তাদের উদ্বেগ, একটি সিদ্ধান্ত এবং আমাদের বাস্তবতা

ইমতিয়ার শামীম
Published : 17 Dec 2013, 05:52 PM
Updated : 17 Dec 2013, 05:52 PM

১.

আমাদের আন্তর্জাতিক শুভার্থীরা এখন বাংলাদেশকে নিয়ে 'উদ্বিগ্ন' বললে কমই বলা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র-বিষয়ক কংগ্রেস কমিটির একজন সদস্য গ্রেস মেং ১৫ ডিসেম্বর জানিয়েছেন, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে আবারও শুনানি করবেন তারা। সেই শুনানির মধ্য দিয়ে তারা 'একটি সিদ্ধান্তে' আসবেন। এর একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা জানিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা জানার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা করছে। তাছাড়াও তিনি কথা বলেছেন ড. ইউনূসের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

এই যুক্তরাষ্ট্রকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমরা, চিনি হাড়ে-মাংসে। এই যুক্তরাষ্ট্র জর্জ হ্যারিসনের যুক্তরাষ্ট্র নয়, জর্জ ওয়াশিংটনের যুক্তরাষ্ট্রও নয়। এই যুক্তরাষ্ট্র নিক্সন-কিসিঞ্জারের যুক্তরাষ্ট্র। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। এই যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন দমাতে, স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রগুলিকে অকার্যকর করতে বিভিন্ন জাতীয় নেতাদের হত্যা করে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইন্ধন যুগিয়েছে, প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে।

আমরা জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনকেও উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি। আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়ায় দুঃখ পেয়েছেন তিনি। আমরা দুঃখ পেতে দেখেছি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ারসিকেও। তিনি জানিয়েছেন, যে কোনো পরিস্থিতিতেই ব্রিটেন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী, তাই তিনি উদ্বিগ্ন কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়াতে।

২০১২ সালেও পৃথিবীর ২১টি দেশে ৬৮২টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এই ২১ দেশের মধ্যে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে এবং সেখানে কার্যকর করা হয়েছে ৪৩টি মৃত্যুদণ্ড। আর সৌদি আরবে চূড়ান্ত শাস্তি বা কল্লা কেটে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৭৯টি। এর মধ্যে কয়টি মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসি ঠেকানোর জন্যে তৎপর ছিল যুক্তরাষ্ট্র? তৎপর ছিলেন সাঈদা ওয়ারসি? তিনি কি কখনও সৌদি আরবে ছুটে গেছেন কারও কল্লা-কাটা ঠেকানোর জন্যে? মৃত্যুদণ্ড ঠেকানোর জন্যে কখনও কি গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে? অথচ কী অবলীলায়ই না তিনি একজন যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর জন্যে ছুটে এলেন বাংলাদেশে!

তাছাড়া আমাদের তো ওই ঘটনাও মনে আছে– ইরাকে যখন সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন ব্রিটেনের ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গারেট বেকেট বলেছিলেন, ''ইরাক কিংবা অন্য কোনো দেশেই মৃত্যুদণ্ড ব্রিটেন সমর্থন করে না… আমরা ইরাকি কর্তৃপক্ষকে আমাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানিয়েও দিয়েছি। কিন্তু একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সিদ্ধান্ত আমরা শ্রদ্ধা করি।''

তাই যদি হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোথায় গেল ব্রিটেনের সেই শ্রদ্ধা? বাংলাদেশকে কি ব্রিটেন সার্বভৌম রাষ্ট্র মনে করে না? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা কি ১৯৬১ সালের পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কসংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশন মানতে রাজি নন, যেটির ধারা ৪১-এ কূটনীতিকদের বলা হয়েছে কর্মরত রাষ্ট্রের স্থানীয় আইনসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে, বলা হয়েছে সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে? না কি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত হওয়ায় ব্যারোনেস ওয়ারসি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই দখলদারি দৃষ্টিতে দেখেন এবং তাই রুচিতে বাধে না অনাহুত ও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করতে?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিকভাবে ভূমিকা রাখার কারণে আমরা অনেকের কাছেই ঋণী। স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো কোনো দেশ আন্তরিক ভূমিকা রেখেছেন, তা কারও অজানা নেই। তারপরও কেউ কেউ মনের ভুলে কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে লিখে বসেন, ''নেতাদের কথা শুনে মনে হয় তাঁদের মতো বীর দুনিয়ায় আর দুখানা নেই। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে, পাকিস্তানের বিপক্ষে না দাঁড়ালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিলম্বিত হত। কতটা বিলম্বিত ও বিঘ্নিত হত তা বিয়াল্লিশ বছরের কমবয়সী বীরেরা ধারণাও করতে পারবেন না।''

এ লেখার রচয়িতা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, এখন যে যুক্তরাষ্ট্র কথায় কথায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের শুনানি করে বেড়ায়, সেই যুক্তরাষ্ট্র একাত্তরে আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল? উদ্বিগ্ন হয়েছিল? এই বিয়াল্লিশ বছরের কমবয়সী বীরেরাই তো চার দশক পরে শাহবাগে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বাধা অগ্রাহ্য করে সম্ভবপর করেছে কাদের মোল্লার ফাঁসি। তা কি পছন্দ হয়নি ওই কলামিস্টের?

একাত্তরে আমাদের একাগ্রতা, স্পৃহা ও উদ্বেগ যাদের স্পর্শ করেনি, যারা পাকিস্তানকে তখন সাহায্য করতে ব্যস্ত ছিল, তারা এখন উদ্বিগ্ন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি পর্যন্ত উদ্বিগ্ন; যার অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা পর্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমাদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, প্রতি রাতে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর অবিরাম কথকশ্রেণি আর বুদ্ধিজীবী- তারাও উদ্বিগ্ন। রাজনীতিবিদরাও উদ্বিগ্ন।

আর উদ্বিগ্ন কে নয়? আমরা প্রত্যেকেই উদ্বিগ্ন। একদিকে প্রতিদিন নিহত-আহত হচ্ছে মানুষ, পুড়ছে বাড়িঘর-দোকানপাট-পরিবহণ– যেসব ঘটনার প্রধান 'কৃতিত্ব' জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের; অন্যদিকে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না, এসবই আমাদের উদ্বেগের জায়গা। অবশ্য মানুষের মৃত্যু-খুন, রক্তপাত, দাহযন্ত্রণা, ভস্মীভূত ছাইস্তূপের সামনে হাহাকার মেশানো কান্না একান্তই আমাদের। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, চ্যানেলের অবিরাম কথকশ্রেণি, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের মূল উদ্বেগ 'সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান' ঘিরে।

এর আগে বেশ কয়েকবারই আমাদের ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি– এ দুটি বড় রাজনৈতিক দলই সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। কিন্তু সে নির্বাচনেও এই ২০১৩ সালের মতো পরিস্থিতি দেখা যায়নি। ভোটার না থাক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো প্রার্থীর অভাব ঘটেনি সে নির্বাচনে।

কিন্তু এবার প্রার্থীর এত 'অভাব' ঘটেছে যে, আবার যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা তাদের মনোনয়নপত্রে এত বেশি 'ভুল' করেছেন যে, ইতোমধ্যেই ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বসে আছেন। এখন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী গণমাধ্যমে বলছেন– দশম নয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে বিরোধী দলের সঙ্গে; বলছেন– রাজনৈতিক বাস্তবতা থাকলে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা সম্ভব।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে যুক্ত একটি রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্বে ও নেতৃত্বে গঠিত সরকারের শাসনামলে অনুষ্ঠিত এ রকম একটি নির্বাচন যে কেবল অর্থহীন তা নয়, গণতন্ত্রকে হাস্যষ্পদ করে তোলার অপচেষ্টাও। কিন্তু তারপরও নির্বাচন হচ্ছে! মনে হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে না পারলেও 'সাংবিধানিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখা' এ সরকারের এক 'ঐশ্বরিক দায়িত্ব'।
কাজেই নির্বাচন নিয়েও নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন আমরা সবাই।

কিন্তু নির্বাচন ঘিরে, আমাদের বা সাধারণ মানুষদের এ রকম সব উদ্বেগের সঙ্গে আমাদের আন্তর্জাতিক শুভার্থী, স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলির অবিরাম কথকশ্রেণি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উদ্বেগের পার্থক্য সুস্পষ্ট। কেননা তাদের উদ্বেগ আমাদের মতো শর্তহীন ও নিরুপায় উদ্বেগ নয়। বরং বড় বেশি শর্তযুক্ত উদ্বেগ, বড় বেশি উপায়যুক্ত উদ্বেগ তাদের সবার।

তাই তারা তাদের পছন্দের ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে না পারলে সহজেই বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো থেকে বিরত থাকতে পারেন! জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো যখন এ দেশে আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশে 'সব দলের অংশগ্রহণে' নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দূতিয়ালি করতে এসেছিলেন, তখন তিনি কেবল একা আসেননি। এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোন, এসেছে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের টেলিফোন, এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের বিবৃতি। ফার্নান্দেজ তারানকো চলে গেলেও নতুন করে পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ারসিকে।

জন কেরির টেলিফোন সম্পর্কে একটি দৈনিকে লেখা হয়েছে (এবং আরও কয়েকটি সংবাদপত্রেও একই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে), ''কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করায় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এর ফলে অচলাবস্থা কেটে যাবে। তবে এ অবস্থায় কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করলে এই ইতিবাচক পরিবেশ থাকবে কি না, সেটা বিবেচনায় রাখতে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। সমঝোতার সার্বিক বিষয়টি যাতে ইতিবাচকভাবে ধরে রাখা যায়, সে ব্যবস্থা নিতেও জন কেরি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।'' (প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০১৩)

এই যদি হয় টেলিফোনের ভাষ্য, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, জাতিসংঘের বা আন্তর্জাতিক মহলের উদ্যোগে 'নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির' বিষয়টি পুরোপুরি শর্তযুক্ত ছিল। আর সে শর্তটি হল, কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা যাবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্ত হিসেবে 'অন্তর্বর্তী সরকার', 'নির্দলীয় সরকার' কিংবা 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার', 'প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার সরে যাওয়া', 'প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো' ইত্যাদি বিষয়গুলো বিরোধী দলের প্রেসব্রিফিং-এ কিংবা টকশো-তে যত গর্জেছে, তত বর্ষেনি জন কেরির টেলিফোনে– বর্ষিত হয়েছে কূটনৈতিক ভাষায় কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ অকার্যকর করার পরামর্শ!

এ রকম সিদ্ধান্তে আসা কি তাহলে আমাদের ভুল হবে যে, বিএনপির অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে আমাদের একটি চরম মূল্য দিতে হত– কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা থেকে সরকারকে সরে আসতে হত? আমাদের অনেকেই এবং ব্যক্তিগতভাবে আমিও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী; কিন্তু যারা একটি রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনে যুক্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য আমাদের।

তাহলে, জন কেরির টেলিফোন কি কোনো পরোক্ষ হুমকি ছিল সেই সর্বোচ্চ শাস্তি ঠেকানোর জন্যে? অথবা আরও নরম ভাষায় বলতে গেলে, কোনো বিশেষ শর্ত ছিল কি তাতে? যেটিই হোক না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ করেনি। এমনকি ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিভিন্ন মিডিয়ায় খালেদা জিয়া যে বিবৃতি পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকার জন্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান 'বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতি, দাবি ও মনোভাবের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্ম থাকার'।

খালেদা জিয়ার এ বিবৃতির অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহল যে অবস্থান নিয়েছে, ভারত সরকারের অবস্থান তা থেকে অন্যরকম এবং তিনি প্রত্যাশা করছেন যে, ভারতের সরকার অবস্থান পরিবর্তন করবে। এইভাবে খালেদা জিয়ার এ বিবৃতিটিও ইঙ্গিতপূর্ণ হয়ে ওঠে, ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশের 'নির্বাচনের জন্যে' মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির নির্ধারিত 'ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টির' ডাকে সাড়া দেওয়ার খোলা আহ্বান হয়ে ওঠে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন পরদিন ১৩ ডিসেম্বর এ বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় জানান, ''পারস্পরিক শ্রদ্ধা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা ও একে অন্যের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে ভারত।'' (নয়া দিগন্ত, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩)

আরেক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আকবরউদ্দিন জানিয়ে দেন, ''একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।''

অথচ পাকিস্তান কিছুতেই রাজি নয় বিষয়টি সেভাবে দেখতে। কাদের মোল্লাকে এখনও তারা 'পাকিস্তানের সৈনিক' মনে করে। অতএব তারা যা বলছে, তাকে কোনো বিবেচনাতেই আর কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পর্যায়ে ফেলা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে কাদের মোল্লার ফাঁসির পর শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। গায়েবানা জানাজা পড়া হয়েছে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান ১৩ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ''কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ও সংহতি প্রকাশের জন্যেই কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।'' (প্রথম আলো, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩)

কাদের মোল্লার অনুসারীরা যখন 'এই কাদের সেই কাদের নয়' তত্ত্ব হাজির করছিল, তখন পাকিস্তান যা বলছে তার সোজাসাপটা মানে দাঁড়াচ্ছে, এই কাদেরই সেই কাদের– এই সেই কসাই কাদের।

'ইসলামি নেতা', 'জামায়াত নেতা' এইসব বিশেষণ যুক্ত করে যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে জামাত-শিবির। কিন্তু সুনির্দিষ্ট ছয় অপরাধ প্রমাণের ভিত্তিতে তার নামের আগে যুদ্ধাপরাধী বিশেষণটি অমোচনীয় কালিতে লেখা হয়ে গেছে। পাকিস্তানের জামায়াত-ই-ইসলামী তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, ''পাকিস্তানকে সমর্থন করায় কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।''

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের শোকপ্রস্তাবেও বলা হয়েছে, মোল্লা ছিলেন 'অবিভক্ত পাকিস্তানের' অনুসারী, তাই পাকিস্তান এখন শোকাহত! কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে শোকপ্রস্তাব ও নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করার অর্থ কী হতে পারে? কারণ 'পাকিস্তানের বন্ধু' তিনি– জামায়াতনেতা সাহিবজাদা তরিকুল্লাহ সে কথাই বলছেন; তবে ওটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি, আবেগে থরোথরো কণ্ঠে আরও বলেছেন, ''মোল্লাও তো মুক্তিযোদ্ধা, ম্যান্ডেলার জন্যে যদি আমরা শোক জানাতে পারি, তাহলে মোল্লার জন্যে পারব না কেন?''

যে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে, মোল্লা হলেন সে পাকিস্তানের 'মুক্তিযোদ্ধা', আর তাই জামায়াত-ই-ইসলামী পাকিস্তানের ওয়েবসাইটে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশে আক্রমণ চালানোর! আর এখন পাকিস্তান দাবি করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই বন্ধ করা হোক। এ বিচারের মধ্যে দিয়ে না কি পুরানো ক্ষত জাগিয়ে তোলা হচ্ছে!

রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কেবল নিন্দা বা উদ্বেগ প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়– বাংলাদেশের এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে, আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে আমাদের মনোভাব জানিয়ে দেওয়ার, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার। তাছাড়া সময় এসেছে, বাংলাদেশের ওপর গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব অন্যায় করে আসছে, তা নিয়ে গণশুনানি করার। একসময় তারা আমাদের দেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে সামরিক শাসনকে উৎসাহিত করেছে; এখন 'খাদের কিনারে দাঁড়ানো দেশ' হিসেবে চিহ্নিত করে কাদের তারা উৎসাহিত করতে চায়?

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার ব্যাপারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর বিশেষত পাকিস্তানের নাক গলানোর ব্যাপারে খালেদা জিয়া ও বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক দূরে থাক, অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও এখনও দেখানো হয়নি। তারা অপেক্ষা করছেন সেই সময়ের জন্যে, যখন সত্যি সত্যিই তারা তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবেন।

সে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে নেমে আসা প্রতিক্রিয়ার মতো? কিন্তু সারা দেশে এখন বিএনপি ও জামায়াত যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে, তা কি ২০০১ সালের অক্টোবরের চেয়ে কম না বেশি?
যে সব সুশীল বুদ্ধিজীবী-কলামিস্ট-মধ্যরাতের অবিরাম কথকদের কাছে মনে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে, তাদের কি কখনও মনে হয়েছে, সেই রাজনীতি আসলে কারা করছে?

আমরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করি, তখন বলা হয়, জামায়াত-বিএনপি নেতাদের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হচ্ছে। কী অদ্ভূত কথা! তারা রাজনীতি করেন বলে যুদ্ধাপরাধ করেও পার পেয়ে যাবেন! এটা কি রাজনীতি নয়?

যখন বলা হয়, আওয়ামী লীগে কিংবা অন্য রাজনৈতিক দলের যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা যায়, তাদের তালিকা দিন, তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা ক্ষমতায় গিয়ে সে তালিকা করব। এটা কি রাজনীতি নয়?
কাদের মোল্লার ফাঁসির ব্যাপারে খালেদা জিয়া ও বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি নয়। কারণ তারা জানে, তারা তাদের সত্যিকারের অনুভূতি এখন জানাতে পারবে না; যদি জানায়, তাহলে ভবিষ্যতে যে নির্বাচনেই তারা অংশগ্রহণ করুক না কেন, ভরাডুবি ঘটবে। এর মধ্য দিয়ে তারা কি ভোটের রাজনীতি করছে না? এটা কি রাজনীতি নয়?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হল, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিবেশ নষ্ট হবে। এটা কি রাজনীতি নয়?

এইসব রাজনীতি মাথায় নিয়ে যারা বাংলাদেশের জন্যে উদ্বিগ্ন হন, যাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এত সব শর্ত থাকে, তাদের সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে আমরা কী করব? খাব? না কি গায়ে দেব?

২.

কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির তাদের সশস্ত্র সহিংসতা অব্যাহত রাখার নতুন অজুহাত খুঁজে পেয়েছে। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে 'গৃহযুদ্ধ' করার খায়েশ জানিয়ে আসছে তারা। 'গৃহযুদ্ধ' শব্দটি বড় বেশি প্রিয় তাদের– এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও তারা চায় 'গৃহযুদ্ধ' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।

এখন তাদের হয়ে বিএনপির বিভিন্ন প্রধান সারির নেতাই সানন্দে ঘোষণা করছেন, দেশে যুদ্ধপরিস্থিতি চলছে, গৃহযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। তা 'যুদ্ধপরিস্থিতি'ই বটে– চলতি বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকে ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস অবধি জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের আক্রমণে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন এমন ৪৭ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, ২০ জন আগুনে পুড়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩৬৭ জন।

জামায়াত-শিবিরের অব্যাহত সন্ত্রাসকে এখন আর 'সহিংসতা' কিংবা 'সন্ত্রাসের' মতো পরিভাষায় আবদ্ধ করে রাখার সুযোগ নেই। মরণকামড় দিচ্ছে তারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্যে মানবতার বিরুদ্ধে নতুন নতুন অপরাধ করে চলেছে তারা। আর আমাদের অনেকেরই বোধহয় মনে নেই, বছরখানেক আগে জামায়াতে ইসলামী যখন তাদের এইসব অপরাধ শুরু করে, তারপর বিএনপির একজন প্রধান সারির নেতা বলেছিলেন, ''এক জামাত মাঠে নামাতেই এই অবস্থা! বিএনপি যখন মাঠে নামবে, সরকার তখন পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।''

এখন আমাদের অপেক্ষার পালা, কখন জামায়াতে ইসলামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএনপিও মাঠে নামবে!

৩.

যারা সুখেদুখে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে চান, বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করতে চান, তাদের বুঝতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ রাষ্ট্রকে নৈতিক ও আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অন্যতম শর্ত। যারা এই শর্ত পাশ কাটিয়ে যেতে চাইবেন, তারা এ রাষ্ট্র বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না, রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলার ক্ষেত্রেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।

জনগণকে যারা রাজনৈতিকভাবে পাশে পেতে চান, তাদের জনগণের প্রাত্যহিক আশাআকাঙ্ক্ষা ও আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে হয়– কিন্তু এ-ও মনে রাখতে হয়, ওই প্রাত্যহিক আশাআকাঙ্ক্ষা ও আন্দোলন কেবল অর্থনৈতিক নয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই সঠিক অবস্থান নিতে পারেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো অর্থনৈতিক আন্দোলন নয়। কিন্তু একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ও প্রতিষ্ঠার, ন্যায়বিচার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা এই বিচারের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেভাবে উচ্চকিত হতে পারে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই মূহুর্তে অন্য কোনো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেভাবে উচ্চকিত হওয়ার নয়।

জামাত-শিবিরের মরণকামড়ের মধ্য দিয়ে তাই বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনীতিতে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার' ইস্যুটির শিকড় গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কিন্তু এই উদ্বেগ নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ওঠে, যখন সেই উদ্বেগ দূর করার পদক্ষেপের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর না করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।

আমাদের 'আন্তর্জাতিক শুভানুধ্যায়ীদের' এবং দেশের সকল রাজনীতিকেরই মনে রাখা দরকার, ভবিষ্যতে যে কাঠামোতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া স্বাধীনভাবে অব্যাহত রাখার ইস্যুটি একটি প্রধান ইস্যু হিসেবে ভূমিকা রাখবে।

এ ইস্যুতে কৌশলী অবস্থান নেওয়ার সোজাসাপটা অর্থ, জনসমর্থন হারানো এবং নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারা।

ইমতিয়ার শামীম: লেখক, সাংবাদিক।