বিড়ালটি ইঁদুর ধরবে তো

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 18 Nov 2013, 06:54 PM
Updated : 18 Nov 2013, 06:54 PM

সোমবার বিকেলে বঙ্গভবনে কজন নতুন মন্ত্রীর শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে যে মন্ত্রিসভাটি রূপ নিতে যাচ্ছে সেটি না সর্বদলীয়, না নির্দলীয়। অর্থাৎ নির্বাচনকালে দৈনন্দিন শাসনকাজ চালানোর জন্য যে মন্ত্রিসভাটি থাকবে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া কারও প্রস্তাবমতো হতে পারল না। তবে কর্তৃত্বটি প্রধানমন্ত্রীর হাতেই থাকছে। বলা যায়, তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই কার্য চলছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি না থাকলে সে মন্ত্রিসভাকে 'সর্বদলীয়' বলা গায়ের জোরে সম্ভব, কিন্তু তা ব্যাকরণসম্মত ও বাস্তবসম্মত হয় না। নতুন মন্ত্রীরা শপথ নেওয়ার আগে মহাজোট মন্ত্রিসভায় যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জাসদ ছিল সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি যুক্ত হল মাত্র। এঁরা সবাই মহাজোটের শরিক।

সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন দল হিসেবে ১৮ দলীয় জোটভুক্ত বিএনপি, জামায়াত ও এলডিপি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি বাদ রইল। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন নতুন মন্ত্রিসভাটি কলেবরে ছোট, দলগত কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হয়ে চরিত্রগতভাবে মহাজোট মন্ত্রিসভাই রয়ে গেল। অথবা খানিক রদবদলসহ মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হল।

মন্ত্রিসভাকে যে নামেই ডাকি, চীনা প্রবাদ স্মরণে প্রশ্ন করা যায়, ''সাদা-কালো যা-ই হোক, অতঃপর বিড়ালটি ইঁদুর ধরতে পারবে তো?'' অর্থাৎ মন্ত্রিসভাটি 'নির্বাচনকালীন সরকার' হিসেবে প্রশাসন তত্ত্বাবধানের কাজটি ঠিকমতো করতে পারবে তো? প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলেও হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; তবে তাতে ভোটার অংশগ্রহণ সন্তোষজনক হবে কি? অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে নির্বাচনটি গৃহীত হবে কি?

প্রশ্নটি এভাবে উত্থাপন করার অর্থ হল, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে সব দিক থেকে উত্তম। কিন্তু শুধু তারা অংশ না নিলেই নির্বাচন 'অগ্রহণযোগ্য' বলে ধরে নেওয়ার যুক্তি নেই। যে কোনো দলেরই তার নিজস্ব রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্বাচনে না দাঁড়ানোর অধিকার আছে। এখানে বিএনপি না এলে নির্বাচনটি 'প্রতিযোগিতামূলক হল না' বলা চলে। তাতে নির্বাচনের একটি ভালো উপাদান অনুপস্থিত।

পরবর্তী সময়ে দেশে শান্ত পরিস্থিতি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার যদি নিরাপদে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নিজের ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, যদি প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের যথেষ্ট তথ্য জানানো হয়, প্রশাসন যদি প্রভাব বিস্তারমূলক হস্তক্ষেপ না করে, নির্বাচনকালীন সরকারে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা, সাংসদরা যদি ক্ষমতা খাটিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার অন্যায় কাজ না করেন, নির্বাচন কমিশনের বিধি যদি ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত না হয়, অর্থাৎ অবাধ নির্বাচনের শর্তাবলী পূরণ হয় তবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হওয়ার বাধা কোথায়? এ ক্ষেত্রে কেবল নির্বাচন বর্জনকারী দলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের বা ক্ষমতাসীন মহাজোটের অবস্থান ছিল সংবিধানের বিধান অনুসারে বিদ্যমান সরকারই ছোট একটি মন্ত্রিসভা নিয়ে নির্বাচনকালীন দৈনন্দিন শাসনকাজ চালানোর সরকার হিসেবে কাজ করবে। আর বিরোধী দল তথা বিএনপির নের্তৃত্বাধীন ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবাধীন ১৮ দলীয় জোটের দাবি ছিল এ সময় সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকেবে। সেটা করতে সংবিধান সংশোধন করে নিতে হবে।

এ নিয়ে বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তারক্তি, প্রাণহানি, সংলাপের ইচ্ছা-অনিচ্ছার নাটক, কূটনৈতিক দূতিয়ালি প্রভৃতির পরও সমঝোতা হল না। এখন অনেকটা ফেইটঅ্যাকমপ্নির মতো, বিএনপিকে বাইরে রেখে পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভাসহ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনের নির্বাচন হচ্ছে। এখনও যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে তবে শেষ মুহূর্তে একটি সমঝোতায় শেখ হাসিনার পরিবর্তে সংসদের ভেতর থেকেই অন্য একজন সর্বসম্মত ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য হয়ে যায়নি, তবে খালেদা জিয়ার দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয় অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

অবস্থাদৃষ্টে অনুমান করি, সংসদের ভেতরের-বাইরের আরও কিছু ছোট-মাঝারি দল ও প্রবীণ নামকরা রাজনৈতিক নেতার পক্ষ থেকে যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা আসে তবে অনেক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বিএনপি এক ধরনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, দল ভাঙনের সম্মুখীন হবে এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে। রাজনৈতিকভাবে দল হিসেবে বিএনপির শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে আসা শ্রেয়।

সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় যোগদান এখনও সম্ভব। সরকার স্বাগত জানাবে।

নতুন মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের অল্প পরেই বিরোধী দল নেতা বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নির্ধারিত এই সাক্ষাতে নতুন কী ঘটে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা না আসুক, এই নির্বাচনকালীন সরকারকে গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই মন্ত্রিসভাকেই নির্বাচনকালে যথার্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে, কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী, সব রকম সহায়তা দিতে হবে।

বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপি ও জামায়াতের সহিংস প্রতিরোধ মোকাবেলা করে আইনশৃঙ্খলা, নাগরিক সাধারণ ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারকাজে সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের যে আচরণবিধি নির্বাচন কমিশন ঠিক করে দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে।

এগুলো নির্বাচনকালীন সরকারের অগ্নিপরীক্ষা যার ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশে গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হবে কি না।

মোজাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক, কলামিস্ট।