আমাদের বৈষম্যবাদ

এহসান ইমদাদ
Published : 9 Sept 2010, 11:26 AM
Updated : 9 Sept 2010, 11:26 AM

বর্ণ বৈষম্য শ্রেনী বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কথায় কথায় দক্ষিণ আফ্রিকার কথা আমেরিকা ইউরোপ খুবই আসে, কম-ই আসে বাংলাদেশ। নিজেদের দোষ সাধারণত দেখা যায় না। আমার তো মনে হয় আমরা পৃথিবীর একটি  শ্রেনী ও বর্ণ বৈষম্যবাদী দেশ। আমাদের দেশে যাঁরা বুদ্ধির চর্চ্চা করেন বা যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবি বলা হয় তারা রোগের ডায়াগনসিস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ভাল করার কথা কম বলেন। অবশ্যই ডায়াগনসিস এর প্রয়োজন প্রথম, কিন্তু তারা যদি সরকার বা আইন প্রণয়নকারীদের সমাধানের পথ খুঁজে দিতেন তাহলে বাংলাদেশ অনেক উপকৃত হতো। কিন্তু, বেশীর ভাগ সময়ই তাঁরা সেটা না করে সমালোচনার সহজ পথে অগ্রসর হন।

বৈষম্য: ছেলের বিয়ে দিতে গেলে অনেকেই ফর্শা মেয়ে খোঁজে। ছেলের গায়ের রং যাই হোক না কেন, দুধ আলতা সাদা বউ তার চাই-ই চাই।

সাদা কালোর বৈষম্য পৃথিবী থেকে প্রায় মুছে গেছে। শুধু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের আউট ডেডেট/রক্ষণশীল তথাকথিত শিক্ষিত কিছু মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্তের ভেতর এখনও তা বিদ্যমান। উঠে আসুন, নিজেকে উন্নত ও আধুনিক করুন। সাদা সুন্দর, কালো সুন্দর, খয়েরী হুলদুও। আর সে জন্যই ত্রিশ কোটির দেশ আমেরিকায় যেখানে মাত্র তিন কোটি কালো অর্থাৎ মাত্র দশ পারসেন্ট, সে দেশে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বারাক ওবামা। গত দশ বছরে বিশ্ব সুন্দরীর তালিকায় ছয় জনই কালো। ভাইশাব, আপনার ছেলের বউটি কালো হলে কোন অসুবিধা নেই। আপনিও হয়তো জাতে উঠতে পারবেন। নিউইয়র্কের একটি বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা একবার বলেছিলেন তিনি নিউইয়র্কের বিশাল এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকাকালে সেখানে বেশ কটি বাঙালী পরিবারও থাকতেন পৃথিবীর আরও দশটি দেশের মানুষের সাথে।

একদিন এলিভেটরে করে আট তলার এপার্টমেন্টে উঠছিলেন। ভেতরে আরো ছিলেন দুই জন শেতাঙ্গ মানুষ, নিউইয়র্ক পুলিশ অফিসার ও ছয় মাস পূর্বে আমেরিকা আসা একজন কালো রঙের বাঙ্গালী যার মাথার চুল ছিল বেইস বল কেপ দিয়ে ঢাকা। সেই শ্যাম কালো বর্ণের বাঙ্গালী হঠাৎ-ই পুলিশ অফিসারদ্বয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ, আমরা তো ভালই ছিলাম এই বিল্ডিংয়ে, কিন্তু ইদানিং কিছু কৃষ্ণাঙ্গ পরিবার এখানে এপার্টমেন্ট ভাড়া করার পর এই এলাকায় ক্রাইম রেট বেড়ে গেছে । পুলিশ অফিসারদ্বয় শ্যাম কালো বর্ণের বাঙ্গালীর কথা শুনে হতভম্ব। ওরা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে নিরব ছিল এবং তাদের গন্তব্যস্থল ছয়তলা আসাতে নেমে পড়লেন। কারণ সেই শ্যাম কালো বর্র্ণের মাথায় ক্যাপ থাকাতে  বোঝা যায়নি তার চুল সোজা না কালোদের মতো কোকরানো। এছাড়াও একজন দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তি কখনই এ জাতীয় সমষ্টিগতভাবে একটি বর্ণের বিরুদ্ধে দোষারোপকারীর মতো মন্তব্য করেন না। পৃথিবীতে কোটির বেশী কৃষ্ণাঙ্গ আছেন যাদের গায়ের রং আমাদের থেকেও ফর্শা। মাথায় টুপি পরিয়ে দিলে বোঝার উপায় নাই কালো না বাঙালী।

ডিসি মিয়া প্রধান অতিথি, এসপি সাব বিশেষ অতিথি; এসব কী? বাংলাদেশের জেলাসমূহে কি আর সম্মানীত গুনীজন নেই? এই প্রথা চালু হয়েছিল বৃটিশ শাসকদের জন্য বৃটিশ শাসকদের দ্বারা বাংলার মানুষকে শোষন করবার জন্যে। এই কোলোনিয়াল সামন্তপ্রথা থেকে দেশ এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

প্রথম কথা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আমাদের প্রধান। তিনি যেই হোন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছি সরকার/প্রশাসন চালাবার জন্যে। এবার সমাধানে যাবার আগে জেনে নেই বিসিএস প্রশাসনের এখনকার হালচাল। যুগের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে সরকারী কর্মকর্তাদের মানদণ্ড। বিট্রিশ ও পাকিস্তান আমলে পরাধীন ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠ মেধাবী দক্ষদের সর্বোচ্চ চাকুরী ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (I.C.S) এবং পরবর্তী কালে বাঙালীদের জন্য পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (C.S.P)। উভয় কালেই আমরা ছিলাম পরাধীন। তাই সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের শ্রেষ্ঠ মেধারা যোগ দিতেন I.C.S পরবর্তীতে C.S.Pপেশায় । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু, বাঙালীর জন্য উন্মুক্ত হয়েছে উন্নত বিশ্ব এবং এর সকল সুযোগ সুবিধা। স্বাধীনতার কারণে বাঙালী স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব ভূখন্ডে। উন্মুক্ত হয়েছে অনেক সম্ভাবনার দ্বার। যদিও একারণে দেশের অনেক শ্রেষ্ঠ মেধা দেশ ছেড়েছেন আবার উন্নত বিশ্বের অনেক দক্ষতা নিয়ে ফিরেও আসছে অনেকে। অনেকেই ভারতের  ঘজও দের মতো বাংলাদেশের ঘজই রাও অবদান রাখতে শুরু করেছে এদেশের সার্বিক উন্নয়নে। বর্তমান কালের বিসিএস অফিসারদের ভেতরে আগের সেই মেধা আর নেই। মেধারা আছে দেশের অন্যান্য সেক্টরে এবং বিশ্ব জুড়ে। এমনকি সচিবদের সন্তানরাও আজ প্রশাসনে আসতে চায় না।

পৃথিবীর উন্নত দেশ সমূহেও সরকারী প্রশাসনে শ্রেষ্ঠ মেধারা আসে না। এতে সরকারী প্রশাসনের তেমন ক্ষতি হচ্ছে না। ক্ষমতাবিকেন্দ্রিকরণ, স্থানীয় সরকার প্রথা চালু, সরকারী শত শত সংস্থা (রেলওয়ে, নৌচলাচল, পর্যটন, বিআরটিসি, টিসিবি, পল্লী বিদ্যুৎ) প্রাইভেট মালিকানা দেয়ার মাধ্যমে এর অনেক অভাব পূরণ সম্ভব। তবে সবার আগে প্রশাসনে স্থবরিতা কমিয়ে আনা দরকার এবং সর্বোপরি দুশ বছরের পুরনো কোলোনিয়াল নিয়ম নীতি-রীতি, কালো অধ্যায় থেকে প্রসাশনকে মুক্ত করতে হবে।  মাত্র পাঁচ হাজার বৃটিশ এসেছিল ভারতবর্ষে তৎকালীন ত্রিশ কোটি (১৭৬৭-১৯৪৭ গড়) ভারতীয়দের (আমরাসহ) শাসন করার জন্যে। তারা যেমন তৈরি করেছিল শুধু ভারতবর্ষের জন্য নতুন ইংরেজী ভাষা যে ভাষার বেইজ হচ্ছে প্রভু ভৃত্য সম্পর্কিত, তেমনি তৈরি করেছিল এক সমাজ যা  পুরোপুরি শ্রেনী, জাত ও বর্ণকে প্রাধান্য দিয়ে। তারা সফলভাবেই তাদের কু উদ্দ্যেশ বাস্তবায়িত করেছে। দুশত বছর এ হীন মানসিতার রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার আওতায় রেখেছিল আমাদের। দু'শো বছর পাল্টে দিয়েছে আমাদের মান, অহংকার, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আরো অনেক কিছু। ফলশ্রুতিতে আজও আমাদের মাথা উঁচু করে দাড়াতে সময় লাগে। আজও আমরা সাদা চামড়া বিদেশীদের মাথায় তুলে রাখি। আমাদের এই ভাঙা মেরুদন্ডকে ঠিক করে ঘুরে দাড়াতে হবে। আমাদের বাংলাদেশ সম্ভাবনার বাংলাদেশ। আমাদের বাংলাদেশ অহংকারের বাংলাদেশ ।

আমাদের বাংলাদেশ হবে ঐকমত্যের বাংলাদেশ। আমাদের তেমনি ঘুরে দাড়িয়ে বিদায় জানাতে হবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, অউই ইত্যাদিকে। আমরা সাহায্য চাইনা। আমরা কাজ চাই। বিদায় জানাতে হবে তাদের দেয়া পলিসি। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বলেছেন আপনারা জনগনের সেবক, জনগনের সেবায় মনোযোগী হন। এ  বক্তব্য নিশ্চয়ই আমাদের উদবুদ্ধ করবে কোলোনিয়াল ও সামন্তপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে। কারণ এখন আর বৃটিশরা নেই  এবং তাদের তৈরি প্রশাসনিক কাঠামো এদেশে থাকতে পারে না এবং পারবে না। সম্মানিত করুন আপনার নিজ নিজ জেলার গুনীজনকে। তাদেরকেই করুন প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি। সিভিল সার্ভেন্ট ডিসি, এস,পি এবং অন্যদেরকে তাদের কর্তব্য পালন করতে দিন।

আরেকটা বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়: সামনে সোফা পেছনে মাদুর! আমাদের দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের যেভাবে বসানো হয় তাতে সমগ্র দেশে যে একটি শ্রেণী বৈষম্য বিদ্যমান তা অত্যন্ত নগ্নভাবে ধরা পড়ে। সাধারণত দেখা যায় সবচেয়ে নামী দামী অতিথিদের প্রথম দু'শারিতে সোফায় বসতে দেয়া হয়। তারপর হাতল যুক্ত চেয়ার, অতপর হাতলহীন চেয়ার এবং বেঞ্চি। সর্বশেষে মাদুর অথবা দাড় করিয়ে রাখা হয়।

এ জাতীয় সামাজিক ও শ্রেনী বৈষম্যের অবসান হ্ওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে এবং নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল চারটি স্তম্ভের উপর, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও  জাতীয়তাবাদ। এর অর্থ বুঝলেই আমরা সরে আসতে পারি এ জাতীয় শ্রেনী বৈষম্য থেকে।

শুনেছি দেশে সরকারি ও প্রাইভেট সেক্টরে অফিসার সাহেবদের অফিসে তোয়ালে ঝোলাতে বছরে পঞ্চাশ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, ওনাদের মাথা কি নোংরা ? চেয়ার ময়লা হয়ে যাবে ? ওনারা কি এখনো মাথায় তেল দিয়ে অফিসে আসেন, যে তেলের দাগ চেয়ারে লেগে যেতে পারে ? যদি তা ই হয় তবে কর্মচারীদের মাথা কি পরিস্কার ? তবে কি কর্মচারীরা তেলের পরিবর্তে মাথায় শেম্পু করে আসেন ?

সম্প্রতি ছয়শত পৃষ্ঠার একটি হাম্বল দিস্তা ইংরেজি বই লিখেছি, নাম " গেটিং আউট অব কোলোনিয়াল পলিসিস এন্ড রিব্র্যনডিং বাংলাদেশ"। বইটি লিখতে বসে ভারতে বৃটিশ শাসন নিয়ে অনেক বই পড়েছি। একটি বইএ হেগেলকে কোট করেছেন ডেবিট গ্রে এবং মারগারেট ক্যামেরুন। তাদের লেখা ও কোটেশন থেকে জানলাম ভারত বর্ষে ইংরেজদের চেয়ারে তোয়ালে ঝুলানোর কাহিনী। তখনকার বর্ণ বৈষম্যবাদী ইংরেজরা কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয় (আমাদের) সংস্পর্শ বা ছোঁয়া যেন না লাগে তাই চেয়ারে তোয়ালে ব্যবহার করতো, শুধু তাই নয় ভারতীয়দের বাড়িতে বা অফিসে গেলেও নিজস্ব তোয়ালে বিছিয়ে বসতো।

পঞ্চাশ কোটি টাকা দিয়ে পঞ্চাশটি ভোকেশনাল বা টেকনিক্যাল  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে উন্নত দেশে পাঠানো যেতে পারে হাজারো বাঙালীর দক্ষ হাত। ভাগ্যের উন্নতি হতে পরে হাজারো পরিবারের। ঐ জনশক্তি দশ পনের বছর পর দক্ষতা ও উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশ  গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।

অন্য আরেকটা বৈষম্য লক্ষ্য করুন।  আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজের অফিস ব্যাগ নিজে বহন করেন, আমাদের দেশের সামান্য একজন কর্মকর্তার অফিসের হালকা ব্যাগটি বহন করার জন্য একজন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। এইসব দেখতেও খারাপ লাগে, মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন কালের প্রভু-ভৃত্য সর্ম্পকের কথা।