সিরাজগঞ্জ ট্র্যাজেডি

মোহীত উল আলম
Published : 14 Oct 2010, 04:44 PM
Updated : 14 Oct 2010, 04:44 PM

সিরাজগঞ্জের সইদাবাদ একটি লোকালয়। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার রেললাইন গেছে এর ভিতর দিয়ে। পাশে যমুনা সেতু থেকে রাজপথ বের হয়ে রেললাইনের পাশাপাশি গেছে। একটি নিরিবিলি ভাবনাহীন লোকালয়। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেখানে একটা জনসভা করবে। রেললাইন থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে। এর মধ্যে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার র্নিবাচিত বিএনপি চেয়্যারম্যান সানাউল্লাহ্ নূর বাবু নৃশংসভাবে রাস্তার ওপরেই খুন হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে জানা যায়, যারা বাবুর মিছিলে হামলা করেছিল তারা সরকারি দল সমর্থিত নেতা-কর্মী ছিল। সংবাদ-চিত্র এবং টিভি চ্যানেলে ভিডিও চিত্র একই কথা বলছে।
বাবুর নিহত হওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তবে রাজনীতিতে প্রতিহিংসার একটা শক্ত জায়গা আছে। বাবুর মৃত্যু বড়াইগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র দীর্ঘদিনের প্রতিহিংসার রাজনীতির একটি মর্মান্তিক ফলাফল। রাজনীতিতে সুযোগসন্ধানও একটি বড় উপায়। বাবুর মৃত্যু জীবনানন্দের বনলতা সেনের নাটোরে বিনপি'র রাজনীতির বিস্তর ক্ষতি করেছে। বিএনপি এটাকে ইস্যু করতে চায়। রাজনীতিতে ইস্যু না থাকলে ইস্যু তৈরি করতে হয়। প্রতিপক্ষের হাতে দলীয় নেতা বা কর্মীর মৃত্যু হলে ইস্যুটা আপনাআপনি হাতে এসে যায়।

সিরাজগঞ্জ থেকে নাটোর কাছাকাছি। সিরাজগঞ্জে জনসভা হলে নাটোরেও তার উত্তাপ লাগবে। বাবুর মৃত্যুকে ইস্যু করে খই ফোটানো যাবে। এরকম একটি রাজনৈতিক 'সদিচ্ছা' বিরোধী দলের ছিল। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ঈর্ষণীয়ভাবে জনপ্রিয়। তাঁদের জনসভায় লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। সেদিনও সইদাবাদের মাঠে মানুষ জমে গেল বিরোধী দলের নেত্রী পৌঁছার বহু আগেই। রেলরাস্তার পাশে জনসভা। আমজনতার মনস্তত্ত্ব কাজ করল। রেলরাস্তা অধিকার করে তারা বসল। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচলিত অভ্যাসও কাজ করল। শহরের রাজপথে তারা সভা করার নামে রাস্তা দখল করে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যানজটের লম্বা সারি পড়ে। কোন এ্যাম্বুলেন্সের ভিতর কোন রোগীর অবস্থা আশংকাজনক থাকলে তিনি যানজটে আটকে পড়ে অক্কাও যেতে পারেন।

রাজনৈতিক সভা করার নামে পথযাত্রী ও সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেবার এ সামাজিক রীতি আমরা ভালোবাসি। আমরা চাই এ রীতি বজায় থাকুক। একই মনস্তত্ত্ব কাজ করল সইদাবাদের সভার বেলায়ও। দলের কেউই এ লোকগুলোকে রেলরাস্তার ওপর বসতে মানা করল না। শহরের রাস্তায় রিকশাওয়ালারা চলন্ত বাসের সামনে বেমক্কা চাকা ঘুরিয়ে ডান দিকে বা বাম দিকে মোড় নেয়। কারণ বাসতো তাকে আর ডলে যাবে না। ব্রেক কষে থামতে বাধ্য হবে। এ নিশ্চিন্তিবোধ থেকে রিকশাওয়ালারা ঐ সাহসটা করে। ঐ ধরনের সাহস ঢাকার পথচারীরাও করে। তারা ফুটব্রিজ ব্যবহার করতে পছন্দ করে না। তারা রাস্তার ওপর লাফ দিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে রাস্তা পার হতে পছন্দ করে। ঐ সাহস দেখানোর মধ্যে একটা থ্রিল আছে। আটপৌরে জীবনে কে না একটু উত্তেজনা চায়! ঠিক এই নিশ্চিন্তিবোধ নিয়ে রেলরাস্তা অধিকার করে জনসভার লোকজন বসেছিল। যে ট্রেনই আসুক, থামতে বাধ্য হবে। ছোটবেলায় সার্কাসে আমাদের শিশুদের একটি প্রিয় খেলা ছিল কূপের ভিতর মোটর সাইকেল চালনা দেখা। দেখতাম, কিন্তু ভয় লাগত।

হঠাৎ যদি মোটর সাইকেল ওপরে ছিটকে বের হয়ে আসে! সমাজের শতকরা নব্বইজন লোক যখন আলাদা আলাদা থাকে তখন এভাবে তারা সতর্ক চিন্তা করে। প্রতিটি কাজের অগ্রপশ্চাত নিয়ে ভাবে। বিপদে পা দেয় না। রেল রাস্তায় কদাপি বসে। কিন্তু একই মানুষ যখন জনসভায় একত্র হয় তখন তাদের ব্যক্তিগত ভয়-ডরগুলো সমষ্টিগত সাহসে পরিণত হয়। তারা তখন রেলরাস্তায় বসে যেতে ভয় পায় না।

এ কান্ডটাই তারা করল ঐদিন সইদাবাদে বিরোধী দলের নেত্রীর জনসভায়। তবে তিনি জনসভায় পৌঁছার ঘন্টা দু'য়েক আগেই সেখানে পৌঁছে গেল "দ্রুতযান এক্সপ্রেস"। উত্তরবঙ্গে দ্রুতগামী মেইল ট্রেনের মধ্যে সবচেয়ে আশরাফী বাহন। ইঞ্জিনের চালক হিসেবে বসেছিলেন আসিরউদ্দিন এবং তাঁর সহকারী রাজ গোবিন্দ। তাঁরা ঢাকার দিকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন, এগারটি বগিসহ। হঠাৎ সইদাবাদের লেভেল ক্রসিং পার হলে তাঁর চোখে পড়ল রেলরাস্তার ওপর অনেক লোক বসে আছে। এরকম গণজমায়েত সাধারণত রেলরাস্তার ওপর হয় না। হলেও পূর্ববর্তী স্টেশন পার হবার সময় সিগন্যালের মাধ্যমে তাঁর সেটা জানার কথা। দ্রুতগামী ট্রেনের গতি হঠাৎ বন্ধও করা যায় না। তাই তিনি বারবার হুইশেল দিতে লাগলেন।

কিন্তু জনসভায় নেত্রী আসার আগে আবহাওয়া তাতিয়ে তোলার জন্য স্থানীয় নেতারা মাইকে জোরালো গলাবাজী করে যাচ্ছিলেন। মাইকের আওয়াজের তলায় হুইশেলের শব্দ চাপা পড়ে গেল। লোকগুলো শুনল না। অথবা ট্রেন থেমে যাবে মনে করে তারা  সরে গেল না হয়তবা। কিছু লোক হয়ত সরল, কিছু সরল না। যন্ত্রদানব এসে পড়ল তাদের ওপর। ঘটাং ঘটাং। মুহূর্তে লোহার চাকার নীচে কাটা পড়ে গেল ছয় থেকে সাতজন লোক। অদৃষ্টবাদীরা বলবেন, ঐভাবে তাদের মৃত্যুটা নির্দিষ্ট ছিল। জাতীয় পত্রিকাগুলির সম্পাদকীয় বলবে বিরোধী দলেরও দোষ, সরকারি দলেরও দোষ। বিরোধী দল বলবে, এটা দুর্ঘটনা নয়, সরকারের ষড়যন্ত্র। সরকারি দল বলবে বিরোধী দলের ইস্যু তৈরি করার জন্য লাশ দরকার। সেজন্য রেল রাস্তার গা ঘেঁষে জনসভার আয়োজন করা।
তারপর রেলের কাহিনীটিও কম ট্র্যাজিক না। ট্রেন থেমে গেল হঠাৎ এঞ্জিনের বাষ্পাধারে কী একটা ছিঁড়ে যাওয়ায়। তখন জনসভার উত্তেজিত লোকেরা চালক এবং উপ-চালককে মেরে ফেলার জন্য মারধর করল। তাঁরা গুরুতর আহত হলেন। তবে স্থানীয় কিছু সাহসী যুবকের হস্তক্ষেপে তাঁরা প্রাণে রক্ষা পান। জনতা এখানে থামল না। তারা ট্রেনের যাত্রীদেরকে নামিয়ে দিল। নামানোর সময় তাদেরকে লুটও করল।

তারপর তারা একের পর এক বগিতে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেল ট্রেনের নারকেলের ছোবড়া আর প্লাস্টিকে ঢাকা বসার সিট, গলে গেল পিতল আর পাতলা লোহার পাত, ঠিক ইংরেজি এ্যাকশন ছবিতে যেরকম দৃশ্য দেখি। ট্রেনের পাওয়ার হাউজে আগুন ধরানো হলে এঞ্জিনসহ গোটা ট্রেনই পুড়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিপুল ক্ষতি করে দিল। রেল আমাদের জাতীয় সম্পদ, সেখানে ক্ষতির পরিমাণ এ পর্যন্ত পঁচিশ কোটি টাকা হিসাব করা হয়েছে। এঞ্জিনটাই কেনা হয়েছিল কোরিয়া থেকে পঁচিশ কোটি টাকা দিয়ে। অর্থাৎ মোট পঞ্চাশ কোটি টাকার ক্ষতি। মেরামত যদি সম্ভব হয়, শুধু মেরামতের সময় লাগবে চার মাস। সে পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষ "দ্রুতযান"-কে আর রাস্তায় আনতে পারবে না। তা হলে?

এখন পত্র-পত্রিকায় এবং মানুষের মনে ঘুরেফিরে এ প্রশ্নটা আসছে: সাতটা লোকের জীবন গেল, এগারজন লোক গুরুতর আহত হল, পঞ্চাশ কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হল, এসবের দায়ভাগ কে নেবে?

কয়েকটা তদন্ত কমিটি হয়েছে। হয়ত ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসবে জনসভায় রেলরাস্তা আঁকড়ে ধরে বসে থাকার জন্য মাইকে কেউ উস্কানি দিয়েছিল কী না, কিংবা রেলের চালকদের দিক থেকে কোন অবহেলা ছিল কী না। আরো হাজার প্রশ্ন।

তবে আমার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন আছে। আমি পেশায় একজন শিক্ষক। চাকরির অংশ হিসেবে আমাকে মাঝে মাঝে ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে শিক্ষাসফরে বের হতে হয়। তখন অভিভাবকেরা বলেন, দেখেন, কোন যেন দুর্ঘটনা না হয়। আমি বলি, দুর্ঘটনার ওপরতো আমার হাত নেই। ঘরের বাথরুমে যেমন মানুষ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে, তেমনি সফরকালীন ভ্রমণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হ্যাঁ, আমি ছাত্রছাত্রীদেরকে নিয়ে পর্যটন করার জন্য সুন্দরবন নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তাই বলে তো আমি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সুন্দরবনের বাঘের ঝোপের কাছে নিয়ে যাব না। সুন্দরবনে হঠাৎ নৌকা উল্টে গেলে সেটা দুর্ঘটনা হবে, কিন্তু বাঘের গুহার কাছে বসে পিকনিক করলে সেটা হবে কন্ট্রিবিউটরি বা অবদানমূলক দুর্ঘটনা। রেলরাস্তার পাশে জনসভা করা সেরকমই বিপজ্জনক এবং দায়িত্বহীন একটা কাজ বলে মনে হয়েছে।
বিরোধী দলের নেত্রী সিরাজগঞ্জের রেস্টহাউজে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি পরে জনসভায় যান। এত বড় ঘটনার পরও সেদিন জনসভায় আগত লোকজন বিরোধী দলের নেত্রীর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয় নি। সিরাজগঞ্জ ট্র্যাজেডির বিপরীতে এটাই একমাত্র সান্ত্বনার কথা।