রামপাল: বিভ্রান্তির অবসান হোক

কল্লোল মোস্তফা
Published : 9 Nov 2013, 01:25 PM
Updated : 9 Nov 2013, 01:25 PM

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের তোলা 'বিভিন্ন অভিযোগ ও প্রকৃত তথ্যের ফারাক তুলে' ধরার কথা বলে চার পর্বের 'রামপাল অভিযোগনামা' লিখেছেন আঞ্জুমান ইসলাম এবং কাজী আহমেদ পারভেজ। চারপর্বের সেই লেখার মাধ্যমে কতটুকু 'প্রকৃত তথ্য' তুলে ধরা হল আর কতটুকু 'বিভ্রান্তি' তৈরি করা হল তার পর্যালোচনা হওয়া জরুরি।

শুধু তাই নয়, আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে তারা প্রকল্প বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে নানান অভিযোগও তুলেছেন। যেমন– মিথ্যা তথ্য দেওয়া, পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করা, একেকবার একেক কথা বলা, গেরিলা কায়দায় একেকবার একেক দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করা, কখনও দূরত্ব, কখনও দূষণমাত্রা, কখনও মালিকানা-কাঠামো, কখনও চুক্তির শর্ত, কখনও দুর্নীতির আশংকা, কখনও আইনের অপর্যাপ্ততা, কখনও সুন্দরবন, কখনও পশুর নদী, কখনও মাটি-ভরাট, কখনও জমি-অধিগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা ইত্যাদি।

চলুন দেখা যাক, মিথ্যাচার কারা করেছে, একেকবার একেক কথা আসলে কারা বলেছে! চারপর্বে লেখকদ্বয় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর নানান কথাই বলেছেন– সবার সব কথা নিয়ে লাইন বাই-লাইন আলোচনা বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় বিধায় তাদের উদ্দেশ্য ও বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য এখানে মূল কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট।

সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্ব প্রসঙ্গে

আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি সুন্দরবনের মতো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা নিরাপদ নয়। এমনকি যে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি'র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে সেই ভারতের ইআইএ গাইডলাইন অনুসারেও কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমির মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ গ্রহণযোগ্য নয়।

এই গুরুতর আপত্তিটি সম্পর্কে আঞ্জুমান ইসলাম তার প্রথম লেখায় বলেছিলেন: "এই অভিযোগটি মিথ্যা।" তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে ভারতীয় আইনে ১০ কিমি দূরত্বসীমার প্রমাণ হিসেবে যে লিংকটি দিয়েছিলেন, তা আসলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত নয়, সাধারণভাবে বনাঞ্চলের কত কিমি দূরের এলাকা বনায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এ রকম কাজে ব্যবহার করা যাবে– সে সংক্রান্ত একটি নোটিশ!

ইআইএ গাইডলাইনের লিংকটি দিয়ে যখন প্রশ্ন করা হল, তখনও তিনি তার ভুল স্বীকার করলেন না, উল্টো তার সেই লেখার নিচে মন্তব্য অংশে বললেন:

"কল্লোল মোস্তাফা যে লিঙ্কটির কথা বলছেন সেটি IL&FS Ecosmart Limited Hayderabad নামের একটি কোম্পানি ২০১০ সালে 'সাজেস্টেড' গাইডলাইন হিসেবে ভারতের মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট ও ফরেস্ট (MoEF)-এ জমা দিয়েছিল। এটিতে ওই কোম্পানি সাজেস্ট করেছে নানান জিনিস। কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই ভারত সরকার আমলে নিয়ে কোনো মেমোরেন্ডাম পাবলিস করেছে বলে খুঁজে পাইনি তাদের ওয়েবসাইটে।"

তারপর, এটা যে ভারত সরকারেরই নিজস্ব গাইডলাইন সেই প্রমাণও তাকে দেওয়া হল।
এরপর তিনি ভিন্ন অজুহাত দাঁড় করালেন, তার 'রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে আমার মতামত ও সাজেশন' শীর্ষক লেখায় লিখলেন:

"ওটি ভারতের একটি গাইডলাইন, বাংলাদেশের নয়। সুতরাং ওই গাইডলাইন আমলে নিয়ে কেন বাংলাদেশের সাইট ক্লিয়ারেন্স হতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। তার উপর হচ্ছে সেটি একটি গাইডলাইন মাত্র, কোনো মেমোরেন্ডাম নয় যে তা অবশ্যপালনীয়।"

এরপর কাজী আহমেদ পারভেজের সঙ্গে যৌথ লেখায় বললেন:

"দূরে গিয়ে অহেতুক নিরাপত্তা বাড়ানোর বিলাসিতা বড় দেশের জন্য বাস্তবসম্মত হলেও হতে পারে, কিন্তু ভারতের চেয়ে আয়তনে ২৩ গুণ ছোট আর জনসংখ্যার ঘনত্বে প্রায় আড়াই গুণ বেশি চাপে থাকা একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তা জন্যে নিতান্তই একটি অযৌক্তিক বাহুল্য বিষয়।"

তাহলে, ২৫ কিমি দূরত্বসীমাকে এই 'বিলাসিতা' মনে করার ব্যাপারটি প্রথমে বললেই তো হত! পাঠক প্রথমেই বুঝতে পারতেন, ভারতে বনাঞ্চলের ২৫ কিমি সীমার মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিরুৎসাহিত করা হলেও, একজন পরিবেশ প্রকৌশলী জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং আয়তনের বিবেচনায় বাংলাদেশের সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সমস্যা মনে করেন না!

পাঠক এই 'যুক্তি' গ্রহণ করতেন কী করতেন না, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু অন্তত এক অজুহাত থেকে পিছলে ক্রমাগত আরেক অজুহাতে যাওয়ার বিরক্তিকর ব্যাপারটা দেখতে হত না। আর আমাদেরকেও এইসব মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের জবাবে একটার পর একটা লিংক/যুক্তি দিয়ে উল্টো 'একেক বার একেক কথা' বলার অভিযোগও শুনতে হত না!

সুন্দরবনকে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকা দেখানো প্রসঙ্গে

এ বিষয়ে আমাদের সুষ্পষ্ট বক্তব্য হল:

সুন্দরবনের ১৪ কিমি দূরে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে, সরকারি ইআইএ রিপোর্ট অনুসারেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা সুন্দরবনের কাছে ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রাম ও ৫১.২ মাইক্রোগ্রাম হবে যা প্রতিবেশগতভাবে স্পর্শককাতর বা সংবেদনশীল এলাকার জন্য পরিবেশ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়।

কারণ পরিবেশে আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী, ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়ার জন্য মানদণ্ড হলো ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। ব্যাপারটিকে গ্রহণযোগ্য মাত্রার মধ্যে দেখানোর জন্য ইআইএ রিপোর্টে একটা চালাকি করা হয়েছে, সুন্দরবনকে সেনসিটিভ এলাকার বদলে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কারণ আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকার মানদণ্ড ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার!

কিন্তু আঞ্জুমান ইসলাম প্রথমে তার লেখায় সুন্দরবনকে এই 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকায় শ্রেণিকরণের বিষয়টিই অস্বীকার করে বসলেন, তিনি বললেন:

"বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০০৫ সালের বিধি-বিধান/ নির্দেশনা অনুযায়ী EIA রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।এতে শহর/আবাসিক/গ্রাম্য এলাকাভিত্তিক কোনো Classification নেই।"

জবাবে ইআইএ রিপোর্টে পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর আওতায় সালফার ও নাইট্রোজেন নির্গমন নিরাপদসীমার মধ্যেই থাকবে এ রকম দেখানোর জন্য কীভাবে সুন্দরবনকে 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা ইআইএ'র রেফারেন্স দিয়ে, পৃষ্ঠা নম্বর উল্ল্যেখ করে দেখানোর পর এখন তারা ভিন্ন অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন! তারা বলছেন:

"সুন্দরবনকে সংবেদনশীল হিসেবে গণ্য হতে গেলে একমাত্র উপায় হল, সিডিউল-২-এর নোট (১) অনুযায়ী পৃথক স্বীকৃতি প্রাপ্তি। যেহেতু সে রকম কোনো স্বীকৃতি EIA তৈরির সময় ছিল না, আইনানুযায়ী EIA প্রস্তুতকারীদের সুন্দরবনকে সংবেদনশীল গণ্য করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।"

তারা এবার বলতে চেয়েছেন, সুন্দরবন ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হলেও ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া বা প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা বলে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত নয়– তাই সুন্দরবনের জন্য 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকার মানদণ্ড নির্ধারণ করাতে কোনো সমস্যা নেই!

বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ এ সুন্দরবনকে সুস্পষ্টভাবে 'প্রতিবেশগত সংবেদনশীল' এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি ঠিক, কিন্তু 'আবাসিক ও গ্রাম্য' এলাকা হিসেবেও তো নির্ধারণ করা হয়নি! এ রকম একটা অনির্ধারিত অবস্থার কথা উল্লেখ করে লেখকদ্বয় স্বীকার করেছেন:

"এই অবস্থায় মান প্রদানকারীরগণের জাজমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে পারতেন এবং সংবেদনশীল স্থানের মান ব্যবহার করতে পারতেন।"

কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই জাজমেন্ট ব্যবহার করে ইআইএ প্রস্তুতকারীরা সুন্দরবনকে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে গণ্য করলেন না কেন? কেন আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা হিসেবে গণ্য করলেন? সুন্দরবনের মতো প্রতিবেশগতভাবে ক্রিটিক্যাল বা সংকটাপন্ন একটা এলাকার জন্য তো প্রতিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকার মানদণ্ড ব্যবহার করাই স্বাভাবিক!

তাছাড়া তারা তো পাশের দেশ ভারতে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বানঞ্চলকে কী হিসেবে দেখা হয় সে নজিরটিও আমলে নিতে পারতেন। ১৯৯১ সালের কোস্টাল জোন ম্যানেজম্যান্ট নোটিফিকেশন অনুযায়ী ভারতে তো শুধু সুন্দরবন নয়, যে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বণ্যপ্রাণির আবাসস্থল, অভয়ারণ্য, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদিকে ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ এরিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়।

Category I (CRZ-I):

(i) Areas that are ecologically sensitive and important, such as national parks/marine parks, sanctuaries, reserve forests, wildlife habitats, mangroves, corals/coral reefs, areas close to breeding and spawning grounds of fish and other marine life, areas of outstanding natural beauty/historically/heritage areas, areas rich in genetic diversity, areas likely to be inundated due to rise in sea level consequent upon global warming and such other areas as may be declared by the Central Government or the concerned authorities at the State/Union Territory level from time to time.

তাহলে, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ 'ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ' হলে কোন বিবেচনায় বাংলাদেশের অংশটি ইকোলজিক্যালি সেনসিটিভ না হয়ে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা হতে যাবে!

মজার ব্যাপার হল, আঞ্জুমান ইসলামরা যে ইআইএ রিপোর্ট কর্তৃক সুন্দরবনকে 'আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা' বলে চালিয়ে দেওয়ার সাফাই গাইছেন, একটার পর একটা প্রতারণা করে যাচ্ছেন, সেই ইআইএ রিপোর্টের সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ সংশোধনীতে কিন্তু সুন্দরবনকে সেনসিটিভ এলাকা বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

"In this studySundarbans have been considered as sensitive zone for limiting the Sox.."(সংশোধিত ইআইএ, পৃষ্ঠা- ২৮৫)

অবশ্য এই স্বীকারোক্তির পরেও সংশোধিত ইআইএ-তে প্রকল্প জায়েজ করার জন্য আবার একটি চালাকি করা হয়েছে। এর আগের ইআইএ রিপোর্টে আমরা দেখেছিলাম, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের ২৪ ঘণ্টার ঘনত্ব সুন্দরবন এলাকায় যথাক্রমে ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রাম ও ৫১.২ মাইক্রোগ্রাম দাঁড়ায় যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুসারে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকার মানদণ্ডের চেয়ে (৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) অনেক বেশি।

এই সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা তারপরেও নিরাপদসীমার মধ্যে দেখানোর জন্য আগের রিপোর্টে সুন্দরবনকে আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছিল, কারণ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ অনুযায়ী আবাসিক ও গ্রাম্য এলাকার জন্য সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের মাত্রা ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার।

কিন্তু যেহেতু তাদের এই চালাকি ধরা পড়ে যায় এবং তারা অবশেষে সুন্দরবনকে স্পর্শকাতর এলাকার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়. তাই স্বাভাবিকভাবেই সুন্দরবন এলাকায় ২৪ ঘণ্টা হিসেবে সালফার ও নাইট্রোজেনের যে ঘনত্ব তা ১৯৯৭ সালের আইন অনুযায়ী নিরাপদসীমার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু নিরাপদসীমার মধ্যে না দেখাতে পারলে তো সুন্দরবনের ১৪ কিমি দূরে প্রস্তাবিত প্রকল্প সরাসরি অগ্রহণযোগ্য স্বীকার করতে হয় যার এখতিয়ার হয়তো তাদের নেই!

এ কারণে তারা নতুন একটা চালাকি করেছে। তারা এবার ২৪ ঘণ্টার ঘনত্বের বদলে সুন্দরবনের কাছে সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের বার্ষিক ঘনত্বের হিসেব বের করে দেখাতে চেয়েছে সালফার ও নাইট্রোজেনের বার্ষিক গড় ঘনত্ব নিরাপদসীমার মধ্যেই থাকে!
সংশোধিত ইআইএ রিপোর্টে সুন্দরবনের কাছে সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের ঘনত্বের হিসাবটি এ রকম:

লক্ষণীয় বিষয় হল, এবারে সুন্দরবনের কাছে সালফার অক্সাইড গ্যাসের ২৪ ঘণ্টার মাত্রা দেখানো হয়েছে ৫৮.৪৩ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার এবং বার্ষিক গড় মাত্রা দেখানো হয়েছে ১৯.৩৬ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর মাত্রাকে এর আগের রিপোর্টে ২৪ ঘন্টার গড়ের সঙ্গে তুলনা করা হলেও এবারে পরিবেশ আইনের স্ট্যান্ডার্ড ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটারকে বার্ষিক ঘনত্বের সীমা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

অথচ এর আগের রিপোর্টে পরিবেশ আইনের স্ট্যান্ডার্ডকে ২৪ ঘণ্টার গড় হিসেবে দেখানো হয়েছিল যা নিচের টেবিল থেকে স্পষ্ট হবে:

একইভাবে এবার নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা দেখানো হয়েছে ২৪ ঘণ্টার গড় ৪৭.২ মাইক্রোগ্রাম যা পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর স্পর্শকাতর এলাকার জন্য নির্ধারিত মাত্রা (৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) এর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু নিচের টেবিলে আমরা দেখছি, ২৪ ঘন্টার গড়ের সঙ্গে পরিবেশ আইনের মাত্রার তুলনাটি করা হয়নি, ঘরটি ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়েছে।

অথচ এর আগের বার, পরিবেশ আইন ১৯৯৭ এর মাত্রাটিকে ২৪ ঘণ্টার গড় মাত্রার সঙ্গেই তুলনা করা হয়েছিল:

সংশোধিত ইআই্এ'র দাবি অনুসারে বার্ষিক গড় মাত্রা যদি নিরাপদসীমার মধ্যে থাকেও, তাহলেও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-– এই চারমাস প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় গড়ে সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাসের মাত্রা এই হারে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ এর নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় বেশি থাকে তাহলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলবে না এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

ছাই দূষণ, ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহার ও ১৪১৪ একর জমি ভরাট প্রসঙ্গে

ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে জমি ভরাটের বিষয়টি প্রথমে আঞ্জুমান ইসলাম সরাসরি অস্বীকার করে বলেছিলেন:

"১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই দ্বারা ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে না।"

জবাবে যখন ইআইএ রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে ১৪১৪ একর land development এর পরিকল্পার প্রমাণ দেওয়া হল তখন তারা বললেন:

"Fly ash দিয়ে land development এর অর্থ হল নিচু জায়গা উঁচু করা হবে মাটি দিয়েই, কিন্তু তারপর সে জায়গাকে কাজের উপযোগী বা develop করার জন্যে Fly Ash ব্যবহৃত হবে।"

মজার ব্যাপার হল, ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে ল্যান্ড ডেভেলপ করার এই ব্যাখ্যা খোদ ইআইএ রিপোর্টে দেয়া হয়নি। এমনকি গণশুনানিতে ইআইএ প্রণেতাদের সামনে যখন আমরা এই অভিযোগটি তুলি তখনও তারা এই ব্যাখ্যা হাজির করেননি। বরং তারা এভাবে জমি ভরাটের মাধ্যমে কোনো ক্ষতি হওয়ার আশংকা নেই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

আর ইআইএ রিপোর্টে যেভাবে প্রথমে ৪২০ একর জমি ড্রেজিং করা মাটি দিয়ে develop করার কথা বলে পরে উৎপাদিত ছাই দিয়ে develop করার কথা বলা হয়েছে, তাতে land develop শব্দটিতে দিয়ে 'জমি ভরাট' ছাড়া অন্য কোনো অর্থ তৈরি করার জন্য আসলেই অনেক কল্পনাশক্তির প্রয়োজন!

ইআইএর ১০৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে:

"At first phase, only 420 acres of land will be developed for the main plant and township by dredged material and the rest area (1,414 acres) will be developed gradually with generated ash."

এখানে প্রথম পর্যায়ে ড্রেজিং করা মেটেরিয়াল দিয়ে ৪২০ একর জমি develop করার কথা বলা হয়েছে। এখানে land develop শব্দটি স্পষ্টতই জমি ভরাট অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে তার পরবর্তী পর্যায়ে ছাই দিয়ে land develop এর তো 'জমি ভরাট' ছাড়া অন্য অর্থ থাকে না! সে ক্ষেত্রে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার মাটি কোথা থেকে আসবে সে কথাও লেখা থাকার কথা, তাই না?

শব্দের মারপ্যাঁচ দিয়ে সত্য আড়াল করার চেষ্টা কারা করছে– আশা করি এ থেকেও পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, যে ইআইএ রিপোর্ট জায়েজ করার জন্য আঞ্জুমান ইসলামরা এমন প্রতারণা করার চেষ্টা করছেন, সেই্ ইআইএ রিপোর্টের ৫১ পৃষ্ঠাতেই তো স্পষ্ট করে ছাই দিয়ে জমি ভরাটের (filled by ash) কথা স্বীকার করা হয়েছে:

Initially, 420 acre of land will be developed for establishment of the site with sand to be dredged from Passur River and later the rest of the land of 1,834 acre will befilled by ash to be generated from coal burning.

এবার দেখতে চাই, আঞ্জুমান ইসলামরা 'filled by ash' এর কী ব্যাখ্যা দাঁড় করান!

লেখকদ্বয় তাদের লেখার তৃতীয় পর্বে ফ্লাই অ্যাশ যে কত ভালো, আমেরিকায় ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে যে কত কিছু হয় তা নিয়ে একগাদা জ্ঞান দিয়েছেন। ভালো হত, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যে ভারতীয় এনটিপিসি নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেই এনটিপিসি কোম্পানির ফ্লাই অ্যাশের ব্যাবহারের ট্র্যাক রেকর্ড এবং খোদ ভারতীয় সরকারি এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটি সার্বিকভাবে এনটিপিসি'র ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার, সাধারণভাবে ফ্লাই অ্যাশের বিপদজনক দিক, কৃষিজমিতে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে কী বলে সে বিষয়ে তারা একটু খোঁজ-খবর নিলে।

যেহেতু তারা এ কাজটা করেননি, তাই একেক বার একেক কথা বলার অভিযোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আমাদেরকেই বিষয়টি তুলে ধরতে হচ্ছে।

২০১০ সালের ৭-৯ জুলাই অনুষ্ঠিত ভারতীয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কয়লা খনির পরিবেশ সমীক্ষা বিষয়ক এক্সপার্ট অ্যাপরাইজাল কমিটি এনটিপিসি কর্তৃক ছাই ব্যবহার সম্পর্কে মন্তব্য করে:

The Committee further observed that the present volume of fly ash generated and the quantity utilized from M/S NTPC Ltd. power plants all over the country is far from satisfactory. The Committee therefore desired that a detailed road map of fly ash utilization for all the power plants in operation shall be prepared and placed before the Committee in its meeting scheduled during the September, 2010. The Committee also decided that the audited report of fly ash utilization (as may be indicated in the last Annual Report of M/S NTPC Ltd.) may also be presented before the Committee.

একই কমিটি ৬-৭ ডিসেম্বর ২০১০ এ কৃষি জমিতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলে:

"Regarding use of Fly Ash in agriculture, the Committee also expressed its strong reservations considering that the available information is limited and not supported by long term scientific study. Considering that fly ash is reported to contain about 48 elements including radioactive elements and toxic heavy metals (in mild dose), the Committee advocated that unless scientific study rules out long term adverse health impacts, as such, this method of fly ash disposal shall not be resorted to."

দেখা যাচ্ছে, খোদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষই এনটিপিসি'র ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহারে সন্তুষ্ট নয় এবং ফ্লাই অ্যাশে ৪৮ ধরনের বিষাক্ত ধাতু, তেজস্ক্রিয় উপাোন ইত্যাদির উপস্থিতির অভিযোগটি আমলে নিয়ে কৃষিজমিতে ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহারের বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে। আর আঞ্জুমান ইসলামরা আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন ফ্লাই অ্যাশ খুব ভালো জিনিস বলে!

লোকদেখানো ইআইএ প্রসঙ্গে

ইআইএ সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট বলেছি, স্থান চূড়ান্তকরণ, জমি অধিগ্রহণ ও চুক্তি সম্পন্ন করার পর অর্থাৎ আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়ে তারপর তা জায়েজ করার জন্য ইআইএ সম্পন্ন করা হয়েছে।

এই অভিযোগ ভুল প্রমাণ করার জন্য লেখকদ্বয় তাদের লেখার শুরুর দিকেই একটা গুরুতর মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে জানুয়ারি ২০১২ সালে। প্রকৃতপক্ষে রামপালে জমির কার্যকর অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২০১০ সালে!

বিবিসি লিখেছে: "২০১০ সালে যখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন স্থানীয়রা আন্দোলন শুরু করেছিলেন জমি রক্ষার জন্য।"

তাছাড়া সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ সাল পর্যন্ত এই দুই বছরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের ৪৫ নং বয়ানটি এ রকম:

"বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাধীন ০৯ নং কৈগরদাসকাঠি এবং ১০ নং সাপমারিকাটাখালী মৌজায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ১৮৩৪.০০ একর জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন।"

শুধু তাই নয়, IEE এবং EIA নিয়েও একটা বিভ্রান্তি তারা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। একদিকে দাবি করছেন পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে ২০১০ সালে, আবার তাদের লেখাতেই স্বীকার করেছেন– "জানুয়ারি ২০১৩ তে CEGIS তাদের করা EIA সম্বলিত রিপোর্টটি কর্তৃপক্ষের কাছে অফিসিয়ালি জমা দেয়।" এরপর পরিবেশ মন্ত্রণালয় সেই ইআইএ'র অনুমোদন দেয় আগস্ট, ২০১৩ সালে।

তাহলে প্রশ্ন হল, ২০১০ সালে পরিবেশ সমীক্ষা কীভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলা যেতে পারে? তাদের দাবি অনুসারে ২০১০ সালে যে পরিবেশ সমীক্ষা হয়েছে তা হল IEE বা প্রাথমিক পরিবেশ সমীক্ষা। প্রাথমিক পরিবেশ সমীক্ষা কি পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সমীক্ষা বা ইআইএ'র বিকল্প হতে পারে?

উনাদের দেওয়া এফএও'র লিংক থেকেই দেখা যাচ্ছে IEE'কে বলা হচ্ছে partial EIA বা 'আংশিক পরিবেশ সমীক্ষা'। পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সমীক্ষা করার আগে আদৌ পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ সমীক্ষা লাগবে কিনা তা যাচাই করার জন্য IEE করা যেতেই পারে, কিন্তু IEE করেই পরিবেশ সমীক্ষা সম্পন্ন হয়ে গেছে ধরে নেওয়া যায় না এবং তার ভিত্তিতে পুরোদমে কাজও শুরু করা যায় না।

আর এ কারণেই IEE এর ভিত্তিতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় যখন ২৩ মে ২০১১ তারিখে "ভারত ও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীদ্বয় কর্তৃক আলোচ্য প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে বিধায় উক্ত প্রকল্পের রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং প্রস্তাবিত প্রকল্পের সাইট উন্নয়নের" কারণ দেখিয়ে "অবস্থানগত ছাড়পত্র" প্রদান করে তখন কতগুলো শর্ত আরোপ করে।

শর্তগুলোর মধ্যে দুটি শর্ত ছিল এ রকম:

শর্ত (চ): ইআইএ অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান জলাভূমি ভরাট করা যাবে না।

শর্ত(ছ): প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান জলাভূমি ভরাটের প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ অনুযায়ী জলাভূমি ভরাটের জন্য বিধি মোতাবেক পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে।

সবশেষে বলা হয়েছিল: "যে কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে এ ছাড়পত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।"

বাস্তবে এই শর্তগুলো ভঙ্গ করা হয়েছিল। কারণ ইআইএ অনুমোদন হয়েছে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে, আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা জলাভূমি ভরাট শুরু হয়েছে তারও অন্তত ছয় মাস আগে থেকে! কিন্তু আমরা দেখেছি ছাড়পত্র বাতিল হয়নি, নিয়মানুসারে কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।

এবার তারা দাবি করলেন, না, অফিসিয়ালি কাগজপত্রে ২০১০ সালে জমি অধিগ্রহণ দেখানো হলেও ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ার আগ পর্যন্ত নাকি জমি আসলে অধিগ্রহণ করা হয়নি! অথচ সরকারি নথিপত্রেই স্পষ্ট করে বলা আছে, সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে এবং স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানেন ২০১০ সালের শেষের দিকেই জমি থেকে মানুষজনকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তখন থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করা জমিতে ক্ষমতাসীন দলের দখলদাররা চিংড়ি চাষ পর্যন্ত করেছেন!

আইইই'র শর্ত ভঙ্গ করে জলাভূমি ভরাটের অভিযোগ সম্পর্কে তারা বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন:

"প্রতিবাদকারীরা একবার বলেন এই রামপাল কৃষিজমি; এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। আবার কখনও বলেন চিংড়ির ঘের। আবার এখন শুনছি রামপালে নাকি 'জলাভূমি' ভরাট হয়ে গেছে।"

সুন্দরবনের কাছে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জোয়ার-ভাটা প্লাবিত ভূমি সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকলেও কেউ এই কৃষিজমি/ জলাভূমি সম্পর্কে এভাবে বিষ্ময় প্রকাশ করতে পারত না! প্রকৃতপক্ষে অধিগ্রহণকরা জমি জোয়ার-ভাটা প্লাবিত এবং এখানে বছরের একটা সময় ধান চাষ হত এবং আরেকটা সময়ে হত মাছ চাষ।

এখন এই ভূমিকে জলাভূমি বলা যাবে কি না তা যাচাইয়ের জন্য লেখকদ্বয় উল্লিখিত 'জলাধার'-এর সংজ্ঞা নয় বরং যেহেতু বাংলাদেশ রামসার কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী, তাই রামসার প্রদত্ত জলাভূমির সংজ্ঞাই বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য।

রামসার কনভেনশন-১৯৭১ অনুযায়ী জলাভূমির সংজ্ঞা হচ্ছে–

"প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট, স্থায়ী অথবা অস্থায়ী, স্থির অথবা প্রবাহমান পানিরাশি বিশিষ্ট স্বাদু, লবণাক্ত অথবা মিশ্র পানি বিশিষ্ট জলা, ডোবা, পিটভূমি, অথবা পানিসমৃদ্ধ এলাকা এবং সেই সঙ্গে এমন গভীরতাবিশিষ্ট সামুদ্রিক এলাকা যা নিম্ন জোয়ারের সময় ৬ মিটারের বেশি গভীরতা অতিক্রম করে না।"

… জলাভূমির রামসার সংজ্ঞাটি বিস্তৃত পরিসরে স্বাদু পানি, উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পরিরেশকে একত্রে উপস্থাপনা করে। বাংলাদেশে রামসার সংজ্ঞাটিই গৃহিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ হিসেবে ৪২০ একর ভরাট জমির মধ্যে জলাভূমির অংশ আছে বৈকি।

তাছাড়া শুধু জোয়ার-ভাটা প্লাবিত ভূমিই নয়, সরাসরি খালও বালু ভরাট করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় বালু ভরাট কাজের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বাওনাখালী খাল ও কাটাখালী খাল সম্পূর্ণ(প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত অংশ) ভরাট করা হয়েছে। আংশিক ভরাট হয়েছে কালটা খাল।

সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহণের বিপদ ও মংলা বন্দর প্রসঙ্গে

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহণের বিপদ সম্পর্কে যখন আমরা কথা বলছি, তখন আঞ্জুমান ইসলামরা কুতর্ক তুলছেন, তারা বলার চেষ্টা করছেন মংলা বন্দরের জন্য তো এমনিতেই জাহাজ চলাচল করছে, তাহলে মংলা বন্দর বন্ধ না করে শুধু রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিরোধিতার যুক্তি কী? তারা তাই প্রশ্ন তুলেছেন:

"কিন্তু সেই সব বাড়তি জাহাজ চলাচল বা এর থেকে দূষণ/শব্দ/আলো নিয়ে তো কোনো কমিটির মাথাব্যথা দেখছি না আমরা। তাহলে রামপালের জন্যে চলাচল করবে যে বাড়তি কয়েকটি জাহাজ/কার্গো তা নিয়ে কেন এত হইচই?"

এই অজুহাতটা খুব ইন্টারেস্টিং। কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে শুধু গুগল ম্যাপ দেখে লম্বা-চওড়া কথা বললে এ রকম অজুহাতই দিতে হয়!

বাস্তবতা হল মংলা বন্দর চালু রাখতে হলে যে সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই জাহাজ চলাচল করতে হবে এ রকম কোনো কথা নেই। আর মংলা বন্দরঅভিমুখী জাহাজ কিছুদিন আগেও তো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করত না। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত খুলনা হয়ে মংলা বন্দরের দিকে জাহাজগুলো ঘসিয়াখালী খাল দিয়ে আসা-যাওয়া করত।

এই খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং ভরাট হয়ে যাওয়া খালটি সময়মতো ড্রেজিং না করায় ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে বিআইডব্লিইউটিএ সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মণিরগোল হয়ে মংলা বন্দরে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

এবং এভাবে ঘাসিয়াখালী খালের বদলে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের কারণে ইতেমধ্যেই সুন্দরবনে পরিবেশ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। ১৫ মার্চ, ২০১৩ 'প্রথম আলো' লিখেছে:

"যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ স্তন্যপায়ী প্রাণি প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। তাতে দেখা গেছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ১৬০টি নৌযান চলে। এতে বনের নদীগুলোতে ঢেউয়ের গতি ও উচ্চতা বেড়ে গেছে। ফলে বনের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। চাঁদপাই, নন্দবালা, জয়মনি, তাম্বুলুবুনিয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। গাছগুলো মরতে শুরু করেছে। পাড় ভাঙনের ফলে চাঁদপাই বনফাঁড়িটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা গেছে, বনের যেখানে-সেখানে জাহাজ নোঙর করা হচ্ছে। ওই জাহাজে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কোনো বস্তু আছে কি না, তা কেউ তদারক করছেন না। যারা নোঙর করে অবস্থান করছেন, তারা বনের মধ্যে বর্জ্য তেল ফেলছেন কি না, বা তাদের ফেলে যাওয়া কোনো পদার্থের কারণে বনের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা-ও দেখভালের কেউ নেই।"

এই অবস্থায় কয়লাভর্তি জাহাজ চলাচল করলে যে দূষণ আরও বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাছাড়া কয়লা পরিবহণের জন্য সুন্দরবনের মধ্যে কোল টার্নিমাল আরেক বিপদ হিসেবে কাজ করবে।

কাজেই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে মংলা বন্দর অভিমুখে বর্তমান জাহাজ চলাচলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কয়লা জাহাজ চলাচলের যৌক্তিকতা আরোপের চেষ্টার বদলে দাবি তোলা দরকার– ভবিষ্যতে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লাভর্তি জাহাজ চলাচলের পরিকল্পনা তো বাতিল করতেই হবে, সেই সঙ্গে বর্তমানে জরুরিভিত্তিতে ঘাসিয়াখালী খালের ৮ কিমি পূর্ণ খনন করে সাধারণ কার্গো জাহাজগুলোর দূষণের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, খোদ ইআইএ রিপোর্টের মতোই, যে কোনো মূল্যে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সপক্ষে দাঁড়ানোই যেন লেখকদ্বয়ের মিশন। বার বার তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বার বার তারা পিছলে নতুন অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন, এক যুক্তি খারিজ হয়ে গেলে আরেক যুক্তি দিচ্ছেন! অবশ্য বিশেষজ্ঞ সাইনবোর্ড ব্যবহার করে গণবিরোধী প্রকল্প জায়েজ করার এই ধরনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে নতুন নয়– কমিশন, ক্যারিয়ার, দলবাজি ইত্যাদি নানান কিছুই এসব প্রকল্পের সপক্ষে দাঁড়ানোর প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে থাকে।

সবশেষে, সুন্দরবন রক্ষার এই আন্দোলনকে লেখকদ্বয় কর্তৃক এনজিওবাজি, 'পরিবেশ মাফিয়া' কিংবা টাকার বিনিময়ে আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার কুৎসিত অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই। পশ্চিমা মিডিয়ায় পরিবেশবাদ বিষয়টা ধনকুবের সেলিব্রেটিদের কতিপয় প্রাণিরক্ষার বিলাস হিসেবে হাজির হলেও, দুনিয়ার দেশে দেশে বিশেষত দরিদ্র-নিপীড়িত জনগণের পরিবেশ চেতনা কোনো বায়বীয় শখের বস্তু নয়। সাধারণ জনগণের পরিবেশ চেতনা তার জীবন জীবিকা আর সংস্কৃতিরই অংশ।

ভারতের হিমালয় অঞ্চলের অধিবাসীরা যখন উত্তরখণ্ডের বনরক্ষার জন্য 'চিপকো' বা বৃক্ষ আলিঙ্গন আন্দোলন গড়ে তুলেন কিংবা ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের জনগণ যখন আমাজন বনভূমিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য 'চিকো' আন্দোলনে নারী-পুরুষ-শিশুদের হস্তবন্ধন বা 'এমপাতে' তৈরি করেন কিংবা বাংলাদেশের ফুলবাড়ির জনগণ যখন জল-জমি-জীবন রক্ষার জন্য ফুলবাড়ি অভ্যুত্থান ঘটান তখন তা রক্ত-ঘাম-শ্রমের বিনিময়ে জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতিরক্ষার লড়াইয়েরই অংশ।

সুন্দরবনের পরিবেশ ধ্বংস করে রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে চলমান লড়াই তারই অংশ।

কল্লোল মোস্তফা : প্রকৌশলী।