সিদ্ধান্ত আপনার

সজীব ওয়াজেদ
Published : 27 April 2011, 08:34 AM
Updated : 2 Jan 2014, 08:12 PM

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন এসে গেছে, এমন সময় খুব হতাশা নিয়েই বলতে হয়, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন ও তাদের দাবিগুলির আসল কারণ আমাদের জানা। পুড়ে যাওয়া লাশের সারি আর একের পর এক বোমাবাজির ভেতর দিয়ে ওরা ওদের দাবিগুলোর জানান দিয়েছে। কিন্তু আজ রাজনীতির এই উত্তপ্ত প্রসঙ্গগুলি সরিয়ে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।

আজ আপনারা কি পাঁচ বছর আগের চেয়ে ভালো নেই? আজ দেশটা কি পাঁচ বছর আগের চেয়ে ভালো নয়? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে তা আপনা থেকে হয়নি। একটা ভালো সরকার যদি না থাকত তাহলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট কিছুই তৈরি হত না। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে আপনাদের রোজগার বাড়তে পারত না। একটা শক্তিশালী সরকার না থাকলে আপনার সন্তানের স্কুলের পথটি সন্ত্রাসী বোমার ত্রাস থেকে মুক্ত থাকত না। শেখ হাসিনা ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তিও দেওয়া যেত না।

তবু আমাদের বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে নাছোড়বান্দা আচরণ করেছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, আমরা তো খালেদা জিয়ার অধীনে নির্বাচনে যেতাম না। আমি এর জবাবে অন্যান্য টাউন হলের সভায় যা বলেছি তাই বলব। ধরুন, আপনার বাড়িতে কেউ এল, আপনি তাকে ঢুকতেও দিলেন আর সে আপনাকে লুট করে চলে গেল। কয়েক বছর পরে সে আবার এল, ক্ষমা চাইল, আপনি তাকে আবার ঢুকতে দিলেন এবং সে আবারও ডাকাতি করল। এখন সে-ই যদি তৃতীয়বার আসে, ক্ষমা চায়, তাহলে কি আপনারা তাকে আবারও সুযোগ দেবেন?

খালেদা জিয়া যে দুইবার ক্ষমতায় গেছেন নির্বাচনে কারচুপি করেছেন। তিনি একবারের জন্যও কোনো অবাধ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সম্পাদন করেননি। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ তাহলে কী করে খালেদা জিয়ার অধীনে নির্বাচনে যেতে চাইবে?

শেখ হাসিনা জীবনে একটা নির্বাচনেও কারচুপির আশ্রয় নেননি। এই আমলেও ছয় হাজারের বেশি নির্বাচন হয়েছে যেগুলোর একটার বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে কী করে এই দুজনের তুলনা দেওয়া হয়? খালেদা জিয়া প্রত্যেকবার ভোটচুরি করেছেন বলে শেখ হাসিনাও করবেন– এটা একেবারেই অযৌক্তিক!

যদিও কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের পক্ষে এই দাবি করা সম্ভব হয়নি যে আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, সুশীল সমাজের কতিপয় সদস্য এবং বিদেশি কূটনীতিকদের কেউ কেউ বলেছেন এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা বিরোধী দলকে নির্বাচনের বিপক্ষে ভেটো দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।

দীর্ঘমেয়াদে এর অর্থ দাঁড়াবে এই যে ভবিষ্যতে একটা নির্বাচন যতই অবাধ ও সুষ্ঠ হোক না কেন, কোনো একটা বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মর্জি না হলেই ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্ট হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে? ভবিষ্যতে তো তাহলে নির্বাচনে হারের সম্ভাবনা দেখলেই কোনো দল বেঁকে বসে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে দিতে পারে-– যে চেষ্টা আজ বিএনপি করছে।

আজকের সংকটের গোড়ায় রয়েছে এই সত্য। আমি বিভিন্ন বিদেশি কূটনীতিককে দুই বছর আগেও এই আশঙ্কা জানিয়েছিলাম যে বিএনপি যদি পাঁচ বছরের শেষে মনে করে তারা জিতবে না, তারা নির্বাচন বয়কট করবে। হয়েছেও ঠিক তাই। কেউ কি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমাদের সরকারের এত সব সাফল্য আর বিপরীতে বিএনপির লাগাতার জ্বালাও-পোড়াও, সাধারণ মানুষের ওপর হামলার পরও বিএনপির নির্বাচন জেতার সুযোগ রয়েছে? আর বিএনপি যদি বিশ্বাস করে তারা জিতবে তাহলে প্রমাণ করে দেখাক না্।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আজ একটাই রাস্তা-– বেরিয়ে আসুন, ভোট দিন। এটা এখনকার পরিস্থিতি আর রাজনীতি দুয়েরই উন্নতি ঘটাবে। ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে সবসময়ই একটা সমালোচনার ধারা চলে আসছে। কিন্তু এর ফলে কী হচ্ছে? একজন সংসদ সদস্য যখন অনেক ভালো কাজও করেন, তাকে অপরাধীর পর্যায়ে টেনে নামানো হয়। এতে লাভ কার হয় বলুন তো? ও্ই ভালো ব্যক্তিটির অসৎ প্রতিদ্বন্দ্বীরা যারা নিজেদের আখের গোছাতে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। আর এ কারণেই নেতিবাচক প্রচারগুলো চলতে পারে, এতে ওদেরই লাভ।

এতে সৎ রাজনীতিবিদদেরও নিরুৎসাহী করে দেওয়া হয়। ঘাম ঝরিয়ে শত ভালো কাজ করার পরেও কপালে গালমন্দ জুটলে তারাও এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। এতে আপনারা কেবল এমন প্রার্থীই পান যারা মনে করেন তারা এক মেয়াদের বেশি সুযোগ পাবেন না, যতই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটুন, তাদের নামিয়ে দেওয়া হবে। তারা নির্বাচিত হলে কী করবেন? তারা মন দেবেন ওই এক মেয়াদে নিজের আখের গোছাতে। কে কত খারাপ হতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা হবে।

এটা ঠেকানোর একটাই উপায়-– ভোট দিন। বিএনপি ও সুশীল সমাজের একাংশের রাজনীতিবিদদের খাটো করার নিরন্তর চেষ্টার পরও এই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক প্রচার মোকাবেলায় সাফল্য পেয়েছে। বিএনপির জন্য আর কোনো কৌশল ছিল না। তাই তারা নিবার্চনকে বিতর্কিত করে তোলার জন্য এটা বয়কটের রাস্তা বেছে নেয়। তাদের এই চাল যদি সাফল্য পায় তবে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

ভোট দেওয়ার মাধ্যমে আসলে আপনারা এটা পরিষ্কারভাবে জানান দেবেন যে আপনার সবার ওপরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ঠাঁই দেন। যে দলটা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে, আপনাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তাদের ভোট দেওয়ার মাধ্যমে আপনারা ভালো রাজনীতিবিদদের পুরস্কৃত করবেন।

আপনারা যদি এটা করতে পারেন তাহলে বিরোধীরা ভাবতে বাধ্য হবে যে তাদের কূটকৌশলে আর কাজ হবে না। তারা একসময় অনুধাবন করবে নির্বাচিত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভোটারদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া এবং নির্বাচিত হওয়ার পরে সেগুলো পালন করা।

ঠিক এই কারণে ভোট দেওয়াটা এত গুরুত্বপূর্ণ। এটা সত্য যে দল বা প্রার্থীর ক্ষেত্রে খুব বেশি বাছাইয়ের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এর চেয়ে বড় কতগুলো বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাদের। আপনারা কি যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্রের পাশে দাঁড়াবেন, নাকি দাঁড়াবেন না? ভালো রাজনীতিবিদেরা কি সচল থাকবেন, নাকি থাকবেন না? রাজনীতির উন্নতি ঘটবে, নাকি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত চলতে থাকবে?

সিদ্ধান্ত আপনার। আমার মন বলে আপনি যাচ্ছেন ভোট দিতে।

সজীব ওয়াজেদ: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক কর্মী।