পরিবর্তনশীল এরশাদ ও রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্রদ্ধা

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 8 Dec 2013, 05:16 AM
Updated : 8 Dec 2013, 05:16 AM

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় পাটির প্রধান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দলের অবস্থান সর্ম্পকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলে অনেকের মনে তার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ বিরাজ করছিল তা ধরে রাখতে পারছেন না। দলের কর্মীরা অনেক সময় জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ আবার হাসাহাসিও করছেন। তারা অনেকেই খবরের পিছনের খবর সর্ম্পকে ভালোভাবে জানেন না।

জনাব এরশাদ সাহেব যখন প্রধান মার্শাল ল' অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন তখনও অনেকে এ জাতীয় দ্রুত সিদ্ধান্তের রদবদল নিয়ে সমালোচনা করতেন। Chief Martial Law Administration কে অনেকে Cancel My Last Announcement বলে সমালোচনা করতেন। কিন্তু এখন তার পরিচিতি ভিন্ন। তিনি একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা। রাজনীতিবিদদের মানুষ শ্রদ্ধার আসনে দেখতে চায়, কারণ গণতান্ত্রিক ধারায় তাদের প্রজ্ঞা ও মেধা এবং দেশপ্রেম অনেক গভীর ও উঁচুমানের বলে মানুষ মনে করে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিবিদের ভাবনা ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত। তাদের কথায় ও বক্ত্যবে এমন সুর ও আস্থার ভাব প্রতিভাত হলে জনগণের শ্রদ্ধাবোধ গভীর হয়।

তদুপরি, এখন হচ্ছে ভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাইয়ের এক বিশেষ মুহূর্ত। এখানে একজন রিকশাচালক ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমান ভোটের অধিকারী। যে কোনো হালকা বক্তব্য সমালোচনার পাত্র হয়ে গণতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। তাই আমাদের উৎকণ্ঠা।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উপর থেকে জনগণের শ্রদ্ধাবোধ মনে হয় দিনের পর দিন হ্রাস পেতে চলেছে। তারা ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ মানুষের, শুধুমাত্র গণমাধ্যমের নয়। এই তো সেদিন, ডিসেম্বর ২, ২০১৩, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলেন আগুনে পোড়া মানুষদের দেখতে। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ গৃহবধূ গীতা সরকার কাঁদতে কাঁদতে প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে তার আকুতি আর তীব্র ক্ষোভের কথা জানালেন। তিনি বললেন, "আমরা ভালো সরকার চাই, অসুস্থ সরকার চাই না। আমরা আপনাদের তৈরি করেছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।" আরও অনেক বড় বড় কথা বলেছেন গীতা সরকার, "আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না।" (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩)

সাবলীল অথচ এমন জোরালো ভাষায় জনতার উৎকণ্ঠা কেউ ইতোপূর্বে প্রকাশ করেছেন কিনা, আমাদের জানা নেই। একজন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে তাঁর মুখের সামনে এমন নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরতে পারেন একজন গৃহবধূ, আমরা অনেকেই ভেবেও দেখিনি কোনোদিন। গীতা সরকার বলেছেন, "আমরা আপনাদের তৈরি করেছি"– এ যেন মনে হয় এব্রাহাম লিঙ্কনের মহান উক্তির প্রতিধ্বনি– 'জনগণ সরকার গঠন করে'।

আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, এমন কথা সম্ভবত বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জের আপামর জনগণের মনের কথা যা অতি সহজে গৃহবধূ গীতা সরকার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে বলে দিলেন নির্ভয়ে। এরই নাম হচ্ছে জনতার কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশের জনগণ এখন অনেক সচেতন, তারই প্রতিধ্বনি হয়েছে এক গৃহবধূর কথায় ও ভাবনায়। ভাবতেও ভালো লাগে, সম্ভবত গণতন্ত্রের এখানেই শিক্ষা ও সাফল্য।

বাস্তবে এদেশের জনগণ চায় একটি ভালো সরকার। কোনো প্রকার অসুস্থ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বিব্রত দিশাহীন কোনো সরকার নয়। সরকার দেশ পরিচালনায় সাবলীল গতি ও প্রকৃতি ধারণ করতে ব্যর্থ হবে, সুশাসনের নিদর্শন হবে তিরোহিত এবং প্রশাসন দুর্র্নীতিতে হবে ভারাক্রান্ত– দেশবাসী এমনটি আশা করে না এবং এরই নাম আসলে অসুস্থ সরকার। এমন সরকার চায় না দেশবাসী এবং দুর্বল রাজনীতিও আশা করে না। তাই ১৯৯১ সালের পর প্রতিবারই সরকার বদল হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের ধারণা হচ্ছে, রাজনীতিবিদেরা তাদের প্রত্যাশা পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, প্রত্যাশিত পথে চলছে না। তাই উচ্চারিত হচ্ছে বারবার– আমরা ভালো সরকার চাই, চাই সুশাসনের নির্দশন।

ভালো সরকার পেতে হলে ভালো নেতার প্রয়োজন হয়। জনগণ এখন ভালো নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে। এ ক্রান্তিলগ্নে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি যেভাবে কথা বলছেন এবং অনেক বড় বড় নেতা যেভাবে ভাষণ দিচ্ছেন জনগণ হতাশ হচ্ছে। আস্থা পাচ্ছে না দেশের ভবিষ্যৎ এ জাতীয় নেতৃত্বের কাছে। যে কোনো দেশের জন্য রাজনীতিবিদের উপর থেকে এমনভাবে আস্থা হারানো কোনো শুভলক্ষণ নয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে অনেক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, আর্থিক অঙ্গনে, সামাজিক মূলধন সৃষ্টিতে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি তৃতীয় বিশ্বের জন্য উদাহরণ। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে এমন অর্জন বিস্ময়কর। শিক্ষাখাতে অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র বিমোচনে উৎকর্ষ সাধন, বৈদেশিক মুদ্রা উপাজর্নে প্রবাসী বাংলাদেশিদের শ্রম এবং তৈরি পোশাক শিল্পের অভাবনীয় সাফল্য সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। এতসব অগ্রগতি ও অর্জনে রাজনীতিবিদদের উল্লেখযোগ্য অবদান আছে বলে অনেকেই মনে করেন না।

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূ বেড়ে এখন হয়েছে ৬৮ বছর যা ১৯৭২ সালে ছিল চল্লিশ বছরের নিচে। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়ে উপনীত হয়েছে প্রতি লক্ষে ১৯৪, যা ছিল ৬৫০ এর অধিক। তেমনিভাবে শিশুমৃত্যূর হার হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ৩১ যা ছিল প্রায় ১৫০ জন। প্রজননহার কমে হয়েছে ২.৩, যা ছিল ৬ এর অধিক। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সংক্রামক ব্যাধি নিবারণে জনগণ সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ সবই হচ্ছে বড় প্রাপ্তি।

এমনসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির অন্যতম কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং প্রচুর ছোট-বড় বেসরকারি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের অমূল্য অবদান। তেমনিভাবে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়ে উন্নীত হয়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ এবং মহিলাদের শিক্ষাঙ্গনে পদচারণা চমক সৃষ্টি করেছে।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করত, সেই হার বর্তমানে হ্রাস পেয়ে হয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। এ খাতে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, প্রশিকাসহ নারীদের দ্বারা পরিচালিত বেসরকারি সংগঠনসমূহের অবদান অমূল্য ও অসাধারণ। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ এ ক্ষেত্রে ব্যাপক কৌশলগত ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৪০ লক্ষ মহিলা কর্মী নিয়োজিত আছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ক্ষেত্রে এ খাত প্রায় ৬৭ শতাংশ অবদান রাখছে। স্মরণ করতে হয় প্রয়াত সচিব নুরূল কাদের খানের অবদান যিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এ খাতকে বিশ্ববাজারে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রতিযোগিতায় আজ বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এজন্য বেসরকারি মালিকানাধীন উদ্যোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষ ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য।

পক্ষান্তরে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সরকারে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাসীনেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও দলবাজি করে অগ্রগতির ধারা ব্যাহত করেছেন এবং সুশাসনের পরিবেশ বিঘ্নিত করে আমলাতন্ত্রকে দুর্বত্তায়নে বাধ্য করেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী পিয়ন ও দারোয়ান নিয়োগে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা অপহরণ করেছেন। যেমন হয়েছে খাদ্য বিভাগে, তেমনি হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগে। এ কারণেই উচ্চ আদালত প্রায় পাঁচ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে সম্প্রতি। রাজনীতিতে নিবেদিত কালো বিড়ালেরা সমগ্র দেশে অনেক ক্ষেত্রে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এসব কাহিনি এত ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে যাকে সংক্ষেপে বলা যায় গণতন্ত্রবিরোধী এবং অসুস্থ সরকারের প্রতিচ্ছবি।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতা দেখে আমেরিকা ও ভারত থেকে বিভিন্ন স্তরের কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আসছেন, আমাদের সর্বোচ্চ স্তরের নেতাদের পরামর্শ দিতে এবং তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডারে কিছু সংযোজন করতে। হয়তো-বা কখনও ধমকের সুরে কিছু বলছেন, আবার কখনও শিক্ষকের ভূমিকায়। এ লজ্জ্বা রাখব কেমন করে! বাংলাদেশের বেশ কিছু জ্ঞানী-গুণী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক সন্মানের আসনে আসীন আছেন। সেখানে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের দৈন্যদশা উপহাসের পাত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়ে সমগ্র জাতিকে লজ্জা দিচ্ছে।

রাজনীতিবিদদের কাছে অনুরোধ থাকবে– জনগণের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করুন এবং তাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এমন কাজ করুন। ইতিহাস আপনাদের স্মরণ করবে যুগ যুগ।