বৈশ্বিক পুঁজিবাদে মজুরি নির্ধারণের রাজনৈতিক অর্থনীতি

এম এম আকাশ
Published : 22 Nov 2013, 06:45 PM
Updated : 22 Nov 2013, 06:45 PM

পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা বহু আগে থেকেই বলা হচ্ছে। কেবল পোশাকই নয়, সমগ্র শিল্পে এ ধরনের মজুরি নির্ধারণ করার রীতি কেবল বাংলাদেশে নয়; সকল সভ্য দেশেই রয়েছে। এ ধরনের আইনের যুক্তি অনেকটাই স্বতঃসিদ্ধ। কেননা যে কোনো শ্রমিককে কর্মে নিয়োজিত করার পূর্বশর্ত– শ্রমিকের শ্রমশক্তি পুনরোৎপাদনের জন্য যা 'ন্যূনতম' তা তাকে প্রদান না করলে শ্রমশক্তির সরবরাহ চলমান থাকবে না।

পুঁজিবাদী সমাজে 'ন্যূনতম' মজুরির এই শর্তটির সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন কার্ল মার্কস 'পুঁজি'র প্রথম খণ্ডে। প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটি হচ্ছে–

''If the owner of labour power works today, tomorrow he must again be able to repeat the same process in the same conditions as regards health and strength. His means of subsistence must therefore be sufficient to maintain him in his normal state as a laboring individual. His natural wants, such as food, clothing, fuel, and housing, vary according to the climate and other physical conditions of his country. On the other hand, the number and extent of his so called necessary wants, as also the modes of satisfying them, are themselves the product of historical development, and depend therefore to great extent on the degree of civilization of a country, more particularly on the conditions under which, and consequently on the habits and degree of comfort in which, the class of free labourers has been formed."

মার্কসের মডেলে মালিকশ্রেণি (যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের মালিক) শ্রমশক্তির মূল্য বাবদ এতটুকু দেওয়ার পর এর উপরে শ্রমের যে বর্ধিত উৎপাদনশীলতা ও উদ্বৃত্ত থাকে সেটি গ্রহণ করবে। সেটি হবে মুনাফা। সে মুনাফা থেকে মালিকের ক্রমশ উন্নতি হবে।

এই উন্নতির দুই রকম বহিঃপ্রকাশ সম্ভব। একটি হচ্ছে বিলাসী ভোগব্যয়। আরেকটি হচ্ছে ওই উদ্বৃত্তের একটি অংশ উৎপাদনশীলভাবে বিনিয়োগ করে কারখানার আয়তন বৃদ্ধি তথা ক্রমাগত পুঁজির কেন্দ্রীভবন। যার ফলে আবার শ্রমিকদের বর্ধিত কর্ম নিয়োজনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণিরও আয়তন বৃদ্ধি তথা কেন্দ্রীভবন ঘটবে।

মার্কসের এ বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের দেশে এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। তবে আমাদের দেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এই দেশের পুঁজিবাদী বিকাশে নেতৃত্ব দিচ্ছে শ্রমঘন রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প।

এ ধরনের উৎপাদনশীল পুঁজিবাদে শোষণ রয়েছে বটে, তবে তার একটি উৎপাদনশীল চরিত্রও রয়েছে। এ কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎপাদনের স্বার্থেই শ্রমিককে সে তার ন্যূনতম পাওনাটুকু দিতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমাদের মতো অনুন্নত পুঁজিবাদে প্রথম প্রজন্মের পুঁজিপতিরা উৎপাদনের চেয়ে বেশি আগ্রহী মুনাফায়।

এরা কেউ কেউ ধাপে ধাপে বর্ধিত পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের চেয়ে এক লাফে সমস্ত মুনাফা পেতে ইচ্ছুক। এদের অনেককেই সেই লোভী কৃষকের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যারা রাজহংসকে জবাই করে তার পেটের সবগুলো সোনার ডিম একসঙ্গে পেতে চায়।

এ ধরনের পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রাপ্তির অধিকার স্বীকার করেন না বা করলেও সেটি যেন না দিতে পারলেই তারা খুশি হয়। এদের ভোটের উপর প্রধানত নির্ভরশীল ইএগঊঅ নেতৃত্বও তাই 'ন্যূনতম' মজুরিটুকুও না দেওয়ার জন্যই সচেষ্ট থাকে সবসময়। আমরা জানি, দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধেই যায়।

তবে কোনো বিশেষ শিল্পের কোনো বিশেষ কারখানার যদি সেই ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তারা তখন কিন্তু বাজারে টিকতে পারে না। তারা ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যায়।

বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে— এটাও পুঁজিবাদেরই নিয়ম। পুঁজিবাদে সব কারখানাই যে টিকবে, এ কথা সত্য নয়। কোনো কোনো কারখানা মুনাফা করবে, কোনোটি করবে না। মুনাফার শর্ত– শ্রমিকদের দিয়ে উৎপাদন করানো। আর শ্রমিকদের দিয়ে উৎপাদন করানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে, তাদের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি দেওয়া। এ ন্যূনতম শর্ত যে সকল কারখানা পূরণ করতে পারে না তাদের বাজারে টিকে থাকারও কোনো যৌক্তিকতাও নেই এবং তারা থাকেও না। এটিই অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিষ্ঠুর নিয়ম।

এখন বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে সমস্ত অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশের শ্রম উৎপাদনশীলতা উঁচুতে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মজুরি অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কারণে সেখানে মুনাফার হারও কমে এসেছে । সেখানে যে সব পণ্য উৎপাদন করছে সেগুলো অত্যন্ত পুঁজিঘন, শ্রমঘন নয়।

কেননা শ্রমঘন পণ্য উৎপাদন করতে গেলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা অনিবার্যভাবে হ্রাস পাবে এবং তখন শ্রমের মূল্য বাবদ যে দাম পরিশোধ করতে হয়, তা দেওয়ার পর মুনাফা অস্বাভাবিক স্তরে ( সুদের হারের চেয়ে নিচে!) নেমে যায়। একটি উপায় হচ্ছে নিজস্ব তৈরি পোশাকের দাম বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু তাদের বাজারে সেটি সাধারণ ভোক্তারা অত দামে কিনতে রাজি নয়।

এ কারণে বিদেশি পুঁজিপতিরা নিজেদের দেশে শ্রমঘন পণ্য আর উৎপাদন করছে না। সেটি উৎপাদন করলে একদিকে ক্ষতি। অন্যদিকে সে ক্ষতি পোষানোর জন্য শ্রমিকের মজুরিও তারা কমাতে পারছে না। এখানে উন্নত অর্থনীতির সাপেক্ষে শ্রমের উৎপাদন-পুনরুৎপাদনের খরচের মধ্যে এমন অনেক বিষয় ঢুকে গেছে যেগুলো নৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে তারা মেনে নিতে বাধ্য।

যেমন– আমেরিকার একজন শ্রমিককে পোশাক, খাদ্য, চাহিদা, যাতায়াতের জন্য গাড়ি ও অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ করে দিতেই হবে। এখন আমেরিকান পুঁজিপতি সে দেশের শ্রমিককে বাংলাদেশের মজুরি দিয়ে উৎপাদন করাতে পারবে না।

এক কথায়, খুব শ্রমঘন পণ্য উৎপাদন যে প্রযুক্তি দিয়ে করা হয় সেটি আর উন্নত পুঁজিবাদী দেশে সম্ভব নয়। তারা এখন কী করছে? উন্নত বিশ্বের সকল পুঁজিপতি আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজন তৈরি করছে। সেই শ্রম বিভাজন অনুযায়ী শ্রমঘন পণ্যগুলো তুলনামূলক কম মজুরি যেখানে, একই সঙ্গে ন্যূনতম মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করার সক্ষমতাও যাদের রয়েছে, সে সব দেশে স্থানান্তরিত করে উৎপাদনের জন্য দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বায়নের এই সুযোগটি গ্রহণ করে কোনো কোনো দেশ রপ্তানিমুখী শ্রমঘন শিল্পায়নের পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এরাই বর্তমানে উন্নয়ন লিটারেচারে 'উদীয়মান ব্যাঘ্র' বা 'মধ্যআয়ের দেশ' হিসেবে পরিচিত। সেখানে কিছু উন্নত ব্রান্ডের পোশাকও তৈরি হচ্ছে। এই মাঝারি মাত্রা এতদিন দখল করে রেখেছিল মধ্যআয়ের দেশ বা আমাদের চেয়ে একটু উন্নত দেশ অর্থাৎ চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশ।

কিন্তু যে ব্রান্ডের পোশাকগুলো আরও নিম্নস্তরের অর্থাৎ যেগুলি তৈরিতে আরও বেশি শ্রমিক লাগে এবং সেই শ্রমিক নিয়োগ করতে যে ব্যয় হয়, সেটি চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ায় পোষায় না, সেগুলির কী হবে? তারা যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে আরও অনুন্নত, আরও শ্রমঘন, আরও কম মজুরির দেশে সেই উৎপাদনগুলি স্থানান্তরিত করা।

এ কারণেই বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিম্নমানের পোশাক তৈরি দিয়ে শুরু করতে হয়েছে। এটি তৈরি করতে বাংলাদেশ তখন রাজি হয়েছে এই কারণে যে, এ দেশের কৃষিখাতে তখন মজুরি ছিল খুব কম। সুতরাং এর চেয়ে সামান্য বেশি মজুরি দেওয়ায় শ্রমিকের অভাব হয়নি।

আর বিশেষ করে এ খাতটিতে যেহেতু নারীরা কাজ করছে, সুতরাং নারীদের অপারচুনিটি কস্টের (সুযোগ ব্যয়) ওপর নির্ভর করছে এ মজুরির সীমা কত নিচুতে ঠেলে দেওয়া হবে। যেহেতু নারীদের অপরচুনিটি কস্ট প্রায় শূন্য, চাকরিই ছিল না অতীতে, অধিকাংশ সময়ে গৃহকাজই করতে হত।

অর্থাৎ যে তরুণীরা পোশাক খাতে কাজ শুরু করেন, সেই তরুণীরা আগে বাবার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন; আর রান্নাবান্না কিংবা ঘর-গেরস্থ সামলাতে মাকে সাহায্য করতেন। সুতারাং তাদের কাছে যে কোনো মজুরিই প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। তাদের কাছে তখন এটি কেবল মজুরিই নয়; গৃহের কষ্টদায়ক শ্রম থেকে মুক্তিও বটে। সুতরাং প্রথম দিকে এই পোশাক শিল্প মুক্তির সুযোগ করে দিয়েছে। তবে স্বল্পতম মজুরি ও তীব্রতম শোষণের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছিল।

উন্নত দেশগুলির শ্রমিকদের আগের ইতিহাসে যদি যাওয়া হয়, দেখা যাবে, সেখানেও নারী ও শিশু শ্রমিকদের মানবেতর মজুরি দিয়ে প্রথমে শোষণ করা হয়েছে। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের পুঁজিবাদী শোষণের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের নারী শ্রমিকরা প্রায় দুই দশক অর্থাৎ আশির দশক এবং নব্বইয়ের দশক অতিক্রম করেছেন। পুঁজিবাদের গতিশীলতা এ রকম রক্তাক্তভাবেই অর্জিত হয়েছে। কিন্তু ২০০০ সালের পরে আমাদের অপেক্ষাকৃত সাবালক পুঁজিবাদকেও তার মজুরি বাড়াতে হবে!

কেন তা অনিবার্য সেটাই এখন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। এই গতিশীল ব্যাখ্যার যুক্তিটা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের বিস্তৃতি ঘটছে অসমভাবে। সর্বত্র সমানমাত্রায় তা বিকশিত হচ্ছে না। সবচেয়ে ওপরে ছিল আমেরিকা। তার সঙ্গে রয়েছে সমপর্যায়ের গুটিকয়েক পুঁজিবাদী দেশ। তারপর রয়েছে মাঝামাঝি কয়েকটি মধ্যআয়ের দেশ। এরপর রয়েছে বাংলাদেশের মতো কতগুলো নিম্নআয়ের দেশ।

এখানে স্বল্পআয়ের দেশের তুলনায় মধ্যআয়ের দেশে মজুরি বেশি। আবার মধ্যআয়ের তুলনায় আমেরিকার মতো দেশে মজুরি বেশি। এরূপ পরিস্থিতিতে শ্রমবিভাজন হবে নিম্নরুপ– সবচেয়ে শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে বাংলাদেশে, মাঝারি শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে। আর সবচেয়ে কম শ্রমঘন প্রযুক্তি থাকবে যুক্তরাষ্ট্রে।

অপেক্ষাকৃত শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে যে উচ্চ মুনাফা হয়, সেটি যদি জাতীয়ভাবে সে দেশেই পুনঃনিয়োগ করা হয় তাহলে সেখানেও পুঁজির ঘনত্ব বাড়তে থাকে। এজন্যই জাতীয়তাবাদী চীন এবং ভারত চিরকাল মাঝারি স্থানে থাকবে না। তারা উচ্চ আয়ে যেতে চাইবে। বিষয়টি পরিযায়ী পাখির মডেলের সাহায্যে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

'ফ্লাইংগিজ মডেল' অনুসারে, সবচেয়ে উপরে থাকে একটি পাখি, মাঝে দুইটি আর নিচে চারটি। দ্বিতীয় স্তরে যার অবস্থান, সে চায় প্রথম স্তরে যেতে। আর প্রথম অবস্থানে কোনো সংকট তৈরি হলে ওই স্তরের সদস্য নিচে নেমে যায় এবং সেখানে একটি শূন্যতা তৈরি হয়। সেই শূন্যতা পূরণ করে দ্বিতীয় স্তরের কেউ।

'৯০-এর পর বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বপুজিবাদী কেন্দ্রগুলিতে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশে সেই সুযোগগুলো তৈরি হচ্ছে। উচ্চআয়ের দেশগুলোর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ায় মধ্যআয়ের দেশগুলো উচ্চআয়ের দিকে যেতে চাচ্ছে। 'ইকোনমিস্টে'র মতো আমেরিকাপন্থী পত্রিকা বলতে বাধ্য হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দী হবে চীন কিংবা এশিয়ার শতাব্দী।

তার মানে আমেরিকার পুঁজিবাদ এতটাই পরিপক্ক পর্যায়ে চলে গেছে যে, সেখানে মুনাফার পতন হচ্ছে। এই পুঁজি হয় চীন, ভারত, নয়তো বাংলাদেশে আনতে হবে অথবা তাদেরকে বাজারে জায়গা করে দিতে হবে। ঠিক তাই হয়েছে! চীন আমেরিকার বাজার দখল করে নিয়েছে।

এ কারণে চীন ধীরে ধীরে মধ্য পর্যায়ের পণ্য রেখে উচ্চ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। চীন যতটা ওদিকে যাবে, ততটাই ওদের মজুরি বেড়ে যাবে। চীনে মজুরি বাড়বে যেই পরিমাণে, সেই পরিমাণে তাকে শ্রমঘন পণ্য তৈরি ছাড়তে হবে। তখন ওই জায়গায়ও শূন্যতা তৈরি হবে। তখন বাংলাদেশের মতো নিচের দেশগুলিকে সেই শূন্যতা পূরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ যদি সেখানে যায়, তবে আগে যে মজুরি ছিল, সেটি ধাপে ধাপে বাড়বে। নব্বই সালের পর বাংলাদেশে সে সুযোগটা তৈরি হয়। ভিয়েতনাম-পাকিস্তান-কম্বোড়িয়ার মতো বাংলাদেশের সমপর্যায়ভুক্ত দেশগুলিতে এখন ন্যূনতম মজুরি বেড়ে ৮০ ডলার হয়ে গেছে। ৭৭ টাকা=১ ডলার ধরলে এটির পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় হবে ছয় হাজারের চেয়ে একটু বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ৫৩০০ টাকার চেয়ে একটু বেশি।

এখন আমরা চীনের বাজার দখল করব বলে ভাবছি এবং চীনে ন্যূনতম মজুরি ১৬৮ ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৩ হাজার টাকা। ভারতেও মজুরি প্রায় ৮০০০ টাকার সমান। এই অবস্থায় এখন চীন ও ভারতের বাজার দখল করতে ওর চেয়ে কম মজুরি রেখে একই প্রযুক্তি আনতে পারলে আমরা যেমন প্রতিযোগিতা করতে পারব, তেমনি শ্রমিকদের শ্রমের বর্ধিত দামও দিতে পারব।

এ সুযোগটা আগে ছিল না, এখন হয়েছে। 'ফ্লাইংগিজ মডেল' অনুসারে এ সুযোগটা এসেছে। এই সুযোগ পুঁজিপতিদের কেউ কেউ ধরতে পেরেছেন। তবে সবাই না। যারা ধরতে পেরেছেন, তারা মজুরি বাড়াতে দ্বিমত পোষণ করবেন না। হয়তো আট হাজার দিতেও রাজি হবেন। কিন্তু যারা সুযোগটা ধরতে পারেনি বা ধরারই যাদের উপায় নেই, তারা ন্যূনতম মজুরি ৬০০০ টাকার উপরে দিতে রাজি হবেন না। কেননা এটি দিতেতে হলে পণ্য হালনাগাদ ও পুঁজি বাড়াতে হবে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মাধ্যমে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে শ্রমিককে বেশি মজুরি দিয়ে, মুনাফা বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার এই প্রণালীকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন 'আপেক্ষিক শোষণ'। বাংলাদেশের অধিকাংশ মালিক এই প্রণালী গ্রহণ করেননি। তাদের নিজস্ব নিয়মে তারা চরম শোষণ করে চলেছেন। 'চরম শোষণ' হচ্ছে মজুরি স্থির রেখে ওভারটাইম বা খাটুনি বাড়ানো অথবা মূল মজুরিটা কমিয়ে রাখা।

বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা নিয়ে শ্রমিকদের আপত্তিটা এই জায়গাতে বলে তারা আমাকে জানিয়েছেন। মূল মজুরিটা সব গ্রেডেই সম অনুপাতে বাড়ানো হোক এবং সোয়েটার কারখানাগুলোর 'পিস রেট' টাইম রেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থির করা হোক এটুকুই তাদের মূল দাবি।

এখন এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব, যারা এই ন্যূনতম মজুরি প্রদানে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, তাদের এভাবে বোঝানো যে, একজন শ্রমিক যদি কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকে (এখন মেয়েরাও কৃষিকাজে নিয়োজিত, এমনকি অধিক হারে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তারা অংশগ্রহণ করছেন) তবে সে দিনে ৩০০ টাকা করে পায়। অর্থাৎ মাসে তার আয় ৯ হাজার টাকা ; যদি সারা মাস কাজ থাকে। যদি ২০ দিন কাজ থাকে তবে পাবে ছয় হাজার টাকা।

এখন আরেকটি ঘটনা ঘটছে। যেহেতু এখন চুক্তিভিত্তিক শ্রমপদ্ধতি এসেছে, ফলে শ্রমিকরা একটি কাজ ভাড়া নেয়। যেমন তারা চুক্তি করে এক বিঘা জমির ধান কেটে দেবে। কতদিনে কাটবে সেটি তাদের বিষয় এবং পরিবারের সকলকে নিয়ে কেটে দিলে পুরো টাকাটা নিজে পাবে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের একটি ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেখানে সে ভালো উপার্জন করতে পারে। এসব সুযোগ তৈরি হওয়ার কারণে এখন আর মধ্যবিত্তদের গৃহকর্মে লোক পাওয়া যায় না। এসব চাপ পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এখন আমাদের লক্ষ্য মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়া। লক্ষ্য যদি তা-ই হয়, এটা বুঝতে হবে সেই পুঁজিপতিদের, যারা এর নেতৃত্ব দেবেন বলে দাবি করছেন, এরা হবেন তারা যারা আপেক্ষিক শোষণের পথে যেতে রাজি। যে পুঁজিপতিরা চরম শোষণের পথ আঁকড়ে ধরে রয়েছেন, তারা অর্থনীতি পেছনের দিকে টেনে রাখতে চাচ্ছেন। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এ কথা অবশ্য ঠিক, আমাদের এখানে সাব-কন্ট্রাক্টিং সিস্টেম খুব চালু। আরেকটি বিষয়ও সত্য, আমাদের এখানে যেভাবে টোটাল প্রাইসের বণ্টন হয়, সেটি সমানভাবে সব কারখানা সত্ত্বাধিকারী পায় না। একটা বড় অংশ, যাকে বলি দুই-তৃতীয়াংশ ভোক্তা মূল্য (কনজিউমার প্রাইস) বা চূড়ান্ত মূল্য অর্থাৎ একজন আমেরিকান ক্রেতা যে শার্টটি ১০০ ডলারে কিনছেন, সেটির ৭৫ শতাংশ নিয়ে নিচ্ছে বায়ার ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা; উৎপাদনে কোনো রকম অংশগ্রহণ ছাড়াই। মাত্র ২৫ ডলার পাচ্ছে আমাদের উৎপাদকরা। এর মধ্যে যদি সাব-কন্ট্রাক্টিং থাকে, তবে এই ২৫ ডলার সাব-কন্ট্রাক্টরদের ভাগে গিয়ে ১৫ ডলারে পরিণত হবে! তখন তো আর তার পক্ষে বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব নয়।

ফলে এ ক্ষেত্রে সরকারকে যেটি করতে হবে– এই ২৫ ডলার শেয়ারও বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন করতে হবে। ভারত-চীনও করেছিল এটি। আমেরিকায় নিজেদের বিনিয়োগ থাকতে হবে। আমরা দাবি করছি, আমরা দ্বিতীয় বৃহৎ উৎপাদক। এ স্থানটি ধরে রাখতে পণ্যে বৈচিত্র্য এনে আরও উচ্চপর্যায়ে নিতে হবে। ওদের পোশাক বাজার নিয়ে গবেষণা করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। পোশাক শিল্পকে আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে হবে।

আমাদের পুঁজিপতিদের কাছে এখন যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বৃত্ত টাকা রয়েছে। তারা বিদেশে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতিস্থাপিত করার জন্য বিনিয়োগ না করে সেখানে বাড়ি কিংবা অন্যান্য সম্পদ কিনছেন। তারা যদি চীন ও ভারতের মতো একটু জাতীয়তাবাদী হতেন, তাহলে ওখানে নিজেদের আউটলেট নিজেরাই খুলতেন।

উৎপাদন বাড়িয়ে উভয়ই লাভবান হওয়ার এ দৃষ্টিভঙ্গিতেও শোষণ রয়েছে। তবে এটি আপেক্ষিক শোষণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে তাদের যত অনাগ্রহ। এটি নিতে পারলে মজুরি ছয় থেকে আট হাজার কিংবা তার চেয়ে বেশি নেওয়া কঠিন হবে না। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত ছিল, এ ক্ষেত্রে আট হাজার দেওয়াই শ্রেয়। কেননা অতীতে ওদের ওপর এতটাই শোষণ হয়েছে যে, এটা দিলে মালিকের ক্ষতি হবে না। কেবল মুনাফা কিছুটা কমবে।

তবে এও ঠিক, কিছু কারখানা এটি দিতে নাও পারতে পারে। ওই কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের মজুরি ভর্তুকি দিতে হবে। যেমন, শ্রমিকদের রেশন ও বাসাভাড়া ভর্তুকি দেওয়া। আর কোনো কারখানাকে সাব-কন্ট্রাক্টিং নয় বরং তাদেরকে আরও আপগ্রেড করতে হবে। তাহলে সকল কারখানা, সকল মালিক, সকল শ্রমিক ও দেশ– সবারই মঙ্গল হবে।

সমগ্র শিল্প ও শ্রমিকের স্বার্থে, সরকার, বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি মালিক ও শ্রমিক এক টেবিলে বসে সমঝোতা করতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মালিক এটি করতে রাজি নয়। আবার সরকারও এদের উপর ভীষণ নির্ভরশীল। কারণ নির্বাচনের সময় এদের কাছ থেকেই অর্থ নেয় সরকারি দল।

শ্রমিকরা মাঠে সংগ্রাম করছেন বটে। তবে তাদেরও রাজনীতি-অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। নইলে বিক্ষোভ করতে গিয়ে তারা কেন গাড়ি ভাঙচুর করবে! সংঘবদ্ধ শ্রমিকরা এভাবে কখনওই সংগ্রাম করে না। সঙ্গত কারণেই তাই সংঘবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন প্রয়োজন, অনেকটাই বিজিএমইএ'র মতো পাল্টা শ্রমিকদের সংস্থা। মাঝে রেফারি হিসেবে থাকবেন সরকার।

এসব কিছু হলে বাংলাদেশের মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নপূরণ সহজেই সম্ভব হবে।

ড. এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।