মনের চিকিৎসায় দূর হোক জেন্ডার ভায়োলেন্স

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 24 Nov 2013, 07:45 PM
Updated : 24 Nov 2013, 07:45 PM

পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নতা বা স্বাতন্ত্র্য থেকে উদ্ভূত বৈষম্যই লিঙ্গবৈষম্য। কিছু আইনি উদাহরণ দেওয়া যাক।

১৮৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় প্রদেশের একজন উকিলের স্ত্রী যার নাম ছিল মিসেস মিরা ব্র্যাডওয়েল, তাঁকে আইন ব্যবসা করতে দিতে রাষ্ট্রের অস্বীকৃতির বিরুদ্ধে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। বিচারক জোসেফ পি ব্র্যাডলি ও তাঁর সহযোগী বিচারক সোয়েন এবং ফিল্ড জেজে এই মর্মে রাষ্ট্রপক্ষের রায় বহাল রাখেন যে প্রকৃতিপ্রদত্তভাবেই মহিলারা কিছু পেশার জন্য অনুপযুক্ত।

"সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারকের মত হলো, পুরুষ নারীর কর্মক্ষেত্র ও অভিলক্ষ্যের মধ্যে একটা পার্থক্যকে সিভিলাইন ও প্রকৃতি বরাবর স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। পুরুষ, আর তা-ই হওয়া উচিত, নারীর অভিভাবক, রক্ষক ও সমর্থক, তার প্রাকৃতিক ও স্বভাব নম্রতা ও কমনীয়তার জন্য নাগরিক জীবনে বহু কর্মকান্ডে নারীকে শোভা পায় না, ঐশ্বরিক অধ্যাদেশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক পরিবেশে প্রাকৃতিকভাবে নারীর অধিক্ষেত্র ও কর্মকান্ড হচ্ছে গৃহের অভ্যন্তরে, একজন নারীর স্বামী ব্যতিরেকে কোনো স্বতন্ত্র আইনী অস্তিত্ব নেই এবং সমাজে তার স্বামীকে তার কর্তা ও প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়; নারীর সর্বোচ্চ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তো সেই মহান ও মঙ্গলময় ভূমিকায় বধু ও মাতার বৃত্তি পালন করা; ইত্যাদি ইত্যাদি।"

এর আগে ১৮৭২ সালে ইলিনয়ের আইনপ্রণেতারা এ মর্মে আইন পাশ করেছিলেন যে, লিঙ্গভেদে সব মানুষ নিজের পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ভোগ করবে। মিসেস ব্র্যাডওয়েল অবশ্য এ রায়ের বিরুদ্ধে আর আবেদন করেননি। তবে ১৮৯০ সালে ইলিনয় সুপ্রিম কোর্ট তাঁর ১৮৬৯ এ করা আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে তাঁকে আইন ব্যবসার অনুমতি দেয়। দু'বছর পর তিনি সুপ্রিম কোর্টে কাজ করার সুযোগ পান।

ইংল্যান্ডে ১৯১৪ সালে মিসেস বেব ও সে দেশের ল' সোসাইটির মধ্যকার এক মামলায় বলা হয়, মহিলারা লৈঙ্গিক তফাতের কারণে আইনজীবী বা ব্যারিস্টার হতে পারবেন না। ১৯১৯ সালে লৈঙ্গিক অযোগ্যতা নিরসন আইন (sex Disqualification Removal act ) পাশ হবার আগ পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।

ব্রিটিশশাসিত ভারতেও কোনো ধরনের আইনি পেশায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ১৯২১ সালের ২৪ আগস্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট মিসেস কোর্নেলিয়া সোরবজিকে আইনচর্চার অনুমতি দেয়। বর্তমানে এদেশে কয়েক হাজার মহিলা আইনজীবী রয়েছেন। আপিল বিভাগে একজন এবং হাইকোর্টে ৭ জন মহিলা বিচারক কাজ করছেন।

১৯৪৭ এ স্বাধীনতার পর ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও লিঙ্গভেদে সমঅধিকারের সংগ্রামের সুফল আসতে শুরু করে। নারীদের সমঅধিকারের সপক্ষে জাঁকালো আর গালভরা কিছু আইনি ঘোষণা এলেও তা ঘোষণাই থেকে যায়। এখনও কিছু ধর্মের ধ্বজাধারীদের জোর গলায় বলতে শোনা যায়, 'নারীরা ন্যায্য পাওনা পেতে পারে, সমঅধিকার নয়'।

ইদানিং এমন মনে হয় যে আমরা নারী-রাজত্বে বাস করি, যাকে বলা চলে 'প্রমীলার সংসার'। আমাজান নারীর দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ এই 'প্রমীলা' শব্দটি। দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর একটা বড় সময় আমরা মহিলা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বাস করেছি। মহিলা প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আমরা পেয়েছি মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী। এমনকি আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলের নেত্রীও নারী।

এতসব গুরুত্বপূর্ণ পদে এত নারী ক্ষমতায় থাকতেও কেন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে সেটাই ভাববার বিষয়। পুরুষদের অধীনে যেমন, নারী নেতৃত্বের অধীনেও নির্যাতন চালু আছে বহাল তবিয়তে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে অন্তত একজন লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের শিকার।

দুর্ভাগ্যজনক যে সংখ্যা বিবেচনায় আমাদের দেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় যেখানে পুরুষ সঙ্গীর হাতে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। আধুনিক প্রযুক্তি নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও জটিল ও পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। এসিড নিক্ষেপ কিংবা ছবি তুলে কিংবা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া নির্যাতনের নতুন নতুন রূপ। ৬০ বছরে আগেও এসবের অস্তিত্ব ছিল না।

ধর্মের নামে ফতোয়া দিয়ে মেয়েদের চাবুকাঘাত করা মারাত্মক নির্যাতনের আরেক নমুনা। আমাদের সর্বোচ্চ আদালত এ মর্মে রায় দিয়েছে যে, যে কেউ ফতোয়া দিতে পারে, কিন্তু আদালত ছাড়া তা কেউ কার্যকর করতে পারবে না। অত্যুৎসাহী ধর্মী্য় নেতারা প্রায়ই তা মানে না।

১৯৯৬ সালে মানবাধিকার সংস্থা সংজ্ঞায়িত করেছে "লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একই সঙ্গে লিঙ্গবৈষম্যের কারণ ও ফলাফল।" সমাজে নারীদের অধঃস্তন অবস্থা বিবেচনায় এনে ভারসাম্য রক্ষার জন্য মূলত পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন সহিংস আচরণই লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে–

১. পারিবারিক নির্যাতন বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতন এবং অন্তরঙ্গ সঙ্গী কর্তৃক নির্যাতন, অর্থাৎ অতীত বা বর্তমান জীবনসঙ্গীর দ্বারা শারীরিক, যৌন কিংবা মানসিক নির্যাতন;

২. যৌন-সহিংসতা, যেমন ধর্ষণ, শারীরিক যৌননির্যাতন, গর্ভধারণে বাধ্য করা, যৌনব্যবসায় বাধ্য করা;

৩. প্রথাজনিত ক্ষতিকর চর্চা, যেমন যৌনাঙ্গহানি, সম্মানরক্ষার্থে খুন ও যৌতুকের কারণে নির্যাতন;

৪. মানবপাচার।

কয়েক বছর আগে ২০০৭ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছিলেন, "পৃথিবীর সব দেশে, মহাদেশে, সব সংস্কৃতিতে নারী ও বালিকাদের প্রতি নির্যাতন বহাল আছে। মহিলাদের জীবন, তাদের পরিবার ও সামগ্রিকভাবে পুরো সমাজের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। বেশিরভাগ সমাজ এ ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ করেছে; যদিও বাস্তবতা হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা চাপা দেওয়া হয় বা অকথিত ক্ষমা পেয়ে যায়।"

পৃথিবীব্যাপী প্রতি ৬ জনের মধ্যে অন্তত একজন নারী– কোনো কোনো দেশে নারী সমাজের একটা বড় অংশ– শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় অথবা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে তাদের স্বামী বা অন্তরঙ্গ সঙ্গী দ্বারা জোরপূর্বক যৌনাচরণে বাধ্য হয়। এ ধরনের নির্যাতন শারীরিক এবং মানুষ হিসেবে অধিকারের প্রশ্নে উদ্বেগজনক। এর ফলে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে নারীসম্ভাবনার পূর্ণপ্রকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

কেবলমাত্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ আর লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা যথেষ্ট নয়। বরং আইনি এবং সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থারই এর প্রতি সংবেদনশীলতা দরকার।

১৯৯৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতাকে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেসব নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে থাকে। কেউ কেউ সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং থেকে বেশি উপকৃত হন।

কাউন্সেলিং মূলত দ্বিপাক্ষিক এক ধরনের সম্পর্ক যেখানে সেবাদানকারী আপনার কথা শুনবে– আপনার যা কিছু বলবার আছে সবই শুনবে কোনো রকম বিচার না করে। কাউন্সেলর সাধারণত কোনো উপদেশ দেন না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রশ্ন করেন কিংবা দ্বিমত পোষণ করেন যাতে রোগী তার স্বতঃসিদ্ধ ধারণা পুনরায় যাচাই করতে পারেন।

মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা (Psychotherapy) কাউন্সেলিং-এর চেয়ে অনেক নিবিড় এবং বেশি সময় ধরে চলতে পারে। কাউন্সেলিং-এর মূল কাজ হল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাতে নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে পারে, যাতে বুঝতে পারে তার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে। কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের যথাযথ যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন।

এছাড়া কাউন্সেলর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির 'আঘাত-পরবর্তী সংকট' যেমন পরিবার বা সমাজে মেলামেশায় যদি তিনি কোনো রকম অসুবিধা বোধ করেন কিংবা কোনো আইনি সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে তাতেও সাহায্য করে থাকেন।

কাউন্সেলিং-এর মূল উদ্দেশ্য হল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে নিজেকে বুঝতে সাহায্য করা, অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করা, ক্ষোভ প্রকাশ করতে সাহায্য করা, জানতে সাহায্য করা যে তিনি একা নন বা এ ক্ষতির জন্যে দায়ী নন এবং প্রয়োজনীয় সেবা ও যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

কয়েকটি দেশে ইউএনডিপি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যেমন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করছে, "নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পুরুষ" শিরোনামে প্রচারণা ইত্যাদি যার প্রভাব পড়ছে জাতীয় নীতিতে।

সহিংসতা রোধে মনোবিদের মাধ্যমে যথাযথ সাহায্য পেতে প্রয়োজন নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠানের মালিক সবার যথাযথ ভূমিকা যাতে সমস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলা করতে পারে। এ ব্যাপক সমস্যা রোধে এর বিকল্প নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্য আরও প্রয়োজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সহযোগী সেবার সমন্বয়।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অবশ্যই আইনি দিক রয়েছে; তবে এটা এমন একটা সামাজিক সমস্যা যা সমাজ বিজ্ঞানী যেমন মনোচিকিৎসকের সাহায্য ছাড়া দূর করা সম্ভব নয়। আমার মতে, মনোচিকিৎসকের মূল ভূমিকা এ ক্ষেত্রে যথাযথ কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করা।

এ চিকিৎসার খরচ অনেক। একজন লেখক তাই যথার্থ বলেছেন, ''স্নায়ুবিকারগ্রস্ত হাওয়ায় প্রাসাদ বানায়, মনোরোগী তাতে বাস করে, আর একজন মনোচিকিৎসক এর ভাড়া নেন।''

আমাদের মতো দরিদ্র দেশে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। আমি আমার কবিতা 'দারিদ্রের প্রবাদ'-এ তাই লিখেছিলাম–

দারিদ্রবচন

মন খারাপ হলে
গরীব যায় বন্ধুর বাড়ি
মাইয়া হলে, সইয়ের বাড়ি,
আড্ডা দিলেই মনডা ঠান্ডা
মনোরোগীর ডাক্তার
তার আবার কিয়ের দরকার।

আমি আশা করি আমার এ বক্তব্য লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধের পথের হদিশ দেবে যা দুঃখজনক হলেও এ দেশে বহুল বিদ্যমান। বিদেশী বন্ধুদের আমি সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। আশা করছি এদেশে তাদের সময় সুন্দর কাটবে।

সবাইকে ধন্যবাদ।

(ঢাকায় ২৪-২৫ নভেম্বর, ২০১৩ তে অনুষ্ঠিত 'সেভেনথ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন সাইকিয়াট্রি'-তে প্রধান অতিথি হিসেবে পঠিত বক্তব্য)

অনুবাদ করেছেন : রেশমী নন্দী।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।