বইটির নাম Larry King, Truth be told কিং-ই বটে

মুন্নী সাহা
Published : 25 April 2011, 06:13 PM
Updated : 25 Dec 2013, 09:48 AM

সাংবাদিকতা বা টকশোর কিং। জীবন্ত কিংবদন্তী। সেই কিংবদন্তীর নানা সময়ের মজার মজার ছোট্ট ছোট্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা, Truth be told, আমার এক ছোট প্রেমিক (বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট এক সাংবাদিক, যে মিষ্টি করে গর্বের সঙ্গে আমার মুখের উপরে বলে, 'আমি আপনাকে ভালোবাসি') আমার হাতে দিয়ে বলল, ''এর চেয়েও আরও অনেক মজার কাহিনি আপনি লিখতে পারবেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের নানান সঙ্কটময় সময়ের কিছু স্মৃতি-কথা-দোটানা। যেগুলো আপনার সামনে ঘটেছে। টকশো করতে গিয়ে চেয়ার উল্টে পড়ে যাওয়া, আর সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সেই 'ছেরি' দেখার গল্পও হতে পারে…। আপনি লিখেন মুন্নীদি। অনেক মজার বই হবে।''

আমার এই স্বঘোষিত ছোট প্রেমিকটির কথাগুলোর মধ্যে এক ধরনের নিবেদন অনুভব করলাম। ফেসবুক-ব্লগ, বিভিন্ন আড্ডার গুজবের কল্যাণে আমি একটা ধারণা নিয়ে বসে আছি যে, আমার বয়েসী এবং আমার চেয়ে কম বয়েসী, আমার প্রফেশনের যারা, তারা তো বটেই– তাদের ফ্রেন্ডলিস্টের তাবৎ বুদ্ধিমান-চৌকষ-ইংরেজি বলতে পারা জেনারেশন আমার কাজ পছন্দ করে না। হয়তো পছন্দ করে, কিন্তু সহ্য করতে পারে না। সম্ভবত আমার চেহারা খারাপ, এ জন্যে। নয়তো আমার নাম 'মুন্নী সাহা' সে জন্যে, অথবা অন্য কোনো এক্স ফ্যাক্টর কাজ করে ওদের ভেতর।

মাঝে মাঝে মজা করে বলি, এটা হল 'শেখ হাসিনা' রাশি। অনেক ভালো কাজ, অনেক সার্ভিস, অনেক কপটতাহীন কমিউনিকেশন সত্ত্বেও উল্টোভাবে ব্যাখ্যার শিকার হয় যারা। তবে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। এই পারসেপশনের কারণে তো, নিশ্চয়ই আমার ভোট অন্য জায়গায় দিয়ে জাতিকে পস্তাতে হবে না…

আর এমনি বোঝাপড়ায় বশ হওয়া এই আমার কাছে যখন কোনো বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ, ভবিষ্যত নেতৃত্ব– সামান্য এই অনুরোধ নিয়ে আসে, 'দিদি, তুমি লিখ'… তখন আমার বোধের কবিকে প্রণাম জানিয়ে বলি– 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, ত্যায়াগিলে আসে কাছে'…

বইটি দেখছিলাম উল্টে পাল্টে, Truth be told, ল্যারি কিং লিখেছেন–

News on twenty-four hour cable is no longer news, Its breaking news. The reality is that much of the time its neither breaking nor news. But the networks have to call it breaking news because if they don't they'll feel left behind the 'breaking news' being churned out by the others. The suits live and die by the ratings.'

অসাধারণ। প্রতিদিন এই dilemma-এর মধ্যে তো থাকছিই। কী সুন্দর করে একজন কিংবদন্তী এই দোলাচল তুলে দিয়ে বললেন– আসলে কী করার আছে আমাদের, Truth be told-এ কিং লিখেছেন তার সঙ্গীতভাবনা। মাঝে মাঝে সিনেমা হলের অভিজ্ঞতা, বিশেষ এক গায়িকা বা নায়িকার প্রতি তাঁর ভালোলাগার টুকরো স্মৃতি। জোকসও আছে।

বইটা দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম কীসব দুষ্টুমির অভিজ্ঞতার কথা লিখব আমি? মাহাথির মোহাম্মদকে চাকরির অফার করার পর, তাঁর আঁতকে ওঠা মুখের বর্ণনা দেব? নাকি যুদ্ধ থমথমে বেনগাজির পথে সেই ভাঙাচোরা গাড়ির বুড়া ড্রাইভারের কথা লিখব? যাকে নিয়ে সারাক্ষণ মিশুক স্যার খুনসুটি করেছেন– 'ভাগ্যিস এই বুড়া ব্যাটা তোমারে পছন্দ করছে, নাইলে গাড়ি পাইতাম কই?'

মজার অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। পলিটিশিয়ানদের কথাই-বা যদি বলি। এখনও মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে দুপুরে একসঙ্গে ভাত খাওয়ার কথাটা মনে হয় যখন পাবদা মাছ খাই। আমার মতো একজন ধুমসি মহিলার পাতে মাছ তুলে দিয়ে, নিজেই কাঁটা বেছে দিতে শুরু করেছিলেন। পথে পথে কাঁটাছড়ানো, হুলবেঁধানো প্রফেশনে হাঁটতে থাকা এই মেয়েটিকে এক মুহুর্তে তিনি দিয়েছিলেন স্নেহের ফুলবিছানো এক অনুপ্রেরণার পথের খোঁজ।

অনেক কিছুই লিখব… এই ভাবতে ভাবতে 'ঘুম'। ভোর রাতে Truth be told আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ২০০০ সালের একুশে টিভির এক দিনের ঘটনায়। দিনক্ষণ, তারিখ মনে নেই। ব্যস্ততম নিউজরুমের সবচেয়ে দ্রুতগামী মানুষটি অর্থাৎ মিশুক মুনীর আমার সামনে হার্ড ব্রেক কষলেন। বললেন, ''শোনো, মধুবাগের দিকে এই বাড়ি, এই হল অ্যাড্রেস, ফোন করবা এই ভদ্রলোককে, এই নম্বরে (আমার হাতে একটি ঠিকানা, ফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে), ওদের বাড়ির ছাদে একটা rare ক্যাকটাস ফুল ফুটেছে, আবারও ৫০ বছর পর এই ফুল ফুটবে (যদি গাছটা বাঁচে, হা হা…)। তুমি একটা ফিচারাইজড story করতে পার। উনি আমার গুরু, আমার বস।''

বসের, অর্থাৎ মিশুক মুনীরের চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম, 'story করলে on air হবে তো? আমাদের তো time কম news-এ। এতসব পলিটিক্স-ফলিটিক্স, কে দেখবে ক্যাকটাস ফুলের গল্প'? স্যার বললেন, 'সে কারণেই তুমি। যাও এটা তোমার চ্যালেঞ্জ। আমি থাকছি অফিসে। যদি ভালো করে প্যাকেজ করতে পার, বুলেটিনের end story সেটাই হবে'।

চ্যালেঞ্জ নিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু বিষয়টি ডাল। একটা ফ্যাটফ্যাটে ক্যাকটাসে লালচে-কমলা টাইপের ফুল। আবারও ৫০ বছর ফোটে কি ফোটে না, তা চ্যালেঞ্জ করার নেই। মধুবাগের অসমাপ্ত কনস্ট্রাকশনের এক বাড়ির ছাদের এই ফুল। তবু TV ক্যামেরা বলে কথা। ক্যামেরা-রিপোর্টার দেখে বাড়ির সব লোক হুড়মুড় করে ছাদে এলেন। পাটি বিছানো হল, গান– 'চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে…' এসব ঢং ঢাং তুললাম।

গৃহকর্তা গর্বের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে কথা বলছেন। গাছের নাম, কবে এই বাড়িতে এসেছে, এসব বলতে গিয়ে বারবার 'কাট' করছিলেন। আর কাকে যেন বারবার নিচে, অর্থাৎ একতলায় পাঠাচ্ছিলেন ঠিকঠাক করে সব জেনে আসবার জন্যে। আমি দুবার বলেছি, 'ভাইয়া, যিনি জানেন, তাকেই আসতে বলেন না… ওনার কাছ থেকে শুনে নিই…। আপনার Interview দেখাব, সঙ্গে তথ্যটা উনি দিক'। আমার এই প্রস্তাব বাড়ির লোকদের পছন্দ হল না। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, 'কী জানি' বলে ব্যাপারটি এড়িয়ে গেলেন।

শ্যুটিং প্যাক আপ করে হুড়মুড় করে নামছি সিঁড়ি দিয়ে। আন্ডারকনস্ট্রাক্ট বাড়ির রেলিংবিহীন অসমাপ্ত একটি সিঁড়ি। আমার পেছনে ওই বাড়ির, আশেপাশের বাড়ির লোক। ঢাউস ক্যামেরা নিয়ে নামছেন ক্যামেরা পারসন মিনহাজ ভাই। হঠ্যাৎ একতলায় এসে থমকে গেলাম। সিঁড়ি বরাবর দরজাটা খোলা, দরজার পাশেই চেয়ার-টেবিল। একটু কম আলো। আর সেই আলোতে এক কিশোর নিবিষ্ট মনে কী যেন করছে। খালি গা। পরনে লুঙ্গি।

হঠাৎ সিঁড়ির আওয়াজে ওর নিবিষ্টতা ভাঙে। মুখ ভেংচি দিয়ে হি….হি…. আওয়াজ তোলে। মনে হল খুশি। আমাদের greet করল। আমি একটু থমকে যাই। ছেলেটি দ্রুত পালানোর জন্যে ঘরের ভেতর দৌঁড়ায়। আমার পেছন পেছন আসা সিঁড়ির ওপর কৌতূহলী মানুষের লাইন থেকে কে যেন বলল– এই ছেলেরই ক্যাকটাস গাছ, ওই-ই যত্ন করে, ফুল ফুটছে ওর জন্যেই।

আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। বাড়ির লোকদের বলি, 'তাহলে ওকে ডাকেন, একটু কথা বলি'। এবার বাড়ির লোকরা নয়, উত্তর করল আশপাশ থেকে আসা কৌতূহলী প্রতিবেশিরা। 'ও পাগল পাগল– মাথায় ছিট আছে। তেমন চিল্লাপাল্লা নাই, যা মন চায় করে, একটা জিনিস নিয়া পইড়া থাকে। দেখেন না পাগলের মতো ভেংচি মাইরা দৌড় দিল!'

আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। মিশুক স্যরের Instruction কানে বাজছিল, 'সিচুয়েশন অনুযায়ী যে যে shot লাগবে বলে মনে হয়, নিবা। তুমি ছবি না নিয়া চইলা আসলে, পরে তো পাবা না…'।

স্যারের এই নির্দেশের অনুরণনে মিনহাজ ভাইকে বললাম, 'Please এই ছেলেটার একটা shot নিন না'। মিনহাজ ভাই বিরক্ত। বললেন, 'এখানে লাইট কম, আর ছাদের সিকোয়েন্সের সঙ্গে ঘরের সিকোয়েন্সে মিলবে না– এই ছেলেটাই-বা ফুল ফোটা গল্পের কী'– ধমকের সুরে আমাকে বললেন, 'আপনার খামখেয়ালী'।

আমি কিন্তু না বুঝেই পাথরের মতো সিঁড়ির গোড়ার দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঝাড়ি খেলাম ক্যামেরাম্যান মিনহাজ ভাইয়ের। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘরের ভেতর ঢুকে, ওই পাগলাটে ছেলেটার (তখন জানতাম না, এখন জানি। ছেলেটা সম্ভবত ছিল অটিস্টিক– বাবা-মা পাগল বলে লোকচক্ষু থেকে আড়ালে রাখত লজ্জায়) একটা ছবি তুলে আনলেন।

হুড়মুড় করে ফিরলাম অফিসে। ইটিভি। তখনকার মানে ২০০০ সালের। ছাদের সিকোয়েন্সের খুব ভালো শ্যুটিং। নেপথ্যে 'চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে' পাঞ্চ করে, ২ মিনিটের একটা News Story এর script দাঁড় করালাম। রাত ১১টার বুলেটিনে ধরাব। দৌড়াচ্ছি এডিট প্যানেলের দিকে। কিন্তু মাথার মধ্যে কোথায় যেন একটু খচখচানি কাজ করছে!

স্যার (মিশুক) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফোন দিলাম। বুলেটিনের ২০ মিনিট বাকি। দ্রুত ২ লাইনে বললাম, কী ছিল, কী করেছি। আর শেষ লাইনে বললাম ওই পাগলা ছেলেটার কথা– যার কথা script এ নেই। স্যার ফোনের ওই প্রান্তে 'চুপ'। বললেন, তুমি script টা আরেকবার লেখো– তুমি যেমন করে লিখতে চাও'।

আজ অনেক বছর পরে যখন এসব কথা লিখছি, ঠিক মনে করতে পারছি না পরে আমি ওই ক্যাকটাসে বিরল ফুল ফোটার Story টা কীভাবে করেছিলাম। তবে Facebook, Twitter এর যুগে রংপুর থেকে একজন দর্শক (যিনি আমাকে দীর্ঘ সময় ধরে ফলো করেন বলে মনে হল) চিঠি লিখেছেন। কোনো আলোচনা-সমালোচনা ঈর্ষা-বিদ্বেষে যেন আমি ভড়কে না যাই।

তিনি লিখেছেন– ''তুমি হলে সে-ই মুন্নী সাহা যে কিনা বিরল ক্যাকটাসে ফুল ফোটানোর অসীম ধৈর্যের এক পাগলকেও হাজির কর– পাগল বলে নয়, সৃষ্টিশীলতার পূজারী বলে। তুমিই সেই মুন্নী সাহা যে কিনা ওয়াইল্ড পোলিওতে আক্রান্ত শিশু অমিতের বেঁচে থাকার আকুতিকে ট্রান্সলেট করো বাংলাদেশের মানুষের অসীম ভালোবাসার শক্তি বলে।''

আমার এই মুগ্ধ ভক্তের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। এমন করেও কেউ টিভি দেখেন! আমরা তো বলি 'ইরেইজড' মিডিয়া– 'উড়ে গিয়েই ফুরিয়ে যাবে এই তারি আনন্দ…'

Larry এর Truth be told-এর অনুপ্রেরণায় লিখতে বসে, আমার আজকাল এ গল্পগুলোই হন্ট করছে। জানি এসবের কাটতি নেই, এ যুগের বন্ধুরা এগুলোকে প্যানপ্যানানি বলে। থাক, আমার প্যানপ্যানানি আমার কাছেই।

জীবনের ধন কিছুই কি যাবে ফেলা??

মুন্নী সাহা: সাংবাদিক।