‘মাথা’ নিয়ে যত মাথাব্যথা

মোজাম্মেল হোসেনমোজাম্মেল হোসেন
Published : 14 Nov 2013, 08:23 AM
Updated : 14 Nov 2013, 08:23 AM

এই লেখাটি লেখার পরে আমি নিজেই প্রত্যয়ী হতে পারিনি বলে প্রকাশের জন্য পাঠাইনি। ছয় দিন ধরে রেখেছিলাম। মঙ্গলবার অপরাহ্নে সবেমাত্র কম্পিউটার খুলেছি অন্য কাজে, এমন সময় আমার পড়ার ঘরের পাশে বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের খবর কানে এল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিছু বলেছেন। তিনি দিন চারেক দৃশ্যপটে ছিলেন না, গা-ঢাকা দিয়েছেন ৮ নভেম্বর এম কে আনোয়ার ও মওদুদ আহমেদসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর।

অজ্ঞাত স্থান থেকে টেলিফোনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। এতে সংলাপের বন্ধ দুয়ার খুলবে। তিনি আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়াকে 'ছেলেমানুষী নাটক' অভিহিত করে বলেন, এ রকম কার্যক্রম সংকট আরও ঘনীভূত করবে।

২৬ অক্টোবর দুই নেত্রীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও নিষ্ফল টেলিফোন-আলাপে গণভবনে সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন দলের চেয়ারপরসন বেগম খালেদা জিয়া ৬০ ঘণ্টা হরতালের কারণ দেখিয়ে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিলেই কেবল তিনি সংলাপে রাজি আছেন।

এখন মির্জা আলমগীর সংলাপের বন্ধ দুয়ার খোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগকে নতুন শর্ত হিসেবে যোগ করলেন কি না বুঝতে পারলাম না। আর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বিরোধী দলের নেতা কার সঙ্গে সংলাপ করবেন, কী নিয়ে সংলাপ করবেন তা-ও বুঝলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম যে, আমার পূর্বপ্রস্তুত লেখাটি মাঠে মারা যাবে না, এটা এখন প্রকাশের জন্য পাঠানো যায়!

একটি বাংলা বাগধারা আছে 'শিরে সংক্রান্তি', যার মানে হচ্ছে আসন্ন বিপদ। 'শির' মানে মাথা, 'শীর্ষ' থেকে আসা শব্দ। আর 'সংক্রান্তি'র প্রকৃত অর্থ হল সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে গমন বা সঞ্চরণ। 'ক্রান্তি' শব্দের অনেকগুলো অর্থের একটি হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। মাসের শেষ দিনটি সংক্রান্তি, যেমন চৈত্র সংক্রান্তি। 'সম+ক্রান্তি' দিয়ে সংক্রান্তি হলে সম্যকরূপ পরিবর্তন বা সঞ্চার এবং সম্যকরূপে সমাপ্ত দুই-ই হয়তো বোঝাতে পারে।

কীভাবে 'শিরে সংক্রান্তি' বাগবিধি তৈরি হল তা পণ্ডিতরা বলতে পারেন, আমি জানি না। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় শব্দ দুটি প্রাসঙ্গিক। আসন্ন নির্বাচনকালে কী ধরনের সরকার থাকবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা এখনও না হওয়ায় কতখানি বিপদ আসন্ন সে চিন্তা তো সকলেরই।

আমরা বাঙালিরা একটু শিক্ষিত হলে ইংরেজি বলি প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে। বিশেষ করে কোনো কথা জোর দিয়ে বলতে গেলে ইংরেজি বেরোবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে যথাক্রমে ১৮ ও ২১ অক্টোবর 'সর্বদলীয়' আর 'নির্দলীয়' দুই কিসিমের দাওয়াই বাতলানোর পর, টেলিভিশনের মধ্যরাতের টক-শোগুলোতে বিশিষ্ট নাগরিকদের দেখেছি বড় বড় মস্তকের পাকা শস্যক্ষেত নেড়ে বারবার বলছিলেন, এখন একটামাত্র প্রশ্নে এসে ঠেকেছে যে, 'হু উইল হেড দা ইনটেরিম গভার্নমেন্ট?'

'হেড' মানে মাথা। ইংরেজিতে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ একই শব্দ দিয়ে হয়। 'হেড' মানে প্রধান হওয়া, নেতৃত্ব করা বা পরিচালনা করা। তা সেই 'হেড' নিয়েই এখন যত 'হেডএইক্'। মাথা নিয়েই মাথাব্যথা। বিএনপির সংসদ সদস্যরা গত ২৩ অক্টোবর সংসদ অধিবেশনে যোগ দিলেও সেখানে সেদিন তারা ছিলেন 'মাথাবিহীন'! বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া আসেননি। সাংসদ জমিরউদ্দিন সরকার খালেদা জিয়ার পক্ষে তাদের নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাবটি পয়েন্ট অব অর্ডারে উত্থাপন করেন। আর অপর নেতা এম কে আনোয়ার ব্যাখ্যায় সেই মাথাব্যথার কথাই বলেন।

বিএনপি তো সংসদে ডুমুরের ফুল। কালে-ভদ্রে কেবল নিজেদের দলীয় প্রয়োজনে ঢুঁ মারেন। আবার এসেই বলেন 'যাই যাই'। সরকারি দলও তাদের রাখতে চায় না। সরকারি দলের নেতারা সবসময় বিরোধী দলকে সংসদে আসার জন্য উদার আহ্বান জানান এবং কালে-ভদ্রে তারা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও পুত্রদ্বয়ের বিরুদ্ধে পুরানা কাসুন্দি ঘেঁটে ঘেঁটে এমন কান ঝালাপালা করেন যে তারা দ্রুত ওয়াকআউট করে বেরিয়ে যান।

সেদিন সরকারি দলের পক্ষে মহান দায়িত্বটি পালন করেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। যথারীতি ওয়াকআউট করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বিএনপির সাংসদ এম কে আনোয়ার আলোচনায় বলেন যে, "প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারপ্রধান যা-ই বলা হোক, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে। এটা হলে কোনো সমস্যা নেই।" তার কথায় ওই দিন এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের 'প্রধান' ঠিক হয়ে গেলে সরকারের অন্যান্য সদস্য উভয় পক্ষ ভাগাভাগি করে স্থির করে ফেলবেন, সমস্যা হবে না।

সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধনী-পূর্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার দাবিতে বিএনপি এখন আর নেই। যদিও গত দু'বছর তারা ওই এক কথা বলে এসেছেন যে আওয়ামী লীগকেই সংসদে বিল এনে তত্ত্বাবধায়কে ফিরে যেতে হবে। এত দীর্ঘ দিন তারা নিজেরা কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও ফর্মুলা দেননি। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার গঠন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক– এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় হওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো সমাধান না জানিয়ে কেবল দাবিটিই আঁকড়ে থেকেছেন।

পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে আহ্বান সত্ত্বেও বিএনপি মতামত দিতে ওই সংক্রান্ত কমিটিতে যোগ দেয়নি। সরকারি দল তাড়াহুড়ো না করে অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু অপেক্ষা করলেও বিএনপির অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছাড়া সংসদে ঐকমত্য তো সম্ভব ছিল না। নিজেরা সংসদে যাবেন না, আলাচনা করবেন না, প্রস্তাব-পরামর্শ দেবেন না, কমিটিতেও প্রতিনিধি দেবেন না, আওয়ামী লীগকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে এককভাবেই তত্ত্বাবধায়ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে– এই গোঁ ধরার পেছনে কারণ কী?

১৯৯৬ সালে বিএনপি তাদের একদলীয় নির্বাচনের ফসল সংসদে রাত জেগে বসে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। এখন খালেদা জিয়া কি একই কাজ শেখ হাসিনাকে দিয়ে করিয়ে ঝাল ওঠাতে চান? রাজনীতিতে বদলা নেওয়া, ঝাল ওঠানো, প্রতিহিংসাপরায়ণতা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য মনোভাব।

কিন্তু সংসদের বাইরে থেকে আন্দোলন বা রাজপথের সহিংসতা দিয়ে বিএনপি এই গোঁ কার্যকর করতে পারেনি। প্রথমে বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী যা-ই বলা হোক, সরকারটিকে নির্দলীয় হতে হবে। তবে নির্দলীয় কীভাবে কার্যকর হবে তার কোনো ফর্মুলা তারা দেবেন না।

অবশেষে প্রধানমন্ত্রী যখন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিলেন তখন সেটি গ্রহণ না করে হুটহাট করে নির্দলীয় সরকারের একটি প্রস্তাব রাখলেন খালেদা জিয়া। এতে দেখা গেল প্রস্তাবটি যারা বানিয়েছেন তাদের মাথা অঙ্কে কাঁচা। পূর্ববর্তী ২০০১ ও ১৯৯৬-এর দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্য থেকে ১০ জনকে নেওয়ার কথা বলে সে হিসেব তারা মেলাতে পারেন না। সংসদে এম কে আনোয়ার বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান নির্বাচন করা গেলে উপদেষ্টা কারা হবেন সেটা সমস্যা নয়। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রস্তাব একদিন পরই এম কে আনোয়ার সংশোধন করে দেন!

এই সংশোধিত প্রস্তাবের মূল কথা 'মাথা'। উপদেষ্টাদের সম্পর্কে যেন-তেন হিসেব দিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব ছিল প্রধান উপদেষ্টা হবেন দুই পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সম্মানিত নাগরিক। বর্তমান অবস্থায় কীভাবে একজন নাগরিক সম্পর্কে সকলে ঐকমত্যে আসবেন তা বোধগম্য নয়। কার্যক্ষেত্রে বিএনপির প্রস্তাবে হয়তো একটি কবন্ধ সরকার হলেও হতে পারে যার 'মাথা' খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

এই 'মাথা' নিয়েই ২০০৬ সালে গোল বাঁধিয়েছিল বিএনপি। তখন তাদের অঙ্কের মাথা সরেস ছিল। সূক্ষ্ম হিসেব কষে বিচারকদের চাকরির বয়স বাড়ানো হয়েছিল যেন বিশেষ একজন প্রধান বিচারপতি পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা হন। আওয়ামী লীগ তা মেনে না নিয়ে আন্দোলন করায় তিনিও যখন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন তখনও সংবিধানের অব্যবহিত পরবর্তী বিকল্পগুলো এড়িয়ে বিএনপির সমর্থনে জবরদস্তি বংশবদ রাষ্ট্রপতি নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যান।

এই 'মাথা'টি বন্ধক ছিল খালেদা জিয়ার কাছে। তাই উপদেষ্টারা কাজ করতে পারলেন না। চার জন পদত্যাগ করলেন। এর পরের ওয়ান-ইলেভেনের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। অর্থাৎ সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দলীয় স্বার্থে কলুষিত ও বিতর্কিত করা হয় বিএনপির দ্বারাই। সেই ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন বিএনপির দাবি এবং এই দাবিরও নির্গলিতার্থ 'মাথা'। অর্থাৎ শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের প্রধান সমালোচনা হচ্ছে, ওই সরকারের প্রধান কে হবেন তা বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে এ কথাও বলা হয়নি যে বিরোধী দল প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই ওই সরকারের প্রধান থাকবেন। প্রস্তাবটি গ্রহণ করার পর আলোচনার টেবিলে তো ভিন্ন প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ বিরোধী দলের আছে। সংলাপে বসে সেটা আদায় করার চেষ্টা তো তারা করতে পারেন।

কিন্তু তাদের আন্দোলনের প্রধান আওয়াজ হচ্ছে 'শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না, নির্বাচন হতেও দেব না।' তারা অবশ্য আগে থেকেই 'হাসিনামুক্ত বাংলাদেশ' চাচ্ছেন। এখন তাদের আন্দোলনের নিকটতম দোসররা 'হাসিনামুক্ত' এবং 'গোলাম আযমযুক্ত' বাংলাদেশ চাচ্ছেন। ওরা চাচ্ছেন শেখ হাসিনা যেন সংলাপের আগেই তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে ওই মুহূর্তে বিজয়মিছিল বের করা তাদের লক্ষ্য।

এটাই সবকিছুতে অনমনীয়তার কারণ। রাজনৈতিক যুক্তি-বিবেচনা-হিসেব-নিকেশ সব মাথায় উঠেছে। এই সুযোগে দোসররা ২৪ অক্টোবরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশ থেকে আপোসহীন নেত্রীকে দিয়ে ক্ষমতায় এলে গোলাম আযমদের মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়াতে পেরেছে।

ফলে বেশ বড়সড় গোল বেঁধেছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন এখন গৌণ। আসল গণ্ডগোল মাথায়!

প্রশ্ন দুটি– বিএনপির এই শিরোপীড়া দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? আর দেশের জনগণ এখন কী করবেন?

মোজাম্মেল হোসেন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।