খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরুদ্ধে প্রধান সংগ্রাম

ফরিদা আখতার
Published : 16 Oct 2010, 03:56 PM
Updated : 16 Oct 2010, 03:56 PM

বিশ্ব এখন বড় ধরণের খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। এই খাদ্য সংকটের কারণ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি শুধু ক্ষুধার্থ কিংবা পুষ্টির অভাবে শিকার মানুষের সংখ্যা। তবে এতোদিন এই সংখ্যা কমাবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কমেনি, বরং ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেড়ে গেছে। যেমন, ১৯৯৬ সালে ৮০ কোটি ( ৮০০ মিলিয়ন) মানুষ ক্ষুধার্ত বা পুষ্টিহীনতার শিকার ছিল, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯২ কোটি, ৫০ লক্ষ (৯৫০ মিলিয়ন)। এই সংখ্যা প্রমান করে যে খাদ্য ঘটতি মেটাবার এবং ক্ষুধা নিবারণের বিশ্ব পরিকল্পনা বিশেষ করে এমডিজি বা হাজারবছরী উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে এবার ১৬ অক্টোবর, বিশ্ব খাদ্য দিবস, ২০১০ পালিত হচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারও জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐক্য (United against hunger)। এটা খুবই জরুরী কিন্তু কী ভাবে এই ঐক্য সম্ভব? কাদের ঐক্য? খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দৃষ্টি এবার বিশ্বের সকল দেশের প্রতি নয়, তারা ২২টি দেশকে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার বিচারে "protracted" বা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছে, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও সংঘাত এবং দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কারণে খাদ্য ঘাটতির অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটছে আর বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় র‌য়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসুচীর (WFP) যৌথ প্রকাশনায় "State of Food Insecurity in the World 2010" এই সকল দেশের খাদ্য ও ক্ষুধা কিংবা পুষ্টিহীনতার পরিস্থিতির বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রোট্রেক্টেড অঞ্চলে অপুষ্টির অবস্থা তিনগুন বেশী। এই ২২টি দেশের মধ্যে ১৬টি দেশই আফ্রিকার, বাকী গুলো হচ্ছে, আফগানিস্তান, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এই সকল দেশই দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ কিংবা সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। এখানে খাদ্য ঘটতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটি, ৬০ লাখ। প্রতিবেদনে ক্ষুধার্ত এবং পুষ্টিহীনতার শিকার এই দুটো কথাকে সমার্থক হিশেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্য না জুটলে পুষ্টিহীনতা হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেট ভরে খাবার জুটলেও পুষ্টির অভাব হতে পারে, এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি হচ্ছে, কারণ খাদ্যের মান কমে যাচ্ছে। বেশী খাদ্য উৎপাদন পুষ্টিমান নিশ্চিত করে নি। প্রতিবেদনে খাদ্য উৎপাদন নিয়ে খুব আলোচনা হয় নি, বরং বেশী মনোযোগ দেয়া হয়েছে খাদ্য সাহায্য অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানী করা খাদ্যের ওপর ।

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) মতে সাধারণভাবে উন্নয়নশীল দেশেই পুষ্টিহীনতার শিকার মানুষের সংখ্যা সব চেয়ে বেশী। মাত্র ৭ টি দেশে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ অপুষ্টির শিকার মানুষের বাস। এই সাতটি দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া ও বাংলাদেশ রয়েছে। যে সব দেশের কথা বলা হচ্ছে এরা সবই খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ণ দেশ ছিল, তারা খাদ্য রপ্তানীও করতো তাহলে কেন বিশ্বের এতোগুলো দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি বিরাজ করছে তার কোন ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে নাই, এবং খাদ্য উৎপাদনের অবস্থাও বর্ণনা করা হয় নাই।

তাই বিশ্ব খাদ্য দিবসে আমরা জনগনের দিক থেকে দেখতে চাই, খাদ্য সংকট কেন হচ্ছে। অন্তত বাংলাদেশে আমরা বিগত কয়েক বছরে খাদ্য সংকটের পর্যালোচনা করলেই এই সংকটের কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে। শুধু পরিমানগত ভাবেই সংকট নয়, খাদ্যমানের দিক থেকেও ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব নামে আধুনিক কৃষির প্রবর্তন করা হয়েছে, দীর্ঘ অর্ধ শত বছর ধরে। আমাদের কথায় কথায় উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, সব্জি ও অন্যান্য খাদ্য ফসলের কথা বলা হয়। সরকারী পর্যায়ে খাদ্য সংকট বা ঘাটতির কথা উঠলেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় এবং তার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, এই নিয়ে নতুন করে তথ্য দিতে হবে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সব দেশেই ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে এবং তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

গত পয়লা অক্টোবর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র (ব্রি) তাদের ৪০ বছর পুর্তি পালন করেছে। কেক কেটে জন্মদিন পালন করলেও তারা বাংলাদেশের কমপক্ষে ১৫,০০০ জাতের বৈচিত্রপুর্ণ ধানের বিপরীতে ঢাকঢোল পিটিয়ে কেবল মাত্র ৫৭টি জাতের ধান প্রবর্তন করেছে। সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে দেশীয় জাতেরই ধান। একে তারা উচ্চ ফলনশীল জাত বলতেই ব্যস্ত, তবে উচ্চ ফলনশীল করতে গিয়ে উচ্চ মাত্রায় সার-কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে, তুলতে হচ্ছে মাটির তলার পানি, এই কথা বলছে না। ইংরেজী এক পত্রিকার (অক্টোবর ১, ২০১০) একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে দেশের ৪০% জমির জৈব পদার্থের ঘাটতি এবং পুষ্টির অভাব দেখা দিয়েছে। কৃষককে একই পর্যায়ের ফলন ধরে রাখতে হলে আরও বেশী পরিমান সার ব্যবহার করতে হয়। ব্রি উদ্ভাবিত ধানের ফলন বেশী হলেও কৃষকের লাভ নেই কারণ এতে সার-কীটনাশকের ব্যবহার বেশি করতে হয়। একজন কৃষক উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, এক বিঘা জমিতে বি-আর ২৯ করতে হলে তাকে ৮০ কেজি ইউরিয়া, ২০ কেজি টিএসপি, এবং ৪০ কেজি অন্য সার দিতে হয়, অথচ দেশীয় শাইল ধান করতে গিয়ে তাকে এর অর্ধেক পরিমান ব্যবহার করতে হয়। আসলে কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলে।

এদিকে Xinhua News Agency ২২ সেপ্টম্ব্ র, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র (ব্রি) –এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেছে যে গত ১০ বছরে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান ৩২৮% বেড়েছে, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৭ সালে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান ছিল ৮০০০ টন, ২০০৮ সালে তা বৃদ্ধ্বি পেয়ে হয়েছে ৪৮,৬৯০ টন। কীটনাশকের এই ব্যাপক ব্যবহার প্রধানত হয়েছে সব্জি চাষে, যার কারণে বিদেশে বাংলাদেশের সব্জির চাহিদা কমে গেছে। আমরা বুঝতে পারি না, ব্রি নিজেই এমন ধানের জাত কেন কৃষকের জন্য উদ্ভাবন করে যা সার-কীটনাশক নির্ভর। এখন ব্রি'র গবেষকরা বহুজাতিক কোম্পানীর সহযোগিতায় জি এম ধান প্রবর্তন করার প্রস্তাব করছে, যা হবে এদেশের খাদ্য উৎপাদনের জন্য এক মারাত্মক হুমকী, কারণ এখানে কৃষকের ভূমিকা গৌণ হয়ে যাবে, বেড়ে যাবে কোম্পানীর পেটেন্ট করা প্রযুক্তি নির্ভরতা, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশের কৃষকরা কিভাবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে খাদ্য ফসল উৎপাদন করতে পারেন, তার জন্য কোন পরিকল্পনা নাই। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকীর সাথে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি নির্ভর করার জন্য যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তা জলবায়ু পরিবর্তনের চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে খাদ্য উৎপাদন করাই যথেষ্ট নয়, কোন খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে এবং কী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হচ্ছে তা বিবেচনা করা দরকার।

আমাদের দেশে খাদ্য সংকটের পেছনে আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে খাদ্য ফসলের জমিতে অ-খাদ্য ফসলের ব্যাপক ও নিয়ন্ত্রণহীন চাষ। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তামাক চাষ যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে তা খাদ্য উৎপাদনের জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তামাক চাষ এক নাগাড়ে একই জমিতে করলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয় তাই তারা নতুন নতুন এলাকার দিকে ছোটে। রংপুর, কুষ্টিয়া হয়ে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ব্যাপক চাষ হচ্ছে। শীতকালীন ফসলের মৌসুমে খাদ্য ফসলের পরিবর্তে তামাক চাষ করে ব্যাপক খাদ্য ঘটতি সৃষ্টি হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রায় ৭৪০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে, অথচ এই জমিতে আলু, ডাল, ধান, মরিচ, ধনিয়া, সরিষা, শীতকালীন সব্জি, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলাসহ সকল ধরনের খাদ্য ফসল উৎপাদন করা যেতো।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে ২০০৯-১০ সালে ১,১৫,৯৭৮ হেক্টর চাষের জমির মাত্র ৪৭ ৭৬৭ হেক্টর জমিতে বোরো, সরিষা, এবং সব্জি আবাদ হয়েছে, বাকী জমি তামাক কোম্পানী তামাক চাষের জন্য আগেই নিয়ে রেখে দিয়েছে (চিন্তা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। বান্দরবানের লামা উপজেলায় বেসরকারী এক প্রতিষ্ঠানের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৫৩৯৯ একর জমিতে তামাক চাষ হওয়াতে ১১ কোটি টাকার সম পরিমানের খাদ্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এখন সেসব এলাকায় খাদ্য অন্য এলাকা থেকে আমদানী করতে হয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২০,০০০ একর জমিতে তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসলের ক্ষতির পরিমান ১৪ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা। এগুলো নেহায়েতই কৃষকদের হিশাব। জাতীয় পর্যায়ে হিশাব কষলে ক্ষতির পরিমান শতগুণ বাড়বে সন্দেহ নাই। সম্প্রতি বান্দরবান জেলার আদালতে একটি মামলা হয়েছে এবং বান্দরবান জেলা যুগ্ম বিচারক সামস উদ্দিন খালেদ বান্দরবান জেলায় তামাক চাষ বন্ধের আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশের ফলে কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে, এবং আদালতের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যদি কোম্পানী তামাক চাষের কার্যক্রম বন্ধ করে তাহলে মাতামুহুরী নদীর তীরে যেসব খাদ্য ফসল উৎপাদন হবে তার সুফল আমরা পাব।

আশার কথা যে ইতিমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় তামাক চাষে সারের ভর্তুকী না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সহযোগিতা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে, জাতীয় বাজেটে তামাক পাতা রপ্তানীর ওপর ১০% শুল্ক ধার্য করেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে সরকার বিষয়টি আমলে নিয়েছে। তবে এর ফলাফল বোঝা যাবে এ বছর তামাক চাষের অবস্থা দেখে। আশা করছি খাদ্য ফসলের জমিতে অন্তত তামাক চাষের সম্প্রসারণ ঘটবে না। সরকার আরও একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন যা বাস্তবায়ন করা জরুরী। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও ভূমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে 'কৃষি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন, ২০১০'-এর খসড়া তৈরি শেষ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয় (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৮ সেপ্টেম্বর , ২০১০) । তামাক চাষকেও এই আইনের আওতায় এনে অনুমতি নেয়ার নিয়ম করতে হবে।

বিশ্ব খাদ্য দিবসে আমাদের দাবী খাদ্য উৎপাদনের বাধাগুলোকে দূর করা হোক, এ দেশে খাদ্য ঘাটতি অবশ্যই দূর করা সম্ভব হবে।