ভারতের ঝারিয়া সিংগ্রুলি অতঃপর আমাদের সুন্দরবন

শামীমা বিনতে রহমান
Published : 17 April 2011, 04:45 PM
Updated : 16 Nov 2013, 12:59 PM

এমন দৃশ্য থ্রিলার মুভিতে দেখা ছাড়া সম্ভবত খুব কম বাংলাদেশিরই বাস্তব অভিজ্ঞতায় আছে। দৃশ্যটা এ রকম– যে দিকটায় হাঁটছেন সেই দিকটাতেই একটু পরপর পায়ের কাছের মাটি থেকে বেরুচ্ছে ধোঁয়া। একটু দূরে পাথর আর পাথুরে মাটির ফাটলে জ্বলছে আগুন। চারপাশে মেঘের মতো ঘন ধোঁয়া।

দৃশ্যটা বেশ থ্রিলিং বটে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কয়লা-মাটিপোড়া গন্ধ আর ধোঁয়ায় চোখ-মাথা ব্যথা করবে। আর মুভিতে যে দৃশ্য কখনওই দেখা যাবে না তা এখানে দেখবেন– এসবের মধ্যেই কিছু মানুষ খায়, ঘুমায়, দিনযাপন করে।

ভারতের পূর্বদিকের প্রদেশ ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার ঝারিয়া এলাকার বোকা পাহাড়িয়া ভোগাড্ডি নামের পাহাড়ি গ্রামে যে উন্মুক্ত কয়লা খনি আছে, এ দৃশ্য সেখানকারই। ব্রিটিশ আমলে ধানবাদ-ঝারিয়া এলাকায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা শুরু হলেও, এটা এখন রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার অসংখ্য অবৈধ কয়লা খনির এলাকা। আর তাতে কয়েক দফা স্থানিক উচ্ছেদ হয়ে, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ না পাওয়া আদিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শিডিউল ট্রাইবের লোকেরা বাস করছেন।

ধানবাদ-ঝারিয়া কোল বেল্ট ভারতের সবচেয়ে ভালো কোকিং কয়লা বা জ্বালানিযোগ্য কয়লা সম্পদ এলাকা এবং একই সঙ্গে 'বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত' এলাকা হিসেবে পরিচিত। ভারতে মাইনিং ট্যুরিজমে একটি আ্যাকটিভিস্ট গ্রুপের সঙ্গে ওখানে গেলে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা রাখা যে কারও মনে হবে, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীবাসী প্রতিরোধের কী চমৎকার দৃষ্টান্তই না স্থাপন করেছে বিশ্বমানচিত্রে।

আ্যাকটিভিস্ট যারা জানে তো জানে– যারা আলাপে কেবল জেনেছে ফুলবাড়ীর প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত– তারা সাফ সাফ বলে দিয়েছে কত ভয়াবহ হতে পারে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি স্থাপনের প্রতিক্রিয়া! কেবল নিজেদের জীবনযাপনের জন্যই।

বোকা পাহাড়িয়া ভোগাড্ডি নামের জায়গায় একদম খনির পাশের একটি ঘরের বাসিন্দা ধান্নু ভুঁইয়া যিনি ১৯৬৯ সাল থেকে এখানে বসবাস করে আসছেন, জানালেন, ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভারত কোকিং কোল লিমিটেড বা বিসিসিএল ১৯৭৬ সালে যখন এখানে জমি অধিগ্রহণ করে উন্মুক্ত কয়লা খনি শুরু করে। তখন যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দান ও পুনর্বাসনের কথা বলেছিল সরকার এখনও তা দেয়নি। বরং ধোঁয়া আর কার্বন-পোড়ার গন্ধের অসহনীয় অবস্থার মধ্যে তাদের থাকতে হচ্ছে। ধান্নু ভুঁইয়ার কাছে প্রতিশ্রুতি 'একটা পুরাই মিথ্যা ব্যাপার', তা সরকারের দিক থেকে হোক কী বেসরকারি মালিকদের পক্ষ থেকে।

দামোদর নদীর ধারে ২৮০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে সরকারি হিসেবে ১১০ টি ওপেন এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং কয়লা খনি আছে। তবে বাস্তবে এখানে 'ইলিগ্যাল' হিসেবে পরিচিত আরও দুগুণ বেশি কয়লা খনি আছে বলে জানিয়েছেন ঝারিয়া কোল ফিল্ড বাঁচাও সমিতির কর্মী কুশল ভগত।

তিনি জানান, উন্মুক্ত কয়লা খনির কারণে গত প্রায় ৮০ বছর ধরে এখানে মাটির নিচে আগুন জ্বলছে। সেই অব্যাহত আগুনের কারণে পাথুরে মাটি এলাকায় ভূমিধস হয়েছে বেশ কয়েকবার। ১৯৮০ সালে তাই সরকার একটা মাস্টার প্ল্যানে ঝারিয়া শহরটাকে অন্য কোনোখানে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু এখনও তার কিছুই হয়নি, উল্টা তাদের ভয়াবহ বিপজ্জনক একটা অবস্থার মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে।

ধানবাদ ব্যাংক মোড় থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে বোকা পাহাড়িয়া ভোগাড্ডিতে ঢোকার পুরো রাস্তাই কালো। কয়লা পরিবহণ এবং কয়লার ছাই পড়ে পড়ে চারপাশের পাহাড়ের সঙ্গে সবুজের সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সবুজ গাছের বদলে এখানে দেখা যায় মরা আর মরতে-বসা সব গাছপালা। ধান বা ফসল, সবজি ক্ষেত কিছুই নেই এখানে। নেই কোনো ধরনের ফলের গাছের অস্তিত্ব একসময় যা এখানে ব্যাপকভাবে ছিল।

বিস্তৃত পাহাড়ের যে দিকেই চোখ মেলে তাকাই দেখতে পাই কয়লা তোলার জন্য বড় বড় গর্ত। গর্ত করার ফলে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা মাটি, পাথর, কয়লার রাবিশ বা ওভার-বারডেন দিয়ে পূর্ণ আরেকটা ম্যান-মেইড টিলা চোখে পড়ল। কয়লা তোলার কাজ, ট্রাকের যাওয়া-আসা, মাইনিং বিস্ফোরণের আগে সাইরেন বাজানোর শব্দ, বিস্ফোরণের শব্দ, আগুন, ধোঁয়া– সব মিলিয়ে পরিবেশ দূষণের বিরাট আয়োজন। বোকা পাহাড়িয়া ভোগাড্ডিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের গভীর খাদে দশ মিনিটের ব্যবধানে দু দুটো বিস্ফোরণ!

ধানবাদ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে রামগড় জেলার হাজারিবাগ। ওখানে আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেন্ট্রাল কোল ফিল্ড লিমিটেড বা সিসিএল, আর ব্যক্তিমালিকানাধীন টাটার কয়লা খনি। সেসব জায়গাতে গেলেও চোখে পড়বে একই দৃশ্য। চারপাশের সান্তাল, ওঁরাওসহ অন্যান্য আদিবাসী এবং শিডিউল ট্রাইবদের যন্ত্রণা একই রকম।

হাজারিবাগ জেলার ফুচরি গ্রামের কয়লা খনির ধারের বাসিন্দা আশুক ওঁরাও জানালেন, কয়লা খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার কোনো সুযোগ তারা পান না। মানে, তাদের কাজে নেওয়া হয় না। জায়গা-জমি কয়লা খনিতে অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন বা চাকরির প্রতিশ্রুতি কোনোটাই না পাওয়া এবং জমি দিন দিন কৃষিকাজের পুরো অনুপযুক্ত হওয়ায় এখন তাদের রোজগারের উপায় নেই।

স্থানীয় খনি-বিরোধী এবং পুনর্বাসন আন্দোলন কর্মী বুদ্ধিমান শ্রীবাস্তব জানান, লোক্যালদের খনির কাজে নেওয়া হলে তারা তাদের দাবি বুঝে নেওয়ার জন্য আন্দোলন করতে পারে, এই আশঙ্কায় তাদের কাজে নেয় না মালিকরা। তিনি জানান, বেশিরভাগ শ্রমিকই অন্য প্রদেশের, স্থানীয় নয়।

১০৮ বছর ধরে ঝাড়খণ্ডের এসব এলাকায় কয়লা খনির কারণে দামোদর নদী দূষিত হয়ে মাছ তো মরে গেছেই, শোধন করে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহের উৎসও নষ্ট হয়ে গেছে। ২ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের পানি উঠাতে পারে এ রকম টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় বাসিন্দাদের। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে কুয়ায় রাখাটা এখন একেবারেই বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্বাসকষ্ট, সর্দি আর চর্মরোগ এখানে খুবই সাধারণ ঘটনা।

এত এত বড় বড় কোম্পানি কয়লা তোলার কাজ করলেও, এখানে স্কুল বা হাসপাতাল তৈরির প্রবণতা একদমই চোখে পড়ে না। ওপেন পিট মাইনিংয়ের কারণে এখানকার উত্তোলিত কয়লার ডাস্ট প্রোডাকশন অনেক বেশি। আর তাতে ঝলমলে রোদেও চারপাশের পরিবেশ সবসময়ই থাকে কালচে, ধোঁয়াটে।

বুদ্ধিমান শ্রীবাস্তব বলেন, কোনো এলাকা একবার খনি এলাকা হয়ে গেলেই সেটি আর ফেরত পাবার কোনো সুযোগ থাকবে না। তারপর লিগ্যাল মাইনিংয়ের পাশাপাশি শুরু হবে অবৈধ মাইনিং। তৈরি হবে কোল মাফিয়া। আর কোল মাফিয়াদের হাতে থাকবে রাজনীতিবিদ ও পুলিশ প্রশাসন। সরকারের বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচিতে এলাকাবাসীর জন্য ন্যায্য প্রাপ্তি বলে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। এখনকার ঝাড়খণ্ডের বাস্তবতা যেমন।

ঝাড়খণ্ডের কালো ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ পার হয়ে মধ্যপ্রদেশের কোনার জেলার সিংগ্রুলিতে গিয়ে দেখি পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। এখানেও ঝাড়খণ্ডের মতো উচ্ছেদ, ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার চিৎকার আছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে পকেটে মুদ্রার ঝনঝনটাও শোনা যায়। সিংগ্রুলি পাওয়ার প্ল্যান্ট এলাকা যেটাকে বোঝানো হয়, সেটার এক অংশ মধ্যপ্রদেশে, আরেক অংশ উত্তর প্রদেশে। এই পুরো এলাকাটি ভারতীয়দের কাছে 'কর্পোরেট কোল মাফিয়া'দের এলাকা হিসেবে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত।

ভারতে সবচেয়ে বেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। কোল ইন্ডিয়ার পার্টনার, নর্দার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড বা এনসিএল এখানে প্রতি বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ১৩ হাজার ২৯৫ মেগাওয়াট। এনটিপিসি উৎপাদন করে ৭ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট। বেসরকারি রিলায়েন্স, হিন্দালকো, এসারসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যক্তিমালকিানাধীনসহ সিংগ্রুলিতে প্রতি বছর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৩২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এ জায়গাতে যারা বিভিন্ন সময় জমি দিয়েছিলেন, তাদের একজন রামপাল ভারতী বললেন, বিদ্যুতের জন্য জমি দিয়েছিলেন, অথচ তাদের ঘর এখনও বিদ্যুতের মুখ দেখল না। আয়রনি হলেও এটাই বাস্তবতা এখানকার ক্ষমতাহীন মানুষগুলোর জন্য!

এখানেও এলাকাটা পাহাড়ি। পাথুরে শক্ত মাটি। সিংগ্রুলি থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এলাকার অর্ন্তগত উত্তর প্রদেশের সোনভদ্র জেলায় রিহান্ড নদীতে বাঁধ দিয়ে ১৯৬০ সালে ওয়াটার রিজার্ভার তৈরি করা হয়েছে, যার পানি ব্যবহার হয় এসব পাওয়ার প্ল্যান্টে। পাহাড়ি নদী রিহান্ডের একটা পাশের পানিতে ছাই ফেলে ফেলে (যেটাকে অ্যাশ-পণ্ড বলা হয়ে থাকে) এমন অবস্থা হয়েছে যে ওটাতে আর মাছ নেই। এই নদীর এক অংশের পানি ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে পুরোপুরি।

আর পরিবেশবিজ্ঞানী বা পানিবিশারদ না হয়েও খোলা চোখে, সাদা অনুভূতিতে যেটা বোঝা যায় তা হল, ওই এলাকা বসবাসের পুরো অনুপযোগী। তার মধ্যেও মানুষ থাকছে, কারণ মুম্বাই বা দিল্লির মতো বড় বড় শহরের ফুটপাতে ঘুমানোর আতঙ্ক-অস্থিরতা নিতে চায় না ওরা।

ফুলবাড়ী আন্দোলনের জায়গা থেকে ধানবাদ-ঝারিয়া এবং সিংগ্রুলিকে দেখলে, আর ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ নামে খ্যাতি পাওয়া 'বাংলাদেশের ফুসফুস' সুন্দরবন রক্ষার দাবির কথায় কান পাতলে, একটা উত্তরই আসবে– আমি এবং আমরা বাঁচতে চাই, আমার দেশেই। বাঁচা মানে, ঝাড়খণ্ডের সান্তাল এবং ওঁরাও আদিবাসীদের মতো অপুষ্টির মধ্যে নয়। চরমপন্থী বলে পরিচিত মাওবাদী ও নক্সালিস্ট বা কোল মাফিয়া ও সরকারের বিরতিহীন চাপের মধ্যে জীবনযাপন করব না আমরা। আমাদের কাছে বেঁচে থাকা মানে সিংগ্রুলির মতো প্রতিদিন পাহাড়ধসের 'জানা' আতঙ্কের মধ্যে ঘুমানো নয়।

এসব ঘুরে দেখার পর সুন্দরবনের কাছেই কয়লাভিত্তিক রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে তেমনই একটা 'জানা' আতঙ্ক বলে মনে হয়েছে আমার। বাঁচা মানে তাই এই 'জানা' আতঙ্কের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে যাওয়া।

আর সেটাই আমাদের করতে হবে এখন।

ছবি : অমৃতরাজ স্টেফান।

শামীমা বিনতে রহমান: লেখক ও সাংবাদিক। সাংবাদিকতা বিষয়ে ভারতের লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।