জীবিকা জীবন নৈতিকতা

মারুফ রায়হান
Published : 14 April 2008, 05:51 AM
Updated : 4 Oct 2010, 02:29 PM

জীবন ধারণের জন্য জীবিকার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সেই জীবিকা সম্মানজনক হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সম্মান বলতে সামাজিক সম্মানই বোঝেন বেশির ভাগ ব্যক্তি। এভাবে বলা যেতে পারে, আমাদের দেশে সামাজিক মর্যাদা যে সব মানদণ্ডের ওপর নির্ভরশীল তাতে জীবিকার ধরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও উন্নত বিশ্বে ব্যক্তির জীবিকার চাইতে ব্যক্তির মানবিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে। এখানে নাগরিক সুবিধার প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। বাংলাদেশে হোটেল রেস্তোরাঁয় যারা টেবিলে খাবার পরিবেশন করেন, তাদের সামাজিক মর্যাদা কতটুকু? কিংবা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কতখানি সুবিধা তারা অর্জন করে নিতে সক্ষম?

একই পেশায় থেকে একজন মার্কিন নাগরিক সামাজিকভাবে কোনো বৈষম্যের শিকার হন না। তার নিজেকে ছোট ভাবারও কোনো কারণ ঘটে না। কাজ দায়িত্ব যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা সুচারুরূপে নীতি বজায় রেখে পালনের মধ্যেই প্রকৃত সম্মান ও কৃতকার্যতা নিহিত। সেজন্যেই আসনে আসীন অকর্মণ্য ব্যক্তি আঁকড়ে রাখতে চান পদ, আর আসন হারালে একেবারে ভূপাতিত হন। সত্যিকারের কর্মী বা প্রকৃত মানুষের ক্ষেত্রে এমন অঘটন ঘটে না। তার 'পদমর্যাদা' অক্ষুন্নই থাকে। তিনি সব সময়েই সম্মানিত ব্যক্তি, কুর্সি থাকুক, কি নাই থাকুক।

বিষয়ের অন্য পিঠে আলোকপাত করা যাক। একটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি পেশারই অনিবার্য প্রয়োজন রয়েছে। আমি অনিবার্য শব্দটির ওপর জোর দিতে চাই। ধরুন একজন ধাঙ্গড় বা মেথর যদি কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। বাসাবাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ যিনি করছেন, একদিন যদি তিনি অনুপস্থিত থাকেন তবে গৃহকর্ত্রীকে কতো না ঝামেলা পোহাতে হয়, তার হিসেব আমরা পুরুষরা কি নিতে চাই? মোদ্দা কথা হলো পেশাবৈচিত্র বা পেশাবহুলতা সমাজে একটা জালের মতোই বিরাজমান। সুতো ছিঁড়ে গেলে তাতে বিচ্যুতি চলে আসে। একটু বেশি ছিঁড়ে গেলে সৌন্দর্য পরিণত হয় কদর্যে। তাই মর্গে লাশ কাটাকাটি ও সেলাই করেন যে ডোম, পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখেন যে মেথর, একটি সমাজে এদের প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও অবস্থান রয়েছে। সেটাই তার জীবিকা। তার জীবনও আবর্তিত হয় ওই জীবিকাকে ঘিরে। কখনো সংস্কৃতিতেও প্রভাব রাখে।

আমাদের এক সব্যসাচী লেখক, যিনি সার্বক্ষণিক লেখকও বটে, ঈদসংখ্যা নিয়ে টেলিভিশনে আলোচনা করছিলেন ঈদের আগে-আগে। তার জীবিকা হলো লেখালেখি। লেখার সম্মানী বাড়ানোর ব্যাপারে সোচ্চার হতে তাকে দেখা গেছে পর্দায়। তার বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত হই বা না হই, তিনি স্পষ্টভাবে এবং তীব্রভাবে তুলে ধরেছেন তার দাবী। বলেছেন, ঈদসংখ্যাগুলো লেখকদের লেখা নিয়েই মুনাফা করে থাকে। তাই লেখকের সম্মানীও বাড়াতে হবে। সেই সম্মানিত সাহিত্যিক এবার কোনো ঈদসংখ্যাতেই উপন্যাস লেখেননি, কারণ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সম্মানী বাবদ তাকে অগ্রীম নগদ এক লক্ষ টাকা প্রদানে অপারগ ছিলেন। শুধু নিজের কথা বলেই ক্ষান্ত হন নাই লেখক, তিনি তার সতীর্থ লেখকদেরও আহবান জানিয়েছেন সম্মানী বৃদ্ধি না করলে যেন আগামীতে তারা ঈদসংখ্যায় লেখা না দেন। পুরো বিষয়টি যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে সংগত কারণেই প্রথমে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে যে, লেখকের সম্মানী নির্ধারণের চলমান প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু কিনা। তারপর প্রশ্ন উঠবে লেখকসৃষ্ট 'সাহিত্যপণ্য'টির বাজারদর এবং পত্রিকার কর্মীব্যয়, প্রকাশনা খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বিবেচনায় একটি উপন্যাসের জন্য এক লক্ষ টাকা দাবীর যৌক্তিকতা কতখানি।

টাকার অঙ্ক এক মারাত্মক বিষয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতার অনুসরণে বলতে পারি টাকা, এক অন্ধকার জিনিশ। এই অন্ধকারের পেছনে কবিমন কখনো ছুটতে পারে না। আবার একজন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠাকারী বলবেন, টাকা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত বস্তু, তার চলাচলে অর্থনীতির চাকা গতি পায়। টাকার বিনিময়েই মেলে সুখ-স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ। দুটোই সত্য; দুরকম সত্য। গূঢ় গভীর সত্য। এই অক্টোবরের প্রথমদিন আমি আশ্চর্য এক গল্প শুনলাম। মহানগরীর আকাশ-ছোঁয়া এক ভবনের মালিক, যার ব্যবসার সংখ্যা এক ডজন, ছয় ছয়টি গাড়ি তার। অথচ একজনও ড্রাইভার নেই তার। ড্রাইভারকে যে টাকা দিতে হবে! বিপত্নীক ওই ভদ্রলোক বাড়িতে পাচক পর্যন্তও রাখেননি টাকা খরচ হবে বলে। সত্তরোর্ধ বয়সে নিজেই নিজের খাবার তৈরি করে নেন। এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? অর্থ আছে অগাধ, যে অর্থের সামান্যতম কণাও তিনি পৃথিবী থেকে প্রস্থানের সময় সঙ্গে নিতে পারবেন না। তবু টাকা খরচে তার কষ্ট হয়, কষ্ট করে রোজগার করেছেন যে! অথচ কি দারুণভাবেই না তিনি জীবনের বাকি দিনগুলোয় আনন্দ উপভোগ করতে পারতেন; চাই কি মানবকল্যাণেও যুক্ত হতে পারতেন উপার্জিত অর্থের অংশভাগ ব্যবহার করে। টাকা তাহলে মায়াও বাড়ায়? সন্ততির মতো তা আগলে রাখতে হয়?

এ লেখার প্রথম লাইনটি একটু বদলে লিখতে চাই এখন। জীবনধারণের জন্য টাকার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সেই টাকার অর্জন নীতিসম্মত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দুদিন আগে এক বিমানবালার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা যার মূল্যমাণ টাকার হিসাবে আড়াই কোটি। নখের ডগা থেকে কোমর পর্যন্ত যে সূক্ষ্ম আচ্ছাদন (টাইট্স্) পরেন আধুনিক নারী, তার ভেতর থরে থরে আটকানো ছিল 'টাকাগুলো'। দুবাইয়ে পাচার করার জন্য এমন গুপ্ত ব্যবস্থা নেন তিনি। খবরটি যেহেতু একজন নারীকে ঘিরে, আবার তার শরীর থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে টাকা, তাই এ নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ এবং রসালো রিপোর্ট না হয়েই যায় না।

এমনটাই ছিল আমার ধারণা। হয়েছেও তাই। একটি ট্যাবলয়েডে 'নারী-শরীরের সংবেদনশীল স্থান'- এর কথা বিলক্ষণ এসেছে। সুযোগ পেলেই নারীকে ব্যবহার করে আনন্দ লাভ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্য যেন অতি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা হোক, আমার প্রসঙ্গ সেটা নয়। আমি বলছিলাম নৈতিকতার কথা। নারী পুরুষ যেই হোন, মুদ্রা পাচারের মতো অপরাধে জড়িত থাকলে তার জন্য শাস্তির বিধান আছে। আর আমি তুলছি নৈতিকতার প্রসঙ্গ। নাম-পরিচয়ের বা পেশা-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। 

একটা সিনেমা দেখেছিলাম। ব্যাংকে কর্মরত তিন নারীকর্মী দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন সুকৌশলে। ক্লিনারের কাজ করার সুবাদে ব্যাংকের সর্বাধিক সুরক্ষিত কক্ষেও তাদের যাতায়াত ছিল। বিমানবালা কি একাই নিজের পেশার সুবিধাকে অনৈতিক অর্থোপার্জনে প্রয়োগ করেছেন? এই কাহিনী ফলাও করে প্রচার হওয়ায় আমরা যারা পাঠক তাদেরও নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ এসেছে। টাকা পাচার, টাকা চুরি না করেও টাকা হাতানোর ফন্দিফিকির আঁটার লোক কি প্রতিটি পেশায় নেই? শুধু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণের গল্প সমাজে কুখ্যাতি পায়। শিক্ষকতা, চিকিৎসাসেবা পেশাতে ওই অনৈতিক অর্থোপার্জনের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন না অনেক পেশাজীবী? আমাদের বাঙালি মানসিকতা হলো চুরি করো কিন্তু 'ধরা পড়লে খবর আছে'। এখন যেমন খবর হচ্ছে বিমানবালার। হ্যাঁ, ভদ্রমহিলা মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তার সংসার অস্বচ্ছল থাকতো না। এমন বিমানবালাও তো আমাদের সমাজে রয়েছেন যিনি সৎ পথে উপার্জন করে নিজের পুরো মধ্যবিত্ত পরিবারটিতে স্বস্তি ও সম্মান ফিরিয়ে এনেছেন। এই পেশায় পারিশ্রমিকও তো বেশি। তবু মানুষের আকাংক্ষার ফানুস উড়তে উড়তে যেন সাত আসমান ছুঁয়ে ফেলতে চায়!

টাকার জন্য ভাই ভাইকে খুন করছে, এমন দৃষ্টান্ত সমাজে পাওয়া গেলে আমরা শিউরে উঠি। না, বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে মা, ছেলে ও পুত্রবধূ খুনের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো কিছু বলা ঠিক হবে না। যেহেতু বিষয়টি তদন্তের অধীন। তবে পুলিশ বলছেন, সম্পত্তি বা ব্যবসায়িক বিরোধই যাত্রাবাড়ীর ওই ট্রিপল মার্ডারের কারণ। যদিও নিহত মিজানের পরিবারের অভিযোগ, নিহতের পুত্র আশিকুর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার চাচাদের হাত রয়েছে বললেও পুলিশ তা আমলে নেয়নি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনারও বলেছেন, 'প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, মিজানের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। এ ছাড়া ব্যবসায়িক বিষয়ে কারও সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে। ডাকাতির ঘটনা হলে কাউকেই খুন হতে হতো না।'

প্রসঙ্গত এই ঘটনা কেস স্টাডি হিসেবে আমরা গ্রহণ করছি। পরিবারটি যথেষ্ট স্বচ্ছল। মিজানুরের বাবা ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ৬৬ কাঠা জমি রেখে যান। বিক্রির পর এখন ২২ কাঠা জমি অবশিষ্ট আছে। এই জমির ওপর নির্মিত হয়েছে দুটি চারতলা বাড়ি ও বেশ কয়েকটি দোকান। বাড়ি ও দোকানের ভাগাভাগি নিয়ে একাধিকবার তিন ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ হয়েছে। পাশাপাশি দুটি চারতলা বাড়ি চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়েছে।
শুধু সম্পত্তির জন্য বা টাকার জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে সেক্ষেত্রে নৈতিকতার কোনো জায়গা থাকে কি? ভদ্রভাবে চলার জন্য একটি পরিবারের যতটুকু সহায়সম্পত্তি থাকা দরকার তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও মানুষের টাকার মোহ কেন যায় না! এই টাকারই সঙ্গে সম্পর্কিত কারণে আক্রোশ ও প্রতিহিংসার জন্ম হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াচ্ছে! যাত্রাবাড়ির খুনের রহস্য উদঘাটনের যাত্রা সেদিকেই যাচ্ছে বলে অনেকেই অনুমান করছেন।

তাত্ত্বিকরা এই প্রবণতাকে পুঁজিবাদী সমাজের অবশ্যম্ভাবী প্রবণতা হিসেবেই চিহ্নিত করবেন। কিন্তু পুঁজি যদি মানুষের মনে পুজের জন্ম দেয় তাহলে শিক্ষা মূল্যবোধ ও মানবিকতার ঠিকানা কি ভাগাড়খানা হবে না? সত্যি বলতে কি, মানুষের অভাব থাকলেও সে অভাবী হয় না, অভাববোধ থাকলেই কেবল অভাবপূরণের জন্য তার তৎপরতা বেড়ে যায়। সেই তৎপরতায় অনৈতিকতা এসে শাসন করলে মানুষের সমূহ বিপদ। স্বজনের বিপদে একজন ব্যক্তি পাশে এসে দাঁড়াবেন তার সমস্ত শক্তি নিয়ে। অবশ্যই অর্থনৈতিক শক্তি নিয়েও। অথচ অর্থের কারণেই মানুষ নীতিচ্যুত হচ্ছে, রক্তের সঙ্গে সম্পর্কিতদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন আদর্শবাদীরা। মানুষের আশ্রয়ের জায়গাও ওইখানে। সেই আশ্রয় যদি আশ্রম না হয়ে জল্লাদখানায় পরিণত হয় তাহলে বুঝতে হবে সমাজ এক গভীরতর ব্যাধিতে আক্রান্ত। ব্যাধিমুক্তির উপায় সম্মিলিতভাবেই ভাবতে হবে বৈকি।