সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার

সুলতানা কামাল
Published : 25 Oct 2007, 05:20 PM
Updated : 12 Dec 2009, 03:32 AM

"সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।"

— অনুচ্ছেদ ২৭, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই গৃহীত সংবিধানের মূলনীতি রচিত হয়েছিল কয়েকটি মহান আদর্শের ওপর। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিল, ত্রিশ লক্ষ নারী-পুরুষ আত্মাহুতি দিয়েছিল এবং নির্যাতিত হয়েছিল দুই লক্ষ নারী।

এই আত্মত্যাগ, এই জীবনদানের প্রণোদনা শুরু সেই ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থেকে, যা ধাপে ধাপে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে।

সংবিধান প্রণেতারাও সেই উপলব্ধি থেকেই অনুচ্ছেদ ৭এ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:

"প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।"

[৭.১]

একই সঙ্গে এই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে:

"জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেটা আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।"

[৭.২]

সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বিধৃত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসমঞ্জস সব আইন বাতিল করা হবে। শুধু তাই নয়, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইনও রাষ্ট্র প্রণয়ন করবে না। ২৮ ধারা আরও ভেঙে বলছে যে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণেও কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।

এ কথা ঠিক যে, নারী ব্যক্তিজীবনে সমঅধিকার ভোগ করবে কি না সে সম্পর্কে কোনো অনুচ্ছেদ কোনো কিছু উল্লেখ করেনি।

এখন দেখা যাক বাস্তবে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে কী ঘটছে। উপরোক্ত সাংবিধানিক অঙ্গীকার ও নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন প্রচলিত রয়েছে, যার ফলে যে ব্যক্তি যে ধর্মে জন্মগ্রহণ করবেন, নারী অথবা পুরুষ, সেই ধর্মের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন।

কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে না যেয়ে বলা যায়, এর ফলে শুধুমাত্র যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন অধিকার ভোগ করছেন তা নয়, একই ধর্মের নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে বিরাজ করছে বিস্তর তফাৎ ও বৈষম্য এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের নারীরাও ভিন্ন ভিন্ন অধিকার ভোগ করছেন। যা সংবিধানের সমঅধিকার ও আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান এবং সর্বপোরি রাষ্ট্র কারও প্রতি কোনো বৈষম্য প্রদর্শন করবে না– এ সবগুলো নীতির সরাসরি বিপরীত ও বিরোধী। এর ফলে সংবিধানের যে সরাসরি লঙ্ঘন ঘটছে এ কথা নিশ্চয়ই বিশেষভাবে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।

ব্যক্তিগত জীবনে যে যে ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার  সেগুলো হল: বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও প্রতিপালন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার।

নারী যে মাত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, বিবাহিত জীবনে সর্বক্ষেত্রে স্বামীর তুলনায় তার অধিকার নানাভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। সামাজিক জেন্ডার-ভিত্তিক শ্রম-বিভাজনের কারণে নারীর জনজীবনের অধিকারের সুযোগ নেওয়ার অবকাশ কমে যায়। স্বামীর বহুবিবাহ, একচ্ছত্র তালাক দেওয়ার অধিকার, ভরণ-পোষণ ও মোহরানা নিয়ে তালবাহানা, সন্তানের অভিভাবকত্ব না পাওয়া এবং সবশেষে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সম অধিকার না-থাকা নারীর মানবিক মর্যাদা ও মানুষ হিসেবে পূর্ণ বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়।

মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ, প্রতিটি ধর্মের বিধানেই নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারে বৈষম্যের নীতি প্রচলিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীদের অধিকারের সংস্কার করা হয়েছে এবং অনেক দেশেই এখন নারীরা সমান উত্তরাধিকার ভোগ করে থাকেন। যে সমস্ত দেশে তা এখনও সম্ভব হয়নি, সেখানেও পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে।

মুসলিম পারিবারিক আইনেও উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর সপক্ষে পরিবর্তন এলেও এই বিশেষ অধিকারের ক্ষেত্রে একটি স্পর্শকাতরতা রয়ে গেছে। তার মূল কারণ পবিত্র কোরান শরীফে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত দিকনির্দেশনায় বলা আছে মেয়ে সন্তানকে ছেলে সন্তানের অর্ধেক অংশ দিতে হবে।

মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী একজন মৃত ব্যক্তির মা ও বাবা কিন্তু সমান অংশ পেয়ে থাকেন। ১:২ অনুপাতটি শুরু হয় স্বামী-স্ত্রী ও ভাইবোনের ক্ষেত্রে। বিষয়টি নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং নারীর সপক্ষে অনেক বিজ্ঞজন, বিশেষত নারী পণ্ডিত ব্যক্তিরা যুক্তি দিয়েছেন যে, যেহেতু কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই যে, সমান অংশ দেওয়া যাবে না এবং মৃত ব্যক্তির মা ও বাবা যেহেতু নারী ও পুরুষ হয়ে সমান অংশ পান, তাই নারীর সমান অংশ নির্ণয় করা ধর্মবিরোধী ব্যাপার বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়।

এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান শুধু নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দলিল, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য অপনোদন দলিল (সিডো), বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন, নারীর অধিকার মানবাধিকার– এইসব ঐতিহাসিক দলিলে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ শর্তহীনভাবে নারীর সমঅধিকারের অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন নীতিমালাও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তাই আজকের দিনে নারী যেন সম্পত্তিতে সমঅধিকার অর্জন করতে পারে তার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।