প্রশাসনের উন্নতিকল্পে কিছু সুপারিশ

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 6 Oct 2010, 05:07 PM
Updated : 6 Oct 2010, 05:07 PM

মানুষ নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতা চায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে না। গণতন্ত্রের আদর্শটা বেশ দীর্ঘজীবীই বলতে হবে, কিন্তু এর স্বাস্থ্য ও সাফল্য প্রায়ই অনিশ্চিত। আমরা নিজেদের অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্য প্রায়ই বলি দেশে গণতন্ত্রকে সুযোগ দেয়া হয়নি। গণতন্ত্রের নিজস্ব কোন অবয়ব বা প্রাণ নেই। গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয় নয়। এর ভেতরে একটা তারল্য রয়েছে, যে পাত্রে অবস্থান করে সে তার আকার পায়। হুজ্জতে বাঙালের দেশে গণতন্ত্র যে কী ভঙ্গুর হতে পারে তার নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। ব্যাংকে আগুন জ্বালিয়ে, রিকশাওয়ালাকে জীবন্ত দগ্ধ করে, যত্রতত্র বোমা ফাটিয়ে, পটকাবাজি করে এবং বাসে বারুদ ছড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দলীয় নন্দিভৃঙ্গিরা গণতন্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি, অত্যন্ত স্বল্পকালের জন্য ক্ষমতায় আরোহণ করে দ্রুত তাদের পদস্খলন ঘটেছে মাত্র।

ঐতিহাসিকেরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে গণতন্ত্রের তরঙ্গের দেখা পান, তার মধ্যে তিনটি প্রধান উত্থান-পতন ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বিংশ শতাব্দীর বিশ দশক পর্যন্ত আমরা প্রায় ২৯টি গণতন্ত্রের দেখা পাই। ১৯২২ সালের দিকেই সেই গণতন্ত্রের তরঙ্গে ভাটা দেখা দেয়। গণতন্ত্রের সোপানে আরোহণ করেই ফ্যাসিজম ও নাৎসিজমের জন্ম। ১৯৪২ সালে বিশ্বে গণতন্ত্রের সংখ্যা ১২-তে নেমে আসে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার দেখা যায়। ১৯৬২ সালের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩৬-এ। আবার ভাটায় সত্তরের দশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা নেমে আসে ৩০-এ। ১৯৭৪ সালের দিকে স্মরণকালের তৃতীয় জোয়ারে আরও ৩০টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এই জোয়ার আবার ভাটায় নামতে পারে। মধ্য একবিংশ শতাব্দীতে কয়টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বেঁচে থাকবে তার ওপর সাহস করে কে বাজি ধরবে? অর্থনৈতিক সংকটে গণতন্ত্র হারিয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্র আত্মহত্যাও করতে পারে। সংকটকাল থেকে যেসব দেশ সংশোধনের চেষ্টা না করে বিভাময় নেতার পেছনে ঘুরে সেখানে গণতন্ত্র তো মৃত্যুপথযাত্রী।

রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের ব্যাপারে ও অঙ্গদল সঙ্গে রাখার ব্যাপারে নানা গড়িমসি করে। সাংবিধানিক প্রয়োজনে কোনো কোনো দল সংশোধন করে বড়ো অনিচ্ছায়, শুধু নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের প্রতি তেমন অঙ্গীকার লক্ষ করা যায় না। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেনি। এবার নির্বাচন কমিশন যেসব গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে, তা পালন করার মতো দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তার চাহিদা মেটাতে হবে, যাতে নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন দ্রুত এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ কঠোরতার সঙ্গে প্রতিরোধ করা যায়।

বাংলাদেশের চাইতে অশান্তিময় দেশও পৃথিবীতে রয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় ৩৫। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্থান ৮৬, ভুটানের নিচে। আমাদের দেশে প্রায় চার কুড়ি রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সাইনবোর্ড ও দলীয় নেতার পোর্টফোলিও ব্যাগ ছাড়া প্রায় কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমাদের নির্দিষ্ট তারিখ তফসিলের ব্যত্যয় ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের কয়েক বছরে। এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারত বিভাগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে নির্দিষ্ট তারিখের ধারণায় বড় তারল্য ঘটে।

দেশের সুশীল সমাজ নির্বাচনের জন্য নানা সংস্কারের সুপারিশ করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের কিছু সংস্কার প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে নেয়নি। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত  নির্বাচন কমিশনকে বড় হেনস্তা করা হয়েছে। তার জন্য নির্বাচন কমিশনও কিছুটা দায়ী। ফুটবল খেলা নিয়ে ইংরেজ দর্শকেরা যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তার চেয়ে আমরা অনেক বেশি অনাচার করে থাকি। মামলা হলেও তার শেষ পর্যন্ত সুরাহা হয় না। সপ্তম সংসদে ভোলার একটি নির্বাচনী এলাকা প্রতিনিধিহীনভাবেই কাটিয়ে দেয়। নির্বাচন আইন ভঙ্গের জন্য তেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়াও হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে চোখ রাঙায় এবং হম্বিতম্বি করে তার এক সহস্রাংশ করলেও আন্তর্জাতিক ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় কোন ভদ্রলোক রেফারির কাজ করতেন না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক মাস্তানি সুবিদিত। আমরা কোন কর্তৃপক্ষের শাসন মানতে চাই না। আমরা প্রত্যেকে একেকজন খুদে কর্তৃত্ববাদী। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকৃতকরণের প্রতিভা বিস্ময়কর।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে স্বল্পকালের মধ্যেই বিত্তবান ও উচ্চবিত্তদের জন্য বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশগড়া ও ভাঙার সময় অর্থকরী উদ্যোগের জন্য সে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। চতুর বাঙালি বৈধ ও অবৈধ উপায়ের সর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে। নিম্নবিত্ত ও গরীবদের জীবনে বিজয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে দেশে বিশেষ করে রাজনীতিতে যে বিপ্লব ঘটে যায়, তাতে দেশের মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধে। তারা দ্রুত বুঝতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো কেবলই দলীয় লক্ষ্য সামনে রেখে আত্মচিন্তায় মগ্ন। সপ্তম ও অষ্টম সংসদ ওয়াক আউটের জন্য ধুধু মরুভূমির মতো দেখায়। গত দুই বছরে দেশে যতো বাক্য ব্যয় হয়েছে তাদের ডেসিবল ছিল উচ্চমাত্রায়।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামোটা বড়ই ভঙ্গুর। আমাদের দেশের প্রথম আনুগত্য আত্মীয়ের প্রতি। বাংলা ভাষায় আত্মীয় সম্পর্কের শব্দের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেশি, প্রায় ২১৫। পরিবারতন্ত্র নিয়ে ইতিমধ্যে নানাজনে সাতকাহন গেয়েছেন। আমাদের দ্বিতীয় আনুগত্য পাড়াগত বা অঞ্চলের প্রতি। শত অপকর্মের মহাজন তার নিজের অঞ্চলে 'হামার ছাওয়াল' বা 'হামার মাইয়া'। সেখানে জনগণ তাঁর অনুগত, তিনি সেবিত এবং প্রচুর ভোট পান।

আর দুর্যোগপ্রবণ দেশে কে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়? তাঁরাই তো তাঁদের সহায়সংগতি! এমন ব্যক্তিদের দলে টানার জন্য কে না চেষ্টা করেছেন। একজন রাজনৈতিক দলপ্রধান বলেছিলেন, 'নির্বাচনে হেরে গেলে কোথায় থাকবে আদর্শ?' সত্যিই তো, নির্বাচনে হেরে যাওয়া ভাবাই যায় না! যেনতেন প্রকারে নির্বাচনে জিততে হবে। যে আদর্শের ধারকেরা মধ্যবিত্তÑনিুবিত্তদের ঘরে বড় অনাদরে বেড়ে উঠেছিল তারা তো এখন দ্রব্যমূল্য ঠেকাতে মুরুব্বিদের ঘরে ঋণের মক্কেল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আমাদের প্রশাসনে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক অধঃস্তন কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মের তদারকি দিন দিন কমে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যারা আনুগত্য প্রকাশে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রদর্শন করেছেন তাদেরকে দল নিরপেক্ষ প্রশাসনের শাসন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সরকারি সেবা খাতে সিসটেম লস ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায়। ৩রা অক্টোবর ২০১০ জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক বলেছেন, বিগত জোট সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সংসদকে জানান, বিগত চার দলীয় জোট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংঘটিত বিভিন্ন আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম উদঘাটনের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রাণয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি সাব কমিটি গঠন করেছে। সাব কমিটি এসব বিষয় যাচাই বাছাই করছে। এরপর অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে জনসম্মুখে প্রকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারের ঘোষিত নীতিমালা অনুসারে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ৮৭ হাজার ৩৭২ টি গ্রামের মধ্যে ৪৭ হাজার ৬৮২টি গ্রামে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আইপিপি-রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল প্রক্রিয়ায় নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ১৪টি কোম্পানির ১ হাজার ২৭২ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ বা জ্বালানি আমদানি ও উৎপাদনে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়ার বিধান রেখে 'বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০' সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে।

বিরোধী দলের সদস্যরা বিল পাসের আগে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিলেও অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকার কারণে তা উত্থাপিত হয়নি। একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব অধিবেশনে উত্থাপন হলেও তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

'বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০' এর বিধান অনুযায়ী বিদ্যুৎ বা জ্বালানি আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন বা বিপণন, সঞ্চালনের ব্যাপারে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এ সংক্রান্ত কোনো কাজে জড়িত সরকারি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা বা কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে গৃহীত যে কোন পরিকল্পনা ও প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার টেকনিক্যাল ও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে প্রক্রিয়াকরণ কমিটি গঠন করবে। উক্ত কমিটি পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রস্তাব প্রণয়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে। এই আইনের বিধান অনুযায়ী, সীমিত সময় প্রদান করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে।

প্রক্রিয়াকরণ কমিটি একক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বা দরকষাকষি করে কাজের জন্য মনোনীত করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে প্রেরণ করতে পারবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হলে মন্ত্রণালয় বা বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে।

সরকারের কথা, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি দূর করে শিক্ষা, ব্যবসা বাণিজ্য ও গৃহস্থলি কাজের চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিলটি আনা হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য জ্বালানি সম্পর্কিত খনিজ পদার্থের দ্রুত আহরণ ও ব্যবহারের দ্রুত সিদ্ধান্ত  নিতে হবে। এ বিশেষ আইনের ফলে নির্বাহী বিভাগের যেমন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলো তেমনি অনিয়ম প্রতিকারের জন্য আদালতের দ্বার রুদ্ধ করা হলো।

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি দূর করে শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিলটি পাস করা হয়েছে।

বিলটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংক্রান্ত কোনো ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। ১০ ধারা অনুসারে আদালতের এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে কৃত বা কৃত বলে বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। দায়িত্ব পালন কালে সরল বিশ্বাসে কৃতকার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

আজ যে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হচ্ছে এই প্রতিবেদনের জ্বালানী খাতের উন্নয়নের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হলেও প্রণোদনার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ, জনপ্রিয়তার জন্য গৃহীত নীতি বাস্তবায়নে সমস্যা এবং সরকারের স্বল্পমেয়াদী কর্মসূচিকে এই খাতের শাসন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়েছে। এই খাতের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আমলা, বেসরকারি ও বিদেশী বিনিয়োগকারীর জন্য লাগসই প্রণোদনা, সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনে দ্রুত সাড়া দিতে পারে এমন একটি স্বায়ত্তশাসিত রেগুলেটরি কমিটি এবং জনঅংশগ্রহণে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

গবেষণায় খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে-সরকারের নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক, অতিদরিদ্রদের খাদ্য পাওয়ার বিষয়ে তথ্যে বিভ্রান্তি, খাস জমি পুনর্বন্টনে দুর্নীতি, চাষাবাদ সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির অকার্যকর ব্যবস্থা ও দুর্বল ক্রয় কাঠমো। এই খাতের উন্নয়নের জন্য নীতি বাস্তবায়নে অতিদরিদ্রদের গুরুত্ব দান, খাদ্যের সহজলভ্যতা প্রতিষ্টার জন্য প্রান্তিক কৃষক ও ভূমিহীনদের ভূমির মালিকানা ও দখল নিশ্চিত করা, তদারকি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বাড়ানো এবং খাস জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।

ই-গভর্নেন্স অধ্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে–ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির প্রতি সরকারের যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও সর্বস্তরে এর অংশিদারিত্বের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। এই খাতের উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানিক ও প্রক্রিয়াগত সংস্কারকে জোরদার করাসহ আইসিটি আইন ২০০৯ সংশোধন, ৩০৬ টি করণীয় বিষয়ে তদারকি বাড়ানো, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মালিকানাবোধ তৈরি, ই-গভর্নেন্স বিষয়টিকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা, জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবধান কমানো ও গরিব মানুষের জন্য সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

গবেষণায় অভিবাসন বিষযে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, শ্রমিকদের জন্য বিদেশে কাজ করতে যাওয়া ব্যয়বহুল, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নিয়ন্ত্রহীন কার্যক্রম, বিদেশ গমন দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া এবং অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। গবেষণায় অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্বদান, বিদেশের সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উত্তম দরকষাকষি, স্বচ্ছ ও কার্যকর অভিবাসন প্রক্রিয়ার জন্য তদারকি কৌশল উদ্ভাবন এবং বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর সহজ উপায় বের করার সুপারিশ করা হয়েছে।

মনে হয়, দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। যেখানে নাগরিকদের কোনো পাওনা বা প্রাপ্য রয়েছে সেখানেই বাজিকররা একটা উৎকট ব্যস্ততায় উন্মত্ত। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি এত বিভিন্ন ধরণের বাজির রকমফের দেখে দেশের লোক দিশেহারা। যেখানে একটা চতুর্ত শ্রেণীর চাকুরির জন্য তিন লক্ষ টাকা গুণতে হয় সেখানে মেধাভিত্তিক প্রশাসন কেমন করে আমরা গড়ব। বাংলাদেশে এখন দেবী লক্ষ্মী নতুন নন্দীভৃঙ্গিদের কবজায়। দেবী সরস্বতী অধোবদনে চিন্তান্বিতা। আজ চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে নানা তত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, তা হচ্ছে রাজনৈতিক ক্যাডাররা নয়,  চীনের মেধাভিত্তিক প্রশাসনই তার উত্থানের প্রধান কারণ।

এক সময় বলা হতো নুতন আইন প্রণয়নের সময় আইন প্রণেতাদের হাত কাঁপা উচিত। সেদিন গত হয়েছে যখন বলা হত নূন্যতম সরকারই শ্রেষ্ঠ সরকার। সমাজের প্রত্যাশা বৃদ্ধির সাথে আইনের তদারকি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আইন প্রণয়ন যদি মুন্সীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সংসদে হ্যাঁ বা না বলেই তা বিবেচনা সীমিত থাকে তবে কর্তার ইচ্ছায় কানুন হবে। আর সে হবে এক বিষম ব্যাপার। বিশেষ আইন চিরকালের হতে পারে না। বিশেষ আইনে একটা উৎকট পত্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। আর আদালতের এখতিয়ার ক্ষুন্ন করে কেবল প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার  বিবেচনা করা হলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আনবে না। পাঁচ বছরের ক্ষমতায়ন একটা স্বল্পকালীন ব্যাপার। দুই তৃতীয়াংশ ভোট সরকারকে দিশেহারা করে তুলতে পারে। ম্যান্ডেলা তাঁর নির্বাচনের সময় যখন দেখলেন তাঁর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও লোকে তাকে দুইতৃতীয়াংশ নিরঙ্কুশ ভোটদান করেনি তখন তিনি বলেছিলেন, "ঈশ্বরকে ধন্যবাদ"। গত চল্লিশ বছরে দুই তৃতীয়াংশ ভোট পাওয়া সরকারের আমলগুলো তেমন সুখকর হয়নি। আজ সারা পৃথিবীতে অহংপ্রজন্মের রবরবা। মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ সীমাবদ্ধ করে জনস্বার্থ অক্ষুন্ন রাখাই সরকারের কাজ। আর এত বড় দায়িত্ব পালন করতে হলে সরকারের প্রশাসনকে শুধু দক্ষ ও সমর্থই হতে হবে না অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি তাকে ন্যায়পর হতে হবে।

আমরা দেশের প্রশাসনে নাগরিকদের শরিকানা বৃদ্ধি করতে পারি নি। দেশের অভ্যুদয়ের কাল থেকে আমরা সংবিধানে প্রদত্ত স্থানীয় শাসনের বিধান লঙ্ঘন করে আসছি। এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও আমরা পালন করিনি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধান সম্পাদক সাধারণত স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক সংগঠনের দিকে। এখন স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে সংসদ-সদস্যদের ক্ষমতা অভাবিতরূপে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের নানা ধরনের বেদাত প্রর্বতনা করার চেষ্টা করেছি। একসময় জেলাওয়ারি সংসদ সদস্যের যে খবরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা অবৈধ বলে আদালত ঘোষণা দেন। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যে অপচয়ের দুর্নাম তা লোকে সমভাবেই কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে পারে। আমি একবার বলেছিলাম বাংলাদেশের যদি কোনো সাম্রাজ্য থাকত তা হলে সেই বিরাণভূমিতে কোনো উপনিবেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের চারা গজাতো না। গত চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার পর আমার এ ব্যাপারে মত পরিবর্তন করার কোনো অবকাশ দেখি না।

দেশের প্রশাসন সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত আসতেই পারে। না-থাকাটাই অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। তবে সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে যে সব মূলনীতি লিপিবদ্ধ রয়েছে তা তো আমাদের বিভক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে সহজেই একটা মতৈক্য সৃষ্টি করতে পারে। সংবিধান সংশোধন-সম্পাদনের কথা উঠেছে। দেশের সকল নাগরিককে অধিকতর সংবিধান-অনুগ হতে হবে। প্রশাসনে সুশাসনের সুবাতাস বহাতে হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে দেশের লোকের সেবক নয় তা তারা হাড়ে হাড়ে বোঝে। জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক এটা যে একটা নিছক সাংবিধানিক আপ্তবাক্য নয় তা প্রতিষ্ঠাকল্পে আমাদের কঠোরভাবে ব্রতী হতে হবে। গত চল্লিশ বছরে হনন-আত্মহননে আমরা হিসাবদিহি নীতির যে অবমাননা করেছি তা বড়ই হৃদয়বিদারক।

গত চল্লিশ বছরে তখাকথিত তলাফুটো বাংলাদেশকে নিয়ে নানা আশঙ্কা ও আশা-নিরাশার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে এবং দেশের অভ্যন্তরে। সেইসব গবেষণার একটা সারাংশ একশ পৃষ্ঠায় সংক্ষিপ্ত করে নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। তা না হলে নাগরিকদের অনীহায় ও অনৌৎসুকে সব পরিশ্রম অর্থহীন হয়ে পড়বে। লোকে 'থিংক ট্যাংক'কে বাংলা করবে 'বুদ্ধির ঢেকি'!

৬ই অক্টোবর ২০১০ যাত্রীর সম্মেলন কক্ষে  প্রধান অতিথির বক্তব্য