কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ অনুসন্ধান

বৃন্দলেখক
Published : 22 Dec 2013, 07:23 PM
Updated : 22 Dec 2013, 07:23 PM

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট অর্জন, বলাই বাহুল্য। এবারের বিজয় দিবস এবং সেই সঙ্গে নতুন বছরের আগমনটাই যেন ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে গেছে এই অর্জনের ফলে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের বিচারের যে আকাঙ্ক্ষা একটা সময় আমাদের রক্তে শিহরণ তুলত, একটা অপ্রাপ্তির বেদনা গ্রাস করে ফেলত বছর খানেক আগেও, সেটা থেকে যেন আমরা মুক্তি পেয়েছি।

অন্তত একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি নানা ধরনের বিতর্ক, প্রতিবন্ধকতা, বিশ্বমোড়লদের তরফ থেকে দেওয়া আন্তর্জাতিক চাপ সবকিছু অগ্রাহ্য করে। এটা যে কত বড় অর্জন তা বোধহয় আমরা কেউ বুঝতে পারছি না। এই দিনটা দেখার স্বপ্ন আমরা বুকের মধ্যে লালন করেছিলাম বহুদিন ধরে।

কিন্তু আমরা কী দেখলাম? কাদের মোল্লার ফাঁসির পর বাংলাদেশের আপামর জনগণ যখন আনন্দোচ্ছ্বাস করছে, ঠিক তখনই এক মুখচেনা মহল সারা দেশে শুরু করেছিল সহিংসতা আর নৈরাজ্যের বিস্তার। জ্বালাও-পোড়াও, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর আক্রমণ, বিচারকদের বাসায় বোমাবাজি সবই শুরু হল পুরোদমে। পাশাপাশি আরেকটা কাজও জামাতিদের তরফ থেকে করার প্রচেষ্টা চালানো হল– যেটা তারা সবসময়ই করে থাকে– বিভ্রান্তি ছড়ানো।

সত্য যখন উন্মোচিত আর দিনের আলোর মতো উদ্ভাসিত, বিভ্রান্তি আর মিথ্যে প্রচারণা– এটাই বোধহয় একমাত্র অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন। সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর চাঁদে সাঈদীর মুখচ্ছবি দেখা নিয়ে কী প্রচারণাটাই না চালানো হয়েছিল। অথচ পুরোটাই ছিল ফটোশপে এডিট করা খুব কাঁচা হাতের কাজ। যারা নিজেদের ধর্মের একনিষ্ঠ সেবক মনে করেন, তাদের সাচ্চা সৈনিকেরা এভাবে ফটোশপে ছবি এডিট করে যাচ্ছেতাই প্রচারণা চালায়-– ভাবতেও হয়তো অনেকের অবাক লাগবে।

কিন্তু যারা এই গোত্রটির কাজকর্মের নাড়ি-নক্ষত্রের হদিস জানেন, তারা অবাক হন না। শাহবাগ আন্দোলন শুরুর সময় একে কলঙ্কিত করতে নানা ধরনের রগরগে ছবি জোড়াতালি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল-– 'প্রজন্ম চত্বর' নাকি আসলে 'প্রজনন চত্বর'। ওখানে নাকি রাত্রিবেলা গাঁজা খাওয়া হয়, ফ্রি সেক্স হয়, তরুণীরা সেখানে গেলেই ধর্ষিত হতে হয়, আরও কত কী।

কী না করেছিল তারা! মুম্বাই মেডিকেলের স্ক্যান্ডালের ছবির সঙ্গে ইমরান এইচ সরকারের চেহারা জোড়া দেওয়া, শাহবাগের জমায়েতে নাইট ক্লাবের নগ্নবক্ষা নারীর ছবি কাট অ্যান্ড পেস্ট করে লাগিয়ে দিয়ে ফেসবুকে ছড়ানো, নামাজরত এক পাকিস্তানি পুলিশকে শিবিরের কর্মী হিসেবে চালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতীকী রশি নিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি সম্বলিত ছবির শিরোনাম বদলে 'ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে শাহবাগে যুবক প্রাণ হারাল' টাইপ মিথ্যে নিউজ তৈরি করা-– কোনো কিছুই বাদ যায়নি।

মুক্তমনা ব্লগে আমাদের সতীর্থ দিগন্ত বাহার 'কথিত ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীর মিথ্যাচার সমগ্র' শিরোনামের পোস্টে খুলে দিয়েছিলেন তাদের মিথ্যের মুখোশ; লিঙ্কটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া গেল:

কাদের মোল্লার ফাঁসির পরেও নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হবে তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। ফাঁসির আগে থেকেই কাদেরের তথাকথিত 'অ্যালিবাই' উপজীব্য করে ছড়ানো হয়েছিল মিথ্যে। কাদের ট্রাইব্যুনালকে বলেছিল:

"আজ এই কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ১৯৭১ সালে মিরপুরে কসাই কাদের কর্তৃক যেইসব হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল তার একটি অপরাধের সঙ্গেও আমার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। কাদের মোল্লা বলেন, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি আমি ১৯৭৩ সালের আগে কোনোদিন মিরপুরেই যাইনি।"

এই অ্যালিবাইকেই সত্য ধরে নিয়ে অনেকে জল ঘোলা করছেন। কিন্তু এটাই কি স্বাভাবিক নয় যে কাদের মোল্লার মতো এত বড় একটা পাষণ্ড এবং ঠাণ্ডা মাথার খুনি এ ধরনের অ্যালিবাই হাজির করেই নিজেকে আত্মরক্ষা করতে চাইবে? তার তো এটাই বলার কথা যে ঘটনার সময় সে ঘটনাস্থলে ছিল না।

এ নিয়ে সম্প্রতি ব্লগার নিঝুম মজুমদার কিছু গবেষণা করেছেন। মুক্তমনায় প্রকাশিত তার দি কিউরিয়াস কেইস অব কাদের মোল্লা এবং সাক্ষী মোমেনা শিরোনামের লেখাটি থেকে জানা যায়, এই কাদের মোল্লার একসময়ের সবচাইতে বড় ইয়ার দোস্ত 'আক্তার গুণ্ডা' ছিল কাদের মোল্লার মতোই এক ভয়াবহ খুনি। কাদের মোল্লা এই আক্তার গুণ্ডার সঙ্গে মিলেই মূলত ১৯৭১ সালে মিরপুরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।

১৯৭২ সালের দালাল আইনে এই আক্তার গুণ্ডার বিচার হয় এবং বিচারে তার ফাঁসিও হয়। মজার ব্যাপার হল, এই আক্তার গুণ্ডাও আজ থেকে ৪০ বছর আগে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে সেই একই ধরনের অ্যালিবাই হাজির করেছিল যে, সে ঘটনাস্থলে ছিল না, ছিল পাকিস্তানে। গণহত্যার সে কিছুই জানে না ['আক্তার গুণ্ডা ভার্সেস বাংলাদেশ রায়' দ্র:]।

কিন্তু কেউ এ ধরনের 'ভেজা বিড়াল' সাজতে চাইলেই যে সেটা ঠিক তা তো নয়। বহু চাক্ষুষ সাক্ষীই আক্তার গুণ্ডার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং সে দোষী প্রমাণিত হয়েছিল।

কাদের মোল্লাও বিয়াল্লিশ বছর পরে তার প্রিয় গুণ্ডা বন্ধুর মতোই অ্যালিবাই হাজির করতে গিয়ে বলেছে, সে কস্মিনকালেও মিরপুরে যায়নি, গণহত্যা তো কোন ছাড়! এমন একটা ভাব যে, কাদের মোল্লা ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। সহজ সরল এক ভালো মানুষকে যেন 'কসাই কাদের' ভেবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একই কাজ তারা অন্য আসামির বেলায়ও করেছে। এই 'সাকাচৌ' সেই সাকা চৌধুরী নয়, সে ছিল পাকিস্তানে। এই দেলু রাজাকার সেই 'দেইল্যা' নয়। একই ধারাবাহিকতায় এখন বলছে, এই কাদের মোল্লা সেই কসাই কাদের নয়। কিন্তু তাদের এই কথা ঠিক কতটুকু যৌক্তিক– এই প্রবন্ধে আমরা সেটা পুংখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখব।

একাত্তরে কাদের মোল্লার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ব্যাপারটা বহুভাবেই আসলে প্রমাণ করা যায়। শুরু করা যাক ইন্টারনেটে পাওয়া একটি বহুল প্রচারিত ছবি দিয়ে, যেখানে নিয়াজীর পেছনে আশরাফুজ্জামান এবং কাদের মোল্লাকে দেখা যাচ্ছে। আশরাফুজ্জামান বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করেছিল, বর্তমানে ব্রিটেনে পলাতক আলবদর নেতা মুঈনুদ্দীনের সঙ্গে মিলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান খ্যাত ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে তারা। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মুঈনুদ্দীনের সঙ্গে আশরাফুজ্জামান খানেরও ফাঁসির আদেশ হয়েছে সম্প্রতি। সেখানেই বীরদর্পে কাদের মোল্লা দণ্ডায়মান। মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত 'মুক্তিযুদ্ধ কোষ' বইয়ে ছবিটির হদিস পাওয়া যায়। ইউটিউবেও এর একটি ভিডিও আছে।

সেই বিয়াল্লিশ বছর আগের ছবিটির কথা যদি আমরা বাদও দিই, আজকের দিনের প্রসঙ্গ গোণায় ধরলেও, কাদের মোল্লার পরিচয় গোপন থাকে না। তার ফাঁসির পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান বলেছেন–
"১৯৭১ সালের ঘটনার বিয়াল্লিশ বছর পর কাদের মোল্লার ফাঁসি একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ততা ও সংহতির জন্য কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মৃত্যুতে সকল পাকিস্তানি মর্মাহত এবং শোকাহত।''

তিনি আরও বলেন, "এ ঘটনার মাধ্যমে পুরনো ক্ষত আবারও জাগিয়ে তোলা হয়েছে।"

জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের প্রধান মুনাওয়ার হাসান কাদের মোল্লাকে তাদের 'বাংলাদেশি সহচর' এবং 'পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা' আখ্যায়িত করে তার ফাঁসিকে 'শোচনীয়' বলে মন্তব্য করেন। শুধু তাই নয়, কাদেরের ফাঁসি দেওয়ায় বাংলাদেশ আক্রমণের জন্য নিজেদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল জামায়াত-ই-ইসলামী। 'কসাই কাদের' আর 'কাদের মোল্লা' এক ব্যক্তি না হলে পাকিস্তানি জামাতের এত শখ হল কেন এই বিবৃতি দেবার?

বারবারই বাংলাদেশের জামাত দাবি করে এসেছে কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নয়, তারা হাজির করে কাদেরের জবানবন্দি, যেখানে কাদেরের অ্যালিবাই ছিল:

"১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই তিনি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। গ্রামে অবস্থানকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত (পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত) অন্যদের সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান ডামি রাইফেল দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেন।" (ইত্তেফাক)

কাদের এবং তার দলবলের দাবি অনুযায়ী সে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ছিল; অথচ পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছেন–

''কাদের মোল্লা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং তা তিনি নিজের মুখেই বলেছিলেন।''

নিজের মুখে কাকে এ কথা বলেছেন কাদের? তিনি বিরাট মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তো নিজেকে 'অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন' সেটা বলার কথা নয়। যেভাবে নিউজগুলো পত্রিকায় এসেছে তাতে মনে হয় নিসার সাহেবের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল এবং তিনি কাদেরের পরিচয় সম্বন্ধে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। না হলে নিসার সাহেব বলবেন কেন যে, পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ততা ও সংহতির জন্য কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই?

এগুলো থেকে কী প্রমাণিত হয়? কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা দুই ব্যক্তি? সেই হিন্দি সিনেমার মতো আসল কাদেরকে জীবিত রেখে তার 'জরুয়া' ভাইকে ঝোলানো হয়েছে? মোটেও তা নয়। বরং সম্প্রতি একটি পত্রিকায় ড. জিনিয়া জাহিদ যে কথাগুলো তার 'কাদের মোল্লা মরিয়া প্রমাণ করিল' শিরোনামের লেখায় উল্লেখ করেছেন সেটাই সত্য হিসেবে প্রকট হয়ে উঠেছে–

''সেই যে রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনী গল্পে পড়েছিলাম, 'কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে, সে মরে নাই', ঠিক তেমনি কাদের মোল্লার ফাঁসিতে মৃত্যুর পর তাদের সমগোত্রীয় পাকি-জামায়াতের স্বীকারোক্তিতে এটাই প্রমাণ হল যে, এই কাদের মোল্লাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা এবং এই কাদের মোল্লাই আমৃত্যু পাকি-সমর্থক ছিলেন। এই কাদের মোল্লা একাত্তরেও যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন।''

মিথ্যাচারী এবং মিথ্যার বেসাতি করা জামাত-শিবির কেবল কাদের মোল্লাকে কসাই কাদের থেকে পৃথক করার মিশন নিয়েই মাঠে নামেনি, তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পর্যন্ত প্রমাণ করতে চেয়েছে। সে নাকি একাত্তরের যুদ্ধে গ্রামে বসে কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছে। মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকে! অথচ এই কাদের মোল্লাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে করেছিল চরম বিদ্রূপাত্মক উক্তি, যেটা ২০০৭ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল:

"কেউ সুন্দরী নারীর লোভে, কেউ হিন্দুর সম্পদ লুণ্ঠন, কেউ ভারতীয় স্বার্থরক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কেউই আন্তরিকতা কিংবা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি।" (কাদের মোল্লা, সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ অক্টোবর, ২০০৭)

এর বাইরেও বহুবারই কাদের মোল্লার বাংলাদেশ বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের প্রতি অবজ্ঞার ব্যাপারটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন এ বছরের নভেম্বর মাসে বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমে প্রকাশিত এই নিউজটি দ্রষ্টব্য:

এই লোক 'কসাই কাদের'না হয়ে মুক্তিযোদ্ধা হবে, সেটা কি কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে?

এবার কিছু চাক্ষুষ সাক্ষীর বয়ান শোনা যাক।

এক: ফজর আলী

"মিরপুর ১১ নম্বর বি ব্লকের বাসিন্দা ফজর আলী গণতদন্ত কমিশনকে দেওয়া সাক্ষ্যে তার ছোট ভাই মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন কাদের মোল্লাকে। ২৯ মার্চ নবাবপুর থেকে পল্লবকে তুলে নিয়ে আসে কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গরা। এরপর তার নির্দেশে ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশনের শাহ আলী মাজার পর্যন্ত হাতে দড়ি বেঁধে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ছাত্রলীগ কর্মী পল্লবকে। এরপর আবার ১ নম্বর থেকে ১২ নম্বর সেকশনের ঈদগাহ মাঠে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে টানা দু'দিন একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় পল্লবকে। ঘাতকরা এরপর তার দু'হাতের সবকটি আঙুল কেটে ফেলে।

৫ এপ্রিল একটি মজার খেলা খেলে কাদের মোল্লা। সঙ্গীদের নির্দেশ দেওয়া হয় গাছে ঝোলানো পল্লবকে গুলি করতে, যার গুলি লাগবে তাকে পুরষ্কার দেওয়া হবে। পরে কাদের মোল্লার সঙ্গী আক্তার পল্লবের বুকে পাঁচটি গুলি করে পরপর। পল্লবের লাশ আরও দু'দিন ওই গাছে ঝুলিয়ে রাখে কাদের মোল্লা, যাতে মানুষ বোঝে ভারতের দালালদের জন্য কী পরিণাম অপেক্ষা করছে। ১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ৭ জন হতভাগার সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয় পল্লবকে।

অক্টোবরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে একজন মহিলা কবি মেহরুন্নেসাকে প্রকাশ্যে নিজের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করে কাদের মো্ল্লা। প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সিরাজ এই নৃশংসতায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মূলত বিহারিদের নিয়ে একটি খুনে দল তৈরি করেছিল কাদের মোল্লা। আর বুলেট বাঁচাতে জবাই করা ছিল তার কাছে বেশি প্রিয়।"

দুই: ফিরোজ আলী

"ফিরোজ আলী তখন মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি, একাত্তর সালে সপরিবারে মিরপুরে থাকতেন। ২৫ মার্চের পর তার ভাই পল্লবকে শুধু 'জয় বাংলা'র অনুসারী হওয়ার অপরাধে কাদের মোল্লার নির্দেশে অবাঙলি গুণ্ডারা অকথ্য নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন সমগ্র মিরপুরে হত্যা আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কাদের মোল্লা ও তার অনুসারী অবাঙালিরা। জবাই করে বাঙালি হত্যা ছিল তাদের প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজ। একেকটি জবাই'র আগে ঘোষণা দিত যারা বাংলাদেশ তথা 'জয় বাংলা'র অনুসারী, তারা বিধর্মী-নাস্তিক-ভারতের দালাল, এদের হত্যা করা সওয়াবের কাজ!

এমন জবাই'র নেশা বেড়ে যাওয়ায় কাদের মোল্লার নাম তখন এ তল্লাটে আতঙ্কের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্থানীয়রা আবদুল কাদের মোল্লাকে 'কসাই কাদের'নামকরণ করে। গরু জবাই-এর মতো মানুষ জবাই-এ দক্ষতার নামডাকে (!) কসাই কাদের 'মিরপুরের কসা‌ই' নামেও পরিচিতি লাভ করে ব্যাপক।

কসাই কাদের মোল্লার প্রতিহিংসার শিকার শহীদ পল্লবের ডাক নাম ছিল 'টুনটুনি'। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বেশ কিছু চলচ্চিত্রে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে সুখ্যাতি অর্জন করে প্রতিপক্ষের চক্ষুশূল হন পল্লব। এ কথা জানান ফিরোজ আলীর স্ত্রী।

পল্লব ছাড়াও কবি মেহেরুন্নেছা নামের এলাকায় খুবই শান্ত-নিরীহ প্রকৃতির বাঙালি গৃহবধূ কসাই কাদের মোল্লার প্রতিহিংসার বলি হন। মিরপুর ৬ নং সেকশন, ডি ব্লক মুকুল ফৌজের মাঠের কাছাকাছি একটি বাড়িতে থাকতেন কবি মেহেরুন্নেছা। তিনি ছিলেন কবি কাজী রোজীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।

কসাই কাদের মোল্লার নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লেখালেখির অপরাধে মেহেরুন্নেছাসহ তার পুরো পরিবারকে বটি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল! এরপর টুকরো করা মাংসখণ্ডগুলো নিয়ে ফুটবলও খেলা হয়েছিল ৬ নং মুকুল ফৌজের মাঠে! কসাই কাদেরের নির্দেশে ৩০/৩৫ জনের একটি অবাঙালি ঘাতকের দল, মাথায় লাল ফিতা বেঁধে, ধারালো তলোয়ারে সজ্জিত হয়ে অংশ নেয় কবি মেহেরুন্নেছা ও তার পরিবারের হত্যাযজ্ঞে!"

তিন: কাদের মোল্লার বন্ধু মোজাম্মেল এইচ খান

ড. মোজাম্মেল এইচ খান ছিলেন রাজেন্দ্র কলেজে কাদের মোল্লার সহপাঠী। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন কাদের মোল্লার কাজকর্ম, একাত্তরে এবং তার পরবর্তী সময়। তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দৈনিক জনকণ্ঠে একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন, ''কাদের মোল্লাকে নিয়ে 'আমার দেশ' পত্রিকার আষাঢ়ে কাহিনী'' শিরোনামে:

"কাদের মোল্লা হলেন আমাদের রাজেন্দ্র কলেজের ১৯৬৪-১৯৬৬ এইচএসসি ব্যাচের সবচেয়ে পরিচিত মুখ এবং তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমধিক পরিচিত ব্যক্তি, তা সে যে কারণেই হোক না কেন। এমনকি তিনি আমাদের সে সময়ের আরেক সহপাঠী বেগম জিয়ার বিগত শাসনামলের মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদকেও পরিচিতির দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন; যদিও মুজাহিদও একইভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার অপেক্ষায় রয়েছেন, যদি না সুপ্রীম কোর্ট তার দণ্ডকে উল্টে দেয়।''

ড. মোজাম্মেল খান তাঁর প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এমনকি কাদেরের পরিবারের দেওয়া বিবরণেও তিনি ১৯৭২ সালে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে 'তার ডিপার্টমেন্টে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন' এ ধরনের কোনো দাবি নেই; বরং তিনি যে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন সে কথাই বলা হয়েছে। এমনকি তিনি যে কোনো ডিগ্রি পেয়েছেন সেটার কোনো উল্লেখ নেই।

তেমনিভাবে 'যুদ্ধের পুরো সময় তিনি গ্রামেই অবস্থান করেন' সে কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সেটার কোনো উল্লেখ নেই। 'শেখ মুজিবুর রহমান তাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরিও দিয়েছিলেন' সেটাও কাদেরের পরিবার উল্লেখ করেনি; অথচ 'আমার দেশ' এবং 'বাঁশের কেল্লা'রা চাঁদে সাঈদীর মুখচ্ছবি দর্শনের মতো করে ঠিকই 'সত্যের সন্ধান' পেয়ে গেছে!

জামাতিদের পক্ষ থেকে আরও ছড়ানো হয়েছে যে, কাদের মোল্লা নাকি 'ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট' হওয়া 'গোল্ড মেডেলিস্ট' ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা মোটেই সে রকমের নয়। মোল্লার 'ভালো ছাত্রত্বের' গুমোর ফাঁস করে দিয়েছেন মোজাম্মেল খান তাঁর কলামে:

''এইচএসসির ফলাফলে কাদের গড়পড়তা ছাত্রের থেকে নিচে ছিল যার ফলে সরাসরি সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি। সে রাজেন্দ্র কলেজেই বিএসসি পড়ে (১৯৬৬-১৯৬৮) এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস কোর্সে এমএসসিতে ভর্তি হয় যেটা তার পরিবারের দেওয়া সময়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে; যদিও তার পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী সে এসএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। অথচ কাদের আমাদের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেছে ১৯৬৬ সালে।

তাহলে এর মাঝে দুই বছরের বেশি সময় সে কী করেছে? তার পরিবার বলেছে সে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করে। এ বক্তব্যের প্রথম অংশটুকু সত্য নয় এবং যে কোনো পাঠকই বুঝতে পারবেন দুই বছরের এমএসসি ডিগ্রির জন্য ৮ বছর (১৯৬৯-১৯৭১, ১৯৭২-১৯৭৭) বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করার হিসেব মেলানো যায় না।''

বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী অধ্যাপক মোজাম্মেল খান সেই একই প্রবন্ধে বর্ণনা করেছেন যখন তিনি ১৯৭৯ সালে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন, কীভাবে কাদের মোল্লার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল এবং কীভাবে সে উল্লসিত হয়ে মোজাম্মেল সাহেবকে বলেছিল 'জয় বাংলা'কে সরিয়ে 'জিন্দাবাদ' রাজত্ব করে চলেছে:

"১৯৭৩ সালের প্রথমার্ধ্বে আমি যখন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে আসি তখন জানতাম না কাদের কোথায় আছে। ১৯৭৯ সালে আমি দেশে বেড়াতে গেলে একদিন যখন ঢাকার মগবাজারের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি তখন পেছন থেকে একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'তুই কি মোজাম্মেল? আমি কাদের।' আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, 'কাদের, তুই বেঁচে আছিস?' কাদেরের উত্তর ছিল, 'হ্যাঁ, আমি ভালোভাবে বেঁচে আছি এবং এখন আমি দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদক। তোর জয় বাংলা এখন এদেশ থেকে নির্বাসিত; ফিরে এসেছে আমাদের জিন্দাবাদ এবং এটা এখন প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত।' যেহেতু কাদের সত্য কথাই বলেছিল, সেহেতু আমি ওর কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি।

কয়েক সপ্তাহ পরে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাই তখন সংবাদপত্রে পড়লাম প্রেসক্লাবে একটি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিল কাদের মোল্লা; একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস!"

মোজাম্মেল এইচ খান ইংরেজিতেও এ নিয়ে একটি লেখা লিখেছেন Quader Mollah: fact versus fiction শিরোনামে যেটা মুক্তমনা সাইটের ইংরেজি ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে।

ড. মোজাম্মেল এইচ খান কাদের মোল্লার ফাঁসির পর স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন, ''বিদায় এককালের সহপাঠী কাদের মোল্লা। তোমার এ পরিণতিতে আমি শোক করতে পারছি না'' বলে:

পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন আমরা এ লেখায় এখন পর্যন্ত মোমেনা বেগমের কথা আনিনি। এই নারী কাদের মোল্লার দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত তাঁর ভাষ্য থেকে জানা যায়, বেলা ডোবার আগে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মোমেনাদের বাড়িতে হামলা হয়। "আব্বা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আসে এবং বলতে থাকে 'কাদের মোল্লা, মেরে ফেলবে'। আক্তার গুণ্ডা, বিহারিরা তারা ও পাক বাহিনীরা দৌড়াইয়া আসছিল। আব্বা ঘরে এসে দরজার খিল লাগায়ে দেয়।"

হযরত দরজা এঁটে সন্তানদের খাটের নিচে লুকাতে বলেন। মোমেনার সঙ্গে তার বোন আমেনা বেগমও খাটের নিচে ঢোকে। তখন দরজায় শোনেন কাদের মোল্লাসহ বিহারিদের কণ্ঠস্বর, 'এই হারামি বাচ্চা, দরজা খোল, বোম মার দেঙ্গা।' শুরুতে দরজা না খোলায় বাড়ির দরজার সামনে একটি বোমা ফাটানো হয়। এক পর্যায়ে হযরতের স্ত্রী একটি দা হাতে নিয়ে দরজা খোলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়।

"আব্বা তখন আম্মাকে ধরতে যায়। কাদের মোল্লা পেছন থেকে শার্টের কলার টেনে ধরে বলে, 'এই শুয়ারের বাচ্চা, এখন আর আওয়ামী লীগ করবি না? বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাবি না? মিছিল করবি না? জয় বাংলা বলবি না?' আব্বা হাতজোড় করে বলে, 'কাদের ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও'। আক্তার গুন্ডাকে বলল, 'আক্তার ভাই, আমাকে ছেড়ে দাও'।" তবু না ছেড়ে হযরত আলীকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় বিহারিরা।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এরপর কাঁদতে কাঁদতে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন মোমেনা। "দাও দিয়ে আমার মাকে তারা জবাই করে। চাপাতি দিয়ে খোদেজাকে (বোন) জবাই করে। তাসলিমাকেও (বোন) জবাই করে। আমার একটি ভাই ছিল বাবু, বয়স ছিল দুই বছর, তাকে আছড়িয়ে মারে। বাবু মা মা করে চিৎকার করছিল," বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন মোমেনা।

বাবুর চিৎকার শুনে খাটের তলায় লুকানো আমেনা চিৎকার দিলে তার অবস্থান জেনে যায় হামলাকারীরা। মোমেনা বলেন, "আমেনাকে তারা টেনে বের করে, সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলে। এরপর তাকে নির্যাতন করতে থাকে। আমেনা অনেক চিৎকার করছিল, একসময় চিৎকার থেমে যায়।"

কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অজ্ঞান মোমেনা এরপর শোনান নিজের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা।

মোমেনার সাক্ষ্য নিয়ে কম জল ঘোলা করেনি জামাতিরা। বলা হচ্ছে মোমেনা নাকি তিনবার সাক্ষ্য দিয়েছেন। একেক জায়গায় নাকি তার একেক রকম বক্তব্য। তিনি নাকি মিরপুরের জল্লাদখানার জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তাতে কাদের মোল্লার নাম ছিল না। তিনি নাকি বোরকা ও নেকাবে মুখ আবৃত করে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়েছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এগুলো আসলে একেবারেই বানোয়াট প্রোপাগাণ্ডা। ব্লগার নিঝুম মজুমদার মুক্তমনায় প্রকাশিত দি কিউরিয়াস কেইস অব কাদের মোল্লা এবং সাক্ষী মোমেনা প্রবন্ধে প্রতিটি কুযুক্তিই খণ্ডন করেছেন। পাঠকেরা প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।

আসলে মোমেনা মূলত তার জীবনে একবারই সাক্ষ্য দিয়েছেন তাঁর পিতা-মাতা আর ভাই-বোন হত্যা মামলায়। আর সারাজীবন যদি অন্য কোনো বক্তব্য দিয়ে থাকেন তবে সেটি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি, হবার কথাও নয়।

মোমেনার যে জবানবন্দির কথা বলে জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়– যেটি তিনি মিরপুরের জল্লাদখানার জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন বলে 'বাঁশের কেল্লা'রা ক্রমাগতভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেটি কিন্তু মাননীয় আদালতের চোখে সম্পূর্ণভাবে অসাড় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যে অভিযোগ আদালতে ধোপে টেকেনি, সেটা যদি 'কন্সপিরেসি থিওরি' হিসেবে কেউ ছড়িয়ে বেড়ায় তখন তার ঘাড়েই দায় বর্তায় সেটা প্রমাণ করার, আমাদের ওপর নয়।

নিঝুম মজুমদারের অনুসন্ধানী পোস্ট থেকে জানা যায়, ''কাদেরের আইনজীবী একটা কাগজ নিয়ে এসেছে ছবি ফরম্যাটে [ফটোস্ট্যাট] যাতে কোনো কর্তৃপক্ষের সাক্ষর নেই, সাক্ষ্যদাতার সাক্ষর নেই, এটি কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সেটির ব্যাখ্যা নেই কিংবা বলতে পারেনি, এই বিচারের আইনের ধারা ৯, সাব সেকশন ৫-এর নিয়ম ফলো করা হয়নি, এটা কোনো সাক্ষ্য নয়।'' [ট্রাইব্যুনাল-২ এর মামলার রায়, পৃষ্ঠা ১১৯, প্যারা ৩৯১-৩৯২ দ্র:]

আর কোনো জাদুঘরের সাক্ষাতকারে যদি মোমেনা কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ না করে থাকেন কিংবা আদালতে যদি বোরকা পরে সাক্ষ্য দিতে এসে থাকেন তাতেই-বা কী সমস্যা ছিল? যে মানুষটি তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে চোখের সামনে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছেন, যে ব্যক্তি গত বিয়াল্লিশটি বছর শোক-দুঃখ-হাহাকার নিয়ে বড় হয়েছেন, কাতর হয়েছেন অমানুষিক যন্ত্রণায়, তিনি কি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা নেবেন না? মোমেনা বেগম নিজ মুখেই তো বলেছেন যে, আদালতে সাক্ষ্যের আগে তিনি ভয় এবং নিরাপত্তার কারণে অনেক সময়ই নাম গোপন করে গেছেন:

"অনেক মানুষ আমার কাছে এসেছিল ও আমার ছবি নিয়েছিল; কিন্তু ভয়ের কারণে আমি কাউকে কাদের মোল্লা এবং আক্তার গুণ্ডার নাম বলি নাই।"

তাঁর ভয়ের ব্যাপারটা তো অমূলক নয়। জামাত-শিবিরের সন্ত্রাস সম্বন্ধে কেউ তো অজ্ঞ নয়। সাঈদীর মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গোলাম মোস্তফা নিহত হননি? তারা বোধহয় একই পরিণতি মোমেনা বেগমের জন্যও চেয়েছিল। সেটা বাস্তবায়িত না হওয়াতেই কি এত ক্ষোভ আর মিথ্যাচার?

আর এই মামলায় তো কেবল মোমেনা বেগম নয়, অনেক সাক্ষীই 'ক্যামেরা ট্রায়ালে' সাক্ষ্য দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এই জাতীয় ট্রায়ালের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো প্রচলিত রয়েছে, সে ধরনের নিয়ম মেনেই সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অথচ হঠাৎ করেই মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য কেন্দ্র করে গোয়েবলসীয় প্রচারণায় মেতে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মহল।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকেরই হয়তো জানা নেই– সাক্ষী নিয়ে বরং ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলেন কাদের মোল্লার পক্ষের আইনজীবীরাই। মোল্লার এক ভিকটিম পল্লবের ভাইয়ের স্ত্রী মোসাম্মৎ সায়েরাকে তারা হাত করতে চেষ্টা করেন, তাকে দিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন তিনি। (ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্যারা ১৮২-১৮৯ দ্রঃ)। মজা হচ্ছে এগুলো নিয়ে গোয়েবলস বাবাজি আর তার সাগরেদরা সব নিশ্চুপ।

পাঠকদের অবগতির জন্য জানাই, কেবল মোমেনা বেগম নয়, অনেকের সাক্ষ্য থেকেই জানা গেছে এই কাদের মোল্লাই– আক্তার গুণ্ডা, নেহাল, হাক্কা গুণ্ডা যারা মীরপুরে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল একাত্তরে– তাদের সহচর ছিল। এদের অনেকেই সরাসরি কাদেরকে নিজ চোখে শনাক্ত করেছিল। সেই চাক্ষুষ সাক্ষীর মধ্য থেকেই দু'জনের বয়ান উপরে এই লেখাতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আছেন প্রধান সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক মামা, যিনি আদালতে দাঁড়িয়ে কাদের মোল্লাকে শনাক্ত করেছিলেন। কাদের মোল্লার আসল-নকল নিয়ে প্রধান সাক্ষী শহিদুল হক মামা 'একাত্তর' টিভিতে ১৩.১২.২০১৩, ইউটিউব ভিডিও:

তারপরও বেশিরভাগ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, জামাত-সমর্থক গোষ্ঠীর ধারণা কাদের নির্দোষ ভালো মানুষ। কিছু "বিকৃত তথ্য"এবং তার সঙ্গে একগাদা নির্জলা 'মিথ্যাচার' জড়িয়ে সারাদিন এরা করে যাচ্ছে ধর্মব্যবসা। গোয়েবলসীয় কায়দায় তারা বলেই চলেছে কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের নাকি এক নয়। যারা এখনও বলে, কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের এক নয়, তাদের কাছে আমাদের একটাই প্রশ্ন–

'কসাই কাদের'টা তাইলে গেল কোথায়? রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি?

আমরা মনে করি, কাদের আর কসাই একই লোক সেটা আদালতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে আর শাস্তিও দেওয়া হয়েছে, আমাদের নতুন করে আর কিছু প্রমাণের নেই। 'বার্ডেন অব প্রুফ'টা তাদের কাঁধেই যারা মনে করেন দুই কাদের ভিন্ন ব্যক্তি। আমরা মনে করি, তারা সেটা প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে মোমেনার মতো চাক্ষুষ সাক্ষীরাই যথেষ্ট যাদের পরিবার কাদের মোল্লার হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাকে চিনতেন তার বন্ধু এবং সহপাঠীরাও, যেমন ড. মোজাম্মেল এইচ খানের মতো ব্যক্তিরা।

বিপরীত পক্ষ বরাবরই সেগুলো অস্বীকার করে 'বাঁশের কেল্লা' আর গোলাম মওলা রনির মতো লোকজনের কথাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। আসুন দেখি কতটা নির্ভরযোগ্য এই গোলাম মাওলা রনি, যে সরকারদলীয় সাংসদ অতীতে সাংবাদিক পেটানোসহ বহু কারণেই বিতর্কিত হয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন।

কাদের মোল্লার ফাঁসির আগ মুহূর্তে তিনি একটি চিরকুট প্রকাশ করেন ফেসবুকে এবং দাবি করলেন রনির সঙ্গে মোল্লা সাহেবের কারাগারে সাক্ষাত হয়েছিল এবং সেই সুবাদে মোল্লা রনিকে একটা চিঠি দেন, সেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে কাদের মোল্লার 'একটু উস্তাভাজি খাওয়ার' বাসনা ছিল আর মোল্লা নাকি রনিকে এও অনুরোধ করে বলেছিলেন, 'আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বল বা লিখ যে, কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়'। এই সেই চিঠি:

এই চিঠি পুঁজি করেই সহানুভূতির বাণিজ্য শুরু করেছিলেন গোলাম মওলা রনি ফেসবুকে। গোলাম শুরু করেছিলেন কাদেরের গোলামী।

কিন্তু আমরা যখন এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলাম তখন বেরিয়ে এল অন্য তথ্য, বিশেষ করে যখন কাদের মোল্লার স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি অনলাইনে প্রকাশিত হয়ে যায়:

ব্যাপারটা কি লক্ষ্য করেছেন পাঠক???

পাঠকদের সুবিধার জন্য দুটো ছবি একসঙ্গে দেওয়া গেল। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়':

গোলাম মওলা রনি সাহেবের যে ফেসবুক স্ট্যাটাসটা নিয়ে এত চেঁচামেচি, এখন তো থলের বেড়াল বেরিয়ে এসেছে; সেই চিরকুটের সিগনেচার আর কাদের মোল্লার পরিবারের কাছে লেখা চিঠির সিগনেচার ভিন্ন!

লেখাটি শেষ করার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। এই ট্রাইব্যুনাল যদি স্বচ্ছ না হয়, যদি কাদের সত্যই মনে করে যে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, তাহলে ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ের পর কসাই কাদের কেন দুই আঙুল দিয়ে জয়সূচক 'ভিক্টরি চিহ্ন' দেখিয়েছিল? যে ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ নয়, নিরপেক্ষ নয়, আন্তর্জাতিক নয়– সেই ট্রাইব্যুনালে প্রথম রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়ার পরেও কেন কাদের নিজেকে জয়ী মনে করল?

যদি সে সত্যিই কসাই কাদের না হয়, কস্মিনকালেও যদি মিরপুরে না গিয়ে থাকে, একটি মানুষও হত্যা না করে থাকে, তবে কতবড় পাগল হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাবার পরেও হাত তুলে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে? হিসেবটা কি মেলে?

আশা করি আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটি বিভ্রান্তি দূর করে হিসেবগুলো মেলাতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।

আরিফ রহমান: বস্ত্রপ্রকৌশলে অধ্যয়নরত ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।

ড. অভিজিৎ রায়: মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।