রামপাল: ভারতের কল্পকথার গাইডলাইন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

বৃন্দলেখক
Published : 23 Nov 2013, 05:14 PM
Updated : 23 Nov 2013, 05:14 PM

[আমাদের লেখা চার পর্বের "রামপাল অভিযোগনামা''র পরিপ্রেক্ষিতে বিডিনিউজের মতামত-বিশ্লেষণে ৯ নভেম্বর "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক" নামে একটি অপ-এড প্রকাশিত হয়েছে। এই অপ-এড-এর কিছু বক্তব্য নিয়ে আমাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন এসেছে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাতে আবার হাজির হতেই হল। আসুন সরাসরি মূল প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যাই।]

প্রশ্ন ১-

"রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক" শিরোনামের আর্টিকেলে বলা হয়েছে–

"ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে, সেই ভারতের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের গাইডলাইন অনুসারে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমির মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়।"

এটা কি ঠিক যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমির মধ্যে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ ভারতে গ্রহণযোগ্য নয়?

উত্তর ১:

এ ব্যাপারে অনেক বার বলেছি যে 'গাইডলাইন' কোনো আইন নয় যে মানতে হবে। গাইডলাইন হল একটা সাজেশন মাত্র। থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের নিঃসরণের মাত্রার উপর নির্ভর করে যে কতটা দূরত্ব 'নিরাপদ' দূরত্ব বলে বিবেচিত হতে পারে; এ ব্যাপারটি গ্যাস ডিসপার্সন মডেল দিয়েও দেখানো হয়েছে রামপাল অভিযোগনামার দ্বিতীয় পর্বে যে, ১৪ কিমি দূরত্বটি যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপদ সুন্দরবনের জন্যে।

কিন্তু তারপরও একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে যে "সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা জাতীয় উদ্যানের ২৫ কিমি দূরত্বের মধ্যে যেখানে ভারত নিজে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে পারত না তা কেন বাংলাদেশে তারা করছে? কেন যে ১৪ কিমি দূরত্ব ভারতে গ্রহণযোগ্য নয় সেটি বাংলাদেশের জন্যে প্রযোজ্য হবে?"

এ কারণে একটু খোঁড়াখুঁড়ি করতেই হল দেখার জন্যে যে এই "সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমির মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়" গাইডলাইনটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য ভারতের নিজের কাছেই। আসলেই সময় এসেছে এটি খতিয়ে দেখার যে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে– সেই সুপরিচিত (প্রতিবাদীদের কাছে যা বাইবেলতুল্য) ২৫ কিমির গাইডলাইন কিংবা ১০ কিমির নিরাপদ দূরত্ব– কোনটিকে কতটা বিবেচনায় নেয় ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় (MoEF)।

প্রথমেই জানিয়ে নিই যে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ২৫ কিলোমিটার তফাতে থাকার গাইডলাইনটি যে শুধু আগস্ট ২০১০ সাল থেকে ভারতে বহাল আছে তা কিন্তু নয়। ভারত সরকারের Department of Environment, Forest & Wildlife এর অধীনস্থ Ministry of Environment & Forests ১৯৮৭ সালে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থাপনা সংক্রান্ত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করে "Environmental Guidelines for Thermal Power Plant" নামে। এই রেয়ার ডকুমেন্টটি পাবেন এখানে–

এই গাইডলাইনে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের লোকেশনের ব্যাপারে সেকশন ২.২.১ এ বলা হয়–

আগস্ট ২০১০ এ এই ১৯৮৭ সালের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট গাইডলাইনেই সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে ভারতের MoEF তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয় যার আলোচিত অংশটির স্ক্রিনশট নিচে দেওয়া হল–

পুরো ফাইলের লিঙ্ক এখানে–

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আগস্ট ২০১০ সালের একটি লিংকের বরাত দিয়ে যে গাইডলাইনের কথা বলা হচ্ছে সেটি আসলে নতুন কিছু নয়। গত ২৬ বছর ধরেই এই গাইডলাইনটি বহাল তবিয়তে বর্তমান। এই গাইডলাইনে যা বলা হচ্ছে তার মধ্যে ইমপরটেন্ট পয়েন্ট মূলত দুটি–

(i) মেট্রোপলিটন সিটি, ন্যাশনাল পার্ক ও বন্য পশুপাখির অভয়ারণ্য, কিছু ইকলোজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া যেমন ট্রপিক্যাল ফরেস্ট, বায়োস্ফিয়ার রিসার্ভ, ইমপরটেন্ট খাল-লেক-কোরালসমৃদ্ধ কোস্টাল এরিয়া থেকে ২৫ কিমি দূরে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের জায়গা নির্বাচন করা;

(ii) ফরেস্ট বা প্রাইম এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড অ্যাভয়েড করতে হবে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের সময়।

এই ছাব্বিশ বছর ধরে গাইডলাইন হিসেবে থাকার পরও কিন্তু ভারত এটাকে Act অথবা রুল, কোনো হিসেবেই বের করেনি। আচ্ছা তা না হয় না করুক, আসুন দেখি ভারতের থার্মাল প্ল্যান্টগুলোকে Environmental Clearance দেবার সময় এই গাইডলাইন ঠিক কতটা আমলে নেয় ভারতীয় Ministry of Environment and Forest, তবে সবার আগে অনুরোধ করব একটু সময় নিয়ে এই লিংকটির সঙ্গে পরিচিত হতে–

এই লিংকটি আসলে ভারতের "Environment Clearance Status Query Form" যেখানে এ যাবতকালে ভারতের সকল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের তথ্য দেওয়া আছে। লিংকটিতে গেলে চারটি ঘর পাবেন তথ্য সিলেক্ট করার জন্যে।

এখানে EC Generated, Thermal Projects, Year ও State সিলেক্ট করলেই ওই বছরের ওই প্রদেশের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের লিস্ট আসবে। ছাড়পত্র পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে Environmental Clearance (EC) সহ নানা ধরনের ধরনের ডকুমেন্ট অ্যাটাচড করা আছে। খুলে দেখে নিন।

আশা করি এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের EC দেখে ফেলেছেন। এখন বলুন তো কয়টি থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ছাড়পত্রে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের বিখ্যাত সেই গাইডলাইন অনুযায়ী ২৫ কিলোমিটার দূরে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করার বিষয়টিকে আমলে নিয়ে ছাড়পত্র দিতে দেখলেন?

জি। যা ভাবছেন ঠিক তাই। কোনো ছাড়পত্রেই ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব আমলে নেওয়া হয়নি। এখানেই বেরিয়ে এল কেঁচো খুঁড়তে সাপ। ভারতে ছাড়পত্র পাওয়া অনেক থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টই কিন্তু Reserved Forest, wildlife sanctuary ইত্যাদি থেকে সর্বনিম্ন যে ১০ কিলোমিটার দূরত্ব রাখার কথা সেটি বজায় না রেখেও পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়ে গেছে অনায়াসে। এ ব্যাপারে ওপরের এই

লিংক থেকে পাওয়া কয়েকটি EC এর স্ক্রিন শট দেখি আসুন এটি জানার জন্যে যে ভারতে Environmental Clearance (EC) দেওয়ার সময় বাইবেলের বাণী বলে খ্যাত ২৫ কিমিই হোক আর পুরো গাইডলাইনই হোক, কতটা গুরুত্ব পায়–

i) ২০০৬ সালে অন্ধ্র প্রদেশের ছেলপুর গ্রামের ভুপালাপল্লীর ৫০০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটি EC লাভ করে। এই ছাড়পত্রেই উল্লেখ আছে যে তাড়িছাড়লা নামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে এই প্রজেক্ট সাইটের দূরত্ব ৩.৩ কিমি। অর্থাৎ গাইডলাইনে ২৫ না কি সাজেস্ট করেছে সেটা তো বাদই গেল, ছাড়পত্র দেওয়ার সময় ১০ কিমি দূরত্বে থাকার আইনটিও মানা হয়নি। দেখুন স্ক্রিনশট–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে-

ii) ২০০৯ সালে মহারাষ্ট্রের চন্দ্রাপুর জেলার তাড়ালি গ্রামে ২x৩০০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটি EC লাভ করে। এই ছাড়পত্রে উল্লেখ আছে যে বান্দাক নামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে এই প্রজেক্ট সাইটের দূরত্ব ৭.৮ কিমি। অর্থাৎ গাইডলাইনে আছে সেটা তো বাদই গেল, ছাড়পত্র দেওয়ার সময় ১০ কিমি দূরত্বে থাকার আইনটিও মানা হয়নি। দেখুন স্ক্রিনশট–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

iii) ২০০৯ সালে ছাড়পত্র পাওয়া মহারাষ্ট্রের রায়গত জেলার আলীবাগ তালুকের মাধেকর গ্রামের এই ৪০৫ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটি তো আশেপাশে ৭ কিমির মধ্যে ন্যাশনাল পার্ক ও বন্য পশুপাখির অভয়ারণ্য নেই বলেই ছাড়পত্র পেয়ে গেছে। ১০ কিমির কথাও আমলে নেওয়া হয়নি। সেখানে ২৫ কিমি তো প্রশ্নেরই বাইরে। স্ক্রিনশট এখানে–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

iv) সেই বিখ্যাত গাইডলাইনে বলা আছে যে ফরেস্ট ল্যান্ডকে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ছত্তিসগড় প্রদেশের রায়গড় জেলার ১৬০০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটির ১২০৫ একর জায়গার মধ্যে ১৩৫ একরই 'ফরেস্ট ল্যান্ড' বলে এই প্ল্যান্টের পরিবেশ ছাড়পত্রেই উল্লেখ রয়েছে। স্ক্রিনশট এখানে–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

v) ডিসেম্বর, ২০১০ এ পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার দুটি গ্রামের ২x৬৬০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটির ৫ কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত মাধক অভয়ারণ্য বা স্যাংচুয়ারি। সেটা উল্লেখ না করে পাওয়া পরিবেশ ছাড়পত্রের স্ক্রিনশট–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

vi) ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে ছাড়পত্র পায় উড়িষ্যা প্রদেশের কাটাক জেলার নারাজ মার্থাপুরের ২x৬৬০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই থার্মাল প্ল্যান্টের বাউন্ডারির থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে চান্দাকা দামপাড়া ন্যাশনাল পার্ক ও বন্য পশুপাখির অভয়ারণ্য; ৭.৫ কিমি দূরে নান্দানকানন ন্যাশনাল পার্ক।

শুধু তাই নয়, এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ৭ কিমির মধ্যে আরও ৫ টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবস্থিত। এ রকম একটি জায়গাতে, যেখানে দূরত্বের বিচারে সকল নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে, সেখানেও শুধুমাত্র বন্য পশুপাখি সংরক্ষণ প্ল্যানের উপর ভিত্তি করে এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটির পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে যা এখানে দেখা যাচ্ছে–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

vii) এ বছরেরই (২০১৩) মে মাসে পরিবেশ ছাড়পত্র পায় উত্তর প্রদেশের রায় বিরুলিতে ফিরোজ গান্ধী উষ্ণাচার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ৫০০ মেগাওয়াট এক্সপ্যানশন প্রজেক্ট। এই থার্মাল প্ল্যান্ট প্রথম ছাড়পত্র পেয়েছিল ১৯৮৫ সালে। তখন এটি করেছিল NTPC; এখনও সেটার এক্সপ্যানশনের কাজ পেয়েছে NTPC, এই প্রজেক্টের Environmental Clearance সার্টিফিকেটে দেখা যায় যে সাসামপুর বার্ড sanctuary-এর মতো একটি অতিসংবেদনশীল এলাকা থার্মাল প্ল্যান্ট সাইটের মাত্র ৭.৯ কিমির মধ্যে থাকার পরও প্রকল্পটি ২০১৩ সালে EC পায় এই এক্সপ্যানশন কাজের জন্য। পাঠকদের জন্য স্ক্রিনশট দেওয়া হল–

এই থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পুরো পরিবেশ ছাড়পত্রটি পাবেন এখানে–

এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে ভারতের Environmental Clearance এর ওয়েবসাইটে যেখানে ১০ কিমি দূরত্বকেও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি, আর সেখানে তথাকথিত সেই গাইডলাইনের কথা আর কী বলব? এই ২৫ কিমি দূরত্বকে ভারতের MoEF যে শুধু আমলে নেয় না তাই নয়, ওই গাইডলাইনের ২৫ কিমির দেখাই তো কোথাও পাওয়া গেল না।

তাই "ভারতের গাইডলাইন না মানলে খোদ ভারতেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং কেন বাংলাদেশ মানল না সেই গাইডলাইন" … এটি একটি প্রহসনমূলক কথা ছাড়া কিছুই নয়।

প্রশ্ন ২-

"বাংলাদেশের আইনের হয়তো ব্যত্যয় হয়নি, কিন্তু ১৯৯১ সালের কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট নোটিফিকেশন অনুযায়ী ভারতে শুধু সুন্দরবন নয়, যে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বণ্যপ্রাণির আবাসস্থল, অভয়ারণ্য, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদিকে ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়।"

বাংলাদেশ কেন সুন্দরবনকে ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এলাকা হিসেবে গণ্য করল না, এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?

উত্তর ২-

এ প্রসঙ্গে প্রশ্নকর্তা, সেই সঙ্গে "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"-এর লেখক আমাদের লেখা ''রামপাল অভিযোগনামা পর্ব ২''-এ উল্লেখকৃত আইনগত দিকটি উল্লেখ করেছেন যেটি ছিল এমন–

"সুন্দরবনের জন্য প্রযোজ্য গ্রহণযোগ্য দূষণমাত্রা নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? সিডিউল-২-এ যে শ্রেণিবিভাগ আছে সেখানে বনাঞ্চল, অভয়ারণ্য, জলাভূমি, ম্যানগ্রুভ, বন্যপ্রাণির বিচরণক্ষেত্র ইত্যাদির জন্য কোনো দূষণমাত্রার উল্লেখ নেই। সেখানে সবচেয়ে রক্ষণশীল মানটি দেওয়া আছে সেনসিটিভ বা সংবেদনশীল স্থানের জন্য— যেটার শর্ত সুন্দরবন পুরণ করে না।

আবার দ্বিতীয় রক্ষণশীল মানটি দেওয়া আছে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকার জন্য। সুন্দরবন তো আক্ষরিক অর্থে তাও নয়। এই অবস্থায় মান প্রদানকারীরগণের জাজমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে পারতেন এবং সংবেদনশীল স্থানের মান ব্যবহার করতে পারতেন। তবে না করায় তাদের কোনো অন্যায় হয়নি।"

"রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক" রচনাটিতে লেখক আমাদের উপরের বক্তব্য মেনে নিয়েছেন যে সুন্দরবনকে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকা বিবেচনা করাতে আইনগতভাবে কোনো ত্রুটি হয়নি। ধন্যবাদ প্রশ্নকর্তাকে।

তবে প্রশ্নকর্তা তার স্বভাবসুলভ ভারতপ্রীতির নমুনা হিবেই কিনা জানি না ভারতের উদাহরণ টেনে এনে অভিযোগ করে উত্থাপন করেছেন এই বলে যে ১৯৯১ সালের ভারতীয় কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট নোটিফিকেশন অনুযায়ী কেন Category I-এ যেমনটি বলা আছে Ecologically Critical Area-এর ব্যাপারে, সেই মতো সুন্দরবনকে বিবেচনা করা হল না যেখানে Category I-এর আওতাভূক্ত হল– যে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল (reserved forest), জাতীয় উদ্যান (National Park), বণ্যপ্রাণির আবাসস্থল (wildlife habitats), অভয়ারণ্য (sanctuary), ম্যানগ্রোভ বন (mangroov) ইত্যাদি ইত্যাদি।

তো প্রশ্নকর্তার কৃপায় এটা জেনে আসলেই প্রায় বাধিত হয়ে যাচ্ছিলাম যে ভারতে Category I নামে একটা classification আছে এখানে ভারত 'ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ' বলে কিছু জায়গা প্রোটেক্ট করার ব্যাপারে সচেতন। তা না হলে তো উপরের (প্রশ্ন ১-এর উত্তরে দেওয়া) প্রমাণগুলো থেকে প্রায় নিশ্চিত হয়ে যচ্ছিলাম যে ভারতে এ রকম কোনো ক্যাটাগরি নেই যেগুলোর ক্ষেত্রে ভারত তাদের "১০ কিমির মধ্যে কোনো অ-বনজ স্থাপনা করা যাবে না" আইনটি প্রয়োগে কঠোর হতে পারে।

কিন্তু এরপরই আবার হতাশ হতে হল প্রশ্নকর্তার দেওয়া ভারতের Ministry of Environment and Forest এর যে লিংকটি দিয়েছেন–

সেটিতে ঢুকে। এই লিংকটিতে মূলত Coastal Stretch কে Coastal Regulation Zone (CRZ) হিসেবে Declaration দিয়ে CRZ তে কর্মকাণ্ডকে যে রেগুলেশনের আওতায় আনা হয়েছে সে ব্যাপারে বলা হয়েছে। প্রশ্নকর্তা একটি প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করেছেন এই লিংক থেকে–

"(i) Areas that are ecologically sensitive and important, such as national parks/marine parks, sanctuaries, reserve forests……"

সেই প্যারাগ্রাফেরই উপরের লাইনটি হল–

"For regulating development activities, the coastal stretches within 500 metres of High Tide Line on the landward side are classified into four categories, namely"

অর্থাৎ বলা হয়েছে যে, "ডেভলপমেন্টাল কাজে রেগুলেশনের জন্যে জোয়ার-ভাটার ৫০০ মিটারের (আধা কিমি) মধ্যে থাকা সমুদ্রতটকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে"।

কী সেই ক্যাটাগরিগুলো? সেগুলো হল– Category I (CRZ-I), Category 2 (CRZ-2), Category 3 (CRZ-3), Category 4 (CRZ-4),যদিও প্রশ্নকর্তার দেওয়া লিংকটি খুবই কঠিন ফলো করা, কারণ এর নাম্বারিং সিস্টেম বুঝা দুষ্কর, তারপরও অনেক কষ্ট করেই পুরো লিংকটিতে যা লেখা আছে তা পড়ে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সকল ক্যাটাগরির Coastal Regulation Zone বা CRZ এর জন্যই (অর্থাৎ হোক সেটা Ecologically Sensitive জায়গাযুক্ত ক্যাটাগরি CRZ-I বা অন্য কোনো ক্যাটাগরি) Permissible Activities এর মধ্যে Thermal Power plant এর জন্যে ওয়াটার ইনটেক, পরিশোধিত পানি ও সেই সঙ্গে কুলিং ওয়াটার ডিসচার্জও ইনক্লুডেড।

এই লিংকে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে এই জোয়ার-ভাটার ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকা Ecologically Critically Area (CRZ-I) সহ অন্যান্য CRZ তে কী কী ধরনের কাজ Permissible (গ্রহণযোগ্য), কী কী কাজ permissible under regulation (নিয়ন্ত্রিতভাবে গ্রহণযোগ্য) আর কী কী কাজ prohibited (নিষিদ্ধ)। এটাও জানা গেল যে CRZ-I এ কোনো নতুন কন্সট্রাকশন করার পারমিশন না থাকলেও কিন্তু ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জির প্রজেক্ট, পাইপলাইন ও ট্রান্সমিশন লাইন বসানো, ন্যাচারাল গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামও ট্রান্সফার করা যাবে সব CRZ-I এ।

বুঝলাম তো সবই, কিন্তু যা নিয়ে এত কথা সেটা মনের মধ্যে থেকেই গেল। প্রশ্নকর্তা কেন সেই Environmentally Sensitive এলাকার ভারতীয় মানদণ্ডটি দিয়ে দিলেন না, আর তার বদলে এত এত 'ফাঁকিবাজি', 'প্রতারণা', 'নতুন-পুরাতন EIA' নিয়ে এত প্যাঁচালেন কেন? এত কথা না বলে ভারতীয় মানদণ্ডটি দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত যে কীভাবে কোথায় জোচ্চুরিটা করা হচ্ছে।

যাই হোক, প্রশ্নকর্তা না হয় না দিলেন, আমরা দিচ্ছি ভারতীয় মানদণ্ডটি। দেখুন–

লিংক দেখুন–

প্রশ্নকর্তা তার লেখাতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে করা পুরানো আর নতুন EIA এর বরাত দিয়ে মিলিয়ে ঝুলিয়ে লাল কালি চিহ্নিত করে কিছু ছবি দিয়েছেন। পুরানো EIA এর থেকে যে ছবিগুলো দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে তা থেকে নির্গত SO2 ও NO2 এর কারণে সুন্দরবনের রেজাল্ট্যান্ট 24 hr concentration হবে SO2 এর জন্যে ৫0.৪-৫৩.৪ µg/m3 এবং NO2 এর জন্যে ৪৭.২-৫১.২ µg/m3¬

দেখুন–

অন্যদিকে ২০০৯ সালের National Ambient Air Quality Standard অনুযায়ী ভারতের Ecologically Critical Area এর জন্যে 24 hr Concentration হওয়া উচিৎ SO2 এর জন্যে ৮০ µg/m3 এবং NO2 এর জন্যে ৮০ µg/m3

দেখুন–

24 hr Concentration সমস্যা তো মিটল, এবার আসা যাক বাৎসরিক concentration হিসেবে ভারতীয় Ecologically Sensitive Area এর মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনায়। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সংশোধিত একটি EIA এর বরাত দিয়ে প্রশ্নকর্তা নিচের টেবিল দিয়েছেন "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক" আর্টিকেলে। এখানে দেখা যাচ্ছে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে তার প্রভাবে সুন্দরবনে রেজালট্যান্ট যে SO2 ও NO2 Concentration বাৎসরিক হিসেবে থাকবে তা হল যথাক্রমে ১৯.৩৬ µg/m3¬ ও ২৩.৯ µg/m3¬

দেখুন–

অন্যদিকে ২০০৯ সালে ভারতীয় Central Pollution Control Board প্রকাশিত National Ambient Air Quality Standard-এর মানদণ্ড অনুযায়ী Ecologically Critical Area জন্যে 24 hr Concentration হওয়া উচিত SO2 এর জন্যে ২০ µg/m3 এবং NO2 এর জন্যে ৩০ µg/m3

দেখুন–

দুইয়ে মিলিয়ে এবার কি বোঝা গেছে যে প্রশ্নকর্তা কেন Ecologically Sensitive এলাকার জন্যে ভারতীয় মানদণ্ডটির লিংক দেননি? জি, এবারও ঠিক ঠিক ধরেছেন। মানদণ্ডটি দিলেই তো প্রশ্নকর্তার হম্বিতম্বি ধরা পড়ে যেত এবং এটাও বের হয়ে আসত যে উনি যে প্রশ্নটির উপর ভিত্তি করে অ্যাত্তো বড় একটি রচনা তৈরি করেছিলেন তার পুরোটাই হাওয়ার উপর।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলেও সুন্দরবনের রেজালট্যান্ট SO2 ও NO2 Concentration শুধু যে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীই গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকবে তা নয়, বরং ২৪ ঘণ্টার ও বাৎসরিক হিসেবে, দুদিক থেকেই তা ভারতের Environmentally Critical Area এর মানদণ্ড অনুযায়ীও পুরোপুরি সিদ্ধ।

প্রশ্ন তিন–

ছাই দিয়ে নাকি ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে রামপালে, এটা কি ঠিক? "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"-এর লেখক দাবি করেছেন যদি ১৪১৪ একর জমি ছাই দিয়ে ভরাট করা নাই-ই হবে তাহলে তো অবশ্যই এই জমি ভরাটের মাটি কোথা থেকে আসবে তা তো বলা থাকত। যেমনটা বলা আছে পশুর নদী থেকে ড্রেজিং করে শুরুতে যে ৪২০ একর ভরাট করা হবে সেটার কথা।

আপনারা নাকি কথার মারপ্যাঁচে প্রতারণা করে Land Develop with fly ash এর বাংলা করেছেন "জমি ভরাট করা হবে মাটি দিয়েই, কিন্তু মাটিকে কাজের উপযোগী করতে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার হবে"?

উত্তর ৩–

অভিযোগ তো দেখা যাচ্ছে বেজায় গুরুতর। কিন্তু উত্তর ততটাই সরল, কারণ "রামপাল: বিভ্রান্তি দূর হোক"-এর লেখক বরাবরের মতো এ ক্ষেত্রেও অর্ধেক পড়ে মন্তব্য করছেন। উনি কেন ৫১ পৃষ্ঠা পড়ার পর ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠাতে চলে গেলেন ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠাটি না পড়ে সেটি জানতে ইচ্ছা করছে। ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠাটি পড়লেই তো জেনে যেতেন যে EIA তে বলা আছে ড্রেজিং করে ৪২০ একর জমি ভরাটের মাটি সংগ্রহ করা হবে, সেটা সহই টোটাল যে ৮০ লাখ ঘন মিটার 'EARTH' লাগবে (ছাই নয় কিন্তু!!!), Total Land Development এর জন্যে তার উৎস ও ব্যবস্থা সম্পর্কে বলাই আছে।

এই এত বিশাল পরিমাণ মাটি বিভিন্ন সোর্স থেকে সংগ্রহ করার জন্যে মাটির উৎসের পরিবেশগত সাসটেইনিবিলিটি ও সেই সঙ্গে মাটি পরিবহণের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে কাজটি করা হবে বলেও উল্লেখ আছে এখানে। এ ব্যাপারে যে Bangladesh Water Development Board এবং BIWTA বিশাল ভূমিকা রাখবে সেকথাও বলা আছে।

দেখুন–

"Initially, about 420 acres of land will be developed in which 350 acres will be used for plant and 70 acres for township. The total earth requirement for land development would be approximately 80 lac m3. This volume of earth material will be extracted from different sources depending on the environmental sustainability and economic efficiency. Bangladesh Water Development Board, BIWTA will play an important role during the development of land site of the power plant project. The rest of the land will be filled up by ash to be generated from coal burning for power generation."

৮০ লাখ ঘন মিটার 'EARTH' (বাংলায় যাকে বলে 'মাটি') হল সেই পরিমাণ মাটি যা দিয়ে ১৩০০ একর জমিকে অ্যাভারেজে পুরো পাঁচ ফুট উঁচু করা যায়। আর ১৩০০ একর জমি মানে কোল ইয়ার্ড (যেখানে কয়লা রাখা হবে), আর কোল অ্যাশ ডিসপোসেবল এরিয়া (মূলত অ্যাশ পন্ড) ছাড়া প্রায় পুরোটাই। আর স্বভাবতই এই ১৩০০ একরের বাইরে বাকি এলাকা অর্থাৎ 'অ্যাশ পন্ড'টিকে কোল অ্যাশ দ্বারাই 'filled' বা 'ভরাট' করা হবে।

Land Development মানে যারা ছাই দিয়ে ভরাট করা বুঝে তাদের সঙ্গে আর কতটা কথা বলা যুক্তিসঙ্গত সেটা আসলে ভাবা দরকার। রামপাল প্রজেক্টের ফিজিবিলিটি স্টাডির একটি টেবিল আছে (EIA পৃষ্ঠা ৯৬) যাতে এই প্রজেক্ট সংক্রান্ত অন্যান্য স্থাপনার জন্যে কত শতাংশ জমি বরাদ্দ হয়েছে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়।

মূল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের যে ৪২০ একর জায়গা তার বাইরে এই থার্মাল পাওয়ার জেনারেশন প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট মানুষজনের জীবনধারণের জন্যে এখানে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মসজিদ, পার্ক, হসপিটাল, খেলার মাঠ, ডরমিটরি, ক্লাব হাউস, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং, পার্কিং এরিয়াসহ আরও নানান কিছু স্থাপনা হবে।

কেউ কি কখনও শুনেছেন যে শুধু ছাইয়ের উপর এসব তৈরি করা গেছে কখনও, নাকি যায়? একটু চিন্তা করুন তো ব্যাপারটা যে একজন দাবি করছেন যে এই পুরো এলাকাটা ছাই দিয়ে ভরাট করে তার উপর এইসব স্থাপনা নির্মাণ করা হবে, এও কি ভাবা সম্ভব?

প্রশ্ন ৪-

ভারতের যে কোম্পানি রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করতে যাচ্ছে সেই NTPC এর একটি রিপোর্ট থেকে দুটি প্যারাগ্রাফ তুলে ধরে তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে,

(ক) ভারতে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহারের পরিমাণ ফ্লাই অ্যাশের উৎপাদনের সঙ্গে সন্তোষজনক নয় এবং (খ) ভারতে উৎপন্ন অতিরিক্ত ফ্লাই অ্যাশ কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরুর আগে এ নিয়ে লং টার্ম রিসার্চ হওয়া দরকার। বাংলাদেশে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার নিয়ে আপনারা এই উদ্বেগ সম্পর্কে কী বলবেন?

উত্তর ৪-

প্রথম কথা হল আকৃতিগত পরিমাপের বিচারে যেখানে মশা, পিঁপড়া এদের স্থান সংকুলান হবে কিনা সেই আলোচনা চলছে, সেখানে যদি হাতিকে টেনে এনে বলা হয়, "দেখেছো আগেই বলেছিলাম এখানে হাতির জায়গা হবে না", তাই পরিমাপে জায়গাটা আসলে ছোট, তাহলে যা অবস্থা দাঁড়ায়, এই প্রশ্নের ক-এর অবস্থাও তাই।

বাংলাদেশের রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হবে প্রতি বছর ০.৭ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারিতে "Corporate Sustainability and Responsibility, India (IndiaCSR)" আয়োজিত ফ্লাই অ্যাশের উপর যে সুবিশাল 'মেগা' কনফারেন্সটি হয়ে গেল তাতে ভারতের ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহারের বর্তমান একটি চিত্র পাওয়া যায়।

এতে দেখা যায় ভারতে বর্তমানে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ তৈরি হয়। কোথায় ০.৭ মিলিয়ন আর কোথায় ১৬০ মিলিয়ন টন! ভারতের এই ১৬০ মিলিয়ন টনের মধ্যে ৫০% শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন টন ব্যবহৃত হচ্ছে, যার অর্থ হল যে বাকি ৮০ মিলিয়ন টন উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে এবং এই বাকিটা নিয়েই ভারতের চিন্তা।

১৯৯৪ সালে তাদের উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ (চল্লিশ) মিলিয়ন টন এবং এর মধ্যে ব্যবহৃত হত ১ মিলিয়ন টন যা ছিল সে সময়ে উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশের ২.৫%। স্পষ্টতই এই অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার বেড়েছে ৮০ গুণ। নিচের ছবিতে ভারতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারের ট্রেন্ড দেখানো হল নিচে–

সূত্র:

কিন্তু ভারত এত বিপুল পরিমাণে ফ্লাই অ্যাশ উৎপন্ন করে প্রতি বছরে যে ৮০ মিলিয়ন টন ব্যবহৃত হলেও যে ৮০ মিলিয়ন টন উদ্বৃত্ত থাকছে সেটার জন্যে তারা চিন্তিত হতেই পারে এবং এ ব্যাপারে কী কী পদক্ষেপ নিলে এত বিপুল পরিমাণ বাড়তি ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়ে তারা নানান পরিকল্পনা হাতে নিতেই পারে, বরং না নিলেই সেটা হত চিন্তার বিষয়।

কিন্তু এটা একেবারেই বোধগম্য হল না যে তাতে বাংলাদেশের সমস্যাটা কোথায়। সেই ১৯৯৪ সালে ভারত যে ৪০ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ উৎপন্ন করত, এই এত বছর পরে এসেও তো বাংলাদেশ এখনও ১ মিলিয়ন টনও উৎপন্ন করছে না। আর ১৯৯৪ সালে উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশের মধ্যে যে ১ মিলিয়ন টন ভারত ব্যবহার করত, রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্নই হবে সেটারও দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মাত্র ০.৭ মিলিয়ন টন।

এ ক্ষেত্রে তাই ভারত বা ভারতের NTPC কী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগুবে, বাংলাদেশে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারের ব্যাপারে সেই সব কাসুন্দি নিয়ে আমাদের কেন মাথা ঘামাতে হবে তা বোধগম্য নয়। যেখানে ভারতে শুধু সিমেন্ট খাতেই ৩৫ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে আমাদের সিমেন্ট কারখানা বা অন্যান্য নির্মাণকাজে তো এই ০.৭ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশের ব্যাবহার খুব ভালোভাবেই হয়ে যাবে।

এবার আসি প্রশ্ন খ-এর ব্যাপারে। ভারতের NTPC এর অ্যাপ্রাইজাল কমিটি এগ্রিকালচার অর্থাৎ খাদ্যশস্য উৎপাদনে তাদের ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার নিরাপদ করতে যে আরও রিসার্চের কথা বলেছে সেটা এখানে রামপালের ক্ষেত্রে কী প্রসঙ্গে বলা হল তা-ও বোধগম্য নয়। ভারতে প্রতি বছর ৮০ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ উদ্বৃত্ত থাকছে দেখে যে যে খাতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার কম সেগুলোতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা করছে।

নিচে ভারতে খাত হিসেবে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারও দেখানো হল। যেহেতু কৃষিখাতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার সবচেয়ে কম এখন সে কারণেই ভারত এই খাতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা করছে।

সূত্র:

ভারত তাদের দেশের নানান জাতের, নানান খনি থেকে আহরিত বারোয়ারি কয়লা ব্যবহার করে তাদের ১০০ এর উপর অলরেডি চালু থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টে। এই কয়লাগুলোর অধিকাংশই নিম্নমানের Lignite যাতে অ্যাশ কনটেন্ট ভ্যারি করে ৩৬% থেকে ৪২%। সালফারসহ অন্যান্য পদার্থের মাত্রায়ও বেশ ভালো রকম তারতম্য থাকে বিভিন্ন খনির কয়লার মধ্যে। এ কারণে একেক থার্মাল প্ল্যান্টের কোল অ্যাশের মান একেক রকম।

ফলে ওই কয়লা থেকে উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশের মানেরও তারতম্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। হয়তো এ কারণেই NTPC এর অ্যাপ্রাইজাল কমিটি তাদের ২০১০ সালের রিপোর্টে মন্তব্যটি করা হয়েছে যে কৃষিখাতে ব্যাপক হারে ব্যবহারের আগে এর স্বাস্থ্যগত ইমপ্যাক্ট যাচাই করা প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রের সাম্প্রতিক তথ্যে কিন্তু সেই NTPC এর কমিটি মেম্বার এবং সেই সঙ্গে "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"-এর লেখকের খুশি হওয়ার কথা এটা জেনে যে এরই মধ্যে (২০১৩) বেশ কিছু রিসার্চের রেজাল্ট এসেছে ভারতের ভূমিতে অ্যাশ ব্যবহারের উপর। এইসব ফলাফলে দেখা যায় যে, ফ্লাই অ্যাশ প্রয়োগে গাছের বৃদ্ধি ব্যাপক বেড়েছে, মাটির বিভিন্ন ক্যারেকটারিসটিক্স ইমপ্রুভ করেছে।

দেখুন এখানে–

এ ক্ষেত্রে আবারও সেই প্রশ্ন, জমিতে ভারতীয় কয়লা থেকে উৎপন্ন অ্যাশের ব্যবহারের ব্যাপারে বাংলাদেশকে টেনে আনার মানেটা কী? বাংলাদেশ কি ভারত থেকে তাদের ফ্লাই অ্যাশ আমদানি করে এনে সেটা এখানকার ফসলি জমিতে সার হিসেবে প্রয়োগ করবে? নাকি ভারতের কয়লা ব্যবহার করবে রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে? রামপালের ক্ষেত্রে দুটোর একটিও প্রাসঙ্গিক নয়।

রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে যে কয়লা ব্যবহৃত হবে তা আনা হবে Australia এবং Indonesia (ব্যাকআপ থাকছে সাউথ আফ্রিকা) থেকে। এটি হবে উন্নতমানের বিটুমিনাস ও সেমিবিটুমিনাস কয়লার ব্লেন্ড যাতে অ্যাশ কনটেন্ট ১৫%, সালফার ০.৬% বা তার কম, নাইট্রোজেন কনটেন্ট ১.৬৮% এবং অন্যান্য কনটেন্টসমূহও প্রায় জানা মাত্রায় থাকছে।

তাই কী কী element কত পরিমাণ থাকতে পারে উৎপাদিত ফ্লাই অ্যাশে তা তো অজানা নয়। কয়লাতে যা থাকবে তার চাইতে অন্যকিছু তো আর আকাশ থেকে আসবে না কোল অ্যাশে। আর তারপর যে ফ্লাই অ্যাশ এত বছর ধরে এত কাজে ব্যবহার হচ্ছে সেই ফ্লাই অ্যাশে বিভিন্ন element এর মাত্রা নির্ধারণ পদ্ধতি তো ওয়েল ডিফাইন্ড। US Geological Survey এর ওয়েবসাইটে ফ্লাই অ্যাশে উপস্থিত বিভিন্ন element পরিমাপের পদ্ধতির বিস্তারিত বর্ণনা আছে এখানে–

রামপালে যে ধরনের কয়লা ব্যবহৃত হবে সে ধরনের কয়লা থেকে উৎপন্ন অ্যাশের ব্যাপারে তাই ভারতের নিজেস্ব নানান মানের কয়লা থেকে উৎপন্ন মিক্সড অ্যাশের তুলনা একেবারেই আপেলের সঙ্গে কমলার তুলনার সামিল। তার উপর আবার কৃষিকাজে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার নিয়ে NTPC এর সংশয়ের কথা তুলে ধরলেন ''রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"- এর লেখক, যেখানে EIA তে কৃষিকাজে অ্যাশ ব্যবহার করা হবে সব বাদ দিয়ে এমন কোনো প্রসঙ্গই আসেনি। বাংলাদেশে শুধু সিমেন্টে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার শুরু হলেই তো বছরে ০.৭ টন ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহৃত হয়ে কিছু উদ্বৃত্ত থাকবে না।

এ ক্ষেত্রে ভারতে যে এ বছর ৩৭ মিলিয়ন টন ফ্লাই অ্যাশ শুধু সিমেন্ট তৈরিতেই ব্যবহৃত হয়েছে তা কি ''রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক'-এর লেখকের চোখ এড়িয়ে গেল? আর যদি তাই হয় তবে কেন তার চোখ সবসময় relevant ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যেয়ে অপ্রাসঙ্গিক আর incoherent সব উদাহরণে আটকে যায় তা ভাবার বিষয় বটে!!

আর যে বিষয়টি দুর্বোধ্য তা হল সবকিছুতে লেখকের এই ভারতের প্রতি পক্ষপাতের কারণটা কি ভারত তাদের বিশাল পরিমাণ ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার নিয়ে পরিকল্পনা করেছে, তাই আমাদেরকেও আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণ ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে চিন্তা করে মাথার চুল ছিড়তে হবে। ভারতে একটা ২৫ কিমির গাইডলাইন আছে (ভারত নিজে সেটা না মানলেও) বাংলাদেশকে মানতেই হবে 'ভীষণ প্রাসঙ্গিক' ধরে নিয়ে (কতটা প্রাসঙ্গিক তা তো বোঝাই গেল প্রশ্ন ১ এর উত্তর থেকে)।

ভারতের Air Pollution Regulation এর মানদণ্ড মেনেই বাংলাদেশকে পলিউশন কনট্রোলে নামতে হবে (যদিও শুধু ভারত কেন, বাংলাদেশের মানদণ্ডও বাংলাদেশে লঙ্ঘিত হয়নি) এ রকম পক্ষপাত কিন্তু এখন বেশ একটা প্যাটার্নে চলে এসেছে। যা সত্যিই আশ্চর্যজনক বটে!!!

প্রশ্ন ৫-

জমি অধিগ্রহণ ছাড়পত্র পাবার আগেই সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন "রামপাল: বিভ্রান্তি দূর হোক" লেখক? সত্যি নাকি?

উত্তর ৫-

জি সত্যি। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে লেখক সেই পুরোনো কাসুন্দি আবারও ঘেঁটেছেন। এটা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে লেখক জমি অধিগ্রহণ ও জমি হস্তান্তর এই দুটি বিষয় নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করছেন পুরো প্রক্রিয়াটি না বুঝেই হোক অথবা সব জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে জল ঘোলা করবার জন্যেই হোক।

এ ব্যাপারে আগেও বলেছি, এখনও বলছি এবং খুব স্পষ্ট করেই বলছি– অধিগ্রহণের প্রমাণ জমা দেওয়া হয়েছে IEE রিপোর্টের সঙ্গে, লোকেশন ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার আইনগত পূর্বশর্ত হিসেবে। লোকেশন ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর জমি হস্তান্তর সম্পন্ন করা হয়েছে জানুয়ারি ২০১২ সালে EIA ও এর রিপোর্টসহ পরিবেশ ছাড়পত্র পাবার আইনগত পূর্বশর্ত হিসেবে।

আমাদের লেখা ''রামপাল অভিযোগনামা''র দ্বিতীয় পর্বে EIA এর সঙ্গে সংযুক্ত অধিগ্রহণকৃত জমির 'দখল হস্তান্তর প্রত্যয়নপত্র'টিও প্রকাশ করা হয়েছে। আরেকবার দেখে নিন। পাঠকের সুবিধার্থে এ প্রসঙ্গে সেখানে যা লিখেছিলাম তা আবার তুলে দিচ্ছি এখানেও–

"২০১০ সালে যখন রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ছাড়পত্র চেয়ে আবেদন করা হয় তখন IEE রিপোর্টের সঙ্গে legal requirement হিসেবে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে প্রাপ্ত দাগ নাম্বার ও জমির মালিকদের তালিকাসহ take over certificate দাখিল করা হয়েছিল। কিন্তু IEE রিপোর্টের ভিত্তিতে ছাড়পত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন বা জমি হস্তান্তর করা হয়নি। ২০১১ সালের মে মাসে Location Clearance পাওয়ার পরই ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়।"

এই ধরনের একটি আইনগত দালিলিক বিষয়ের প্রেক্ষিতে বিবিসির রিপোর্টিং করার উদাহরণ শুধু যে হাস্যকর তাই-ই নয়, আপেলের প্রমাণ দিতে আমলকি সামনে এনে হাজির করার মতোই!

প্রশ্ন ৬-

রামপালের জন্যে করা EIA টা নাকি লোকদেখানো ছিল? সিরিয়াসলি করলে নাকি সুন্দরবন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যেত?

উত্তর- ৬

EIA টা লোকদেখানো ছিল নাকি সিরিয়াস ছিল, সে ব্যাপারে এ পর্যন্ত প্রচুর আলোকপাত করা হয়েছে, যুক্তিখণ্ডন করা হয়েছে। আর কিছু বলার নেই, যদি এখনও সন্দেহ থাকে যে Environmental Impact Assessment লোকদেখানো তাহলে দয়া করে লেখকদের স্বীকৃত Independent EIA টি দেখুন এবং বুঝে নিন যে যারা এই CEGIS এর করা EIA টি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন, আর কী কী বিষয় অন্তর্ভূক্ত করলে CEGIS এর EIA টি তাদের চোখে সিরিয়াস হত এবং সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হত।

একবার তাদের নিজেদের করা Independent EIA টি দেখে নিলে আমাদের আর এই বিষয়ে চোখে আঙুল দিয়ে কিছুই দেখিয়ে দেবার দরকার পড়বে না।

প্রশ্ন ৭-

সুন্দরবন বাইপাস করে মংলা বন্দরে যাওয়ার নাকি আরেকটা রাস্তা আছে? রীতিমতো ম্যাপ দেখিয়ে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কী মতামত?

উত্তর ৭-

সুন্দরবন বাইপাস করে যদি মংলায় পৌঁছুনো যায়ই তাহলে তো রামপালে পৌঁছুতেও কোনো সমস্যা দেখি না। সে ক্ষেত্রে জাহাজ চলাচলজনিত নদীদূষণ, জীববৈচিত্র্যে হুমকি ইত্যাদি অনেক অভিযোগ থেকেই রামপালের প্রকল্পটি মুক্তি পাবে। ভালোই তো!!!

এ ব্যাপারে একটা কথা না বলে পারছি না। অভিযোগকারীরা আসলে কি মংলা বন্দরের উন্নতি চান কিনা বা আদৌ এই বন্দরটি থাক সেটাও চান কিনা, এটি কখনওই স্পষ্ট হয়নি। কেননা, রামপালকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে নির্বাচনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে তার অনেকগুলোই (বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিসংক্রান্ত) মংলা বন্দরের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে।

কিন্তু রামপালের বিরোধিতাকারীরা মংলা বন্দর বিষয়ে কখনও সরব হন না বা লং মার্চের ঘোষণাও দেন না। এর কারণ হল তাহলে খুলনাবাসীর আয়-রোজগারের উপর সরাসরি আঘাত আসে। আর উনারা ভালো করেই জানেন যে মংলা বন্দরের ব্যাপারে লং মার্চ করলে সেই লং মার্চ নিয়ে উনারা কখনওই মংলা পৌঁছাতে পারবেন না।

ঠিক একইভাবে উনারা কখনও সুন্দরবনে পর্যটনের বিপক্ষে লং মার্চ করেছেন কি? না, করেননি। করেননি, তার কারণ এ ক্ষেত্রে লং মার্চ করতে গেলে ঢাকা থেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের লোকজনদের, যারা সুন্দরবনের পর্যটক, তাদেরকে সঙ্গে পাওয়া যাবে না। তাই সেই ঝুঁকি তারা নিবেনও না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলবেন এখানে ক্ষতি ও লাভের সিদ্ধান্ত ট্রেডঅফ করে। অর্থাৎ কিছু কমবেশি করে কমপ্রোমাইজ করলে এ ক্ষেত্রে কিন্তু বন্দর বা পর্যটন টিকিয়ে রাখা যায়, আবার সুন্দরবনও মোটামুটি ঠিক থাকে।

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে রামপালের ব্যাপারে কিন্তু তাদের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। কেন? কারণ হল এ ক্ষেত্রে সরকারের বিপক্ষে সরাসরি দাঁড়ানো যাচ্ছে। আর এটা তো জানা কথাই যে মানুষকে যে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দেওয়া সবচাইতে সহজ কাজ।

যাই হোক, বিকল্প রাস্তার খোঁজ পাওয়া গেল, খুব ভালো কথা। কিন্তু এই বিকল্প রাস্তার খোঁজ যে দিলেন এতদিন পরে "রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"-এর লেখক, তা কি আসলে রামপাল প্রকল্পের ভায়াবিলিটি বাড়ানোর জন্য বললেন, নাকি রামপাল বিরোধিতার সঙ্গে যে মংলা বন্দর বিরোধিতা লুকিয়ে আছে তা থেকে গা বাঁচানোর জন্য বললেন, সেটা বোঝার ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি।

প্রশ্ন ৮-

"রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক" এ তো লেখক দাবি করছেন তাদের এই আন্দোলন জনস্বার্থে করা। আপনারা কি জনস্বার্থে করা আন্দোলনের বিপক্ষে?

উত্তর ৮-

না। আমরা জনস্বার্থে করা কোনো আন্দোলনেরই বিপক্ষে নই, বরং পক্ষে। আর দৃঢ়ভাবে এও বিশ্বাস করি যে জনস্বার্থে করা সকল আন্দোলনই ভালো এবং জনস্বার্থে যে আন্দোলন তার পিছনে জনসমর্থন আসতেও সময় লাগে না। এ রকম অনেক আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে এবং এ রকমই একটি আন্দোলনের ফসল হিসেবেই বাংলাদেশের জন্ম।

তবে মিথ্যা কথা বলে, অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে, Ulterior Motive তাড়িত হয়ে, আন্দাজে হাতি-ঘোড়া নামিয়ে এনে যে আন্দোলন, তার অসারতা বুঝতেও সংশ্লিষ্টগণের বেশি সময় লাগে না। এ ধরনের প্ররোচনামূলক আন্দোলনের শুরুতে হয়তো কিছু সমর্থন পাওয়া যায়, কিন্তু তারপরই আন্দোলনের অসারতা বের হয়ে আসে এবং সব ছাপিয়ে সার্বিক জনকল্যাণটাই তখন মূখ্য হয়ে দেখা দেয় জনসাধারণের কাছে।

অনেক সময় এ ধরনের আন্দোলনে স্থানীয়দের সাপোর্টও পাওয়া যায় সাময়িকভাবে। এ ব্যাপারে আশির দশকে কামারখালী ব্রিজ-বনধ আন্দোলনের কথা মনে পড়ছে। ব্রিজ উদ্বোধন হবার পরপরই হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ এসে পালাক্রমে ব্রিজে শুয়ে থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল জীবিকা হারানোর। বাস-ট্রাক-গাড়িকে বাধ্য করেছিল ফেরি দিয়ে পার হতে, মানুষজনকে বাধ্য করেছিল খেয়া ব্যবহারে, ঘাটের হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করতে।

কিন্তু সার্বিক ও বৃহত্তর জনস্বার্থে ও জনকল্যাণের বিচারে কিন্তু স্থানীয়দের ওই আন্দোলনের অসারতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল এবং ক্ষণিকের ওই আন্দোলন আর হালে পানি পায়নি।
"রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক"-এর লেখক নিজেদের চিপকো, চিকো আন্দোলনের সমকক্ষ ভেবে আত্মপ্রসাদ পেতে চান, ভালো কথা। কিন্তু আপনাদের আন্দোলনে সার্বিক জনস্বার্থটা কোথায়, সেটা তো আগে প্রমাণ করে দেখানো লাগবে, নাকি?

এ জাতীয় ভিত্তিহীন আর অতিরঞ্জিত আন্দোলনের একটি ভীষণ ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে প্রকৃত জনস্বার্থ নিশ্চিত করার বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরে যাওয়া। যে কোনো থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্টের যথাযথ মনিটরিং এবং সঠিক ডিজাইন, নির্মাণ আর পরিচালনা নিশ্চিত করা। আর এ ব্যাপারে সরকারকে বেশ কিছু পরামর্শসহ একটি মতামত লিখেছিলাম আমাদের চার পর্বের সেই সিরিজের আগেই।

আমদের চার পর্বের রামপাল অভিযোগনামার প্রেক্ষিতে আরও তিনটি সম্পূরক প্রশ্ন এসেছে হাতে, সেগুলো সম্পর্কে জানাব দুই একদিনের মধ্যেই।

ধন্যবাদ।

ড. আঞ্জুমান ইসলাম: পানি পরিশোধন ও পরিবেশ প্রকৌশলী।

কাজী আহমেদ পারভেজ: শিক্ষক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।