে।

তাছাড়া সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস, পানি ও আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহ ও কার্যকর সহযোগিতা প্রদান আবশ্যক। বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করে নিশ্চিত গ্যাসপ্রাপ্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে।

প্রাথমিক খাত: কৃষি, মৎস্য, পশু ও মুরগি পালন

খাদ্য উৎপাদনে বৈশ্বিক টালমাটাল সত্ত্বেও উপযুক্ত নীতি কৌশল ও উদারহস্ত ভর্তুকি মূল্যে সময়মতো উৎপাদনের উপকরণ জোগান নিশ্চিত করার ফলে বিগত পাঁচ বছরে পঞ্চাশ লক্ষ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হয়েছে। কিষান-কিষানীরা খেটেছেন জানপ্রাণ দিয়ে। এত বেশি উৎপাদন হয়েছে যে খাদ্য সংগ্রহ করে গুদাম সংরক্ষণের জায়গা অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। এদিকে গ্রামীণ অর্থনীতি জোরদার হলেই দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গতিলাভ করে তা আবারও প্রমাণিত হল।

অবশ্য কয়েকটি নতুন বিষয় সামনে এসেছে। গ্রামবাংলায় দৈনিক প্রকৃত মজুরি দশ কেজি চালের সমতুল্য (টাকা ৩০০/৩০=১০ কেজি চাল), এতে কৃষি শ্রমজীবীগণ খুবই খুশি। কিন্তু ভূমিমালিক উৎপাদনকারীগণ অভিযোগ করেছেন যে, উৎপাদন খরচ যে হারে বাড়ছে, কৃষিপণ্যের মূল্য সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। পারিবারিক সাংবৎসরের খোরাকি হিসাবে আনলেও, কৃষিকাজ আগের মতো লাভজনক নাও হতে পারে।

সেজন্য উপকরণ ভর্তুকি বনাম মূল্য সমর্থনের বিতর্কে আবারও যেতে হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো প্রয়োজন খাদ্য গুদাম ক্যাপাসিটি এবং হিমাগার সম্প্রসারণ। শস্যবীমা আর মুখের কথা থাকলে চলবে না। আধুনিক বিশ্বে সফলভাবে পরিচালিত কৃষি উৎপাদন ও সমবায় গঠন, অত্যন্ত সাশ্রয়ী সুদে ফসল কাটার মওসুমে ঋণ দিয়ে কিষান-কিষানীর নিজের উদ্বৃত্ত নিজে কিনে সরকারি খাদ্যগুদামে ভাড়ায় রেখে সারা বছর তা বিক্রি করতে পারবেন। কমে যাবে মধ্যস্বত্বভোগী, স্বস্তিতে থাকবেন ক্রেতারা; আবার তুলনামূলকভাবে বেশি মূল্য পাবেন উৎপাদকরা। খাদ্যমূল্য থাকবে স্থিতিশীল।

গবাদি পশু ও মুরগির খামার উপখাতগুলোতে প্রান্তিকভাবে অগ্রগতি হয়েছে বটে, তবে একটি সর্বাত্মক নীতিকৌশল পরিকল্পনায় এসব খাতগুলোতে আরও ব্যাপকতর প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে একদিকে যেমন সুষম খাদ্যপ্রাপ্তি ঘটবে, অন্যদিকে বাড়বে উৎপাদনকারীর আয়-রোজগার।

তবে প্রাথমিক খাতের উৎপাদনকে 'অফ ফার্ম' প্রক্রিয়াজাত করার শিল্পায়ন কৌশলে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগের আকাশসম প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, অতিরিক্ত স্থানীয় ভ্যালু এডিশন সৃষ্টি এবং দারিদ্র নিরসণ করতে হবে। ফলমূল, হর্টিকালচারও এর মধ্যে সংযুক্ত হবে। সম্প্রসারিত হতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সৃষ্টি ও ব্যবহার। এ খাতে ব্যবহারিক গবেষণা আরও জোরদার করা দরকার।

কর্মসংস্থান ও দারিদ্র নিরসনে শিল্পখাত সম্প্রসারণ

প্রাথমিক খাতে বর্তমানে শতকরা ৫১ ভাগ শ্রমজীবী নিয়োজিত থেকে মোট সামষ্টিক আয়ের শতকরা ২০ ভাগ উৎপাদন করে থাকেন। সুতরাং শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও তৎমাধ্যমে স্থিতিশীল আয়-রোজগার বৃদ্ধি করে জীবনযাত্রার মান বাড়াতেই হবে। হবে দারিদ্র নিরসনও।

তাই দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা বস্ত্রখাতে পুঁজি ও উদ্যোক্তা আকর্ষণ করার নীতি ও প্রণোদনা সৃষ্টি করা আবশ্যক। তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার শিল্প প্রসারের চেয়ে আগ বাড়িয়ে সুতা তৈরি ও বস্ত্রবয়ন শিল্পের প্রসার করে কর্মসংস্থান করতে হবে যাতে বাজারে অভ্যন্তরীন চাহিদার বিস্তার ঘটে।

একই সঙ্গে আমদানি করা বস্ত্র দিয়ে তৈরি পোশাক বানানোর বিয়াল্লিশ দিনের লিড টাইম কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে করে রুলস অব অরিজিনে মৌলিক সুবিধা স্তম্ভ তৈরি হবে যা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী সুফল আনবে।

নির্দিষ্ট অন্য কয়েকটি শিল্প, যেমন চামড়া, খেলাধুলার সরঞ্জাম, জাহাজ নির্মাণ, বৈদ্যুতিক শিল্প (ঘড়ি), রাবার, সিরামিকস, পাটের বস্তা, পাট, কাঠ ও পিভিসির ফার্নিচার এবং অন্যান্য রকমারি হালকা শিল্পকে আরও বেশি করে লালন করার সময় এসেছে। সাহসী পদক্ষেপে ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্বচ্ছ সততায় দক্ষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল জোগান দেবে।

অবকাঠামো, যাতায়াত ও পরিবহণ

একটি দেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির একটি পূর্বশর্ত অবকাঠামো নির্মাণ– ভৌতিক, যথা বন্দর, রেল, বিদ্যুৎ টেলিকম ইত্যাদি এবং সামাজিক, যথা আইনের শাসন, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ইত্যাদি। ট্রাফিকের ভিড়ে সময় নষ্ট, সন্ত্রাসে সম্পদ নষ্ট এবং পরিবহণে অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।

রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাস দমন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে কার্যকর ও টেকসই কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে না। অধরা থেকে যাবে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ও সুষম বিতরণে সর্বোত্তম জনকল্যাণ নিশ্চিত করা।

তাই অর্থনীতিকে রাজনীতির মতপার্থক্যের মধ্যে টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না। যাতায়াত ও পরিবহণে চার দশকে সড়কপথের একচেটিয়া দখল ক্ষতিকারক হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে রেলপথের এবং গত বছর থেকে পানগাঁও টার্মিনাল খুলে নদীপথের যে সূচনা করা হয়েছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক ফল আনবে। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা ও কারিগরি জ্ঞান ব্যবহার করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা যায়।

ব্যক্তি ও আয়বৈষম্য কমাতে হবে

সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীতে শিশুমৃত্যুর হার এখন হাজারে পঁয়ত্রিশ, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, হ্রাস পেয়েছে টোটাল ফার্টিলিটি রেট ও বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বেড়েছে গড় আয়ু, কমেছে পরিবারের মোট গড় সদস্য সংখ্যা।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ১৯৭২ সালের শতকরা তিন ভাগ থেকে বেড়ে এখন শতকরা ৩৫ ভাগ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়ে শিশুর ভর্তি জনসংখ্যার অনুপাতভিত্তিক। নারীর ক্ষমতায়নে হয়েছে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি। তবে পেছনে পড়ে আছে প্রতিবন্ধিতা ও অটিস্টিকে আক্রান্ত ছেলে, মেয়ে ও বয়স্করা, হাওড়-বাওড়ে বাসিন্দা, পাহাড়ি জনপদ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী তেমন বেগে এগুতে পারছে না।

ফলশ্রুতিতে বাড়ছে মানুষে মানুষে আয়বৈষম্য এবং অঞ্চলে অঞ্চলে আয়, সম্পদ ও সুযোগে বৈষম্য। ১৯৭২ সালের গিনি সহগ ছিল ০.২৭, আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪৮; অর্থাৎ সামাজিক সুরক্ষার কর্মকাণ্ডগুলো আয়, সম্পদ ও সুযোগ-বৈষম্যের ক্ষতিকারক বৃদ্ধি ঠেকাতে পারছে না।

এই একটি ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণে রেখে একটি কমিশন গঠন করে সুনির্দিষ্ট, কার্যকর ও অগ্রাধিকারক কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া উচিত হবে অনতিবিলম্বে। হ্রাস করতে হবে আয়, সম্পদ ও সুযোগ বৈষম্য।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।