টিম তারানকোর দূতিয়ালি অতঃপর

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 14 Dec 2013, 01:34 PM
Updated : 14 Dec 2013, 01:34 PM

জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ৬ দিনের ঝটিকা তৎপরতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধনে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে কি না তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের প্রতিনিধি হিসেবেই ঢাকা এসেছিলেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।

সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সব পক্ষকে সংলাপে উৎসাহী করে তুলতে ৬ ডিসেম্বর আরও ক'জন সঙ্গী নিয়ে ঢাকা আসেন তারানকো। ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁর তৎপরতায় পরিস্থিতির 'ইতিবাচক অগ্রগতি' হওয়ায় তিনি আরও একদিন বেশি থেকে ১১ ডিসেম্বর ফিরে যান। কিন্তু ফেরার আগে সংবাদ সম্মেলনে তারানকো বাংলাদেশের চলমান সংকট সমাধানে 'আশাবাদ' ব্যক্ত করা ছাড়া বিশেষ কোনো অগ্রগতির খবর জানাতে পারেননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ তারানকোর সফর 'কার্যত ব্যর্থ' হয়েছে বলে মনে করলেও তিনি নিজে তা মনে করেন না। তাঁর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দ দুই দফা আলোচনায় বসাকেই মি. তারানকো তাঁর 'সাফল্য' বলে উল্লেখ করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের চার নেতা এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপির চার নেতার দুই দফা বৈঠক দেশের বর্তমান বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে একটি অগ্রগতি।

দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে বৈরিতা চলছে, তাদের যে বিপরীতমুখী অবস্থান, সেখানে দুই দলের ক'জন শীর্ষ নেতা এক টেবিলে বসে কথা বলার গুরুত্ব কোনো বিবেচনাতেই কম নয়। একে 'বরফগলা' বলা না গেলেও তার লক্ষণ বলা যেতে পারে। দেশের মানুষের মধ্যে এই বৈঠক নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সুখবর না পেয়ে তারা আবার যথারীতি হতাশ হয়েছে। তবে রাজনীতি নিয়ে সংকট কাটাতে আলোচনা চালিয়ে যেতে উভয় দলের সম্মতি প্রকাশ যদি আন্তরিক হয়ে থাকে, তাহলে এটাকে 'তারানকো-তৎপরতার' একটি অগ্রগতি বলেই ধরে নিতে হবে।

এক বছরের মধ্যে তিনবার ঢাকা সফর করলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো। প্রথমে গত ডিসেম্বর মাসে, তারপর মে মাসে এবং সবশেষে এই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য। ঢাকা অবস্থানকালে পাঁচ দিনে তিনি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কমপক্ষে ২৫টি বৈঠক করেছেন। বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, দুই দলের ক'জন শীর্ষনেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরাষ্ট্রসচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিক, কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক– হয়তো এ রকম আরও কারও সঙ্গে।

ঢাকায় এসেই জানিয়েছিলেন যে তিনি এবং তার সফরসঙ্গীরা কোনো ফর্মুলা নিয়ে আসেননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ফর্মুলা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই বের করতে হবে। তিনি শুধু মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবেন। মি. তারানকো এবং তার সঙ্গীরা অনেক ছোটাছুটি করেছেন, দৌড়ঝাঁপ করেছেন। একটি বৈঠক শেষ হতে না হতেই আরেকটি বৈঠক শুরু করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই তারা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তাদের আন্তরিকতারও নিশ্চয়ই কোনো ঘাটতি ছিল না। তারপরও দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণেই আশাজাগানিয়া কোনো খবর তৈরি করতে পারেননি 'টিম তারানকো'।

নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থানের কথা আমাদের সবারই জানা। এই দুই দল প্রথমে মুখোমুখি এবং শেষে মারমুখী অবস্থানে আছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই মূলত এই বিরোধের সূত্রপাত। বিএনপি তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার কথা বলছে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। কাজেই ওই ব্যবস্থা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।

দুই দলের অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা, অনেক যুক্তিতর্ক চালাচালি হলেও কোনো পক্ষের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। বরং শেষ পর্যন্ত এটা এক গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোও তাদের উদ্বেগ চেপে রাখতে না পেরে নানাভাবে 'ভূমিকা' রাখতে শুরু করে। বিদেশিদের সহঝোতা-উদ্যোগ এতটাই প্রকাশ্য এবং দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে যে, অনেকের কাছেই তা বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছে।

ঢাকায় নিযুক্ত কোনো কোনো বিদেশি কূটনীতিকের অতিউৎসাহী তৎপরতা ক্ষেত্রবিশেষে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করলেও তা রাজনীতিবিদরা মেনে নিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান মি মুন নিজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন, চিঠি পাঠিয়েছেন। দূত পাঠিয়ে সংকট সমাধানের উপায় বের করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ধারাবাহিক উদ্যোগের অংশ হিসেবেই মি. তারানকো ঢাকায় তাঁর তৎপরতা চালিয়ে গেলেন। তিনি চেষ্টা করেছেন, দুই পক্ষের মধ্যে উদ্বেগ ও অবিশ্বাসের ক্ষেত্রগুলো দূর করে, উত্তেজনা কমিয়ে আলোচনার একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার জন্য। কিন্তু এর কোনোটাই হয়েছে বলে মনে হয় না।

তারানকো ফিরে যাওয়ার পর গত শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপি নেতারা তৃতীয় দফা বৈঠক করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি নেতাদের কাছে কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার বিএনপি নেতারাও আওয়ামী লীগের কাছে কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে নতুন কিছু নেই বলেই জানা যাচ্ছে। তারানকোর উপস্থিতিতে বৈঠকেও এসব প্রস্তাব উঠেছিল বলে জানা যায়।

তবুও এই প্রস্তাবগুলো নিয়েই দুই দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে কথা হবে। তারপর তারা আবার আলোচনায় বসবেন। এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়েছে। আলোচনা অব্যাহত থাকাটা ভালো। যে সংকট তৈরি হয়েছে তা একদিনের আলোচনায় নিষ্পত্তি হবে– সেটা কেউ আশা করেন না।

তবে আলোচনা এবং আন্দোলন একসঙ্গে চলবে বলে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা কিন্তু সুষ্ঠু আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না। এটা আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিকতারও পরিচয় বহন করে না। বেগম জিয়া স্বীকার না করলেও এটাই সত্য যে, তারা যে 'আন্দোলন' করছেন সেটা আসলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নয়। দেশজুড়ে আন্দোলনের নামে চলছে সন্ত্রাস-সহিংসতা-নৈরাজ্য। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। রেলপথ-সড়কপথে চলাচল অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, এমনকি সংবাদপত্র বহনকারী গাড়িগুলোও যেতে পারছে না।

দেশ কার্যত অচল। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। দেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে। সহিংসতার মাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো চরিত্র বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের আন্দোলনে নেই। কারণ বিএনপির নামে পরিচালিত হলেও আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণভার চলে গেছে জামায়াতের হাতে। তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গোটা দেশ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করার যে হুমকি জামায়াতের এক নেতা দিয়েছিলেন, তা যে কথার কথা ছিল না, এটা এখন বোঝা যাচ্ছে।

এই অবস্থা চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যারা সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছেন, তারা বিএনপিকে চাপ দিচ্ছেন না ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য। এটা খুবই দুঃখের, বেদনার। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে একাত্তরের ডিসেম্বরের পরাজিত ঘাতক-দালাল চক্র। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?

তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের প্রথম বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু আলোচনার স্বার্থে বিরোধী দলকে অবরোধ তুলে নেওয়া এবং জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বিএনপিও দলের গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তি, দলীয় কার্যালয় খুলে দেওয়া এবং সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দাবি করেছিল।

আলোচনার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি যদি আলোচনায় আন্তরিক হয়, তাহলে কেন অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখছে? বিরোধী দলের সমর্থকরা সারা দেশে যে অরাজকতা-নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে সেগুলো বন্ধ না হলে সরকার কীভাবে নমনীয়তা দেখাবে? বিরোধী দলের নেতারা মুক্তি পেয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে উস্কানিমূলক কথা বলে উত্তেজনা ছড়াবেন না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দিলে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকবে, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে না– তার নিশ্চয়তা কি তারা দিতে পারবেন?

ঘোষিত কর্মসূচি ছাড়াও তো দেশের বিভিন্ন স্থানে অকারণে জ্বালাও-পোড়াও চলছে। বিএনপির সহ সভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী বলেছেন, তারা নাকি এখন যুদ্ধে আছেন! তারা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন? যুদ্ধ এবং আলোচনা একসঙ্গে হয় না। আলোচনার সময় যুদ্ধবিরতি দিতে হয়। তারপর আলোচনা ব্যর্থ হলে আবার যুদ্ধ শুরু হতে পারে। কিন্তু বিএনপি একদিকে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখে আলোচনায় আগ্রহের কথা বললে খুব বিশ্বাসযোগ্য হয় কি?

কোনো আলোচনা বা মধ্যস্থতা সফল হওয়ার পূর্বশর্ত হল দুই পক্ষেরই সদিচ্ছা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা। কিন্তু আমাদের দেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসছে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি কোনোভাবেই শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনে যাবে না। শেখ হাসিনা কোন যুক্তিতে ক্ষমতা ছাড়বেন, কোন প্রক্রিয়ায়, কার কাছে ক্ষমতা ছাড়বেন সে ব্যাপারে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই।

জানা যায়, তারানকো নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করা এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় কি না সেটা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব জাতিসংঘ নিতে পারে বলে জানালে, তাতে আওয়ামী লীগ আগ্রহ দেখালেও বিএনপি শেখ হাসিনাকে সরানোর অবস্থানেই অনড় থাকে।

বিএনপির দাবি অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই যদি তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনার প্রশ্নে নমনীয়তা না দেখানোর কারণ থাকতে পারে না। শেখ হাসিনার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ প্রকাশ ছাড়া বিএনপির এই অবস্থানের পেছনে কোনো রাজনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে না। আওয়ামী লীগ বিচারপতি কে এম হাসানকে মানেনি, বিএনপিও শেখ হাসিনাকে মানবে না– এটা কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না। অধম হওয়ার প্রতিযোগিতা ছেড়ে উত্তম হওয়ার লড়াই কেউ করতে চায় না।

তারানকো ফিরে গেছেন। তারপরও আলোচনা অব্যাহত রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এটা মন্দের ভালো। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্নপ্রায়। বিএনপি ওই নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, নির্বাচন করতেও দেবে না বলে জানিয়েছে। সরকার যে কোনোভাবে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু দেশে নির্বাচনের পরিবেশ আছে বলে কেউই মনে করছেন না।

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই ১৫১ জন প্রার্থীর বিনা নির্বাচনে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী না থাকায়। যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, সেখানেও মানুষ ভোট দিতে যাবে কোন্ আগ্রহে? ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচনের পরিণতি কী হবে সেটা কারও অজানা নয়। বিএনপি এই অবস্থাকে 'নীলনকশার', 'একদলীয়', 'পাতানো' নির্বাচন বলছে।

অথচ সরকারকে এই ধরনের নির্বাচনের দিকে তারাই ঠেলে দিয়েছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত তাহলেই আর সরকারের 'নীলনকশা' বাস্তবায়ন হত না। একদলীয় একতরফা নির্বাচনও হত না। বিএনপি চেয়েছে এই ধরনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাক। কারণ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কলঙ্ক যেহেতু বিএনপির গায়ে লেগে আছে, সেহেতু আওয়ামী লীগের গায়েও সে রকম কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দিয়ে স্বস্তি পাবে বিএনপি। এমন বিদ্বিষ্ট মানসিকতা দেশের রাজনীতির জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে না। একেই বলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ প্রতিমন্ত্রী সাইয়েদা ওয়ার্সি গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা। কী সংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গেলেন, সহিংসতা ছাড়া ভোট হয়েছে কিনা, ভোটাররা অবাধে ভোট দিয়েছেন কিনা, এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ মন্ত্রী এটাও বলেছেন যে, তারা একটি টেকসই নির্বাচন দেখতে চান, যেখানে বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।

এতদিন ধারণা করা হয়েছিল যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে এবং যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনকে একটি উৎসব হিসেবে দেখে থাকে, সেহেতু ৫০ শতাংশের বেশি ভোটারের উপস্থিতি ঘটানো অসম্ভব হবে না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এরশাদের জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে যে নাটক বা তামাশা করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

এসব নোংরা রাজনীতি পরিহার করা উচিত সবারই। জোর করে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রেখে যে নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে তাতে ভোটার উপস্থিতি থাকবে বলে আশা করা যায় না। সব মিলিয়ে এখন যে পরিস্থিতি তাতে ৫ জানুয়ারি যদি নির্বাচন হয়ও তাহলে সে নির্বাচনে যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না এবং সে জন্যই ওই নির্বাচন টেকসই হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

প্রশ্ন হল, তাহলে তারপর কী হবে? এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে আলোচনা করছে, সেটা কি নির্বাচনপরবর্তী সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজতে, নাকি এই নির্বাচনেই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে?

সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। কালক্ষেপণ অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।